Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল: নিয়মতান্ত্রিকতা আর কর্তৃত্ববাদের প্রতি শৈল্পিক উপহাস

স্পেনের এক ধনী দম্পতির বাড়িতে ডিনার পার্টিতে এসে আমন্ত্রিত অতিথিরা আটকা পড়ে যায় একটি কক্ষের মধ্যে। তারা কেউ সে কক্ষ থেকে বের হতে পারে না, কেউ তাদেরকে উদ্ধার করতে বাড়ির ভেতরেও প্রবেশ করতে পারে না, অথচ বাড়ির দরজা সর্বক্ষণই উন্মুক্ত! রহস্যময় ‘অশুভ শক্তি’র কাছে আটকা পড়া এ মানুষগুলোর কর্মকাণ্ড কিছুই বোঝা যায় না, আপাতদৃষ্টিতে মেলে না তাদের অনেক কথার অর্থও। তথাপি শেষতক তারা ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারলেও পুনরায় চার্চে গিয়ে আটকা পড়ে!

এমনই একরৈখিক গল্পের সিনেমা ‘দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’। এর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে দুটি শব্দই ব্যবহার করতে হবে, রহস্যময় ও অর্থহীন। ১৯৬২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কিংবদন্তি স্প্যানিশ পরিচালক লুই বুনুয়েলের এই পরাবাস্তব ঘরনার সিনেমাটি এমনই। এর কাহিনী, চিত্রনাট্য, গল্প বলার ধরন, সবকিছুই অত্যন্ত সহজ এবং রৈখিক, অথচ রহস্যাবৃত। অত্যন্ত সাধারণ একটি গল্পনির্ভর এ সিনেমাটি দেখার পর যেকোনো দর্শকের মাথায় শত শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে।

Image Source: imdb.com

সিনেমার শুরুটা স্পেনের প্রভিডেন্স স্ট্রিটের এক প্রাসাদতুল্য বাড়িতে। বাড়ির মালিক নোবিল এবং লুসিয়া দম্পতি কোনো এক বিশেষ উপলক্ষে তাদের কিছু বন্ধু ও পরিচিতজনকে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ করেন। অপেরা দেখে সকল অতিথি যখন একত্রে বাড়িতে প্রবেশ করেন তখন কোনো এক রহস্যময় কারণে বাড়ি থেকে একে একে চলে যেতে থাকে একজন বাদে বাকি সব ভৃত্যরা। এতে করে নোবিল ও লুসিয়া তাদের অতিথিদের বিনোদনের জন্য যেসব ব্যবস্থা করেছিলেন, সেগুলো ভেস্তে যায়।

যা-ই হোক, অতিথিরা বেশ স্বচ্ছন্দেই ডিনার পার্টি উপভোগ করেন। খাবারের পাশাপাশি হাসি-তামাশা আর একে অপরের নামে কুৎসা রটানোর মধ্য দিয়ে ডিনার পার্টি শেষ হলে শুরু হয় মূল বিপত্তি। ভৃত্যদের রহস্যজনকভাবে বাড়ি ত্যাগ করার চেয়েও অধিক রহস্যজনক ঘটনা ঘটতে শুরু করে ডিনার শেষ হবার পর। স্বাভাবিকভাবেই ডিনার শেষে অতিথিদের চলে যাবার কথা। কিন্তু কোনো অজানা কারণে অতিথিরা খবার কক্ষ ছেড়ে মিউজিক রুমে আরাম করতে শুরু করেন এবং একসময় সোফায়, আলমারি সদৃশ ক্লজেটে, এমনকি মেঝেতে শুয়ে প্রত্যেকে ঘুমিয়ে পড়েন।

একই কক্ষে সপ্তাহখানেক আটকে থাকেন অতিথিরা; Image Source: 

humanizingthevacuum.wordpress.com

এই কক্ষে এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহ কেটে গেলেও কেউ কক্ষ ত্যাগ করতে পারেন না! কেন বের হতে পারেন না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কারণ কক্ষটি উন্মুক্তই ছিল। এদিকে বাড়ির সামনে অতিথিদের পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এসে ভিড় করে, উদ্ধার করতে উপস্থিত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। কিন্তু কেউই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না! শেষতক অতিথিদের একজন আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেন প্রথমদিন তারা সেই কক্ষটিতে যেভাবে বসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই আবার বসেছেন। আর এতে করে অদৃশ্য বাধা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কেটে যায় এবং অতিথিরা কক্ষটি ত্যাগ করেন। মজার ব্যাপার হলো, এই বিপত্তি থেকে মুক্তি পাওয়ায় চার্চে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে সেখানে পুনরায় আটকা পড়েন তারা!

কেন ভৃত্যরা চলে গেল, কেন অতিথিরা কক্ষটি থেকে বের হতে পারছিল না, কেন বাইরে থেকে কেউ ভেতরে আসতে পারছিল না, ভেড়া আর ভাল্লুকটি কী গুরুত্ব বহন করে, কী কারণে সিনেমার শুরু এবং শেষ হয় চার্চে গিয়ে ইত্যাদি প্রশ্নে বারবার মাথা চুলকালেও সিনেমায় সরাসরি পাওয়া যাবে না কোনো উত্তর। বুনুয়েল নিজেও এ বিষয়ে কখনোই মুখ খোলেননি। ব্যাখ্যা করার দায়িত্বটা তিনি দর্শককেই দিতে চেয়েছেন। আর তাই তো এ সিনেমা নিয়ে এত আলোচনা, এত হৈচৈ। দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক, সবাই এ সিনেমার জন্য দাঁড় করিয়েছেন মুখরোচক সব ব্যাখ্যা, যেগুলোর কোনোটিই আদতে ভুল নয়। কারণ বুনুয়েল শিল্পের আর কল্পনার পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে পরাবাস্তব আবহে এমনভাবে সিনেমাটি তৈরি করেছেন যে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

সর্বাধিক প্রচলিত ও সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি দিয়েই শুরু করা যাক। কিংবদন্তি চলচিত্র সমালোচক রজার এবার্ট এই ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন। তার মতে, ‘’দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’’ সিনেমায় সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণীকেই উপস্থাপন করা হয়েছে যারা কি না নিজেদের অর্থ আর বিত্তের কানাগলিতে আটকা পড়ে আছেন। এটি সেই বুর্জোয়া শ্রেণী যারা স্পেনের গৃহযুদ্ধে স্বৈরাচারী ফ্রাংকোর পক্ষাবলম্বন করে এবং সমাজবাদী ও অন্য পন্থার রাজনৈতিক শক্তিকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে সমাজের সকল প্রকার ক্ষমতার চূড়ায় ওঠে।

লুইস বুনুয়েল; Image Source: sensesofcinema.com

এই ব্যাখ্যা প্রসারিত করার পূর্বে আমাদের ঘুরে আসতে হবে পরিচালক বুনুয়েলের জীবন থেকে। তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ এই সিনেমা তৈরির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। ১৯০০ সালে স্পেনের কালান্ডা নামক ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম নেয়া বুনুয়েল তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য জীবনের বড় একটা সময় কাটিয়েছেন নির্বাসনে। প্রতিবারই নতুন করে নির্বাসিত হওয়ার সাথে সাথে নতুন কোনো স্থানে গিয়ে নতুন পরিবেশ ও ধ্যান-ধারণার মধ্যে বাস করতে হয়েছে তাকে। ১৯২০ এর দশকে তিনি প্যারিসে বসবাস করেছেন, যাকে বলা হতো মডার্নিজমের শহর; সিনেমা নির্মাতাদের স্বর্গ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া হলিউডে বসবাস করেছেন ১৯৩০’এর দশকের শুরুতে। এরপর পুনরায় প্যারিস গিয়েছেন এবং সেখান থেকে নিউ ইয়র্কে।

নিউ ইয়র্কে থিতু হতে চেয়েও পারেননি বুনুয়েল। বাম ঘরানার চিন্তাভাবনা ও কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় নিউ ইয়র্কের ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো শীঘ্রই তার শত্রুতে পরিণত হয়। ফলে জীবন বাঁচাতেই নিউ ইয়র্ক ছাড়তে হয় তার। এ পর্যায়ে তিনি মেক্সিকোতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং ছোট বাজেটের বাণিজ্যিক ঘরনার সিনেমা নির্মাণ শুরু করেন। ‘৪০ ও ‘৫০ এর দশক মেক্সিকোতে কাটিয়ে শেষতক ফ্রান্সে গিয়ে থিতু হন। ততদিনে পরিচালক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত, প্রযোজকরা তার সিনেমায় বড় অঙ্কের অর্থ লগ্নি করতে প্রস্তুত। এ সময়ের সিনেমাগুলোতেই তিনি মূলত শৈল্পিক স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্যবহার করতে পেরেছেন।

মূলত, প্রতিবার নির্বাসিত বা বিতাড়িত হয়ে নতুন নতুন দেশে গিয়ে গিয়ে তিনি সিনেমা নির্মাণের নতুন নতুন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ফ্রান্সে তার নির্মিত প্রথম সিনেমা দুটিই ব্যাপক প্রসংশিত হয়েছিল। দুটিই ছিল ছোট বাজেটের ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা যেখানে তিনি নিজের শিল্পী ও ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতার পূর্ণ প্রয়োগ করেছেন। এখানেই তিনি সালভাদর ডালির সাথে কাজ করে পরাবাস্তব সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হয়েছেন। পরবর্তীতে হলিউডে আর মেক্সিকোতে তার ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা নির্মাণের পথ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসলেও ফ্রান্সে ফিরে এসে তিনি পুনরায় স্বাধীনভাবে সিনেমা নির্মাণ করেন। এ সময় বড় বড় প্রযোজকরা তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও দিয়েছিলেন। ‘দ্য ডিসক্রিট চার্ম অব দ্য বুর্শোয়াজি’, ‘দ্য ফ্যান্টম অব লিবার্টি’র মতো অসাধারণ সিনেমাগুলো তিনি এসময়ই নির্মাণ করেছেন।

এই ডিনার পার্টি বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে; Image Source: drafthouse.com

এবার এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেলে ফিরে আসা যাক। বুনুয়েলের জীবনে আলোকপাত করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে স্বৈরাচারী ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ তাতে ছিল। সিনেমায় যে ডিনার পার্টি দেখানো হয়, তা মূলত বুর্জোয়া সমাজের নিয়মতান্ত্রিকতারই প্রতীক, যেখানে মানুষের প্রধান প্রাকৃতিক চাহিদাকেও (খাদ্য) শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে নিজেদের জন্য আলাদা শ্রেণী তৈরি করা হয়। একটি দৃশ্যে দেখা যায় একজন ভৃত্য খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে পিছলে পড়ে যান। এতে করে সকল অতিথিরা একযোগে হেসে ওঠেন। তারা ভাবেন এটি নোবিল আর লুসিয়ার কোনো সারপ্রাইজ! এর দ্বারা পরিচালক ইঙ্গিত করেন বুর্জোয়াদের নীচু শ্রেণীর মানুষের প্রতি কঠোর দৃষ্টিভঙ্গিকে। একজন ভৃত্য পিছলে পড়ে যেতে পারে, এমন সম্ভাবনা তাদের মাথায় উঁকিও দেয় না তাদের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।

এদিকে অতিথিরা আসবার পরপরই ভৃত্যদের সব চলে যাওয়াও নির্দেশ করে ধনী-গরীবের মধ্যকার ক্লাস কনফ্লিক্টকে। ডিনারের সময় ও ডিনার পরবর্তী সময়ে অতিথিদের নানারূপ যৌন ও বৈষম্যমূলক এবং বর্ণবাদী কথোপকথনে বুর্জোয়া শ্রেণীর মানসিকতা ফুটে ওঠে। ডিনার টেবিলে বসা অতিথিরা তাদের পাশের অতিথির কাছে টেবিলের অপর পাশে বসা অতিথি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করতে থাকে। এর দ্বারা পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজের সামষ্টিক বিচ্ছিন্নতাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি মানুষ একে অপরের থেকে স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিচ্ছিন্ন।

ক্ষুধার তাড়নায় বুদ্ধি লোপ পায় অতিথিদের, তারা পরস্পর মারামারিতে লিপ্ত হয়; Image Source: 

asharperfocus.com

একদিন আটকে থাকার পরই খাবারের সংকট দেখা দেয়। ধীরে ধীরে অতিথিরা অস্থিরচিত্ত হয়ে ওঠেন, অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ করতে শুরু করেন, হয়ে ওঠেন মারমুখী। পানি খাবার জন্য ঘরের দেয়াল ভেঙে পাইপ বের করেন তারা, তুচ্ছ বিষয়ে একে অপরের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়ান, এমনকি একে অপরকে প্রাণ নাশের হুমকি পর্যন্ত দিতে থাকেন। এ অংশে সমাজের কঠিন এক বাস্তবতার চিত্রই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সমাজের উঁচু স্তরের তথাকথিত সভ্য শ্রেণী খেতে না পেরে হিংস্র হয়ে উঠছে। এই শ্রেণীটিই যখন অর্থ আর বিত্তের প্রাচুর্যের মাঝে বসবাস করে, তখন তারা সমাজের নীচুতলার মানুষের দিকে ফিরেও তাকায় না, জীবিকার জন্য তাদের সংগ্রাম অনুধাবন করতে পারে না। দরিদ্র এ শ্রেণীটিকে তথাকথিত সভ্য সমাজ বর্বর বলে অভিহিত করে। অথচ সংকটাপন্ন অবস্থায় পতিত হয়ে তারা নিজেরাও বর্বর হয়ে ওঠে।

কেবল পরাবাস্তব জগতে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক খোঁচা নয়, বুনুয়েল তার সিনেমায় খোলামেলা বিদ্রুপ করেছেন সমাজের স্বার্থপর এ শ্রেণীটিকে। লুসিয়া এবং নোবিল তাদের অতিথিদের চমকে দিতে একটি ভালুক ও তিনটি ভেড়া এনে বসিয়ে রেখেছিল রান্নাঘরে। অতিথিরা যখন অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করে, তখন বুনুয়েল বারবার কাট ইন করে ভেড়া ও ভালুকটিকে দেখান। এর মাধ্যমে মানুষ আর পশুর সরাসরি একটি তুলনাই যেন করতে চাইলেন পরিচালক, যেখানে স্পষ্টত পশুগুলো অধিক শান্ত! শুধু তা-ই নয়, ভালুক এর হিংস্রতার জন্য পরিচিত হলেও সেটি ভেড়াগুলোকে আক্রমণ করেনি। অথচ ভেড়াগুলো মিউজিক রুমে প্রবেশ করবার সাথে সাথে সেগুলোকে হত্যা করে ক্ষুধা নিবারণ করতে উদ্যত হয় অতিথিরা!

রান্নাঘরে এনে রাখা ভেড়াগুলো; Image Source: vaguevisages.com

টানা সপ্তাহখানেক একটি কক্ষের মধ্যে আটকে থাকা অতিথিরা একসময় তাদের কক্ষের যাবতীয় ময়লা, ভাঙা তৈজসপত্র ছুঁড়ে পাশের কক্ষে ফেলতে থাকে। সাজানো পরিপাটি সে কক্ষগুলোর দিকে আবর্জনা ছুড়তে থাকা অতিথিদের দৃষ্টিই বলে দেয় সেগুলো সৌন্দর্য নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তাদের যাবতীয় চিন্তা নিজেদের জগতটা নিয়েই। ঠিক যেমনভাবে সমাজের উপরতলার মানুষ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করে এবং নীচুতলার মানুষের জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে ন্যুনতম ভাবে না।

ধনী বুর্জোয়া শ্রেণী বনাম দরিদ্র সর্বহারা শ্রেণীর দ্বন্দ্বের বাইরে এই সিনেমাটিকে স্বৈরশাসক বা একনায়কের অনুগত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অসারত্বের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। বুনুয়েল তার স্বদেশী একনায়ক ফ্রাংকোর অপশাসনের শিকার হলেও তার এই সিনেমা সকল স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্বৈরশাসকদের সাধারণত একটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য থাকে। এই বৈশিষ্ট্যটি হলো দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে বশে আনা। অনুগত এই বুদ্ধিজীবী সমাজ দেশের ক্রান্তিকালে নিশ্চুপ নিশ্চল হয়ে থাকে। তারা বরং সাধারণ শ্রেণীর দিকেই আঙুল তোলে।

ডিনারের রাতে ঘুমিয়ে কাটানোর পরদিন সকালেও যখন কোনো অতিথি চলে যেতে উদ্যত হন না, তখন অতিথিদের মাঝে কয়েকজন ব্যাপারটিকে ‘অশোভন’ বলে মন্তব্য করেন। তারা একে অপরকে ইঙ্গিত করে কারোই ঘর থেকে বের হতে না পারাকে অস্বাভাবিক বলে অভিহিত করতে থাকেন। অথচ নিজেদের দিকে প্রশ্ন আসতেই সকলে চুপ করে যান! এটি তাদের কপটতার বহিঃপ্রকাশ। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। ঘর থেকে বের হওয়ার প্রশ্নে দরজার সম্মুখে এসেই অতিথিরা থমকে দাঁড়ায় এবং পাশেরজনকে অনুরোধ করে সে যেন আগে যায়। এর দ্বারা একনায়কের অনুগত বুদ্ধিজীবী সমাজের ভীরুতাকে নির্দেশ করেছেন পরিচালক। এই বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যেকেই অনুধাবন করতে সক্ষম যে তারা ভুল পথে আছেন, তথাপি কেউই সাহস করে এগিয়ে যেতে পারেন না। সকলেই অপেক্ষায় থাকেন কোনো একজন প্রথমে কিছু একটা করবেন যার পেছনে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে।

বুদ্ধিজীবী সমাজের সবচেয়ে ধারালো সমালোচনাটি এসেছে বাড়ির বাইরে জমা হওয়া জনতার বিরুদ্ধে একজন অতিথির মন্তব্যের মধ্য দিয়ে। একটি দৃশ্যে এক অতিথিকে বলতে শোনা যায় তিনি তাদের অবস্থার চেয়ে বাইরের অবস্থা নিয়ে অধিক চিন্তিত। বাইরের লোকগুলো কেন তাদের উদ্ধার করতে পারছে না এটার তার জন্য অস্বস্তিকর হচ্ছে! এ দৃশ্যে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একনায়কের অনুগত নয় কিন্তু ভীতু, এরকম শ্রেণীর দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। এ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা দেশের ক্রান্তিলগ্নেও নিজস্ব ভাবধারা ও আদর্শ প্রচার করতে পারবে না, সাহস করে বিরুদ্ধমত প্রকাশ করতে পারবে না। বরং তথাকথিত মুক্তি ও সংগ্রামের বৈষয়িক বাণী শুনিয়ে সাধারণ জনতা কেন বিপ্লব করছে না, তা নিয়ে হা-হুতাশ করবে।

উৎসুক জনতা কেউ এগিয়ে না গিয়ে শিশুটিকে এগিয়ে যেতে বলছে; Image Source: classicartfilms.com

কেবল বুর্জোয়া আর বুদ্ধিজীবী সমাজের জন্য সমালোচনার পসরা সাজিয়ে বসেননি বুনুয়েল। তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি আমজনতাও। বাড়ির বাইরে ভিড় করা মানুষগুলোই আমজনতার প্রতিচ্ছবি, যারা সবকিছু দেখতে পায় কিন্তু এগিয়ে যেতে বা প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। একটি দৃশ্যে এক শিশুকে বাড়ির মূল ফটকের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে দেখা যায়। তখন জনতার মধ্যে ‘এগিয়ে যাও’ বলে শ্লোগান শুরু হয়। এখানে পরিচালক বলতে চেয়েছেন যে আমজনতাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভীরু এবং প্রথম প্রতিবাদে অক্ষম। তারাও চায় কেউ একজন প্রথমে এগিয়ে যাবে এবং তার পেছনে বাকি সবাই যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার সেই একজনকে কোথাও পাওয়া যায় না।

বুনুয়েল ব্যক্তিজীবনে একাধিকবার চার্চ কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ক্যাথলিক চার্চের আজন্ম সমালোচক। তাই অনেকে এ সিনেমাটিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখেন। শুরুতে চার্চের ছবি দেখানো মানে সবকিছুই চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে যখন মানুষ বেরিয়ে আসতে চায় (ডিনার পার্টি), তখন অদৃশ্য শক্তি (‘দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’) তাদের আটকে দেয়। বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে তাই সবাই আবার দলবেঁধে চার্চে যায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য এবং পুনরায় আটকা পড়ে। অর্থাৎ, আবারো চার্চের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করে তারা।

‘দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’ সিনেমায় রয়েছে রূপক আর প্রতীকী দৃশ্যের ছড়াছড়ি। সিনেমায় একাধিক দৃশ্যের কৌশলী পুনরাবৃত্তি করেছেন পরিচালক। একই দৃশ্য একটু ভিন্ন এঙ্গেল থেকে কিংবা ভিন্ন ফ্রেমে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে একাধিকবার। চমৎকার কৌশলী এই প্রতীকী দৃশ্যগুলোর মাধ্য দিয়ে দর্শক যেন তার জীবনেরই প্রতিফলন দেখতে পায়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের জীবন এতটাই যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে যে পরিবর্তনের চাহিদাই ফুরিয়ে গেছে। বরং সামান্য একটু পরিবর্তন এলেই (সিনেমায় যেটি ভিন্ন এঙ্গেল বা ফ্রেমে দেখানো হয়েছে) আমরা ভাবতে শুরু করি জীবনে অনেক পরিবর্তন চলে এসেছে। আদতে একই বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের জীবনে, ঘুরপাক খাচ্ছে প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক সীমার মধ্যেই।

একই কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে অতিথিদের সংকট মুক্তির দৃশ্যেও। সেখানে দেখা যায় অতিথিরা প্রথম রাতে যেভাবে মিউজিক রুমে বসেছিল, ঠিক সে সজ্জায় পুনরায় বসেছেন। আর এতেই ঘরের বাইরে যাওয়ার রাস্তা তাদের খুলে যায়। এই দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে আমাদের জীবন এতটাই নিয়মতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে, সেখানে সামান্য পরিবর্তন আসলেও তা স্থবির হয়ে পড়ে। জীবন যখন পুনরায় আগের শৃঙ্খলের মধ্যে ফিরে যায়, তখন আমরা স্বস্তি পাই।

নিজেদের সংকট কাটাতে একজন অতিথিকে একবার কিছু সময় ‘নীরবতা পালন’ করার প্রস্তাব দিতে দেখে যায়। এটি রূপকার্থে বাস্তব জগতের শাসকশ্রেণীর অনুগত বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত সুশীল সমাজের নিয়মতান্ত্রিকতাকে ইঙ্গিত করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ এ শ্রেণী নিজেদের অবস্থান মজবুত রাখতে নীরবতা পালন কিংবা মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মতো নিয়মতান্ত্রিক পন্থার অবলম্বন নেয়, যে পন্থাটি পুরোপুরি নিরাপদ। কারণ, এরূপ প্রতিবাদ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কোনো ক্ষয় সাধন করতে পারে না আর রাষ্ট্রব্যবস্থাও এগুলো দমন করতে সচেষ্ট হয় না। এছাড়াও মুরগির কাটা পা আর ভেড়ার বলিদান দৃশ্যায়নের মাধ্যমে অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারাচ্ছন্নতাকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেছেন বুনুয়েল।

ভেড়াগুলো দৌড়ে ঢুকছে চার্চের ভেতরে; Image Source: classicartfilms.com

সিনেমার একেবারে শেষ দৃশ্যেও একটি অসাধারণ রূপক ব্যবহার করেছেন পরিচালক বুনুয়েল। এ দৃশ্যে দেখা যায় একপাল ভেড়া দৌড়ে চার্চে প্রবেশ করছে আর রাস্তা থেকে শোনা যাচ্ছে বন্দুক আর কামানের গোলার শব্দ। এই কামানের শব্দ হলো স্বৈরাচারী শাসকের শক্তি প্রয়োগ, যে শক্তির কাছে হার মেনে মানুষেরা (একপাল ভেড়া!) বশ্যতা স্বীকার করে। চার্চে প্রবেশ করাকে দর্শক তাই যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে পারেন। চার্চ হতে পারে অন্ধ বিশ্বাসের আখড়া যেখানে সাধারণ মানুষ অলৌকিক ভীতির কারণে আটকা পড়ে। কিংবা চার্চ হতে পারে স্বৈরশাসনের সমর্থনের প্রতীক, যেখানে বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজেদের সমর্পণ করে।

রূপক আর প্রতীকের ব্যবহারের বাইরে ‘দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’ সিনেমার চিত্রনাট্য আর চিত্রগ্রহণ নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই। কোনো চরিত্রকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য না দিয়ে এবং কারো চরিত্রই আলাদা করে গঠন না করে চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে যা সিনেমাটির মূল বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রৈখিক গল্পবলার ধরনের সাথে কিছু দৃশ্যে পরিচালকের কৌশলী পুনরাবৃত্তি সিনেমাটিকে প্রাণ দিয়েছে, দর্শককে প্রতি মূহুর্তেই ভাবিত করেছে। আর বিভিন্ন দৃশ্যে অতিথিদের ব্যাখ্যাতীত সব কর্মকাণ্ড সিনেমাটিকে দিয়েছে পরাবাস্তবতার ছোঁয়া।

সিনেমাটির চিত্রগ্রহণেও রাখা হয়েছে ভাবনার খোরাক। অধিকাংশ দৃশ্যই ‘ওপেন’ বা উন্মুক্ত শটে ধারন করা হয়েছে। এক কক্ষে আটক অতিথিদের উন্মুক্ত পার্শ্ববর্তী কক্ষটির দিকে দৃষ্টিপাত আর বাইরে ভিড় জমানো আমজনতার ইতস্তত দৃশ্যায়ন, সর্বত্রই ওপেন শটের ব্যবহার নির্দেশ করে যে কাউকেই বেঁধে রাখা হচ্ছে না। ভেতরে আটকে পড়া অতিথিরা উন্মুক্তই আছেন যেকোনো সময় বেরিয়ে যাবার জন্য। আবার বাইরের জনতাও উন্মুক্ত আছেন ভেতরে প্রবেশের জন্য। তাহলে কী বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সিনেমার পুরোটা সময়জুড়ে এর উত্তরই খুঁজতে থাকবেন দর্শক।

উন্মুক্ত দরজা দিয়ে অসহায় নয়নে পাশের কক্ষে চেয়ে আছেন অতিথিরা, কিন্তু কেউই সেখানে আসতে পারছেন না; Image Source: ruthlessreviews.com

পরাবাস্তব ঘরানার সিনেমা নির্মাণে লুই বুনুয়েলের তুলনা তিনি নিজেই। ‘দ্য এক্সটারমিনেটিং এঞ্জেল’ সিনেমাটি অবশ্যই এই ঘরানার শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলোর একটি। সিনেমা কেবল বিনোদনের জন্যই নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু, এমনটাই মনে করতেন বুনুয়েল। সিনেমা মানুষকে শিক্ষিত করতে পারে, মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করতে পারে। বুনুয়েলের এই সিনেমাটিও এমনই একটি সিনেমা যা দর্শককে বিনোদিত করার পাশাপাশি অনেক কিছু ভাবতে শেখাবে। এই সিনেমার মূল শিক্ষা হলো উত্তর আধুনিককালের ‘পোস্ট ট্রুথ’ পৃথিবী, যেখানে যাবতীয় অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে থাকবে, সবাই সেগুলো অনুধাবন করতে পারবে, কিন্তু সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা হবে না, কোনো প্রতিবাদ হবে না। বরং অযৌক্তিক বিশ্বাস আর ধারণাকেই জোর করে যৌক্তিক করার চেষ্টা করা হবে। 

Language- Bangla
Topic- 'The Exterminating Angel' cinema analysis
Reference- Hyperlinked inside the article

Featured Image- trailersfromhell.com

 

Related Articles