অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান: দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ২) এর পর থেকে।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর লাভেল কমান্ড মডিউলের কন্ট্রোলে সুইগার্টের বাম পাশের আসনে গিয়ে বসলেন। তারপর সুইগার্টকে ক্যাপকমের কাছ থেকে আসা একটি নির্দেশনা কপি করতে সাহায্য করেন। এতে বলা হয়েছিল নিকটবর্তী এক ধূমকেতু বেনেটের ছবি তোলার জন্য স্পেসক্রাফটকে ডান দিকে ঘোরাতে। তাদের সামনে ছিল দুটো লাল লাইটের অ্যালার্ম, যা মহাকাশযানে গুরুতর সমস্যা দেখা গেলে জ্বলে ওঠে। এগুলোকে বলা হয় ‘মাস্টার অ্যালার্ম’। তাদের মাথার উপর কতগুলো হলুদ লাইট সাজানো ছিল, যা ছোটখাট ত্রুটির সতর্কতার সঙ্কেত দেওয়ার জন্য ছিল।
৯টা ৫ মিনিটে এগুলোর একটি লাইট জ্বলে ওঠে। একই সংকেত আসে হিউস্টনে ইইকমের কনসোলে। ইইকমের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি দায়িত্ব ছিল স্পেসক্রাফটের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। ইইকমের দায়িত্বে তখন ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী তড়িৎ প্রকৌশলী সিমো লিবারগট। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট কলেজের স্নাতক সম্পন্ন করেন। হলুদ বাতি জ্বলে ওঠা নির্দেশ করছিল সার্ভিস মডিউলে থাকা হাইড্রোজেন ট্যাঙ্কের চাপ কমে যাওয়া, যা যন্ত্রপাতি দিয়ে ঠাসা ছিল। মূল পরিচালনা ব্যবস্থার পাশাপাশি হাইড্রোজেন ট্যাঙ্কের কাজ ছিল পানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
এই উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সরল ও কার্যকর। হাইড্রোজেনের ট্যাঙ্কের অভ্যন্তরের ইউনিটের নাম ছিল জ্বালানি কোষ, যার মাঝে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া করত। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি একই সময়ে স্পেসক্রাফটের অধিকাংশ পানি উৎপাদন করত। লিবারগট এই অ্যালার্ম নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কারণ এখানে বিকল্প ব্যবস্থা ছিল। সেখানে ছিল দুটো হাইড্রোজেন ট্যাঙ্ক, দুটো অক্সিজেন ট্যাঙ্ক এবং তিনটি জ্বালানি কোষ। কোনো সঙ্কট দেখা গেলে যেকোনো ট্যাঙ্ক থেকে গ্যাস যেকোনো কোষে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
লিবারগট পুরো সময় জুড়ে ট্যাঙ্কে থাকা হাইড্রোজেনের পরিমাণ লক্ষ্য রাখছিলেন। তাই হাইড্রোজেন নিয়ে সতর্কবার্তা দেখা ছিল নিয়মিত ঘটনা। এটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থার সার্কিটগুলোর সমন্বয় করছিল। ফলে অক্সিজেন সরবরাহে সমস্যা থাকলেও হলুদ অ্যালার্ম দেখাত না। ঠিক তথ্য পেয়েছেন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য লিবারগট ফ্লাইট ডিরেক্টর ইউজিন ক্র্যাঞ্জের কাছে অনুমতি নিচ্ছিলেন নভোচারীদেরকে দুই ট্যাঙ্কের হাইড্রোজেন নাড়ানোর কথা বলার জন্য। ক্র্যাঞ্জ তার মাত্র চার ফুট দূরত্বে থাকার পরও তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লুপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হচ্ছিল।
৩৬ বছর বয়সী ক্র্যাঞ্জ সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন। তিনি ১৯৬০ সাল থেকে নাসায় কাজ করছিলেন। ফ্লাইট ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করার সময় তাকে কন্ট্রোল রুমের সবকিছু তার অধীনে ছিল। তাই মহাকাশযানে তথ্য পাঠানোর আগে তার অনুমতির প্রয়োজন ছিল। এছাড়া মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান হিসাবে কন্ট্রোনালাররাও তার অধীনে ছিলেন। এদিকে সারাদিন কমান্ড মডিউলে সুইগার্ট ২ নং অক্সিজেন ট্যাঙ্কের সঠিক পরিমাণ দেখতে পারছিলেন না দেখে লিবারগট এবার হাইড্রোজেন ট্যাঙ্কের পাশাপাশি অক্সিজেন ট্যাঙ্কেও নাড়াতে বলেন।
লিবারগট যদি দুই অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ভেতরের অবস্থা দেখতে পারতেন, তাহলে এগুলো নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করার ঝুঁকি নিতেন না। ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যের সার্ভিস মডিউলে ছয়টি কম্পার্টমেন্ট ছিল। এর একটি কম্পার্টমেন্ট ছিল বে ফোর। বে ফোরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যান্য অংশের সাথে ছিল অক্সিজেনের ট্যাঙ্কগুলো। বে ফোরের অভ্যন্তর অংশগুলো ছিল কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত। এখানে ছিল রূপালী রঙের নিরোধক আর সোনালী রঙের কিছু তার।
তিন জ্বালানি কোষ ছিল সবার সামনে। সবার পেছনে ছিল দুই হাইড্রোজেন ট্যাংক। মাঝখানে ছিল অক্সিজেনের ট্যাংকগুলো। অক্সিজেন ট্যাংক দুটি ছিল নিকেল-ইস্পাতের মিশ্রণে তৈরি ২৬ ইঞ্চি ব্যাসের রূপালী রঙের মজবুত গোলক। এগুলো প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৯০০ পাউন্ড অক্সিজেন ধরে রাখতে সক্ষম ছিল। অক্সিজেন ট্যাংকের ছিল একটি বহিঃআবরণ ও একটি অন্তঃআবরণ। আবরণগুলোর মাঝখানের জায়গাতে ছিল অন্তরক। প্রতি ট্যাঙ্কের চূড়ায় ছিল একটি গম্বুজ, যা ট্যাঙ্কের ভেতরে থাকা যন্ত্রপাতির তার ও নলের ছিদ্র ঘুরে রাখত। তারগুলো ট্যাঙ্কের ভেতরে থাকা পাখা, হিটার ও সেন্সরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। এই যন্ত্রপাতিগুলোর মাধ্যমে অক্সিজেনের পরিমাণ, তাপমাত্রা ও চাপ পরিমাপ করা যেত।
লিবারগট যদি অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ভেতরে দেখতে পারতেন, তাহলে দেখতেন ২ নাম্বার ট্যাঙ্কের বেশিরভাগ তারেরই নিরোধক নেই। এই অবস্থার পেছনে দায়ী ছিল নকশার ত্রুটি ও ক্রুদের অযত্ন। এটা মার্চ মাসে এক ক্রু কাউন্টডাউন প্রদর্শনীর পরীক্ষার সময় ট্যাঙ্কে অক্সিজেন পূর্ণ করার সময় থেকেই ছিল। অর্থাৎ দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এই সমস্যা ছিল। অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন ছিল ক্রায়োজেনিক। অর্থাৎ তাদেরকে নিম্ন তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় রাখা হতো আয়তন কম রাখার জন্য, যেন ক্ষুদ্র স্থানে জমা রাখা যায়। ট্যাঙ্কে অক্সিজেন ভরার সময় তাপমাত্রা ছিল -২৯৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। নিরীক্ষা করার পর প্রকৌশলীরা দুই নাম্বার ট্যাঙ্ক থেকে অক্সিজেন বের করতে ব্যর্থ হন।
এই সমস্যার কারণ ছিল সম্ভবত ট্যাঙ্কের উপরের থাকা গম্বুজের আবরণী ঝাঁকুনি বা ধাক্কার কারণে কিছুটা সরে যাওয়াতে ভেতরে থাকা নল ও তারগুলো আলগা হয়ে যাওয়া। এ কারণেই সম্ভবত লিবারগট ট্যাঙ্কের অক্সিজেনের পরিমাণ দেখতে পারছিলেন না। যেকোনো ঘটনার ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড ক্রুরা ট্যাঙ্কের ভেতরে থাকা পাখা ও হিটার দিয়ে অক্সিজেন নাড়িয়ে বের করে আনার চেষ্টা করত। পাখার মাধ্যমে অক্সিজেন নাড়ানো হতো এবং হিটার দিয়ে অক্সিজেন গরম করা হতো একে বিস্তৃত করার জন্য।
মহাকাশযানে থাকা ট্যাঙ্কে তখন আট ঘণ্টা ধরে হিটার চালু ছিল, যা এর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় টানা বেশি সময় ছিল। ফলে ট্যাঙ্কের ভেতরের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। তখন কেউই এটা নিয়ে সতর্ক ছিলেন না। গ্রাউন্ড ক্রুরা চিন্তিত ছিলেন না, কারণ তারা জানতেন ট্যাঙ্কের ভেতরে একটা থার্মোস্ট্যাটিক সেফটি সুইচ আছে। তাপমাত্রার নিরাপদ সীমা ৮০ ডিগ্রির বেশি হলে এটা হিটার বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিল। যন্ত্রের প্রকৌশলীরা এটা নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কারণ তারা ট্যাঙ্কের ভেতরে একটা থার্মোমিটার রাখার পরও কখনো ৮৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা প্রদর্শন করেনি।
ডিজাইনাররা যে বিষয়টা উপেক্ষা করেছিলেন সেটা হচ্ছে, এই সুইচটি তারা বিশেষভাবে তৈরি করেছিলেন মহাকাশযানের ২৮ ভোল্ট বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য। কিন্তু কেপ কেনেডিতে ট্যাঙ্কগুলো পরীক্ষা করা হয় ৬৫ ভোল্ট বিদ্যুতে। ফলে দুই নং ট্যাঙ্কের সেফটি সুইচ নষ্ট হয়ে যায়। ডিজাইনাররা এটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তারা মনে করেছিলেন অত্যাধিক ঠাণ্ডা অক্সিজেন সুইচটির তাপমাত্রা বাড়তে দেবে না।
পরবর্তীতে এরকম অন্য একটি যন্ত্রের পরীক্ষা করার সময় একইরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে এই ত্রুটি ধরা পড়ে। সুইচটি নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে ফিউজ হয়ে গিয়েছিল এবং হিটারটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। দায়িত্বে থাকা যে কেউ যদি যন্ত্রপাতিগুলোতে থাকা হিসাবগুলো খেয়াল রাখতেন, তাহলে উপলব্ধি করতে পারতেন হিটারগুলো বন্ধ হয়ে যাবার কথা থাকলেও সেখানে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কেউই সেটা লক্ষ্য করেননি। এতে তাপমাত্রা হাজার ডিগ্রির উপরে উঠে যেতে পারত, যার কারণে তারের নিরোধকগুলো পুড়ে যেত। এরপর ট্যাঙ্কের ভেতর থাকা বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলো চালু করলে কাছাকাছি তারগুলোর মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হতে পারত।
লিবারগট যখন ক্রায়োজেনিক আলোড়নের বার্তা দেওয়ার অনুমতি চান, তখন ফ্লাইট ডিরেক্টর ক্রাঞ্জ কিছু সময়ের জন্য বার্তা পাঠানো বন্ধ রাখতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন টিভি শো শেষ করার পর নভোচারীদের একটু বিশ্রাম দিতে। ক্রাঞ্জ ছিলেন লম্বা-চড়া মানুষ। তার চুল এত ছোট করে ছাঁটা ছিল যে কোনো কোনো দিক থেকে তাকালে চুল দেখাই যেত না। তাকে প্রায়ই রুক্ষ মেজাজের একজন মেরিন কর্পস ইউনিট কমান্ডার বলা হতো। তার ফ্লাইট কন্ট্রোলার গ্রুপ হোয়াইট টিমের সম্মানে তিনি একটি সাদা ভেস্ট পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে ফ্লাইট কন্ট্রোলের দায়িত্ব তুলে দেওয়ার কথা ছিল ব্ল্যাক টিমের কাছে। ব্ল্যাক টিমের কন্ট্রোলাররা ইতোমধ্যে চলে আসা শুরু করেছিলেন।
হাইস কমান্ড মডিউলে না আসা পর্যন্ত ক্রাঞ্জ লিবারগটের অনুরোধ রক্ষা করতে বিলম্ব করছিলেন। হাইস এসেছেন কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ক্রাঞ্জ লুনার মডিউলের ডেটা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা টেলমুকে জিজ্ঞেস করেন লুনার মডিউলের হ্যাচ তখনো খোলা ছিল কী না। টেলমু তখন কমান্ড মডিউলের বৈদ্যুতিক ক্ষমতার পরিমাপ পর্যবেক্ষণ করেন। এখান থেকে লুনার মডিউল এর জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছিল। প্রত্যেক ফ্লাইট কন্ট্রোলারের সামনে থাকা কম্বিনেশন বাটনগুলোর মাধ্যমে টেলিভিশন স্ক্রিনে ২৫০টি চার্টের যেকোনো একটির ডেটা দেখার ব্যবস্থা ছিল। এই ডেটাগুলো সরবরাহ করা হতো গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা অপারেশন উইংয়ের কম্পিউটার থেকে, যেখানে টেলিমেট্রি গ্রহণ করা হতো।
তখন বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ কিছুটা কম দেখাচ্ছিল। ফলে তখন টেলমু অনুমান করেন লুনার মডিউলের হ্যাচ বন্ধ করা হয়েছে এবং হাইস কমান্ড মডিউলে চলে এসেছেন। তখন ক্রাঞ্জ ক্যাপকমকে নির্দেশ দেন কমান্ড মডিউলের পাইলট সুইগার্টকে অক্সিজেন ট্যাঙ্কে নাড়ানোর জন্য। সুইগার্ট তখন কমান্ড মডিউলের চূড়ার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন হাইস ছোট টানেল দিয়ে ফিরে আসছেন। তিনি ততটুকুই দেখতে পারছিলেন। কারণ তিনি পাঁচশরও বেশি ডায়াল, বাটন, নব, সুইচ ও থাম্বহুইল দিয়ে ঘেরা ছিলেন। এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ইংরেজি ইউ আকৃতির ছোট উইকেট দিয়ে ঘেরা, যেন নভোচারীরা হঠাৎ করে অসাবধানতাবসত চাপ না দেন। সুইগার্টের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল খুব সাবধানী। নতুন ক্রু সদস্য হিসাবে তিনি অনুমিতভাবেই খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি লিবারগটের বার্তা পাওয়ার পর তার ডানে থাকা চারটি সুইচে টিপ দেন। কন্ট্রোল রুমে থাকা লিবারগট তখন সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন, যেন তার কনসোলের স্ক্রিনে থাকা ট্যাঙ্কের ভেতরে থাকা পদার্থের পরিমাণ, চাপ, তাপমাত্রা দেখতে পারেন।
প্রথম ১৬ সেকেন্ড তেমন কিছুই হলো না। তখন ২ নাম্বার অক্সিজেন ট্যাঙ্কের অভ্যন্তরে দুটি অনাবৃত তারের মধ্যে বিদ্যুতের আর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তী ২৪ সেকেন্ডে এই আর্ক অক্সিজেনকে উত্তপ্ত করে এবং এর চাপ খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। হাইড্রোজেনের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া থাকায় কোনো সতর্ক বাতি জ্বলে ওঠেনি। লিবারগটও তার সামনে থাকা টেলিভিশন স্ক্রিনের ডানদিকে শুধু হাইড্রোজেনের পরিমাণই লক্ষ্য রাখছিলেন। এদিকে হাইড্রোজেনের তথ্যগুলোর তিন ইঞ্চি বামে থাকা অক্সিজেনের চাপের কলাম যে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেটা তিনি খেয়াল করেননি। এই সময়ে অক্সিজেন ট্যাঙ্কের চাপ বেড়েই চলছিল। কন্ট্রোল রুমে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ‘গাইডো’ উইলিয়াম ফ্যানারই শুধু লক্ষ করেছিলেন কিছু একটা ঠিক নেই। তার ভাষ্যমতে কনসোলে থাকা ‘ইভেন্ট’ এর নাম্বার অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। এটা ‘হার্ডওয়্যার রিস্টার্ট’ সিগন্যাল দিচ্ছিল। এর দ্বারা বোঝাচ্ছিল মহাকাশযানের কম্পিউটার একটা সমস্যা খুঁজে পেয়েছে এবং সাম্প্রতিক কার্যক্রম দেখে যাচাই করতে চাচ্ছে কী সেটা। এটা কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং এই রিস্টার্ট সিগন্যাল পরবর্তীতে ক্রাঞ্জকে ভুল সূত্রের পেছনে ধাবিত করে।
রেকর্ড করা ডেটা, নভোচারীদের নিয়ে আসা আলামত আর মিশন পরবর্তী বিস্তৃত বিশ্লেষণ থেকে ওই দুই মিনিটের ঘটনাকে অনেকটাই নিম্নরূপে বলা যায়। চব্বিশ সেকেন্ডের পর অক্সিজেনের চাপের কারণে ট্যাঙ্কের উপরে থাকা গম্বুজটি উড়ে যায়। বাইরের ও ভেতরের আবরণীর মাঝে থাকা অন্তরণের স্তরে নিঃসন্দেহে আগুন ধরে যায় এবং সার্ভিস মডিউলের বে-৪ এর অভ্যন্তরে পুরো অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বে’র অভ্যন্তরে থাকা মাইলার অন্তরণের রূপালী স্তরগুলোতেই সম্ভবত আগুন ধরেছিল। ফলে বে’র আবরণী দিয়ে গ্যাস বের হতে থাকে। এটি ছিল সার্ভিস প্যানেলের বাইরের আবরণীর ছয়টা প্যানেলের একটা। প্যানেল আগুনে পুড়ে যাওয়া একদিকে ভালোই হয়েছিল। কারণ তা না হলে চাপ বাড়তে থাকলে সার্ভিস মডিউলের সামনে থাকা কমান্ড মডিউলই পুড়ে যেত। পরবর্তীতে নাসার প্রকৌশলীরা ‘বিস্ফারণ’ শব্দটা এড়িয়ে যান। তারা তুলনামূলক কম নাটকীয় পরিভাষা ‘ট্যাঙ্ক বিপর্যয়’ বাছাই করেন। তাদের মতে এটাই ছিল গ্রহণযোগ্য শব্দচয়ন। কারণ ট্যাঙ্ক চাপে ভেঙে পড়লেও বোমার মতো বিস্ফারিত হয়নি।
বিস্ফোরণ বা ট্যাঙ্ক ব্যর্থতা যা-ই বলা হোক না কেন, মহাকাশে এটা পৃথিবীর মতো বোঝার উপায় ছিল না। কারণ পৃথিবীতে বাতাসের মাধ্যমে শব্দ ও শক ওয়েভ প্রবাহিত হয়। ফলে কোনো নভোচারীই জানতেন না অক্সিজেন ট্যাঙ্কে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তারপরও তারা প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে টের পেয়েছিলেন যে, একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে চলছে। প্রথমে সুইগার্ট রেডিওর মাধ্যমে জানান তাদের কাছে মনে হচ্ছে মহাকাশযানে কোনো সমস্যা হয়েছে। তার কণ্ঠ এতটাই শান্ত ছিল যে, ক্যাপকম জ্যাক আর লাউজমা বুঝতে পারছিলেন না কোন নভোচারী কথা বলছিলেন। লাউজমা নভোচারীদের ভালো করেই চিনতেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন নভোচারী।
সুইগার্ট পরবর্তী সময়ে এটা নিয়ে বলেন, মহাকাশযানে তখন একটা কাঁপুনি দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সে অনুপাতে কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন না তিনি। এটা তাকে চিন্তিত করে তুলছিল। তিনি আরো বলেন, শব্দ আর কাঁপুনির মধ্যে পার্থক্য করতে পারছিলেন না। কারণ দুটোই যখন তীব্র পর্যায়ে হয় তখন আলাদা করে উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে। টাইটানিক জাহাজ যখন আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খায়, তখন এর যাত্রীরা যেমন বিরক্তিকর কাঁপুনি অনুভব করছিলেন, সুইগার্টের অনুভূতিটাও সেরকমই ছিল।
সুইগার্ট সিটের সাথে দৃঢ়ভাবে বসা ছিলেন, তাই তিনি স্পেসক্রাফট কমান্ডার লাভেলের চেয়ে কাঁপুনিটা ভালো টের পেয়েছিলেন। লাভেল তার সিটের উপরে ভাসছিলেন। তিনি কোনো কাঁপুনি টের পাননি, তবে একটা ঠুং ঠাং শব্দ শুনেছিলেন। লাভেল মনে করেছিলেন, শব্দটা এসেছে হাইস লুনার মডিউলের ভালভ খোলার কারণে। ৩৬ বছর বয়সী হাইস তখনও ছিলেন অদম্য তারুণ্যে ভরপুর, যিনি কোনো সতর্কতা না দিয়ে বিকট শব্দ করতে পারেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে টানেল থেকে বের হয়ে আসা হাইসের চেহারা দেখেই লাভেল বুঝতে পেরেছিলেন তিনিও ঝাঁকুনি টের পেয়েছেন। কোনো আওয়াজ তৈরি করা তো দূরের কথা, হাইস টানেলের উপর-নিচে ঝাঁকুনি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। সাধারণত টানেলের ঝাঁকুনিগুলো হয়ে থাকে পাশাপাশি। ঝাঁকুনির এই গতি তার কাছে অশুভ মনে হলো। তিনি ওই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছিলেন কোনো মূল বিষয়ে সমস্যা হয়েছে।
লাভেল ও সুইগার্ট উভয়ই ধারণা করেছিলেন, এই শব্দ বা ঝাঁকুনি এসেছে লুনার মডিউল থেকে। হাইস টানেল থেকে বের হয়ে আসার পর সুইগার্ট তার সিট থেকে উঠে কমান্ড মডিউলের হ্যাচ বন্ধ করে দেন। হাইসের ইয়ারফোনে তখন মাস্টার অ্যালার্ম বাজতে থাকায় দ্রুত ডান পাশের আসনটাতে বসে পড়েন। সুইগার্ট দেখতে পেলেন তার মাথার উপর সতর্কতামূলক হলুদ বাতি জ্বলছে। এটা অক্সিজেন ট্যাঙ্কের সমস্যা নিয়ে সতর্ক বার্তা দিচ্ছিল না, কারণ সেটা তখনো হাইড্রোজেন ট্যাঙ্কের নিম্ন চাপের সতর্কতার সাথে সংযুক্ত ছিল। বরং এটা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে জানান দিচ্ছিল, যার কন্ট্রোল ছিল হাইসের পাশে। এই সময়ে ফ্লাইট সার্জন ডা. উইলার্ড আর হকিন্স খেয়াল করলেন তিন নভোচারীরই পালস প্রতি মিনিটে ৭০ থেকে ১৩০ হয়ে গেছে!
এরপর দেখুন- অ্যাপোলো-১৩ চন্দ্রাভিযান : দুর্ঘটনা মোকাবেলার গল্প (পর্ব ৪)