জনমানবহীন ‘জোন’ একটি নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর সেই জোনের মধ্যে কোনো এক জায়গায় অবস্থান রুমের। সেখানে পদার্থবিদ্যার সূত্র কাজ করে না। রুমে প্রবেশের পর প্রার্থনাকারীর মনের গভীরতম ইচ্ছাটিও পূরণ হয় অলৌকিকভাবে। এবারের চলচ্চিত্র যাত্রায় চলুন তবে সেই গোপন কক্ষ থেকে ঘুরে আসা যাক।
গৌতম বুদ্ধের মহানির্বাণের চলচ্চিত্র স্টকার (১৯৭৯)। কারণ, ছবিটি দেখার পর পৃথিবীর অনেক দেখাই অসাড় এবং তাৎপর্যহীন মনে হয়। “The purpose of art is to help man improve himself spiritually.” বেনামী কোনো দেশের অনির্দিষ্ট কোনো সময়ের গল্প স্টকার। সায়েন্স ফিকশন ঘরানার এ ছবি যতটা না বিজ্ঞানের, তার চেয়ে বেশি দর্শন আর মনোবিজ্ঞানের; অগাধ পর্যবেক্ষণের। যা ধীরে ধীরে দর্শকের অবচেতনকে গ্রাস করে কাহিনীর সাথে একাত্ম করে দেয়। একদিকে এ ছবি ভাবের, অন্যদিকে ভাবনা উদয়ের। স্টকার দেখার পরে আত্মার পুনর্জন্ম হয়। “Fear has made you come to your sense.”
রাশিয়ান চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি প্রতিনিয়ত চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা তৈরি করেছেন তার নির্মাণের মাধ্যমে। এটি এমন এক ভাষাপ্রকাশ, যা চলচ্চিত্রের প্রকৃতির জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এই ফিল্মেও আমরা সে ভাষার চর্চা দেখতে পাই। ১৬১ মিনিট ব্যাপ্তিতে সর্বসাকুল্যে শট হয়েছে ১৪২টি। অর্থাৎ প্রতি শটের গড় দৈর্ঘ্য এক মিনিটেরও অধিক! কোনো কোনো শটের দৈর্ঘ্য আবার ৪ মিনিটও ছাড়িয়েছে। এতে করে স্টকার পরিণত হয়েছে নির্মাতার প্রশান্ত স্বর্গীয় বয়ানে। স্টকার অনেক মূর্ত বিষয়কে বিমূর্ত করেছে; আবার অনেক বিমূর্তকে দিয়েছে মূর্ততা। স্টকার বিশ্বাসকে করেছে প্রশ্নহীন। অবিশ্বাসকে করেছে অধিকতর সংশয়পূর্ণ। নির্মাতার ট্রেডমার্ক হিসেবে চিরাচরিতভাবে সেটে ঠাঁই নিয়েছে দালানকোঠার ভগ্ন অবস্থা আর প্রতীকি প্রাণী কুকুর। কেননা কুকুর বিশ্বস্ততা বা বিশ্বাসেরই সমার্থক নাম।
চলচ্চিত্রের সেটে নির্মাতার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বর্তমান তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি কী বলতে চান। তারকোভস্কি বলেছিলেন—
“I don’t know… I think I’d like to say only that they should learn to be alone and try to spend as much time as possible by themselves. I think one of the faults of young people today is that they try to come together around events that are noisy, almost aggressive at times. This desire to be together in order to not feel alone is an unfortunate symptom, in my opinion. Every person needs to learn from childhood how to spend time with oneself. That doesn’t mean he should be lonely, but that he shouldn’t grow bored with himself because people who grow bored in their own company seem to me in danger, from a self-esteem point of view.”
চলচ্চিত্রের অন্যান্য দিক ঘেঁটে দেখার আগে এবার বরং কাহিনীর শুরুটা একটু জেনে আসি। সিনেমার প্রথমে আমরা একটি চরিত্রের সন্ধান পাই যিনি কিনা ‘স্টকার’ পরিচয়ে পরিচিত। যাদের প্রধান কাজ নিষিদ্ধ অঞ্চল জোনের বিশেষ স্থান ‘রুম’-এ আগ্রহী দর্শনার্থীদের নিয়ে যাওয়া। এই রুম নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত। তদুপরি জোনে প্রবেশ অনেক জটিল প্রক্রিয়া। স্টকারদের গাইডলাইন ছাড়া দুর্গম এই অঞ্চলে যাওয়া এবং বেঁচে ফিরে আসা অসম্ভবের কাছাকাছি। এবারে একজন অধ্যাপক আর লেখকের দিক নির্দেশক হিসেবে ভ্রমণসঙ্গী স্টকার পরিচয়ের এই ব্যক্তি। যাক সে কথা, স্টকার নিজের হতদরিদ্র পরিবারকে দুর্দশায় ফেলে চলে যায় জোনের পথে। তার স্ত্রী তাকে বাধা দেয়, এবং বের হতে দিতে চায় না বাসা থেকে। স্ত্রী যে তাকে খুবই অপছন্দ করে সেটি আমরা দেখতে পাই প্রথম সিকুয়েন্সে। তাদের ছোট্ট পঙ্গু মেয়েকেও দেখা যায় ক্রাচ হাতে।
তারপরের পুরোটা সময় প্রধান তিন চরিত্রের জার্নির। এই জার্নির মধ্যবর্তী আলাপচারিতার বিভিন্ন সংলাপে উঠে আসে বিবিধ দর্শন আর তাত্ত্বিক বিচার বিশ্লেষণ। বলাই বাহুল্য, চরিত্রগুলোর সংলাপ বলায় পরিমিত স্বাতন্ত্র্য ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় অবশ্যই সিনেমার সাফল্যের পেছনে বড় নিয়ামক। তবে অন্যান্য নিয়ামক ও অনুষঙ্গও একে সহায়তা দিয়েছে বিশ্বসিনেমার মাস্টারপিস হতে। তারকোভস্কির নির্মাণকৌশল যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়, এবং অধিকাংশই তার নিজস্ব উদ্ভাবন। এক্সট্রিম ক্লোজআপের পাশাপাশি লং টেকের লং শটের ব্যবহার, ধীরগতির ক্যামেরা মুভমেন্ট, অসাধারণ ডেপথ অব ফিল্ড, টেকনিস্কোপিক ইমেজ, নির্জীব অবজেক্টকে দিয়ে গল্প বলানো অন্যতম বিশেষত্বের আওতাধীন। মুভিতে জড় বস্তুর উপর স্রেফ দীর্ঘক্ষণ ক্যামেরা ধরে রেখেই নির্মাতা এদের দিয়ে কথা বলিয়েছেন। অভিনয় বের করে এনেছেন। ফেলনা মনে করা এমন অদ্ভুতুড়ে শটগুলো নিয়ে কেউ হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কিন্তু স্টকারে এমন অভাবনীয় সব এক্সপেরিমেন্ট জায়গা করে নিয়েছে।
“For softness is great and strength is worthless. When a man is born, he is soft and pliable. When he dies, he is strong and hard. When a tree grows, it is soft and pliable. But when it’s dry and hard, it dies. Hardness and strength are death’s companions. Flexibility and softness are the embodiment of life. That which has become hard shall not triumph.”
ডিটেইলিংয়ের সূক্ষ্মতা এবং সংলাপের প্রগাঢ়তা এই মুভির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রথম সিকুয়েন্সে স্টকারের গলায় প্যাঁচানো সাদা কাপড় বিপদসংকুল জোনের চড়াই-উতরাই পেরোনোর পরে ময়লা কর্দমাক্ত ও কালো হয়ে যেতে দেখি, যা দেখে মনে হয় নির্মাতা সময়ের পরিবর্তনকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করাতে চান। সিনেমার উপসংহারে স্টকারের স্ত্রীকে জোনের কুকুরকে বাসায় এনে পরম মমতায় খাওয়াতে দেখা যায়। রূপক অর্থে যা ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে। এবং অবাক করা ব্যাপার- এই অংশে স্ত্রীর, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা এবং আস্থার বয়ান শোনা যায়। পক্ষান্তরে লেখক ও অধ্যাপক গন্তব্যস্থলের খুব কাছ থেকে ঘুরে এসেও তারা কুসংস্কার বিশ্বাস করতে নারাজ! যেন তা আধুনিক যুগের বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার রূপায়ণ!
লেখকের ভাষায়— “My conscience wants vegetarianism to win over the world. And my subconscious is yearning for a piece of juicy meat. But what do I want?”
সিনেমার সর্বশেষ শটটি বড্ড অদ্ভুত। অদ্ভুত এ অর্থে যে, শটটি নির্মোহ বিচারে বিশ্বাস অবিশ্বাসের তীব্র এক দোলাচল। বাসায় কুকুরের আগমন আর বাবার জোন থেকে ঘুরে আসার সুবাদেই কিনা মেয়ে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা অর্জন করে চোখের ইশারায় সাইকোকিনেসিস (Psychokinesis) প্রক্রিয়ায় টেবিলের উপর রাখা বস্তুসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। নতুবা ফিল্মের প্রথম শটের আগমনী ট্রেনের কম্পনের জন্য শেষ শটেও বস্তুগুলোর জায়গা পরিবর্তিত হতে দেখা যায়! এখন দর্শকদের জন্য পরিচালকের প্রশ্ন দৃশ্যটির ব্যাখ্যা হিসেবে আপনি কোন যুক্তিটি গ্রহণ করবেন।
“There’s no need to speak. You must only – concentrate and recall all your past life. When a man thinks of the past, he becomes kinder.”
আর বাড়তি দুয়েকটি তথ্য যোগ করে লেখার ইতি টানছি। চলচ্চিত্র স্টকার রিলিজের পর সমালোচকমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলেও এই ফিল্মের মাহাত্ম্য টের পাওয়া যায় দীর্ঘ সময় অতিক্রান্তের পর। একসময় ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা উপলব্ধি করতে পারেন স্টকারের মহিমা। ফিল্মটির শক্তিমত্তা। ফলে বর্তমানে বিশ্বসিনেমায় স্টকার কালোত্তীর্ণ তকমা পেয়েছে। আবার এই অর্জনের বিপরীতেই ট্র্যাজেডি জড়িয়ে আছে ফিল্মটি ঘিরে। স্টকার রিলিজের কয়েক বছরের মধ্যেই পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি, তার স্ত্রী লারিসা এবং লেখক চরিত্রের অভিনেতা আন্তোলি সলোনিতসিন ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ধারণা করা হয়, সিনেমার শুটিংস্পট চেলিয়াবিন্সকে ১৯৫৭ সালে যে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটে, তার দূষণ তখনও রয়ে গিয়েছিল লোকেশনে। পরে চলচ্চিত্রের সাউন্ড ডিজাইনার ভ্লাদিমির শারুন এই তথ্যটি নিশ্চিত করেছিলেন।