লঙ্কা নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড কিংবা মসলা নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা ভাবা যায়? নাহ, অবশ্যই আজকের দুনিয়ায় এমন কথা ভাবা যায় না। তবে পনেরো শতকের দিকে এমনটাই ঘটেছিল। ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার মসলার চাহিদা ছিল বিশ্বজোড়া। বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে তেরো নদী সাত সমুদ্র পেরিয়ে বণিকরা আসত এই এশিয়ায়, মসলার সুগন্ধে কাবু হয়ে। আর সেসব মসলা কম দামে কিনে নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করত সেই সময়ের বণিকরা। তবে সমুদ্রের এই যাত্রাপথ ছিল বিপদসংকুল। এই কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে গিয়ে জাহাজ বোঝাই করে ফিরতে হতো বণিকদের। কিন্তু একসময় তাদের মাথায় ভাবনা এলো, কেমন হয়, যদি মসলার বাণিজ্যটা নিজেদের করায়ত্ত করা যায়?
এমনই চিন্তাচেতনা থেকে পর্তুগীজ জলদস্যুরা বারংবার আঘাত হেনেছে ভারতবর্ষের বুকে। কিন্তু কালকূটের রাজা এবং সেখানকার জনগণ, এবং এমনকি আরব বণিকরাও পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কেননা, সবাই খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিল, যদি এই জলদস্যুদের অধীনে একবার যাওয়া হয়, তাহলে যে আর নিস্তার নেই। কিন্তু বুঝতে পারেনি গুটিকয়েক দেশি মানুষই। তাই তো, ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটা ইতিহাসে এতটা ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত করা হয়।
ভাস্কো দা গামা– যাকে ইতিহাস সম্মানিত করে জলপথ আবিষ্কারের কারণে। কিন্তু সেই একই ইতিহাস যে তার নৃশংসতাকে আড়ালে ধারণ করে, তা পড়ে যেকোনো পাঠকের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠতে পারে। মক্কা থেকে হজযাত্রীদের নিয়ে কয়েকটি নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের জাহাজটা পড়ে যায় পর্তুগীজ নৌবহরের সামনে। যাত্রীদের মালামাল লুট করার নির্দেশ দেন ভাস্কো দা গামা। কিন্তু কোনো যাত্রীকে তারা দাস হিসেবে নেয় না। বরং জাহাজে থাকা সকল যাত্রীসমেত জাহাজটাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর ভাস্কো দা গামা পরম আনন্দে সেই দৃশ্য উপভোগ করলেন।
পর্তুগীজদের এই তীব্র মুসলমান বিদ্বেষের কারণ কেবলই ধর্ম ছিল না। মূলত বৈষয়িক স্বার্থ বুদ্ধি ছিল এর মূল কারণ। পর্তুগীজরা ভারতবর্ষে এসে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করলেও অন্য ধর্মের বা অন্য দেশের কাউকে ছুঁয়েও দেখত না। তারা মানুষের মনে এই ভাবনা ঢোকাতে সক্ষম হয়েছিল, তারা কেবল মুসলমানের শত্রু এবং অন্যদের বন্ধু। এতে অসাম্প্রদায়িক বন্ধন খানিকটা হলেও ঢিলে হয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষে। আর সে সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিল পর্তুগীজরা।
পর্তুগীজরা যখন মসলার বাণিজ্যে ইউরোপে দারুণ সাফল্য কামাচ্ছে, ঠিক তখনই ওলন্দাজ বণিকেরা বিদ্রোহ করে বসল উচ্চ দামে মসলা কেনার বিরুদ্ধে। ১৫৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ডাচদের নৌবহর ভারতবর্ষের বদলে ইন্দোনেশিয়ার মসলার দ্বীপে যাত্রা করে। সেবার তারা নিজেরা মসলা কিনে এনে ব্যাপক মুনাফা কামায়। তখন থেকেই মূলত ডাচদের বাণিজ্য জাহাজ নিয়মিত চলাচল শুরু করল। গড়ে ওঠে ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
ডাচদের মাথায় অদ্ভুত এক বুদ্ধি এলো। যদি কোনোমতে এই জমিন দখল করা যায়, তাহলে মুনাফা আকাশচুম্বী হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। ডাচ বণিকরা চাষীদের আগাম দাদনের টাকা দিয়ে দিল। আর সরল মনের চাষীরাও দিল সেই ফাঁদে পা। দাদনের সুযোগ নিয়ে নানারকম ছলচাতুরি ও প্রবঞ্চনার সাহায্যে চাষীর জমি হয়ে গেল কোম্পানির সম্পত্তি। ক্ষেতের চাষের কাজ সেই চাষীরাই করত। তবে আগে করত নিজের ক্ষেতে, আর এখন করতে লাগল কোম্পানির বাগিচায় দিনমজুর হিসেবে। কোম্পানির বাইরে যাদের জমি ছিল, তারা তাদের ক্ষেতে লবঙ্গ গাছ লাগাতে পারতো না। এই মসলা চাষের অধিকার ছিল কেবল কোম্পানির।
পর্তুগীজরা এ অঞ্চলে এসেছিল মসলার বাণিজ্য করতে। এ বাণিজ্যকে মুষ্টিগত করা এবং এ জলপথের একচ্ছত্র অধিকারী হওয়াই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মূলত ভারতবর্ষে কালিকট রাজ্য দখল করতে গিয়ে বারংবার ব্যর্থ হওয়াতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গিয়েছিল। অবশ্য তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল বটে। তবে সেটা ছিল মসলার বাণিজ্য পাহারা দেবার লক্ষ্যে, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। কিন্তু ডাচরা কেবল মসলার বাণিজ্য পর্তুগীজদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েই শান্ত হয়নি। বরং তারা শুরু থেকেই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেছিল।
সাম্রাজ্যবাদের সম্পূর্ণ রূপ ডাচরা সর্বপ্রথম দেখিয়েছিল। পর্তুগীজরা মসলার বাণিজ্য নিজেদের করে নিতে চেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মসলা উৎপাদনের বিষয়ে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। পক্ষান্তরে ডাচরা মসলার বাণিজ্য করে মুনাফা অর্জন করেও শান্ত হতে পারেনি। বরং মসলার উৎপাদন নিয়ে তারা চিন্তিত হয়েছিল বলেই ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোর মানুষজনকে শোষণ করা শুরু করেছিল। চাষীরা অবশ্য বিদ্রোহ করেছিল ডাচ কোম্পানির বিরুদ্ধে।
যে মসলা বাণিজ্যের বদৌলতে দেশ-বিদেশে বণিকদের এত সমৃদ্ধি হয়েছিল, সেই মসলার উৎপাদনকারীদের হয়েছিল করুণ দশা। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ এটাই তো দুনিয়ার রীতি। যারা উৎপাদন করে, অভাব আর অনটন তো তাদেরই প্রাপ্য। আর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে দমন নীতির হিংস্র আক্রমণ তো তাদের উপরই নেমে আসে। যুগ যুগ ধরেই এমনটা চলছে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোর চাষীরা হয়তো সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল না, কিন্তু ডাচদের আগমনের পূর্বে যথেষ্ট সচ্ছল ছিল; এমনকি পর্তুগীজদের সময়েও। কিন্তু ডাচ কোম্পানির যাঁতাকলে নিজেদের জমি হারিয়ে মজুরি পেত অতি নগণ্য। কোম্পানি তাদের কাছে চালও বিক্রি করত অতি উচ্চ মূল্যে। ফলে তাদের অবস্থা দিনকে দিন দুঃসহ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।
ডাচরা কখনোই চায়নি, ইন্দোনেশিয়ার চাষীরা তাদের সচ্ছল জীবনে ফিরুক। তাদের নথিপত্র ঘাঁটলে জানা যায়, তারা সর্বদাই শঙ্কিত ছিল, পাছে চাষীরা না অতিরিক্ত ধনী হয়ে যায়। ডাচদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ইন্দোনেশিয়ার সম্পদ শোষণ করে নিজেদের ভাণ্ডার পূর্ণ করে তোলা এবং কোম্পানিকে আরো শক্তিশালী করা। এছাড়াও, চাষীদের এবং সাধারণ জনগণের সুখসমৃদ্ধির পথে যতটা সম্ভব বাধা প্রধান করা।
ডাচ বণিকরা প্রথম যখন এসেছিল, তখন তারা পর্তুগীজদের মতোই বণিকদের কাছ থেকে মসলা কিনে নিয়ে ইউরোপে চালান করে মুনাফা অর্জন করত। বাণিজ্যটা একচেটিয়া হলেও মানুষের জীবনযাপন নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাদের লোভের মাত্রা ক্রমশ বাড়ছিল। তাই এ মুনাফায় তারা সন্তুষ্ট হতে পারল না বেশিদিন। এককালের স্বাধীন চাষী পরবর্তীকালে কোম্পানির বাগিচার কুলি বা দিনমজুরে পরিণত হলো। একটা সময় পরে পুরো ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোই এক বিশাল বাগিচায় পরিণত করেছিল ডাচরা। কয়েকজন ছিল সেই বাগিচার মালিক এবং বাকি সবাই কুলি। ইতিহাসে আর কোথায় এমন আছে, যেখানে পুরো একটা দেশের সমস্ত মানুষকে কুলিতে পরিণত করা হয়েছে?
প্রথমে পর্তুগীজ, তারপর ডাচ এবং সবশেষে ইংরেজরা; মসলার খোঁজে মসলার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় এসে প্রবেশ করল। ইউরোপে মসলার ব্যাপক চাহিদা ছিল। পর্তুগীজদের হটিয়ে ডাচরা আয়ত্ত করে নিয়েছিল মসলার বাণিজ্য। এরপর তারা বিস্তার করে নিজেদের সাম্রাজ্য। ডাচদের উচ্চমূল্যের মসলা কেনা থেকে নিজেকে বিরত রেখে ইংরেজরাই নৌবহর নিয়ে হাজির হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায়। কিন্তু ডাচদের একচেটিয়ে মসলাকে করায়ত্ত করতে তারা ঠিক পেরে ওঠেনি। তাই বাধ্য হয়ে সরে আসতে হয়েছিল তাদের ভারতবর্ষে। এরপরের দু’শো বছরের ইতিহাস তো সবারই জানা।
এমনই অবাক করা সব ইতিহাসের তথ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে সত্যেন সেনের বই ‘মসলার যুদ্ধ’। ইতিহাসের তথ্যে পূর্ণ এই বইটি মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার। তবে এই ৭০ পৃষ্ঠাতেও লেখক কী দারুণ আর নিখুঁত সব তথ্য দিয়ে ঠেসে রেখেছেন। এমন কাজ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
সত্যেন সেন একাধারে একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিক। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তার পিতা বাঙালি গবেষক এবং শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেন। সত্যেন সেনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- অভিশপ্ত নগরী, পদচিহ্ন, বিদ্রোহী কৈবর্ত, আলবেরুনী, মা, অপরাজেয়, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা এবং সীমান্তসূর্য আবদুল গাফফার খান ইত্যাদি। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন।
৫০০ বছর আগে এশিয়াতে ইউরোপীয়দের আগমন থেকে শুরু করে কীভাবে তারা সাধারণ বণিক থেকে জনগণের কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হয়, সেসব গল্পই তুলে এনেছেন বইয়ের লেখক। তাদের নৃশংসতার বর্ণনাও যেমন রয়েছে; তেমনই রয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি ঘৃণা এবং তাচ্ছিল্যও। সরল মনের চাষীদের প্রতি আক্ষেপ যেমন রয়েছে; তেমনই অন্যের সম্পদে পাহাড় গড়া ইউরোপীয়দের প্রতি ক্রোধও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখায়। খুবই সহজ, সরল আর স্বাভাবিক ধারায় ইতিহাস বর্ণনা করেছেন লেখক। জটিলতাকে পরিহার করে তিনি সাবলীলতা আর প্রাঞ্জলতাকেই বেছে নিয়েছেন। তাই তো, ৭০ পৃষ্ঠার এই ইতিহাসের বইটা এক নিমেষেই পড়ে ফেলা যায়। মনে হয় যেন ঐতিহাসিক কোনো উপন্যাস পড়ছে পাঠক। একদম জীবন্ত আর প্রাণবন্ত মনে হয় দৃশ্যগুলো। ইতিহাসপ্রেমী হোক না হোক, পাঠক মাত্রই এমন তথ্যে ঠাসা বই গ্রোগ্রাসে গিলবে, সে নিশ্চয়তা থাকছে।
বই: মসলার যুদ্ধ
লেখক: সত্যেন সেন
প্রকাশনী: মুক্তধারা
মলাট মূল্য: ১২৫/- টাকা