১৯১১ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো বোমা হামলার উদ্দেশ্যে বিমানের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর প্রথমদিকে এটি ছিল প্রায় অপরাজেয় যুদ্ধযান। তারপর এর মোকাবেলায় এলো এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিনগান, ক্ষিপ্রগতির যুদ্ধবিমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলো রাডার প্রযুক্তি, কিছুদিন পরেই এলো এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল। এরপর বোমারু বিমান নিয়ে শত্রুদেশের হামলা তো দূরের কথা, আকাশসীমায় প্রবেশের আগেই সতর্ক করে দেয়ার জন্য বর্তমানে প্রায় সব দেশের কাছে রয়েছে আধুনিক রাডার।
কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, যেকোনো আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের মোকাবেলায় পাল্টা অস্ত্র বানানো হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাডার নজরদারি ফাঁকি দেয়ার জন্য এসেছে স্টেলথ (Stealth) যুদ্ধবিমান। এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এই শ্রেণীর বিমান রাডারকে ফাঁকি দেয় সেটি নিয়েই আজকের আয়োজন।
রাডার কীভাবে কাজ করে?
প্রথমেই আপনাকে রাডার কীভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা নিতে হবে। তাহলে স্টেলথ বিমান কীভাবে রাডার ফাঁকি দেয় সে বিষয়টি সহজে বুঝতে পারবেন।
RADAR এর পূর্ণরূপ RAdio Detection And Ranging। এই প্রযুক্তি দুভাবে কাজ করে। অ্যাক্টিভ হোমিং মোডে বিশাল এন্টেনার সাহায্যে রেডিও তরঙ্গ আকাশে ছুড়ে মারা হয়, সেটি বিমানের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। ফিরতি তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে রাডার স্টেশন থেকে বিমানের দূরত্ব, উচ্চতা, এমনকি আকারও বলে দেয়া সম্ভব। বেশিরভাগ দেশের হাতেই এই শ্রেণীর রাডার রয়েছে।
অপরদিকে প্যাসিভ হোমিং মোডে বিমান থেকে নির্গত তরঙ্গ (যেমন- বিমানের রাডার) ও অন্যান্য সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে এর অবস্থান, উচ্চতা নির্ণয় করা হয়। সাধারণ যেকোনো এয়ারক্রাফট অড়ার সময় রাডারের ছায়া (shadow) অঞ্চলে থাকলে সেটি রাডারে ধরা পড়ে না বিধায় সেটি সাময়িক সময়ের জন্য স্টেলথ। যেমন- পাহাড়ের আড়ালে বা সমুদ্রের পানি ঘেঁষে বিমান উড়লে সেটি রাডারে দেখা যায় না। স্টেলথ যুদ্ধবিমান যেকোনো উচ্চতায় নির্দিষ্ট রেঞ্জ পর্যন্ত অ্যাক্টিভ হোমিংকে ফাঁকি দিতে পারে, কিন্তু প্যাসিভ হোমিংকে পুরোপুরি ফাঁকি দিতে পারে না। এসব বিমানের বিশেষ ডিজাইনের কারণে রাডার তরঙ্গ বিমানে ধাক্কা খেয়ে অন্যদিকে চলে যায়। এছাড়া বিমানের পুরো বডিতে বিশেষ ধরনের রাসায়নিক উপাদানের প্রলেপ থাকে যা রেডিও তরঙ্গ শুষে নেয়। ফলে রাডারে বিমানটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
এছাড়া ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ারের মাধ্যমে রাডারকে ভুয়া টার্গেট দেখিয়ে নিজেকে আড়াল করে স্টেলথ হওয়া যায়। রাডার হচ্ছে এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইলের চোখস্বরূপ। এটি যদি শত্রুবিমান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয় তবে অত্যাধুনিক মিসাইলও কোনো কাজেই আসবে না। এজন্য সামরিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলো আরো আধুনিক রাডার বানানোর জন্য ব্যাপক হারে অর্থ বিনিয়োগ করছে।
তাহলে কি স্টেলথ বিমান রাডারে শনাক্ত করা অসম্ভব?
অনেক সময় খবরে দেখবেন যে বলা হচ্ছে অমুক রাষ্ট্র স্টেলথ বিমান বানিয়েছে, তমুক রাষ্ট্র স্টেলথ শনাক্তকারী রাডার বানিয়েছে। এটি আসলে প্রোপাগান্ডামূলক কথাবার্তা। কারণ ‘স্টেলথ’ এর পুরো বিষয়টি একটি আপেক্ষিক বিষয়। এটি সহজে বোঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
মনে করুন, আপনি-আমি একটি পাখিকে ২০ মিটার দূর থেকে নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পারি। অতঃপর আপনি দোকান থেকে দূরবীন কিনলেন। এখন আপনি পাখিটি ৪০ মিটার দূর থেকে দেখতে পারেন, আমার খালি চোখের রেঞ্জ আগের মতোই ২০ মিটার। তাহলে পাখিটি আপনার সাপেক্ষে যতটা স্টেলথ, আমার সাপেক্ষে তার চেয়ে বেশি স্টেলথ। অর্থাৎ আপনার চোখে পাখিটি যত দ্রুত ধরা পড়বে, আমার চোখে তার চেয়ে দেরিতে ধরা পড়বে। এবার পাখিকে বিমান এবং চোখকে রাডার হিসেবে কল্পনা করুন। একটি রাডারের রেঞ্জে থাকা অবস্থায় একটি বিমান যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে সেটাই হলো স্টেলথ। অর্থাৎ ‘More Stealth, Less Detectable‘।
এখন কোনো রাডারের ‘রেঞ্জের ভেতর’ কত কিলোমিটার পর্যন্ত ‘Undetected‘ অর্থাৎ ধরা না পড়ে থাকবে সেটি বিমান ও রাডার ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন- পাখিটি আপনার অনেক কাছে চলে আসার পর সেটি দেখার জন্য আপনার আর দূরবীন প্রয়োজন হবে না। একইভাবে স্টেলথ যুদ্ধবিমান শত্রু রাডারের রেঞ্জের যত ভেতরে ঢুকবে, ততই তার স্টেলথ ক্ষমতা হ্রাস পাবে এবং একসময় বিমানটি রাডারে ধরা পড়বে। তাই এই শ্রেণীর বিমানের প্রধান যুদ্ধকৌশল হলো স্টেলথ থাকার সুবিধা নিয়ে রাডারকে আরো আগেই ধ্বংস করে দেয়া।
আগেই বলা হয়েছে যে অ্যাক্টিভ রাডার হোমিং নিজেই রেডিও তরঙ্গ ছুড়ে টার্গেট শনাক্ত করে। আধুনিক রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার (RWR) সেন্সর সেই তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে পাইলটকে জানিয়ে দেয় কোথা থেকে তাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে! তারপর রাডার ধ্বংসের জন্য ফায়ার করা হবে এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল!
প্রতিটি রাডারের নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যসহ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আছে। এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল উক্ত রেডিয়েশনকে অনুসরণ করে রাডার ধ্বংস করতে এগিয়ে যায়। এভাবে স্টেলথ বিমান দিয়ে শত্রুর চোখ অন্ধ করে দিতে পারলে নন-স্টেলথ সাধারণ বোমারু বিমান দিয়ে বিনা বাধায় হামলা করা একদমই সহজ ব্যাপার। ইরাক, সার্বিয়া যুদ্ধে আমরা স্টেলথ বিমানের কার্যকারিতা দেখেছি। তাদের আধুনিক রাডারগুলোকে ধ্বংস করে এয়ার ডিফেন্স মিসাইলগুলোকে অকেজো বানিয়ে দিয়েছিল মার্কিন স্টেলথ যুদ্ধবিমান।
এসব কারণে স্টেলথ বিমান শনাক্তে সাধারণত লংরেঞ্জ অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ হোমিং এর সমন্বিত রাডার ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের রাডার খুবই ব্যয়বহুল যা গুটিকয়েক দেশের হাতে রয়েছে। এটি স্টেলথ বিমান থেকে নির্গত বিভিন্ন ধরনের তরঙ্গ, যেমন- বিমানের রাডার তরঙ্গ, ইঞ্জিনের ইনফ্রারেড সিগনেচার, দৃশ্যমান সিগন্যাল লাইট, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি স্পেকট্রাম ইত্যাদির সাহায্যে উক্ত বিমানকে শনাক্ত করে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় Time Difference Of Arrival (TDOA) পদ্ধতি।
এই সিস্টেমে ৩/৪টি প্যাসিভ রাডার থাকবে যা নির্দিষ্ট দূরত্বে মোতায়েন করা হবে। ধরা যাক, এরকম তিনটি রাডার ব্যবহার করা হচ্ছে। তাহলে শত্রুর একটি স্টেলথ বিমানের সিগনেচার তিনটি রাডারে তিন রকম সময়ে তিনভাবে ধরা পড়বে। কিন্তু এই তথ্য দিয়ে তো বিমানের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এজন্য নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের সাহায্যে সবগুলো রাডার থেকে প্রাপ্ত ডাটা এনালাইসিস করে মুহূর্তেই 3D ম্যাপ তৈরি করা হয় যার মাধ্যমে বিমানের দূরত্ব, উচ্চতা নির্ণয় করা যায়। উক্ত ডাটা এয়ার ডিফেন্স মিসাইল ব্যাটারির সাথে শেয়ার করে কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। অনেক সময় প্যাসিভ হোমিংকে ফাঁকি দিতে স্টেলথ বিমান নিজের রাডারসহ রেডিও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্টগুলো সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখার কৌশল অবলম্বন করতে পারে। তবে আজকের যুগে এগুলো ছাড়া লম্বা সময় ধরে বিমান চালানো প্রায় অসম্ভব। তাই দীর্ঘ সময় নিজের স্টেলথ অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব নয়।
রাডার ক্রস সেকশন ও নাজি টেকনোলজির গল্প
স্টেলথ বিমান রাডারে ধরা পড়বে কিনা সেটি আশা করি বুঝতে পারছেন। এবার বলা হবে কীভাবে অ্যাক্টিভ রাডার হোমিংয়ের নিঃসৃত তরঙ্গকে স্টেলথ বিমান কীভাবে ফাঁকি দেয়। প্রতিটি বিমানের সাইজ রাডারে কেমন দেখায় সেটি নির্ণয়ের জন্য রাডার ক্রস সেকশন (RCS) নামক স্কেল ব্যবহার করা হয়। এটি বিশ্লেষণ করে আধুনিক যুগের রাডার শনাক্তকৃত বিমানের মডেল প্রায় নির্ভুলভাবে অনুমান করতে পারে। স্টেলথ বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে এই RCS এর মান যতটা সম্ভব কমানো। এটি ডিজাইন ও স্টেলথ কোটিংয়ের মাধ্যমে কমানো যায় যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘ব্যাটল অফ ব্রিটেন’ নামক এয়ার ক্যাম্পেইনে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার আগেই ব্রিটিশরা তাদের রাডারের মাধ্যমে জার্মান বোমারু বিমানের খবর পেয়ে আকাশে ইন্টারসেপ্টর বিমান ওড়াত। তখন RCS কমানোর বিষয়টি জার্মান ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় আসে। প্রাথমিকভাবে খুবই কাছাকাছি ফর্মেশনে বিমান উড়িয়ে রাডার ক্রস সেকশন কিছুটা কমানো গেলেও সেটি যথেষ্ট ছিল না। বড় বোমারু বিমানের ডানার নিচে এসকর্ট ফাইটারগুলো উড়ত যেন রাডারে একাধিক ব্লিপের বদলে একটি ব্লিপ দেখায়। এই কৌশল আজকের যুগেও কিছুটা কার্যকর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিত্যনতুন বিমান তৈরির ধারাবাহিকতায় নতুন ডিজাইনেরহর্টন Ho 229 নামক বিশ্বের প্রথম জেট ইঞ্জিন চালিত বিমান বানানোর কাজ শুরু করে জার্মানি। এর RCS মান তৎকালীন বিশ্বের যেকোনো বোমারু বিমানের চেয়ে কম। কিন্তু সেটির নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং এই প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র হস্তগত করে। ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস, জার্মানি যদি তাদের অসমাপ্ত সামরিক প্রজেক্টগুলোর অর্ধেকও সময়মতো শেষ করতে পারতো তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ বদলে দিত।
জার্মানির বেশ কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ধারে-কাছেও তখনকার মিত্রবাহিনীর কোনো দেশ ছিল না। যুদ্ধের পর এগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন-যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন যে যার মতো দখল করে। তবে সবচেয়ে ভাগ্যবান ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারা Ho 229 এর একাধিক অসমাপ্ত প্রোটোটাইপ, ব্লুপ্রিন্টসহ বেশ কিছু গোপন প্রযুক্তি হস্তগত করতে সক্ষম হয়। এছাড়া যুদ্ধের পরপরই ‘অপারেশন পেপারক্লিপ’ নামক গোপন মিশনের আওতায় যে ১৬০০ জার্মান বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিমান, রাডার বিশেষজ্ঞ। এদের কারণে যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। Ho 229 প্রজেক্ট যুগের তুলনায় এতটাই আধুনিক ছিল যে নাসা বর্তমানে মঙ্গল গ্রহে বিরুপ পরিবেশে ওড়ানোর মতো গ্লাইডার বিমান বানানোর জন্য এর উপর গবেষণা করছে!
স্টেলথ বিমানের ডিজাইন ও স্টেলথ কোটিং
স্টেলথ বিমানের ডিজাইনগুলো যদি খেয়াল করেন তবে দেখবেন যে এরা অন্যান্য যুদ্ধবিমানের চেয়ে কিছুটা আলাদা। যেমন বর্তমানে সবচেয়ে স্টেলথ বোমারু বিমান হিসেবে খ্যাত মার্কিন B-2 Spirit দেখতে অনেকটা ত্রিভুজের মতো। এর ডিজাইন অনেকটাই হর্টন Ho 229 এর ডিজাইন থেকে নেয়া। সাধারণত বড় আকারের বিমানগুলো রাডারে অনেক বড় RCS মান দেখায়। যেমন- ১৫৯ ফুট লম্বা ও ১৮০ ফুট ছড়ানো ডানার বি-৫২ বোম্বারের রাডার ক্রস সেকশন মান ১০০ বর্গ মিটার, অন্যদিকে ৫৯ ফুট লম্বা ও ১৭২ ফুট ছড়ানো ডানার বি-২ স্টেলথ বোম্বারের RCS মান মাত্র ০.১ বর্গ মিটার। অর্থাৎ এত বড় বিমানটি শুধুমাত্র স্টেলথ হওয়ায় রাডারে একে পাখির সমান দেখাবে।
এর পেছনে কাজ করেছে নির্দিষ্ট ডিজাইন যা রাডার তরঙ্গকে বিমানের সাথে কোনাকুনিভাবে ধাক্কা খাওয়ার পর অন্যদিকে প্রতিফলিত করে দেয়। এই কাজটি সহজ করতে স্টেলথ বিমানের অস্ত্রশস্ত্র (মিসাইল/বোমা) এর ফিউজলাজের নিচে আলাদা ‘ওয়েপন বে’ তে বহন করে যা ফায়ার করার আগমুহূর্তে দরজা খোলা হয়। এসব বিমানের ডানায় একান্ত দরকার না হলে মিসাইল/বোমা বহন করা হয় না।
এছাড়া স্টেলথ যুদ্ধবিমানের বডি কয়েক ধরনের Radiation-absorbent material দিয়ে তৈরি হয়। মাইক্রোস্কোপে স্টেলথ বিমানের বডি অংশবিশেষ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে এর সমতল অমসৃণ, যা রাডার তরঙ্গকে বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত করে দিক পরিবর্তন করিয়ে দেয়। তারপরও রাডার থেকে আগত তরঙ্গের সবটুকু বিচ্যুত করা সম্ভব হয় না। তাই বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের তৈরি একপ্রকার বিশেষ প্রলেপ দিয়ে পুরো বিমানকে ঢেকে দেয়া হয়। একে স্টেলথ কোটিং বলা হয় যা খুবই ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। যেমন বি-২ স্টেলথ বোম্বারকে একবার মিশন শেষ করে আসার পর পুনরায় মিশনে পাঠানোর জন্য পুরো বিমানের স্টেলথ কোটিং তুলে আবার কোটিং করতে প্রায় ৫২ ঘন্টা সময় প্রয়োজন। আবার এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট বৃষ্টিতে আকাশে উড়লে এর স্টেলথ কোটিং ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিমানটি সহজেই রাডারে ধরা পড়ে। এসব কারণে স্টেলথ খুবই জটিল একটি টেকনোলজি।
আকাশযুদ্ধে স্টেলথ যুদ্ধবিমান কতটা শক্তিশালী?
স্টেলথ বোমারু বিমানের কার্যকারিতা সম্পর্কে একটু আগেই বলা হয়েছে। এবার বলা হবে স্টেলথ ফাইটার জেট নিয়ে। আধুনিক যুগের আকাশযুদ্ধ বা ডগফাইটের ধারণা পরিবর্তন করে দিয়েছে Beyond Visual Range (BVR) মিসাইল। এখন দুই শত্রু পাইলট একে অপরের বিমানকে চোখে না দেখেই ভূপাতিত করতে সক্ষম যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু হওয়া ডগফাইট বা আকাশ যুদ্ধের নিয়মের ব্যতিক্রম। এর বাইরেও অত্যাধুনিক শর্ট ও মিডিয়াম রেঞ্জ মিসাইল রয়েছে। এসব মিসাইলের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবহার হতে পারে স্টেলথ যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে।
প্রতিটি মিসাইলের একটি নির্দিষ্ট রেঞ্জ থাকে যে রেঞ্জে থেকে ফায়ার করলে টার্গেট মিস করার কোনো সুযোগ নেই। একে মিসাইলের No Escape Zone (NEZ) বলে। আধুনিক যুগের যুদ্ধবিমানগুলোতে রাডার লক নোটিফিকেশনের জন্য অত্যাধুনিক আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম এবং ধেয়ে আসা মিসাইল শনাক্তের জন্য মিসাইল ওয়ার্নিং রিসিভার থাকে। এর ফলে হামলার শিকার হলে শত্রুবিমানের পাইলট মিসাইল ফাঁকি দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা (জ্যামার/চ্যাফ/ফ্লেয়ার/ডিকয়) নিতে পারে। কিন্তু উক্ত হামলাটি স্টেলথ যুদ্ধবিমান দিয়ে করা হলে ফলাফল হবে একেবারে ভিন্ন। স্টেলথ টেকনোলজির সুবিধা নিয়ে পাইলট তার মিসাইলের নো এস্কেপ জোনের ভেতরে/যত সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে ফায়ার করবেন। এতে মিসাইলের হাত থেকে শত্রু বিমানের বাঁচার সম্ভাবনা একেবারে কমে যায়।
আকাশে স্টেলথ যুদ্ধবিমান আসলে কতটা কার্যকর সেই সম্পর্কে একটি ঘটনা বলা যাক। ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যে আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় উড়তে থাকা একটি মার্কিন এমকিউ-১ ড্রোনকে ইন্টারসেপ্ট করতে আসে দুটো ইরানি এফ-৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান। এগুলো ষাটের দশকের আমেরিকান টেকনোলজি হলেও আজকের যুগে একেবারে অচল যে তা কিন্তু নয়।
ড্রোনকে রক্ষা করতে আকাশে একটু দূরেই তখন উড়ছিল দুটো এফ-২২ র্যাপ্টর যা আজ অবধি নির্মিত সবচেয়ে স্টেলথ ফাইটার জেট। সাধারণত ড্রোনের সুরক্ষার জন্য যুদ্ধবিমান থাকে না। তবে কিছুদিন আগেই সিরিয়ার আকাশে একটি মার্কিন ড্রোন ইরানি সু-২৫ যুদ্ধবিমান কর্তৃক ভূপাতিত হয়েছিল বিধায় বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছিল। ইরানি ফ্যান্টম ড্রোনের পিছু নিয়েছে খবর পেয়ে ফ্যান্টমকে পাল্টা ইন্টারসেপ্ট করতে রওনা দেয় দুটো এফ-২২ র্যাপ্টর। ইরানি ফ্যান্টমগুলো ড্রোনের ১৬ কি.মি. দূরে থাকতেই ইন্টারসেপ্টেড হয়।
মজার ব্যাপার হলো, হঠাৎ করে একটি ইরানি ফ্যান্টমের নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বামদিক দিয়ে ভোজবাজির মতো উদয় হওয়ার আগপর্যন্ত ইরানি ফ্যান্টম পাইলট মার্কিন র্যাপ্টরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেই পারেনি! অর্থাৎ রাডারে স্টেলথ বিমানটি ধরা পড়েনি। আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় থাকায় ও যুদ্ধে লিপ্ত না থাকায় বিমান দুটো কেউ কাউকে হামলা করার অনুমতিপ্রাপ্ত নন। এ সময় র্যাপ্টর পাইলট ইরানি পাইলটকে রেডিওতে বলেন “you really ought to go home”। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ফ্যান্টম হয়তো রাডার বন্ধ করে প্যাসিভ মুডে (মানে ড্রোন থেকে আগত সিগন্যাল পর্যবেক্ষণ) ছিল যার ফলে র্যাপ্টর যে একদম ঘাড়ের পিছনে এসে পড়েছে সেটা টের পায়নি ইরানি পাইলট। এই ঘটনায় যদি মিসাইল ফায়ার করা হতো তবে কিছু বুঝে উঠার আগেই ফ্যান্টম ভূপাতিত হত। স্টেলথ এর বিরুদ্ধে বিমানের রাডার তেমন কার্যকর নয় বিধায় বর্তমানে ইঞ্জিনের তাপ খুঁজে বের করতে ইনফ্রারেড সার্চ এন্ড ট্র্যাক (IRST) সেন্সর আধুনিক যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করা হয়। তবে রেঞ্জ খুবই সীমিত বিধায় আকাশ যুদ্ধে স্টেলথ ফাইটার জেট এখনও প্রায় অজেয় বলা যায়।
৫ম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের স্টেলথ টেকনোলজির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যদি আজকের দিনে যুবক হয় তবে অন্যান্য পরাশক্তি দেশগুলো এখনও শিশু। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো স্টেলথ বিমান পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করায় সেখানে রাশিয়া ২০০০ সালে, চীন ২০১১ সালে প্রথম স্টেলথ বিমানের উড্ডয়ন সম্পন্ন করে। এছাড়া তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্যান্য আগ্রহী দেশগুলোর স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রজেক্ট এখনও কাগজেই সীমাবদ্ধ। ব্রিটেন, জাপানসহ বাকিরা মার্কিনিদের বিক্রি করা এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান কিনে চাহিদা মেটাচ্ছে। চীনের জে-২০, জে-৩১ কতটা স্টেলথ সেটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের যেমন সন্দেহ রয়েছে তেমনি ইরানের স্বঘোষিত স্টেলথ বিমান কাহের-৩১৩ আদৌ উড্ডয়ন করতে সক্ষম কিনা নিয়ে নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হয়।
ভারত রাশিয়ার দাবিকৃত সু-৫৭ স্টেলথ যুদ্ধবিমানের অগ্রগতি নিয়ে হতাশ হয়ে প্রজেক্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। শোনা যায়, বসনিয়া যুদ্ধে ভূপাতিত হওয়া সবচেয়ে পুরোনো স্টেলথ বিমান এফ-১১৭ এর একটি টুকরা বিক্রির জন্য সার্বিয়াকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব করেছিল চীন। যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারির কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। একইভাবে ওসামা বিন লাদেন হত্যা মিশনে ইউএস নেভি সিল কমান্ডোদের ব্যবহৃত স্টেলথ ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেলে সেটি এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে উড়িয়ে দেয়া হয় যেন স্টেলথ টেকনোলজি অন্য কেউ না পায়। আবার পাকিস্তানকে প্রবল কূটনৈতিক চাপ দিয়ে ভাঙা হেলিকপ্টার ফিরিয়ে আনা হয় যেন হেলিকপ্টারের ভাঙা টুকরো চীনের কাছে না যায়। অর্থাৎ আমেরিকা বাদে অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর কাছে স্টেলথ টেকনোলজি এখনও দূর আকাশের তারা।
যুক্তরাষ্ট্র স্টেলথ বিমানের পাশাপাশি যুদ্ধজাহাজও নির্মাণ করেছে। এটি খুবই ব্যয়বহুল প্রযুক্তির বিমান যা নির্মাণ/ক্রয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি। মার্কিন এফ-২২ ও বি-২ স্টেলথ বিমান কারো কাছে বিক্রি করা হয় না। R&D খরচসহ এদের প্রতিটি বিমানের দাম যথাক্রমে ৩৩৪ মিলিয়ন ডলার ও ২.২ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি জুমওয়াল্ট ক্লাস স্টেলথ যুদ্ধজাহাজের দাম ৪.২৪ বিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক বিভিন্ন দেশের ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি এফ-৩৫ এর দাম প্রায় ১১০.৩ মিলিয়ন ডলার। এক ঘন্টা এই বিমান ওড়াতে খরচ পড়ে ৩৬,০০০ ডলার। এছাড়া বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ তো আছেই। ফলে স্টেলথ টেকনোলজি ভবিষ্যতে আরো সহজলভ্য হলেও মাঝারি ও নিম্ন সারির বিমানবাহিনীগুলো এ ধরনের বিমান সার্ভিসে রাখতে কতটা সক্ষম সেটিও কিন্তু দেখার বিষয়।