বয়স যত বাড়ছে, ততই যেন শৈল্পিক ছোঁয়া লাগছে তার ব্যক্তিত্বে ও চেহারায়। তিনি যখন কথা বলেন, তখন মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকেই শুনতে হয়। তার অভিব্যক্তি, অভিনয়শৈলী থেকে শুরু করে তার কণ্ঠে থাকা স্পষ্ট দৃঢ়তা কিছুই যেন চোখ এড়াতে পারে না। অপর্ণা সেন, ভারতীয় বাংলা সিনেমাজগতে এক অতি পরিচিত অতীত ও বর্তমান নাম। ভবিষ্যতের পথেও তিনি এক পা বাড়িয়েই রেখেছেন। অভিনয়, চিত্রনাট্য লেখা, চলচ্চিত্র নির্মাণ- একে একে সেলুলয়েড পর্দার সকল ধাপেই তিনি করতলের স্পর্শ রেখেছেন।
১৯৪৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় জন্ম নেন তিনি। পারিবারিক আবহাওয়া ছিলো শিল্পের ছোঁয়া লাগা, তার পিতা চিদানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন চলচ্চিত্র সমালোচক ও নির্মাতা। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন অপর্ণা সেনের মামা অর্থাৎ তার মা সুপ্রিয়া দাশগুপ্তের মামাতো ভাই। চলচ্চিত্র জগতে তার হাতেখড়ি ঘটে অপরাজিত মানিক অর্থাৎ সত্যজিত রায়ের সিনেমার মধ্য দিয়ে। ১৯৬১ সালে ‘তিনকন্যা’ ছবিতে অভিনয়ই ছিলো এক্ষেত্রে অপর্ণার প্রথম অভিজ্ঞতা। এতে ‘সমাপ্তি’ ভাগে ‘মৃন্ময়ী’ হয়ে দেখা দেন তিনি।
প্রথমদিকে বাণিজ্যিক ছবির তালিকা বেশ বড়ই ছিলো তার, কিন্তু যাকে বলে আর্ট ফিল্ম, তার প্রতি অপর্ণার বরাবরই একটা আকর্ষণ ছিলো। সত্যজিত রায়ের হাত ধরে এই পথে আসা তার, পরবর্তীতেও এই মহাপরিচালকের ‘পিকু’, ‘জনঅরণ্য’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও বাদ যায়নি ভিন্নমাত্রার পরিচালক মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্রও। তার ‘আকাশকুসুম’, ‘একদিন আচানক’, ‘মহাপৃথিবী’-তেও অভিনয় করেন অপর্ণা সেন। বড় পর্দার নায়িকা অপর্ণা সেনের নায়কের তালিকায় রয়েছেন প্রায় সবাই। সবাই বলতে উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, দিলীপ কুমার, শত্রুঘ্ন সিনহা এবং আরো অনেকেই!
একইসাথে অপর্ণাকে দেখা গিয়েছে বাংলা ও হিন্দি সিনেমায়, কিন্তু শেষতক বাংলাতেই ভিত গড়লেন তার ক্যারিয়ারের। চলচ্চিত্র জগতে তাকে সবাই ডাকে রীণাদি বলে। তো এই রীণাদি অভিনয় করতে করতে একদিন ক্যামেরার পেছনের জগতেও অংশ নিলেন। শুরু হলো চলচ্চিত্র নির্মাণের পালা। ১৯৮১ সালে অপর্ণা সেনের প্রথম পরিচালিত সিনেমা ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’ মুক্তি পায়। এর জন্য তিনি ম্যানিলা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন ঈগল পুরষ্কার পান। এটি তার জন্য অবশ্যই একটি বড় সফলতা যে, তার পরিচালনার প্রথম ছবিটিই জাতীয় পুরষ্কারও লাভ করে।
নিজের পরিচালনায় পছন্দের ছবি হিসেবে তালিকাতে প্রথমেই তিনি রাখেন ‘পারমিতার একদিন’, ‘জাপানিজ ওয়াইফ’, ‘আরশিনগর’ ও ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’কে। নারীবাদকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেন এই নারী। হয়তো প্রত্যেক নারীই তা-ই করেন! অপর্ণার মতে নারীবাদ আন্দোলনের সময় যে ক্ষিপ্রতা, যে গতির প্রয়োজন ছিলো তা সাধারণ জীবনে এসে অন্য রূপ নেয়। ব্যাপারটা ঠিক ‘ফেমিনিস্ট’ না হয়ে ‘হিউম্যানিস্ট’-এর কাতারে পড়ে যায়। নারীবাদের সংজ্ঞা ক্রমশ পাল্টাচ্ছে বলেই মনে করেন অপর্ণা সেন।
“আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেনটিন সিক্স/এখনও তো কেউ জানে না, আমার স্ট্যাটিস্টিক্স!”
গানটির সাথে ‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমায় পশ্চিমা পোশাকে অপর্ণার স্বতস্ফূর্ত নাচ আর অভিনয় সেসময়ে অনেক জনপ্রিয়তা পায়। আর ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের কাছে গানটি আজও জনপ্রিয় হয়েই আছে।
অপর্ণা সেন পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা ‘সোনাটা’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। এতে তিন নারীর ভিন্ন জীবন এক মোহনায় মিলে যাবার গল্প আছে, তাদের অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকা বন্ধুত্বের কথা আছে। এতে তিন বন্ধুর চরিত্রে দর্শকরা দেখতে পাবেন অপর্ণা সেন, শাবানা আজমি ও লিলেট দুবেকে। অপর্ণা সেনের চরিত্রের নাম অরুণা চতুর্বেদী। সিনেমাটির ভাষা ইংরেজি রাখা হয়েছে। অপর্ণার অভিনীত কিংবা পরিচালিত সিনেমাগুলোতে ‘নারী’ ব্যাপারটা খুব ভালো করে ফুটিয়ে তোলা হয়। এখানেও তাই হবে বলে মনে করেন তিনি। এটি নিয়ে তিনি বলেন, “অরুণা, দোলন এবং সুভদ্রাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। ছবিতে এঁরা মুম্বাইতে থাকে। মুম্বাইকে বেছে নিয়েছি, কেননা মেট্রো সিটির রঙে এঁদের জীবন কতটা রঙিন সেটা দেখা আমার কাছে খুবই জরুরি ছিল। এঁদের চরিত্রে আমি একটা অন্য মাত্রাও দিতে চেয়েছি।”
আদর্শিক দিয়ে অপর্ণা সেন গোঁড়ামিকে আশ্রয় দেন না নিজের মধ্যে। লালনের গানের আরশিনগর থেকে ঠিক প্রভাবিত হয়ে নয়, বরং অবচেতনভাবেই চলে এসেছিলো এই ‘আরশিনগর’ নামটি, এমনটিই ধারণা অপর্ণার। তবে লালনের গান যে এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে সেটাও স্বীকার করেন তিনি। সম্পূর্ণ মিউজিক্যাল একটি সিনেমা বানানোর ইচ্ছে থেকেই ২০১৬ সালে অপর্ণা সেন টালিগঞ্জকে উপহার দেন দেব-ঋতিকার ‘আরশিনগর’। শেকসপীয়রের বিখ্যাত রোমান্টিক ট্র্যাজেডি রোমিও-জুলিয়েট থেকেই এর থিম নিয়েছেন অপর্ণা। তবে এই সিনেমাটি হয়তো এর নতুনত্বের জন্যই ভালো আয় করতে পারেনি বক্স অফিসে, কিন্তু অপর্ণা নিজে এ নিয়ে সন্তুষ্ট এবং তার পছন্দের তালিকায়ও রয়েছে ‘আরশিনগর’।
চলচ্চিত্রজগতের বাইরে কেমন অপর্ণা?
পেশাজীবনে তিনি শুধু চলচ্চিত্রকেই বেছে নেননি। তার বহুমাত্রিকতা প্রকাশ পেয়েছে এক্ষেত্রেও। সংবাদপত্র সম্পাদনা এবং নিউজ চ্যানেলে তার দক্ষ কাজের দেখে মেলে। রাজনীতিবোধও তার প্রবল এবং সেজন্যই প্রায় তাকে দেখা যায় প্রথাগত নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে।
বাংলাদেশ নিয়ে যা ভাবেন অপর্ণা
বাংলাদেশকে প্রকৃতিগতভাবে একই বাতাবরণের মনে হয় তার। ইচ্ছে আছে বাংলাদেশে কাজ করার। তবে সহ-পরিচালনার আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় রয়েছেন। তার ‘গয়নার বাক্স’ সিনেমাটির কাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই এবং তিনি মনে করেন এটি বাংলাদেশে শ্যুট হলেই বরং আরো ভালো হতো। বাংলাদেশের সিনেমার মধ্যে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ তিনি দেখেছেন, আরো কিছু ভালো ছবির কথা শুনলেও দেখা হয়নি।
অন্যরকম অপর্ণা
একটা সময়ের পর থেকে যেন তিনি সবকিছুতেই বেছে নিয়েছেন একটা ভিন্ন ধাঁচ। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিলে’ যে মাকে দেখতে পাই সে কি সত্যি তার সন্তানের প্রতি উদাসীন? পারিবারিক শত অভিযোগ আর নিজের ক্যারিয়ার দুটোর মধ্যে কোনো একটাকে বেছে নেয়া সম্ভব ছিল না, তাই তাল মেলাতে চেয়েছেন। অতটা তাল মেলালেও কতখানি ফাঁক থেকে যায়- তা বেশ যথার্থভাবেই তুলে ধরেছিলেন সেই চরিত্রটিতে। এটি ছিল ১৯৯৫-এ। এরপর আরো সমৃদ্ধ হয়েছে অপর্ণার ক্যারিয়ার এবং তিনি আরো সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন দর্শকের রুচিকেও। একাধারে অভিনয় ও পরিচালনা দিয়েই কিন্তু তিনি এই সমৃদ্ধির যোগান দিয়েছেন।
অভিনয়ের কথা যদি বলি তবে ২০০০ সালে তারই পরিচালিত ‘পারমিতার একদিন’-এ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের শ্বাশুড়ির যে চরিত্রটি, তাতে একটা বিপরীতমুখী আচরণ থাকে। একইসাথে তিনি তিনি তার পরিবারের প্রতি কর্তব্যে দায়বদ্ধ, কিন্তু পুত্রবধূর প্রতি হওয়া অন্যায়কেও মেনে নিচ্ছেন না। তিনি ঋতুপর্ণাকে সর্বক্ষেত্রে সাহায্য করছেন, আবার দিনশেষে তাকেই দোষ দিচ্ছেন যে সে কেন মানিয়ে নেয় না। এই চরিত্রটি নিজের দাম্পত্য জীবনে নিজের শর্তে পথ চলে, ঘরের কর্ত্রী হয়ে সবকিছু সামলেও নেয় কিন্তু প্রেম সম্পর্কে তার নিজস্ব একটি মত পোষণ করে। এই যে একটা দ্বন্দ্বময়ী হয়ে ওঠা, এতে অভিব্যক্তি কিংবা অভিনয় দুটোই ভিন্ন মাত্রা পায়।
এরপরের বছরই এলো ‘তিতলী’। মেয়ে কঙ্কণার সাথে প্রথম অভিনয়, পর্দায়ও সে মা-মেয়েই। ছোটখাটো খুনসুটি, সহজ সম্পর্ক হঠাৎ করে ধাক্কা খায় ফেলে আসা স্মৃতির টেরাকোটায়। তা কি সত্যিই ফেলে আসা? এতেও রয়েছে সেই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, যার সাথে অপর্ণার অভিনয় অঙ্গাঙ্গিভাবেই জড়িত।
২০০৯ সালে, অন্যরকম অপেক্ষার গল্প- অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ‘অন্তহীন’। ভারতীয় আর্ট ফিল্মের মধ্যে যুক্ত আরেকটি নতুন সৃষ্টি। পারোদি-র চরিত্রে অপর্ণা সেন। কখনো বন্ধু, কখনো কলিগ, কখনো মেন্টর, আবার কখনো নিজের বিচ্ছেদে নিজেই সমাধিস্থ। আবারো বহুমাত্রিকতা, আবারো অপর্ণা। এই সিনেমাতে তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন তার স্বামী কল্যাণ রায়। ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্ককে পর্দায়ও অনায়াসে উপস্থাপন করতে স্বচ্ছন্দ তিনি।
২০১৪-তে এসে ‘চতুষ্কোণ’ সিনেমাটি সমালোচকদের চায়ের কাপে ঝড় তোলা আড্ডার অংশ হয়ে ওঠে। বোঝাই যাচ্ছে চতুষ্কোণের একটি কোণ অপর্ণা সেন। চার নির্মাতার চার গল্প এবং সমান্তরালে চলতে থাকা আরেকটি বাস্তব গল্পের মোহনা এই ‘চতুষ্কোণ’। এতে আছে সিনেমা বানানোর আমেজ, আছে সম্পর্কের টানাপোড়েন, আর আছে পরতে পরতে চমক!
প্রাপ্তির ঝুলি
এত এত বহুমাত্রিকতাই যার বৈশিষ্ট্য, তার প্রাপ্তির ঝুলিতেও খোঁজ মেলে অনেক কিছুরই। ১৯৭০ থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সাতটি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এবং ২০০৩ সালে এসে আজীবন সম্মাননা দেয় তাকে ‘বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড’। এর মধ্যে ১৯৮৭-তে অপর্ণা পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’। দু’বার ‘আনন্দলোক’ পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। এছাড়া আরো রয়েছে কলাকার পুরষ্কার, এটিও পেয়েছেন দু’বার। দু’বার লেখা হয়ে গিয়েছে অপর্ণার জীবনীও। ২০০২ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে সোমা এ চ্যাটার্জি ও রাজশ্রী দাশগুপ্তার কলমে উঠে এসেছেন অপর্ণা সেন।