There is no such thing as the paranormal.
উনিশশো ষাটের দশক। গোটা পৃথিবী এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। এই বিষণ্ণতা থেকে বাদ পড়েনি মিশরের কায়রো শহর। এই শহরেরই এক বাসিন্দা রিফাত ইসমাইল। পেশায় হেমোটোলোজি বা রক্ত বিজ্ঞান বিষয়ের একজন প্রফেসর। মধ্যবয়স্ক রিফাতের শরীরে অদ্ভুত এক বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। মাথায় টাক পড়ে যাওয়া এবং কুঁজো হয়ে হাঁটাটাই যেন সেটার প্রমাণ। চালচলনে আড়ষ্টতা থাকলেও তার রসবোধ মারাত্মক। ছোটবেলা থেকেই একটু ভিন্ন ধরবের হওয়াতে বইপত্রে মুখ গুঁজেই কাটিয়ে দিয়েছে এতগুলো বছর। বিজ্ঞান বিষয়ে আছে প্রবল আসক্তি। আর বিরক্তি তার অনস্তিত্বের বিশ্বাসে।
যেকোনো অদ্ভুত বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করাই রিফাত ইসমাইলের কাছে বেশি প্রাধান্য পায়। কিন্তু ঘুরেফিরে এই অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলোই কেন যেন তার কাছে এসে ধরা দেয়। যেমন ধরা দিয়েছিল সেই ছোটবেলায়। তখন রিফাত ওর ভাই-বোনদের সঙ্গে দূরের মাঠে গিয়ে খেলা করত। একদিন ঝোপঝাড় পেরিয়ে বল আনতে গিয়ে আল খাউদরির বাড়ির দরজায় একটা সুন্দর মেয়েকে দেখতে পায় সে। সিরাজ নামের সেই মেয়ে ওদের সবাইকে নিয়ে প্রাসাদতুল্য বাসায় নিয়ে যায়, আপ্যায়ন করায়। অন্য আরেকদিন খেলার ছলে হঠাৎ করে সিরাজ আর রিফাতকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
উপায়ান্তর না দেখে রিফাতের বোন রাইফা এসে বড় ভাই রিদাকে জানায়। রিদা সবাইকে খুব বকা দেয় আল খাউদরি বাড়িতে প্রবেশ করার জন্য। কারণ, বেশ কয়েক বছর আগে এই বাড়ির সবাই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। আর তখন থেকেই বাড়ি পরিত্যক্ত। রিদাসহ সকলে যখন যায় তখন রিফাত ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে, অদৃশ্য কারো সঙ্গে কথোকপথনে ব্যস্ত। সবাই রিফাতকে অনুনয় করে নীচে নেমে আসার জন্য। কিন্তু ছাদের ওপাশ থেকে সিরাজ ডাকে রিফাতকে। মেয়েটার ডাকেই সাড়া দেয় রিফাত। কিন্তু বিধিবাম। মেয়েটার যে অস্তিত্ব নেই, শূন্যে ঝাঁপ দেবার পর বুঝতে পারে রিফাত। বড় ভাই রিদা নিজের পা ভাঙার বিনিময়ে ছোট ভাই রিফাতকে সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
এরপর থেকেই সিরাজ নামের এই অশরীরী ডা. রিফাত ইসমাইলের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়। কখনো কাজের সময় চায়ের কাপটা উল্টে দিয়ে, কখনো বাতাসের ঝটকায় পর্দা কাঁপিয়ে আর জানালা নাড়িয়ে, কখনো রাতের বেলা খিলখিল করে হেসে উঠে, কখনো রিফাতের বদলে তার পরিবারের কাউকে ভয় দেখিয়ে।
কিন্তু রিফাতও কম না। মারফির মতো নিজেই নিজের মনে মনে বেশ কিছু সূত্র বানিয়ে নিয়েছেন। যেমন- মনের ভুলে নিজের হাত লেগেই চায়ের কাপটা উল্টে গেছে আর তা চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিভ্রম সৃষ্টি করেছে, বাতাসের তোড়েই পর্দা আর জানালা কাঁপছে, ভিন্ন কোনো কিছু ভাবার সুযোগ নেই; সারাদিনে কারো না কারো হাসির শব্দই মস্তিষ্ক রাতের বেলা শুনানোর চেষ্টা করছে মনের সঙ্গে জোট পাকিয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, অনস্তিত্ব আর অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলো পিছু ছাড়ে না রিফাতের। অনেক অনেক বছর পর অশরীরী সিরাজ ফিরে আসে। রিফাত টের পায় ঠিকই, আর নিজেকে প্রস্তুতও করে ফেলে।
The monster in your mind is scarier than the monster itself.
মা ওরা’ আল-তাব্যি’য়ে (আরবীতে: ما وراء الطبيعة) শুধু মিশর নয়; বরং আরব সাহিত্যের অনেক জনপ্রিয় এক সিরিজ। আরবি এই নামের ইংরেজি করলে আসে মেটাফিজিকস, সুপারন্যাচারাল বা প্যারানরমাল। সর্বমোট ৮১টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এই সিরিজের আওতায়। আরব সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং অতিপ্রাকৃত ধারার অন্যতম প্রবর্তক লেখক ডা. আহমেদ খালেদ তৌফিক এই সিরিজের রচয়িতা। মূলত এক হেমাটোলোজিস্ট ডাক্তার এবং অধ্যাপক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে যে প্যারানরম্যাল বা অতিপ্রাকৃত ইনভেস্টিগেশনগুলো করে সেগুলো নিয়েই পুরো সিরিজ রচিত। এই জনপ্রিয় সিরিজটার পাঁচটি গল্পকে অবলম্বন করেই নির্মিত নেটফ্লিক্সের প্রথম কোনো মিশরীয় সিরিজ-প্যারানরম্যাল।
২০১৪ সালের কথা। কোনো এক টিভি অনুষ্ঠানে আহমেদ খালেদ তৌফিক অতিথি হিসেবে ছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা ফোন করছে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য। এক যুবকের ফোন আসে সেখানে। যুবক বলে,
আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার এই প্যারানরম্যাল বইয়ের সিরিজটা যতদিন না বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলছে ততদিন আমি লড়াই করেই যাব। একদিন আসবে যেদিন ডা. রিফাত ইসমাইলের কারণে আপনাকে গোটা বিশ্ব চিনবে।
আহমেদ খালেদ তৌফিক বেশ খুশি হয়েছিলেন সেই যুবকের কথা শুনে। কিন্তু তিনি যুবকের করা ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা দেখে যেতে পারলেন না। যুবকটি ছিলেন আমর স্যালামা। আহমেদ খালেদ তৌফিকের উপন্যাস অবলম্বনে নেটফ্লিক্সের প্যারানরম্যাল সিরিজের নির্মাতা। সৌদি আরবের রিয়াদে জন্ম নেয়া এই নির্মাতা ইতিমধ্যেই আরব জগতে বেশ সুনাম কামিয়েছে। ২০১১ সালে নির্মিত সিনেমা আসমা ২০টিরও অধিক আন্তর্জাতিক পুরষ্কার বাগিয়ে নিয়েছে। আর এক্সকিউজ মাই ফ্রেঞ্চ সিনেমাটি বাগিয়েছে ১৫টি পুরষ্কার।
এ জন্যই চিত্রনাট্য বেশ গোছানো আর পরিপাটি মনে হয়েছে সিরিজের। আর নির্মাণশৈলীতেও ছিল বেশ সূক্ষ্ম একটা ভাব। সিরিজের পরিচালক হিসেবে আরো ছিল মাজিদ আল আনসারির নাম। দুবাই আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরষ্কার পাওয়া ছাড়াও, ২০১৬ সালের আরব ফিল্মমেকার অফ দ্য ইয়ার সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন। এই সিরিজের তিন পর্বের নির্মাতা হিসেবে ছিল মাজিদ আল আনসারির নাম। চিত্রনাট্য বিভাগে আরো ছিলেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত চিত্রনাট্যকার মাহমুদ ইজ্জাত, দিনা মাগের এবং ওমার খালেদ। প্রযোজকের খাতায় ছিল আরবের বিখ্যাত প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার মোহাম্মদ হেফজির নাম।
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং বা সিরিজের মিউজিক করেছেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত মিউজিশিয়ান ও কম্পোজার খালেদ আল খামার। পুরো সিরিজ জুড়ে অদ্ভুত ঘোরলাগা এক ভাব বজায় রাখতে থিমেটিক যে মিউজিকের ব্যবহার করেছেন তিনি, তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। গল্পটা যে শুধুই হররের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বরং ত্রিভুজ এক প্রেমের গল্পে পরিণত হয়েছে, সেদিকেই বিশেষ খেয়াল করেই করা হয়েছে এই সিরিজের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং। সিনেমাটোগ্রাফির কথা বলতেই হয়। আহমেদ বেশারি নিজের দক্ষতা ফুটিয়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন এই সিরিজে। মিশরের ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে তার ক্যামেরায়।
সিরিজের গল্পটা বেশ সাদামাটা। একজন বাস্তববাদী মানুষ অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে যুক্তির বিচারে আর বিজ্ঞানের আলোকে বর্ণনা করতে চায়। বিজ্ঞানের যে অংশটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞান কম, সেটাই যেন তাদের কাছে অতিপ্রাকৃত মনে হয়। কিন্তু কথায় আছে- যাহা রটে তাহা কিছু হলেও ঘটে। ঠিক তেমনই ছয় পর্বের এই সিরিজে ছয়টি আলাদা গল্পে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি রয়ে গেছে কিছু অব্যক্ত কথা বা প্রশ্ন। যেজন্য সিরিজটার শুরু হয় অতিপ্রাকৃত বলতে কিছু নেই দিয়ে। আর শেষটা হয় অতিপ্রাকৃত বলতে আসলেই কিছু আছে বলে।
গল্পে বেশ ভালো গভীরতা ছিল। বিশেষ করে প্রথম পর্ব দ্য মিথ অফ দি হাউজ, চতুর্থ পর্ব দ্য মিথ অফ নায়াদ, পঞ্চম পর্ব দ্য মিথ অফ ইনকিউবাস এবং শেষ পর্ব দ্য মিথ দি হাউজ: দ্য রিটার্ন এগুলোতে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখিত এসব পর্বের মধ্যে আবার শেষ পর্বটা আরো বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতোই। এই পর্বের গল্পটা এতটাই সুন্দর, গোছানো আর পরিপাটি যেন, সিরিজ দেখার তৃপ্তিটা ঠিক এই পর্বেই নিহিত। বরং এই পর্বটা দেখেই মুগ্ধতার রেশটা রয়ে যাবে দর্শকের মনে। কেননা, অতিপ্রাকৃত আর বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে গেছে ত্রিভুজ এক প্রেম আর বন্ধুত্বের গল্প। এমনকি রয়েছে সিরিজে রয়েছে এই অসম প্রেম নিয়ে দারুণ একটি কবিতা –
I will never stop loving you, Maggie.
Until the stars fall from the sky, until the world ends.
Until planets collide and suns wither.
Until the moon is extinguished and all seas and rivers dry up.
Until I become senile and my memory is eroded.
Until my tongue is no longer capable of uttering your name.
Until my heart beats for the last time, only then I may stop, I may stop loving you.
তবে দ্বিতীয় পর্ব দ্য মিথ অফ দি কার্স অফ ফারাও এবং তৃতীয় পর্ব দ্য মিথ অফ দি গার্ডিয়ান অফ দি কেইভ – এই দুটো পর্ব যেন এই সিরিজের প্রধান দুর্বলতা। শুধুমাত্র মিশরের গল্প বলেই যেন ফারাওকে নিয়ে একটা গল্প বলা অত্যন্ত দরকার- অনেকটাই এরকম ধাঁচের। নাহ গল্পের মিথে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তা-ও একটা খাপছাড়া ভাব। তৃতীয় পর্বও তা-ই। যেন মিশরের বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর মরুভূমির জাতিগোষ্ঠীদের দেখানোই মূল উদ্দেশ্য ছিল। এই পর্ব দুটোতে চিত্রনাট্যের পাশাপাশি ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের ক্ষেত্রেও অপরিপক্বতা দর্শকের চোখে লাগে। তবে তা পুষিয়ে যায় পরবর্তী তিনটি পর্বে।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে ডা. রিফাত ইসমাইলের চরিত্রে অভিনয় করা আহমেদ আমিনের কথা। মিশরীয় বংশোদ্ভূত আহমেদ আমিন একইসঙ্গে একজন কমেডিয়ান, অভিনেতা এবং লেখক। ত্রিশ সেকেন্ডের একটা কমেডি ভিডিও মিশর জুড়ে ফেসবুকে ভাইরাল হলে দারুণ জনপ্রিয়তা পান আমিন। ইতিপূর্বেই একটা সিরিজে কাজ করা আহমেদ আমিন নিজের জাত চিনিয়েছেন প্যারানরম্যাল সিরিজ দিয়ে।
চালচলনে আড়ষ্টতা আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। মধ্য চল্লিশের কোটায় থাকা চরিত্র রিফাত ইসমাইল; অথচ তার শারীরিক আর মানসিক বার্ধক্য যেন আশির কোটায়। কেমন যেন স্থবিরতা তার মধ্যে, কেমন একটা ভঙ্গুর ভাব; আর আছে বিষাদময় এক বিষণ্ণতা তার সমস্তটা জুড়ে। আরো আছে গোঁড়া আর নাক সিটকানো এক স্বভাব। এমন এক কমেডিয়ান কী করে নিজেকে এমন অদ্ভুত এক চরিত্রে মানিয়ে নিল তা-ই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আহমেদ আমিনের পরেই রাজানে জামালের কথা বলতে হয়। ম্যাগি চরিত্রে অভিনয় করা লেবানিজ-ব্রিটিশ এই অভিনেত্রী নিজের চরিত্রে বেশ প্রাণবন্ত আর স্বতঃস্ফূর্ত। ডিভোর্সি নারী ফিরে এসেছে প্রাক্তন প্রেমিকের শহরে। অন্যদিকে প্রাক্তন প্রেমিকের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। তবুও প্রেমিকের খেয়াল রাখাটা যেন ম্যাগির সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। যেজন্য রিফাতের ইসমাইলের প্রতিটা বিপদেই যেন ছায়ার মতো পাশে দাঁড়ায় ম্যাগি। রাজানে জামালের অভিনয় বেশ ভালো লেগেছে। চরিত্রের মধ্যে ডুবে যাওয়া যাকে বলে।
অন্যদিকে আবার রিফাত ইসমাইলে বিয়ে ঠিক হয়েছে কাজিন হাওয়াইদার সঙ্গে। হাওয়াইদা স্কুলের পিয়ানো টিচার। খানিকটা মান্ধাতা আমলের স্বভাব। রিফাত ঠিক চায় না হাওয়াইদার সঙ্গে প্রণয়ে জড়াতে। কিন্তু মনে-প্রাণে যেন রিফাতকেই শুধু চায় হাওয়াইদা। এমনই এক চরিত্রে আয়া সামাহা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। কেমন লাস্যময়ী একটা ভাব ছিল তার চালচলন, কথাবার্তায়। সিরিজে অভিনীত সবার অভিনয়ই আসলে প্রশংসার দাবীদার।
পুরো সিরিজ জুড়েই এক থমথমে আর বিষণ্ণ আবহ ছিল। গা ছমছমে একটা ভাব ফুটে উঠেছিল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সুবাদে। তবে ভয়কে ছাপিয়ে গেছে এই সিরিজের এক অসীম অপেক্ষমান প্রেম। বিষণ্ণতার অবগাহনে মনস্তত্বের এক দারুণ গল্প বলেছেন আহমেদ খালেদ তৌফিক। আর সেই গল্পকেই খুব সুন্দর রূপ দিয়েছেন সিরিজের নির্মাতাগণ।
There is definitely, such a thing as the paranormal.