হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে হাউজ র্যাভেনক্ল’র অবস্থা অনেকটা হাউজ হাফলপাফের মতোই, বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সময়সাপেক্ষে কিছু জাদুকরকে দেখানো হয়েছে। হ্যারি পটারে স্লিদারিন আর গ্রিফিন্ডরের নীরব রেষারেষিই চোখে পড়েছে বেশি, তাদের হাউজের জাদুকরেরা সবক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তবে হাউজ র্যাভেনক্লও নানা সময় জন্ম দিয়েছে বিখ্যাত কিছু জাদুকর। হগওয়ার্টসের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ে আলোচনামূলক সিরিজের প্রথম পর্বে গড্রিক গ্রিফিন্ডর, দ্বিতীয় পর্বে হেলগা হাফলপাফকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল, এ পর্ব তথা তৃতীয় পর্ব সাজানো হয়েছে হাউজ র্যাভেনক্ল’র প্রতিষ্ঠাতা রোয়েনা র্যাভেনক্লকে নিয়ে।
স্কটল্যান্ডের খ্যাতনামা নারী জাদুকর রোয়েনা র্যাভেনক্ল ছিলেন হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রির অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা। দশম শতাব্দীর কাছাকাছি কোনো এক সময়ে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। র্যাভেনক্ল উপাধি তিনি নিজ পরিবার থেকে পেয়েছেন, নাকি স্বামীর পরিবার থেকে অর্জন করেছেন, সেটা নিশ্চিত নয়। রোয়েনার গভীর সখ্যতা ছিল ওয়েলসের আরেক কিংবদন্তি নারী জাদুকর হেলগা হাফলপাফের সাথে।
হাজার বছর আগে হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রির ভিত্তিপ্রস্তর হলেও, মাস-তারিখ তেমন ভালো করে জানা নেই। তৎকালীন সেরা চার জাদুকর গড্রিক গ্রিফিন্ডর, সালাজার স্লিদারিন, রোয়েনা র্যাভেনক্ল ও হেলগা হাফলপাফের হাত ধরেই গড়ে উঠে জাদু জগতের অন্যতম সেরা এই বিদ্যালয়। তাদের নাম অনুসারেই এর হাউজকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়, এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আলাদা আলাদা হাউজে পাঠানো হয়। হগওয়ার্টস নামটি মূলত এই রোয়েনা র্যাভেনক্লই নির্বাচন করেছিলেন। এছাড়াও পরিবর্তনশীল ফ্লোর-প্ল্যানের বুদ্ধিও তার মাথা থেকেই এসেছিল।
রোয়েনা নিজ হাউজের জন্য শিক্ষার্থী বাছাই করতেন তাদের বুদ্ধিমত্তা, সৃষ্টিশীলতা, ও বিচক্ষণতা মূল্যায়ন করে। এছাড়াও তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক, ধীশক্তি, চতুরতাকেও বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হতো। রোয়েনা র্যাভেনক্ল নিজের মেয়ে হেলেনা র্যাভেনক্লকেও এ হাউজে ভর্তি করেছিলেন।
একটা সময় পর সালাজার স্লিদারিন মাগলদের এ স্কুলে পড়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারির মত পোষণ করলে, বাকিদের সাথে একত্র হয়ে রোয়েনাও সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। কারণ, হাউজ র্যাভেনক্ল’র অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মাগল ছিল তখন। বাকিদের সাথে মিলমিশ না হওয়ায় নিজেই স্কুল ত্যাগ করে যান স্লিদারিন।
প্রথম ব্যাচ গ্রাজুয়েশন শেষ করলে, গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হন তার মেয়ে হেলেনা র্যাভেনক্লও। কিন্তু সে সময় হেলেনা তার মায়ের মুকুট চুরি করে নিয়ে যায়। তখন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল, এ মুকুট যে পরবে, তার ধীশক্তি দিন দিন শুধু বাড়তেই থাকবে। সেজন্যই মায়ের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে, সে মুকুট চুরি করে আলবেনিয়ায় পালিয়ে যায়। নিজের মেয়ের কাছে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার কবলে পড়ায়, লজ্জায় অনুতপ্ত হতে থাকেন রোয়েনা।
কিছুদিন পর গুরুতর অসুস্থতা তাকে আঁকড়ে ধরে। তখন তিনি হেলেনার প্রাক্তন প্রেমিক ব্যারনকে অনুরোধ করেন, তার মেয়েকে খুঁজে এনে দিতে, যাতে মৃত্যুর আগে মেয়েটাকে একবার দেখে যেতে পারেন। ব্যারন আলবেনিয়ার এক জঙ্গলে হেলেনাকে খুঁজে পেলেও, হেলেন তখন তার সাথে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্যারন অনেক অনুরোধ করে তাকে। একসময় ব্যারনের ক্রোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে, ক্রোধের বশে হেলেনার বুকে ছুরি বসিয়ে দেয় সে। তারপর অনুশোচনায় নিজেকেও বলি দিয়ে দেয় ব্যারন।
সেই থেকে ব্যারন হাউজ স্লিদারিনের এবং হেলেনা হাউজ র্যাভেনক্ল’র ভূত হয়ে হগওয়ার্টসে থেকে যায়। এভাবেই রোয়েনা তার মেয়ের সাথে দেখা করার শেষ সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। এই ভগ্নহৃদয় তাকে একেবারে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসে। কিছুদিন পর মৃত্যু হয় রোয়েনা র্যাভেনক্ল’র। আর দুনিয়া থেকে বিদায় নেন হগওয়ার্টসের চারজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে একজন।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রোয়েনার মুকুট আলবেনিয়ার এক জঙ্গলে লুকানো ছিল। পরবর্তী সময়ে তার মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে স্লিদারিনের চতুর শিক্ষার্থী টম রিডল সেটার আসল ঠিকানা জেনে নেয়। তারপর টম রিডল মুকুটটিকে হরক্রাক্সে রূপান্তরিত করে ফেলে, যা পরে জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ধ্বংস করা হয়।
র্যাভেনক্ল টাওয়ারে স্থাপিত রোয়েনার মূর্তি ও কিছু ছবি দেখে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী এক রমণী। কিছুটা বিবর্ণ চামড়া, ডাগর চোখ, কালো লম্বা চুল তাকে এক অনন্য সৌন্দর্য দান করেছিল।
র্যাভেনক্ল’র উল্লেখযোগ্য দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতা। শিক্ষার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এই দুটো গুণকে তিনি বেশি প্রাধান্য দিতেন। প্রথমদিকে তাকে একটু কঠোর গোছের মনে হলেও পরবর্তীতে তিনি ক্ষমাশীল ও স্নেহময় হয়ে ওঠেন। আর তাইতো নিজের মেয়ের গুরুতর অপরাধকে ক্ষমা করে দিয়ে, শেষ সময়ে তাকে শুধু একটা বারের জন্য দেখতে চেয়েছিলেন।
মুকুট চুরির কথা তিনি কাউকে জানতে দেননি। স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে কারা প্রাধান্য পাবে, এ বিষয়েও তিনি স্লিদারিনের সাথে মতবিরোধ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কে কেমন হবে, সেটা তার রক্তে লেখা থাকে না। সেজন্য তিনি অনেক মাগলকে তার হাউজে ভর্তি করিয়েছিলেন।
জাদু-মন্ত্রে বিশেষ দখল ছিল রোয়েনার। বাকি প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে নিয়ে তিনি গ্রিফিন্ডরের ‘সর্টিং হ্যাট’কে একটি জাদুকরী ক্ষমতা দান করেন, যাতে তাদের মৃত্যুর পরেও সেটা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাছাই করে নির্দিষ্ট হাউজে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়াও হগওয়ার্টস দুর্গের এভার-চেঞ্জিং ফ্লোর প্ল্যানটা রোয়েনারই নকশা করা।
রোয়েনা তার মুকুটটি নিজ হাতে জাদু দিয়ে বানিয়েছিলেন। এবং এর মধ্যে এমন ক্ষমতা দান করেছিলেন, যে এই মুকুট পরিধান করবে, তার ধীশক্তি ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে।
জাদু জগতে হাউজ হাফলপাফের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন যাদুকরের কথা জেনে নেওয়া যাক।
গ্যারিক অলিভেন্ডার
গ্যারিক অলিভেন্ডারকে সেরা ব্রিটিশ ছড়ি নির্মাতা বলে ধারণা করা হয়। জাদু দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো অনেক জাদুকর তার তৈরি ছড়ি ব্যবহার করেই মন্ত্র প্রয়োগ করেছে।
লুনা লাভগুড
হ্যারি পটারের সমসাময়িক লুনা লাভগুড ছিল অন্যতম মেধাবী ও বুদ্ধিমতী একজন শিক্ষার্থী। ডিফেন্সিভ ম্যাজিক আর চার্মে তার সফলতা ছিল অভাবনীয়। জাদু জগতের সেরা ম্যাগিজুলোজিস্টের তালিকা করলে তার নাম উপরের দিকেই থাকবে।
ফিলিয়াস ফ্লিচউইক
মন্ত্র সাধনে ফ্লিচউইকের জুড়ি মেলা ভার ছিল। হ্যারি পটার আমলের প্রথমদিকে তিনি চার্মের প্রফেসর ছিলেন। চার্মের পাশাপাশি ডিফেন্সিভ ম্যাজিকেও তিনি ছিলেন দারুণ দক্ষ। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসের সময় বাকি কয়েকজন প্রফেসরের সাথে মন্ত্র উচ্চারণ করেই তিনি হগওয়ার্টসকে সুরক্ষার চাদরে আচ্ছাদন করেছিলেন।
এছাড়াও, ইগনেশিয়া ওয়াইল্ডস্মিথ, প্রফেসর কুইরেল, মিলিসেন্ট ব্যাগনল্ড, হেলেনা র্যাভেনক্ল, সিবিল ট্রিলনি, গিলডেরয় লকহার্টের জাদুকরেরাও র্যাভেনক্ল হাউজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন।