একই গল্প বার বার শুনতে কি কারো ভালো লাগে? না বোধহয়। কিন্তু সিডনি লুমেটের কালজয়ী চলচ্চিত্র পুনর্নির্মাণ করে রাশিয়ান অস্কারজয়ী পরিচালক আবারও প্রমাণ করেছেন- চলচ্চিত্র শুধুমাত্র কাহিনীসর্বস্ব শিল্পমাধ্যম নয়। নিছক কাহিনী জানার আকর্ষণে আমরা চলচ্চিত্র দেখি না। যদি সেভাবে দেখতাম, তাহলে সাহিত্য থেকে নেয়া কোনো গল্পের চলচ্চিত্র কেউই দেখত না। সত্যজিতের পথের পাঁচালী কালোত্তীর্ণ হতো না। কিংবা লা মিজারেবলেরও এত এত রিমেক হত না। এই সূত্রের সাহায্যে চলচ্চিত্রের স্পয়লার অ্যালার্টের যে তথাকথিত ধারণা, সেটাকেও অগুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করা যায়। অর্থাৎ গল্পের বাইরেও অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যেগুলো পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে চলচ্চিত্রমান নির্ধারিত হয়। চলচ্চিত্রের ভিজুয়্যাল আবেদন এবং এর নির্মাণশৈলী জানা ঘটনাকেও নতুন করে দেখায়, নতুন করে ভাবায়। ফলস্বরূপ, ৮০ তম অস্কারে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে শীর্ষ পাঁচে মনোনয়নও পায় এ রিমেক ফিল্ম।
আমেরিকার বিখ্যাত ছবি টুয়েলভ এংগ্রি ম্যানকে (১৯৫৭) সম্পূর্ণ রাশিয়ান ছাঁচে ফেলে পর্যাপ্ত সংযোজন বিযোজন করে চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে সংলাপনির্ভর চলচ্চিত্র ১২ (২০০৭)-এর। ফলে অফিসিয়াল রিমেক এবং মূল চলচ্চিত্রের নির্যাস থাকা সত্ত্বেও ছবিটি হয়েছে পরিচালকের একান্ত নিজস্ব স্টাইলের রুশ সংস্করণ। কোর্টরুম ড্রামার যে অবরুদ্ধ দম ও রুদ্ধশ্বাস- উত্তেজনা তা অব্যাহত থেকেছে প্রায় ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট ব্যাপ্তিতেই। একটি ছবির পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এর থেকে বড় চমক আর কী-ই বা হতে পারে! ভীষণ দুর্দান্ত একটি চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক নিকিতা মিখালকভ। রাশিয়ান ছকে ফেলে তিনি যে কাহিনীতে স্বকীয়তা সৃষ্টি করেছেন তা রীতিমতো অবাক বিস্ময়ে তাক লাগায়! কাহিনীর পরিধিকে টেনে বর্ধিত করে একে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং অর্থবহ করে তোলার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জে কীভাবে সফল হতে হয় তারই নমুনা দেখিয়েছেন তিনি।
চেচনিয়ান (চেচেন) এক বালকের পিতৃহত্যার সাজা, যুক্তি, সাক্ষ্য, আর প্রমাণের ভিত্তিতে ইতোমধ্যেই কোর্ট দ্বারা নির্ধারিত। কেবল ১২ জুরির আনুষ্ঠানিক মতামত জানানোর বাকি। দেখে নিছক আনুষ্ঠানিকতা সারার পর্ব বলে মনে হবে, যাতে ১২ জনের ঐক্যমত্যের জন্য মোটে সময় লাগার কথা বড়জোর ২০ মিনিট! অন্তত প্রাথমিকভাবে এমনটাই ধারণা হবে! কিন্তু তাদের ১১ জন চেচনিয়ান বালককে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের ভোট প্রদান করলেও বাকি একজনের ভেটো প্রয়োগে পাল্টে যায় সময়ের হিসাব-নিকাশ। তবে, সবার মতের প্রতিকূলে তার কণ্ঠস্বর খুব মৃদু, খুবই নিচু শোনায়। যাবজ্জীবন সাজার মতো ভয়াবহ একটি বিষয়ে সকলের এমন তাড়াহুড়োতে তিনি বেজায় নাখোশ। কারণ, তিনি কেসটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে চান, আরেকটু খতিয়ে দেখতে চান অভিযুক্তের সাথে সংঘটিত অপরাধের সম্পৃক্ততা। কিন্তু শুরুতে দৃঢ়কণ্ঠে আপত্তি জানাতে গিয়ে ঘাবড়ে তোতলাতে আরম্ভ করেন, “I want… well, to talk, at least…”। তিনি অভিমত দেন যে কোর্টরুমে নানা ত্রুটি স্পষ্টত প্রত্যক্ষ হওয়ায় আদালতের তদন্তের ডিটেইলিংয়ে অনাস্থা জ্ঞাপন করে সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে।
Beyond reasonable doubt থেকে অপরাপর সম্ভাব্যতা নিয়ে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় সামিল হতে আগ্রহী এই ব্যক্তি। কিন্তু সবাই বিরক্ত অহেতুক কালক্ষেপণে। অতঃপর নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর যুক্তির শানে তাদের সভা হয়ে ওঠে জমজমাট বারোয়ারি বিতর্কের আসর। তাতে ড্রামস আর বিটে নৃত্যের তালে চেম্বার থ্রিলারের নতুন স্বাদ পাওয়া যায়। অপরূপ চিত্রায়ণ গল্পের স্তরে স্তরে। অঙ্গভঙ্গির সূক্ষ্মতম বিষয়গুলো না এড়িয়ে, বরং ধরা দেয় অধিকতর সিনেম্যাটিক কম্পোজিশনে। ফ্ল্যাশব্যাকের ভাঁজে কাহিনীর খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত টুকরো আগ্রহ বাড়ায় অজানা ঘটনার রহস্যভেদের প্রতি। তবে ধারাবাহিক বিক্ষিপ্ততা সুনিপুণ অস্পষ্টতা তৈরি করে দর্শকদের প্রদীপের আলোর তলায় ঠিক অন্ধকার প্রকোষ্ঠতেই বদ্ধ রাখে।
একজন নাগরিকের ন্যায়বিচার পাবার যে রাজনৈতিক অধিকার তাতে সংশ্লিষ্টজনদের অনাগ্রহ এবং অবহেলা চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে নিকিতার সিনেমায়। মুসলিম চেচনিয়ান বালক উমার সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে থেকেছে উপেক্ষিত, অচ্ছুৎ। এমনকি দায়সারা আনুষ্ঠানিকতা সেরেছে তার পক্ষের আইনজীবীও। ইহুদীবাদ নিয়ে বিরূপ ধারণার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ফিল্মে। ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের প্রতিও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে সচেতনভাবে। উমারের কেসটি নিয়ে তাদের অবহেলার প্রকটতা বোঝা গেছে যখন তারা কখন কীজন্য হাত তুলছে তা নিয়ে তাদের অমনোযোগিতা দৃশ্যমান হয় তখন। তেমনই স্পর্শকাতর নানা ন্যারেটিভ পাওয়া যায় ভিন্ন পেশাজীবী ১২ জনের জীবন অভিজ্ঞতায়। যুক্তিতর্কের খাতিরে কাছাকাছি উচ্চারিত ভিন্ন অর্থ বহন করে এমন রুশ শব্দ নিয়ে ধাঁধা সৃষ্টি করে এ ছবি।
এডওয়ার্ড আর্তেমুয়েভের শব্দ এবং সঙ্গীত একাধারে ড্রামাটিক এবং জ্যাজ ঘরানার। এতে ফলি সাউন্ড ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। কাফকাজের বাসিন্দাদের অস্ত্র হিসেবে ছুরিচালনা, এবং আত্মরক্ষা কৌশলের সাথেও দারুণ পরিচিতি ঘটিয়েছে চলচ্চিত্র টুয়েলভ। এডিটিংয়ে ম্যাচ কাটের ব্যবহার গল্পের গতি বাড়িয়েছে। গতিময়তার জন্যই ব্যাপ্তির দীর্ঘায়ন অনুভূত হয়নি। আমার দেখা সবচেয়ে দুর্দান্ত সিকুয়েন্স মনে হয়েছে ১২ জন সম্মত হয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মুহূর্তটি। স্কুলের গেমসরুমের করতালি থেকে কী চমৎকার ম্যাচকাট ট্রাঞ্জিশনে চেচনিয়ায় বিদ্রোহীদের উদোম নৃত্য, এরপর আবার সেই শট থেকে ম্যাচকাটে অন্ধকার বন্ধ প্রকোষ্ঠে শীত তাড়াবার নিমিত্তে নৃত্য। এর মধ্যেই আবার কোর্টে চূড়ান্ত রায় ঘোষণায় সবার হতভম্ব হবার এক্সপ্রেশন। মোটের উপর সম্পাদনার টেবিলে দারুণ বিন্যাস-সমাবেশের অংক কষেছেন এডিটর এঞ্জো মেনিসনি ও আন্দ্রেই যেতসেভ। এছাড়া আর্ট ডিরেকশনে স্কুলের গেমসরুমের পুরনো সরঞ্জামাদিগুলো বেশ গ্রহণযোগ্য। প্রপস হিসেবে বৈচিত্র্যময় সব এলিমেন্টের অন্তর্ভুক্তি বড্ড নান্দনিক। তবে এমারসনের CQC7 মডেলের ছুরির কথা বলা হলেও বস্তুত আসলে ছবিতে দেখানো ছুরিটি অন্য কোনো মডেলের ছিল, এমারসনের নয়। অবশ্য তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে না। যেমন- কোনো পাহাড়ি এলাকায় ঘন জঙ্গলে ক্লোজ আর মিডশটে শুট করে তাকে আপনি সুন্দরবন বা আমাজন বন বলেন তাতে খুব একটা মাথাব্যথা হয় না যদি না এর বিশেষ মাহাত্ম্য থাকে।
একটি ক্রাইম থ্রিলারকে মানবিক গল্পে রূপ দেয়ার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব পরিচালক নিকিতা মিখালকভের প্রাপ্য। তার নিখুঁত পরিচালনায় প্রতিটি চরিত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে, স্টোরিলাইনে চরিত্রগুলো যেভাবে বের হয়ে এসে ক্যারিশমাটিক অভিনয়প্রতিভার জাদু দেখিয়েছে তাতে বিশেষ প্রশংসার দাবিদার তারাও। ভিন্ন ভিন্ন পেশাজীবী মানুষের আচরণের বৈচিত্র্য সহজেই চোখে পড়ে। ক্রাইম থ্রিলার ১২-এর সমাপ্তিতে আধ্যাত্মিক এক ফাইনাল টাচ ফ্রাংক ডেরাবন্টের দ্য গ্রিন মাইল ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বহু কাকতালীয় ঘটনার সন্নিবেশে যুক্তিতর্ক নয়, বরং ভাগ্যবিধাতার সহায়তা ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে অধিক প্রাসঙ্গিক লাগে। যুক্তিতর্কের বাইরেও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে আস্থা দেখিয়েছে এ সিনেমা। সম্মিলিতভাবে ফ্ল্যাশব্যাকের পরিকল্পিত অস্পষ্টতা আর বর্তমান মানবিক স্পষ্টতার অভূতপূর্ব মিশেলের সমন্বয়ের চেম্বার ড্রামা ফিল্ম— টুয়েলভ নিখাদ মুগ্ধতা ছড়ায়।