প্রথম পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: কোম্পানি শাসন (পর্ব-১)
১৮৫৭ সাল। পলাশীর ঠিক ১০০ বছর পর, মার্চ মাসের এক সন্ধ্যায় ব্যারাকপুরের শিবিরে ৩৪নং বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির এক সৈনিকের হাতের মাস্কেট হঠাৎ গর্জে উঠল। অ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট বাফের অর্ধোচ্চারিত হুঁশিয়ারি স্তব্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ এর প্রত্যুত্তর দিতে সময় নেয়নি, এক সপ্তাহের মধ্যেই মঙ্গল পান্ডের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। তারপর সবকিছুই নিস্তদ্ধ, কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি এটি ঝড়ের আগের শান্ত অবস্থা। ভারতব্যাপী রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের সঙ্কেতরূপী যে স্ফুলিঙ্গ উৎক্ষিপ্ত হলো, এক বছরের মধ্যেই তার চূড়ান্ত অবস্থা দেখা গেল। যদিও ইংরেজরা তাদের দেশীয় সাগরেদদের নিয়ে এই বিদ্রোহ দমিয়ে দিল কয়েক মাসের ব্যবধানেই।
সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল মূলত বেঙ্গল আর্মির সেপাইরা, এছাড়া বোম্বে আর্মির হাতেগোণা কিছু রেজিমেন্ট অংশ নিলেও মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ছিল একেবারে চুপ। বিদ্রোহের পর বেঙ্গল বাহিনীর ৭৪টি ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের মধ্যে মাত্র ১২টি রেজিমেন্ট শেষমেশ ইংরেজদের কব্জায় ছিল, এছাড়া লাইট ক্যাভালরি বা সওয়ার বাহিনীর ১০টি রেজিমেন্টের সবগুলোই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। বেঙ্গল বাহিনীর বিদ্রোহের এই কারণ খুঁজতে গেলে চোখ ফেরাতে হবে এই বাহিনীর সদস্যদের দিকে।
বেঙ্গল বাহিনীর অধিকাংশই ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু কিংবা প্রভাবশালী মুসলমানরা, বিশেষ করে বিহার ও আউধের ব্রাহ্মণ ও রাজপুতরা ছিল অধিক সংখ্যক। যেখানে মাদ্রাজ বা বোম্বে আর্মির সৈন্যরা ছিল নিচুবর্ণের অথবা জাত-পাত বিবেচনা না করা সেপাইরা, সেখানে বেঙ্গল আর্মির রেজিমেন্টের সৈন্যরা খুব সতর্কভাবে তাদের ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলতেন। এছাড়াও উঁচু জাতের হওয়ায় তাদের মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা ও হারিয়ে যাওয়া গৌরব-সম্মান ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও কম ছিল না। ছুটির অভাব কিংবা কম মাইনে পাওয়ার সমস্যা তো ছিলই, এছাড়াও ধর্মীয় কারণে কালাপানি পার হতে অস্বীকৃতি, জাহাজে আলাদা রান্না করে খাওয়ার অসুবিধা নিয়ে এমনিতেই বেঙ্গল বাহিনীর সেপাইরা একটু চটে ছিলেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদের মতে, এর সাথে যুক্ত হয়েছিল এনফিল্ড রাইফেলের গরু আর শূকরের চর্বি মেশানো টোটা। তবে ইতিহাসবিদরা যা-ই বলুক, কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে হঠাৎ বারুদের আগুন ধরে যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ও দেশীয় সৈনিকদের বৈষম্যের সাথে সাথে ধর্মীয় কারণ ও জাতীয় চেতনা মিলেমিশে একাকার হয়ে এই সেপাই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের মতে, বেঙ্গল বাহিনীতে এত বেশি সংখ্যাক ‘পুরবিয়া’ (বিহার ও উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণ ও রাজপুত) ভর্তি করা ছিল অদূরদর্শিতার কাজ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই পুরবিয়াদেরকে দমাতেই তাই দলে দলে শিখরা ভর্তি হয়েছিল ইংরেজ বাহিনীতে, কারণ তাদের মতে, তারা তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছিল এই পুরবিয়াদের হাতেই। পুরবিয়ারা সহযোগিতা না করলে ইংরেজরা তাদের খালসাকে পদানত করতে পারতো না। তাছাড়া মুঘলরা ছিল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তা-ই মুঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা সেপাইরা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। শিখদের ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার আরও একটি কারণ হিসেবে ধরা হয় উত্তর ভারতের অঢেল সম্পদ। সেপাই বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে লুটপাট চালানো শিখরা পাঞ্জাবে ফিরে গিয়েছিল মুঠোভরা সম্পদ নিয়ে, এ গল্প আজও প্রচলিত।
যা-ই হোক, বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষে রাজনৈতিক পরিবর্তন অবধারিত হয়ে দাঁড়ায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীর্ঘ ১০০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে, এবং তার কয়েক বছর পরেই, ১৮৭৪ সালে একসময়ের পরাক্রমশালী কোম্পানি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয় ফৌজ আর কোম্পানির ফৌজ না হয়ে ব্রিটেনের সরকারি ফৌজে পরিণত হয়। ভারতীয় ফৌজকে আমূল সংস্কার করার পরিকল্পনাও গৃহীত হয়। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শিক্ষা নিয়েই পুনরায় যেন এরকম কোনো ঘটনা সংঘটিত না হয়, সে ব্যবস্থা নেয় ইংরেজরা।
প্রথমত, উঁচু জাতের পুরবিয়াদেরকে যতদূর সম্ভব ফৌজে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; দ্বিতীয়ত, সব সম্প্রদায় বা শ্রেণি থেকে সৈন্য নিয়ে বিশেষ কিছু শ্রেণি, যাদেরকে সামরিক জাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের থেকে সৈন্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; তৃতীয়ত; জাত হিসেবে কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন গঠন করে একটি মিশ্রিত বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাকে প্রতিষেধক তত্ত্ব বলা হয় এবং চতুর্থত, সিপাহী বিদ্রোহের সময় দেশীয় রাজাদের ইংরেজদের প্রতি বিশ্বস্ততা ও ইরেগুলার বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা তাদেরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে ইংরেজ কর্তৃপক্ষকে।
সামরিক জাত ও প্রতিষেধক তত্ত্ব
সিপাহী বিদ্রোহের পর সতর্ক হয়ে যাওয়া ইংরেজ সরকার ভারতীয় বাহিনীতে লোক সংগ্রহের জন্য নতুন এক কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করে। ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল, প্রদেশ ও জাত থেকে সৈন্য সংগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়, যার বিশেষ ভুক্তভোগী হয় পুরবিয়ারা। সেপাই বিদ্রোহের সময় কোনো জাতির ইংরেজদের পক্ষ নেওয়ার হার, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু যাচাই-বাছাই করে এক বিশেষ ‘সামরিক’ জাত তত্ত্ব প্রবর্তন করে তারা। আপাতদৃষ্টিতে, যে জাতি যত বেশি যুদ্ধবাজ, তাদেরকে ফৌজে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে মনে হলেও বাস্তবে ইংরেজরা চেয়েছিল তাদের অনুগত এক বাহিনী। তবে শুধু সেই সামরিক জাতির অন্তর্ভুক্ত হলেই হবে না, সেই জাতির গ্রাম্য কৃষক পরিবার হতে হবে, শিক্ষিত শহুরে হওয়া চলবে না।
এই সামরিক জাতের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে শিখরা। সেপাই বিদ্রোহের সময় বেঙ্গল আর্মির পুরবিয়াদের শূন্যস্থান পূরণ করতে এই শিখ আর ব্যাপক পরিমাণ পাঞ্জাবি মুসলমানদেরকে নেওয়া হয় ফৌজে। এছাড়াও ডোগরা, পাঠান, বেলুচি, জাঠ, গাড়োয়ালি, মারাঠি, কর্ণাটি এবং বিশেষ কিছু অঞ্চলের রাজপুত ও ব্রাহ্মণকে সামরিক জাত হিসেবে ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। মূলত ফৌজের জন্য মানুষ সংগ্রহ নয়, একদল অনুগত লড়িয়ে জীব প্রয়োজন ছিল ইংরেজদের এবং সে কাজে তারা সফলও হয়েছিল।
বিদ্রোহের পর ভারতীয় বাহিনীকে নতুন করে গঠনের নীতি প্রস্তুত করার জন্য যে রয়্যাল কমিশন (১৮৫৮) নিয়োগ করা হয়, তার একটি সুপারিশ হলো: ‘The native Indian Army should be composed of different nationalities and castes, and, as a rule, mixed promiscuously through each regiment.’ অর্থাৎ, দেশীয় ভারতীয় বাহিনীকে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও জাতের লোক দ্বারা গঠন করতে হবে এবং প্রত্যেকটি রেজিমেন্টে এই জাতির লোকদেরকে এমনভাবে মিশিয়ে রাখতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে কোনো সংহতি তৈরি না হতে পারে। এর মাধ্যমেই উৎপত্তি হয় প্রতিষেধক তত্ত্বের।
ঐ রয়্যাল কমিশনেরই আরেকটি সুপারিশ ছিলো: ‘Next to the grand counterpoise of a sufficient European force, comes to the counterpoise of natives against natives. (ভারতীয় ফৌজ যাতে বিদ্রোহী না হয় এজন্য তাদের প্রতিষেধক হিসেবে গোরা বা ইংরেজ বাহিনী রাখা হয়েছে, উপরন্তু এক জাতের ফৌজের প্রতিষেধক হিসেবে রয়েছে আরেক জাতের ফৌজ।)’
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে একই জাতের লোক নেওয়া হতো, এবং সেই কোম্পানির প্রতিষেধক হিসেবে আরেকটি কোম্পানির সবাই অন্য জাতের হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: একটি শিখ কোম্পানির বিপরীতে একটি পাঠান কোম্পানি কিংবা একটি রাজপুত কোম্পানির প্রতিষেধক হিসেবে আরেকটি বেলুচি কোম্পানি; এভাবে পুরো রেজিমেন্টে সব ধরনের জাতের লোকজন নিয়ে গড়ে উঠতো। এর ব্যতিক্রম দেখা যায় কেবল কিছু শিখ ও গুর্খা রেজিমেন্টে, এসকল রেজিমেন্টের সবাই ছিল একই জাতের। বলাই বাহুল্য, শিখ ও গুর্খারা তাদের ইংরেজপ্রীতির প্রমাণ দিয়েই ইংরেজদের এই বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিল।
ইংরেজদের সামরিক জাতিবাদ কিংবা এই প্রতিষেধক তত্ত্বের মূলে ছিল জাতীয়তাবোধহীন মানুষ সংগ্রহ। ফৌজের জন্য কৃষক সমাজ থেকে লোক সংগ্রহ করার নীতির মধ্যেও এই মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। যত বেশি অশিক্ষিত, ফৌজের পক্ষে তত বেশি উপযোগী – বাহিনীর লোক সংগ্রহের ব্যাপারে ইংরেজদের এই নীতি বহুদিন অপরিবর্তিত ছিল। তাই পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ভারতের অনেক অঞ্চলে ইংরেজরা শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনা নেয়নি স্রেফ সেখান থেকে অশিক্ষিত সৈন্য সংগ্রহ করার জন্য। মাদ্রাজি হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটায় পরবর্তীতে সেখান থেকেও সৈন্য নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয় ব্রিটিশরা।
বিদ্রোহ পরবর্তী লী কমিশন (১৮৫৯)-এর সুপারিশ অনুযায়ী আরও একটি নীতি গৃহীত হয় ভারতীয় ফৌজে, আর সেটি হলো ‘৩:১ অনুপাত’ নীতি। এই নীতি অনুযায়ী, ফৌজে দেশীয় সৈন্যের সংখ্যা কখনোই ইউরোপীয় সৈন্যের ৩ গুণের বেশি হতে পারবে না; এবং এই নীতি ২য় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত মেনে চলা হয়েছে, হোক সেটি শান্তিকালীন কিংবা যুদ্ধকালীন সময়। বাহিনীতে সৈন্যের পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন হলে সেই অনুযায়ী ইউরোপীয় ও দেশীয়, উভয়েরই পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে সমানুপাতে, কম-বেশি নয়। এবং বাস্তবেই দেখা যায়, প্রতিটি ভারতীয় দেশীয় ব্রিগেডের মধ্যে একটি করে ইংরেজ দল ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। ইংরেজদের মত ছিল, ভারতীয় ফৌজের রণদক্ষতা বাড়ানোর জন্যই একটি দক্ষ ইংরেজ দলকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু কী কারণে নেওয়া হতো, তা ইংরেজদের মনোভাব লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হয়।
তৃতীয় পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: দ্য রয়্যাল ইম্পেরিয়াল আর্মি (পর্ব-৩)