ইতিহাসে পাওয়া এমন কিছু বিশেষ যুদ্ধের নথিপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সময়ের সাথে সাথে বদলেছে সংঘাতের কারণ। কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তাবাদ, আবার কখনো হয়তো সংঘর্ষ হয়েছে সাম্রাজ্য বিস্তারের জের ধরে। তবে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি সংঘটিত সকল যুদ্ধেই অন্তত একটি বিষয় রয়েছে অপরিবর্তিত। তা হলো দু’পক্ষের লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সাধারণ মানুষের জীবনগল্প।
সভ্যতার উত্থান-পতন কিংবা পৃথিবীর বুকে বড় কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসা যুদ্ধগুলো নিয়ে শত শত বই লেখা হয়েছে। যে বইগুলোতে বিশেষজ্ঞরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। কিন্তু হাতেগোনা অল্প সংখ্যক লেখাতেই প্রকাশ পেয়েছে সংঘর্ষের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথাই বলা যাক, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্রের তাণ্ডব দেখেছিল মানবসভ্যতা। জাপানের দুটো শহর নিমেষেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল লিটল বয় আর ফ্যাট ম্যানের আঘাতে। সেই সময়কার সংবাদমাধ্যম ও নথিপত্র ঘাঁটলেই তা জানা যায়।
এমনকি এ যুগের বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও ইতিহাসনির্ভর বইয়েও পারমাণবিক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জাপানিদের দুঃখ-দুর্দশার গল্প তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু সেই যুদ্ধের প্রকৃত ভয়াবহতা বোঝার জন্য এগুলো কি আদৌ যথেষ্ট? সম্ভবত না। কারণ, মানবজাতি এর আগে কখনো এমন ধ্বংসলীলার সম্মুখীন হয়নি। সেই লোমহর্ষক গল্পগুলো শুধু তারাই জানে, যারা পারমাণবিক হামলার পরেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ছিল।
‘সাচিকো: অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি’ হলো এমন একটি বই, যেখানে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে তুলে ধরা হয়েছে নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার নির্মম ভয়াবহতা সম্পর্কে।
আমেরিকান লেখক কারেন স্টেলসনের লেখা বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। শুরুর দিকেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় পাঠকদের কাছে। তা গুড-রিডসের ৪.২৫/৫ রেটিং দেখলেই বোঝা যায়। ইংরেজি পড়তে যারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাদেরও হতাশ হওয়ার কারণ নেই। বইটি বাংলাতেও অনুবাদ হয়েছে। তরুণ লেখক মুহাইমিনুল ইসলাম অন্তিকের চলমান ‘ওয়ার ডায়েরি সিরিজ’-এর প্রথম বই ‘সাচিকো’।
অনুবাদগ্রন্থ নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এই বইটি নিঃসন্দেহে পড়তে পারেন। ‘সাচিকো’র বাংলা অনুবাদ খুলে বসলে অন্তত এটা বুঝবার উপায় নেই যে বইটি ভাষান্তরিত হয়েছে। লেখক যে একেবারে গল্পের গভীরে প্রবেশ করে সেই নির্মম দিনগুলো অনুধাবন করে তবেই লিখেছেন, তা সাবলীল শব্দচয়ন আর বাক্যের গঠন দেখেই অনুধাবনযোগ্য।
১
১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের মাধ্যমে যে যুদ্ধের সূচনা করেছিল, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই তা ইউরোপ থেকে এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রভাবশালী রাষ্ট্র জাপান যোগ দেয় জার্মানির পক্ষে।জাপান চেয়েছিল, এশিয়াতে এক বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া জাপানের পথ আগলে দাঁড়ানোর মতো কোনো দেশ ছিল না। আর জাপানের খুব কাছাকাছি পার্ল হার্বারে ছিল মার্কিন সেনাঘাঁটি। তাই জাপানিরা সবসময় একপ্রকার আতঙ্কের মাঝে থাকত।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর; নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধবিমান আকস্মিক হামলা করে বসে পার্ল হার্বারে। ২,৩৩৫ জন মার্কিন নাগরিক প্রাণ হারায়। জাপানের এমন আচরণে যুক্তরাষ্ট্র হতবিহ্বল বনে যায়। কারণ, তখনও পর্যন্ত মার্কিনীরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
১৯৪১ সালের ৮ ডিসেম্বর। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপানের বিরুদ্ধে। ক’দিন পরই তৎকালীন তিন সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে আক্রমণ শুরু করে অক্ষশক্তির দেশগুলোর উপর। শুরু হয় ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়। দফায় দফায় আক্রমণে বেসামাল হয়ে পড়ে জার্মানির মিত্র দেশগুলো। যুদ্ধে জাপানও সুবিধা করতে পারেনি। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালানোর মতো সক্ষমতা তাদের ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানেই খাদ্য সংকটে পড়ে জাপান।
১৯৪৩ সালে ইতালি ও ১৯৪৫ সালের মে মাসে আত্মসমর্পণ করে জার্মানি। অক্ষশক্তির দুই গুরুত্বপূর্ণ শক্তি পরাজয় মেনে নিলেও জাপান লড়ে যাবার সিদ্ধান্তে অটল ছিল তখনও। যদিও ১৯৪৪ সাল থেকে মার্কিন বোমারু বিমানগুলো নিয়মিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল জাপানের বিভিন্ন শহরে, তবু তাদের দম্ভ চূর্ণ হচ্ছিল না।
২
সাচিকো, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমেরিকা যখন নিয়মিত জাপানের শহরগুলোতে বোমা ফেলছে, তখন তার বয়স পাঁচ বছর মাত্র। এই দুঃসহ দিনগুলোর মাঝেও বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিল। যদিও খাবারের সংকট ছিল, সারাক্ষণই এক উৎকণ্ঠার মাঝে থাকতে হতো; কখন যেন আকাশ থেকে বোমা পড়ে।
থেকে থেকেই বেজে উঠত বিপদ সংকেত। তখন সাচিকোর পরিবার আশ্রয় নিত পাহাড়ের গায়ে বানানো গুহাতে। নাগাসাকির সব পরিবারই বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে এ পদ্ধতি বেছে নিয়েছিল।
এভাবে ক’দিন যাবে? কবে আবার স্কুলে যেতে পারবে? এসব নিয়ে ছোট্ট সাচিকোর ভাবনার অন্ত ছিল না। রেডিওতে নিয়মিতই খবর আসত, “জাপান অবশ্যই যুদ্ধে জিতবে”। সাধারণ মানুষ এসব মনভোলানো বার্তায় স্বস্তির খোঁজ করলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। আসলে জাপানিদের যুদ্ধজয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। বরং আত্মসমর্পণের পথেই হাঁটছিল তারা।
এদিকে আমেরিকা করছিল আরেক পরিকল্পনা। জাপানকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করাতে পারমাণবিক হামলার মতো এক নির্মম সিদ্ধান্ত নেয় তারা। যদিও এর আগে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে এই বোমার ব্যাবহার হয়নি, তবে এর বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা ছিল।
৬ আগস্ট, ১৯৪৫। হিরোশিমাতে প্রথম পারমাণবিক আঘাত হানে আমেরিকা। ১৫,০০০ টন টিএনটির শক্তি নিয়ে বিস্ফোরিত হয় লিটল বয়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর বিকিরণ। ৫০০ মিটারের ভেতরে থাকা সকল জীবিত প্রাণী মুহূর্তেই ঝলসে যায়। চোখের পলকে হিরোশিমা শহরের ৯২ শতাংশ ধ্বংস হয়, নরকে পরিণত হয় অঞ্চলটি।
হিরোশিমায় যখন এ তাণ্ডব চলছিল, নাগাসাকির মানুষগুলো তখনও জানত না, তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।
৯ আগস্ট, ১৯৪৫। দু’বছর বয়সী ছোট ভাই তোশির দুষ্টুমিতে ঘুম ভাঙল সাচিকোর। বাকি দিনগুলোর মতোই মা খাবার বানাতে ব্যস্ত, ঘুর্ঘুরে পোকাগুলো শব্দ করে ডাকছে। কিন্তু হঠাৎই চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল, বেজে উঠল অশনি সংকেত।
মা দ্রুতই বাচ্চাদের নিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিল গুহায়। সাচিকোদের মতো আরও কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে এখানে। কিছুক্ষণ পর সাইরেন থেমে যায়। বিপদ কেটে গেছে ভেবে বাড়িতে ফিরে যায় সকলেই। তবে সাচিকো গুহাতেই অন্য বাচ্চাদের সাথে হাঁড়ি-পাতিল খেলা শুরু করে দেয়।
কয়েক ঘণ্টা পরের কথা, সাচিকো অন্য বাচ্চাদের সাথে তখনো খেলছে সেখানেই। হঠাৎই আবার মার্কিন বোমারু বিমান দেখা গেল আকাশে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছুটতে শুরু করল। ১১টা বেজে ২ মিনিট, এক বিকট শব্দে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যান বিস্ফোরিত হলো নাগাসাকিতে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে গেল আকাশ, তৎক্ষণাৎ মারা গেল ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। শতবর্ষী কর্পূর গাছগুলো কেঁপে উঠল, বাতাসে ধূলিকণার সাথে গাছের অংশ, পাথরের টুকরো, ভাঙা টাইল উড়তে লাগল।
বিস্ফোরণ কেন্দ্রস্থল থেকে ৯০০ মিটারের মধ্যেই ছিল সাচিকো। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল সে। কিছুক্ষণের মাঝেই মামা এসে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে সাচিকোকে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে সে দেখল, যে বাচ্চাগুলোর সাথে সে খেলছিল, তারা সবাই মারা গেছে।
একটু পর সাচিকো খুঁজে পেল বাবা-মা ও ভাই-বোনদের। শুধু পাওয়া যাচ্ছিল না সবচেয়ে ছোট ভাই তোশিকে। কিছুক্ষণ পর তাকেও পাওয়া গেল। কিন্তু তাকে এ অবস্থায় দেখতে কেউ প্রস্তুত ছিল না; একটি কাঠের টুকরো তোশির মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে!
সেদিন থেকে সাচিকোর জীবনে শুরু হলো স্বজন হারানোর ব্যথা। পরিবারের একজন বাদে বাকি সবাই বেঁচে ছিল ঠিক, কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণের ভয়াবহ বিকিরণ গ্রাস করেছিল সকলকে। নাগাসাকি পরিণত হয়েছিল মৃত মানুষের নগরীতে। যে অল্প সংখ্যক মানুষ বেঁচে গিয়েছিল, তারাও চিকিৎসা পাচ্ছিল না, হাসপাতালগুলোতে জায়গা ছিল না।
সাচিকোর পরিবার আধমরা অবস্থায় নাগাসাকি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, তবে তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল আরো ভয়াবহ বিপদ।
নাগাসাকির সেই বিস্ফোরণের প্রভাব এতই ভয়ংকর ছিল যে, বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ মানুষই ক্যান্সারসহ ভয়ানক সব রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে। অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা জন্ম দেয় বিকলাঙ্গ শিশুর। এদিকে আবার জাপান আত্মসমর্পণের পর মার্কিন সেনারা ঘাঁটি বানিয়েছে তাদের দেশে। পারমাণবিক হামলার ভয়াবহতার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করাও যায় না, আমেরিকার প্রতিনিধিরা নিয়মিত তদারকি করে এসব নিয়ে।
জীবনে যা-ই ঘটে যাক, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, ঘরবাড়ি হারিয়ে যাক, তবু বেঁচে থাকতে হয়। কষ্টগুলো পিছু ছাড়ে না, ঘুমন্ত মস্তিষ্কে স্বপ্ন হয়ে বারবার ফিরে আসে; তবুও এসব সঙ্গী করেই সামনে এগিয়ে যেতে হয়। সাচিকোকেও বাঁচতে হবে, নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে, যেভাবে শতবর্ষী কর্পূর গাছগুলো আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, তাকেও সেভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়তে হবে। প্রিয়জন হারানোর স্মৃতি ভুলে আর কষ্টগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করে চালিয়ে যেতে হবে জীবনসংগ্রাম।
বই: সাচিকো – অ্যা নাগাসাকি বম্ব সারভাইভার্স স্টোরি
লেখক: কারেন স্টেলসন
অনুবাদক: মুহাইমিনুল ইসলাম
প্রকাশক: স্বরে অ
প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা ২০২০
মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা