“তবু মানুষের এ দীনতার বুঝি শেষ নেই।
শেষ নেই মৃত্যুরও।
তবু মানুষ মানুষকে হত্যা করে।
ধর্মের নামে।
বর্ণের নামে।
জাতীয়তার নামে।
সংস্কৃতির নামে।
এই বর্বরতাই অনাদিকাল ধরে আমাদের এই পৃথিবীর শান্তিকে বিপন্ন করেছে।”
উপন্যাস কতটা চমকপ্রদ ও বহমান ঐতিহাসিক নদীস্বরূপ রুপক নিয়ে শুরু হতে পারে তা এ কথাগুলোতে লুক্কায়িত। রাখঢাক নেই, পরিচয় নেই, প্রতিষ্ঠা নেই তথাপি শুরু হয়ে গেল গল্প। সে গল্প আবার বর্তমান সময়ের। না, ভুল বলা হলো! শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বেড়াজালে আটকে নেই এটি। অনাদিকাল ধরে চলে আসা গল্প।
খ্যাতিমান পরিচালক মৃণাল সেন তার ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭১) সিনেমাটিও আকস্মিকভাবে শুরু করেন কয়েকটি কথা দিয়ে –
“আমার বয়স কুড়ি
কুড়ি বছর বয়স নিয়েও
হেঁটে চলেছি
হাজার বছর ধরে।”
তবে এ হাজার বছর ছাপিয়ে সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে চলমান সময় কিংবা আরও যতদিন সময় বয়ে যাবে ততদিনকে ব্যাপ্তি করে ‘আর কতদিন’ (১৯৭০)। আমাদের নিজেদের আবাস এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে শান্তি বিনাশ করার গল্প জহির রায়হানের ‘আর কতদিন’। মাত্র ২৮ পৃষ্ঠায়, কখনও ছোট ছোট লাইন দিয়ে ব্যতিক্রমী ঢংয়ে লেখা হয়েছে এটি।
জ্ঞান, আলো কিংবা সুখের জন্য কতকাল বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। বর্বর থেকে হয়েছি সভ্য। উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে, শ্বাপদসংকুল পাথর-পর্বত পেরিয়ে অন্ধকার থেকে আলোতে এসেছি। গুহায় থাকার ভয়ানক সময়কে পেছনে ফেলে এসেছি। টিকে থাকার তাগিদে সেই হিংস্রতাকে বিদায় বলেছি বহু আগে।
কিন্তু আজও আলো নেই!
আলো না থাকার পর যে অন্ধকার বিরাজ করছে, জহির রায়হান তার চিত্র এঁকেছেন ইটের টুকরো আর মৃতদেহ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর সাথে এক কাতারে রয়েছে আমাদের মরদেহ। জহির রায়হান দেখিয়েছেন, এ মরদেহের যোগানদাতা আসলে মানুষের চেহারা নিয়ে থাকা হিংস্র জানোয়ার। রক্তের নেশায় ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’র কাউন্ট ড্রাকুলার মতো বেরিয়ে আসছে তার জিভ। রাক্ষসের জিন বহনকারী দাঁত চারটি থেকে বেরিয়ে আসছে লালারস।
গল্পের শুরুতেই দেখা যায় এদের ভয়ে নোংরা অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠে জড়ো হয়ে থাকে একজন, দুজন কিংবা অনেকে। টের পেয়ে যাওয়ার ভয়ে আওয়াজ করতে পারে না। আওয়াজ করলেই অস্তিত্ব বিলীনের ভয় দুনিয়ার বাসিন্দাদের। চুপচাপ থাকতেই হবে। আরশোলা আপনমনে হাঁটলেও তাঁর সেই সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে তাঁরা নিজেদেরকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। কেউ বাঁচাতে আসলে ভাবছে সে হয়তো অত্যাচারীর দালাল।
অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকা আতংকিত মুখে এক ঝলক আলো এসে পড়লে তারা শিহরিত হয়-
“না। না। আমরা আলো চাই না।”
যে আলোর জন্য এতকাল সংগ্রাম করে এসেও এখনও অন্ধকারেই থাকতে হয়, তা চাওয়াটাই এখন তাদের কাছে আজন্ম পাপ বলে মনে হয়। লেখক এখানে কালের ধারায় চলমান এক প্রহসনের রুপ দেখিয়েছেন।
আশ্রয় নেবে কি না- এমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানায় পড়ে থাকলেও লেখক জয়গান গেয়েছেন মানবতার। মানুষকে বাঁচাতে চাইবে তো মানুষই। কেননা সে মানুষটির কাছের কেউ হয়তো আছে আরও খারাপ অবস্থায়। তাই প্রকোষ্ঠের তারা আশ্রয় পান আরও নিরাপদ আশ্রয়ে। বাইরে তখনও চলছে হানাহানি। এ হানাহানিকে জহির রায়হান বলছেন আজীবন ধরে চলে আসা অত্যাচারের চিত্রকে।
উপন্যাসে প্রায় অনেকবার বলা আছে মৃতদেহের কথা। মানুষের, পাখির, কুকুরের। যেন অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষেরা স্বাভাবিক আর চুপচাপ দেদারসে মরণকে বেছে নিচ্ছে।
রুপকের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ শান্তির দিকে যেতে চাচ্ছে। অগণিত জনতা হেঁটে চলেছে। বৃষ্টি উপেক্ষা কট, হাঁটু পানি ডিঙিয়ে নানা বর্ণের নানা বয়সের মানুষ হিংস্রতা থেকে পালাতে হেঁটে চলেছে অবিরাম।
তাদের বাড়ি কোথায়?
যাচ্ছে কোথায়?
আমাদের চোখে ভেসে উঠে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাড়ি জমানো মানুষদের ছবি। কিন্তু রূপক অর্থে জহির রায়হান প্রশ্ন করে খোলাসা করেছেন তার লেখার সীমানাকে, উন্মুক্ত করেছেন স্বাধীনতাকে। এদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে-
“আমরা এখন কোথায়? ইন্দোনেশিয়ায়। না ভিয়েতনামে।
না সাইপ্রাসে।
কোথায় আমরা।
জানি না।”
অর্থাৎ আমাদের ‘মা’ নামক এ ধরায় কোথাও শান্তি নেই। কোথায় আমরা শান্তি পাবো তা নিজেরাই জানি না। যেদিকেই যেতে চাই রক্তে লাল হয়ে আছে সেখানকার মাটি।
আপনজনকে খুঁজতে থাকা মানুষদের আশার বাণী নেই যেন। প্রত্যেকের মুখে খুঁজে নিজের আপনজনের মুখ খুঁজে পাওয়া তো শতাব্দীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে যায়। হাতে গুণে শেষ করা যাবে না এমন সংখ্যক লোককে মেরে রক্তে রঞ্জিত করেছে ভূমি। বইয়ের ভাষায়-
“কত মেরেছে জিজ্ঞেস করছো? তার কি কোনো হিসেব আছে। এক বছর নদীতে কোনো স্রোত ছিল না। মরা মানুষের গাদাগাদীতে সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শকুনরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে দু’বছর ধরে। এখনো খাচ্ছে।”
যখনই এমন চিত্র দেখে বর্তমান সময়ের আমরা ভাবতে থাকি আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার কথা। লাখ লাখ মানুষের জীবন জলে ভেসে যাওয়ার কথা। তখনই লেখক চিত্রায়িত করেন হিরোশিমায় বোমা মেরে মানুষ হত্যার চিত্র। জেরুজালেমের রাস্তায় পাষন্ডের মতো মাকে হত্যার চিত্র। দেখিয়েছেন আফ্রিকা আর ভিয়েতনামের মানুষদের বঞ্চিত হয়ে থাকার চিত্র।
ইট দিয়ে আলোর উৎস ভেঙে চারপাশ অন্ধকার করে নিজেদের আড়াল করছে উপন্যাসের পরিচয় না থাকা দুই চরিত্র ইভা আর তপু। রুপক অর্থে পুরো মানবজাতি। তবে তপু সেই মানুষটার আপনজন যিনি সহস্র মানুষের ভীড়ে খুঁজছিলেন তাঁর ছেলে তপুকে।
হুট করে লেখক অনাদিকালের বঞ্চনার গল্পে চমৎকারিত্ব নিয়ে আসলেন। নিয়ে আসলেন ভালোবাসাকে। ইভা-অপুর ভালোবাসাকে।
ইভা অপুকে কেন ভালোবাসে?
ভালো লেগেছে।
ভালো লাগে।
তাই ভালোবেসেছে। জটিল ভালোবাসার কী সহজ উত্তর! সুন্দর জিনিসের ব্যখ্যা হয়তো এমন সহজই হয়। মানুষের হিংস্রতার উত্তর হয় ভয়ানক।
এদিকে, হাজার হাজার বছর ধরে এক ঘরে জবুথবু হয়ে বসে থাকা মানবজাতি যখন একটু সুযোগ পায় হাঁটাচলা করার, তখন অবাক হয়ে খেয়াল করে, তার হাত-পা নড়তে চাচ্ছে না। মাথা নিচু হয়ে আছে। দীর্ঘদিন নিজেদের বন্দী করে রাখার পর অবশ হয়ে যাওয়া মানবজাতির প্রতিনিধি তাঁরা। চুপসে গিয়ে আড়ালে লুকানো দ্বিপদ মানুষকে তখন চলতে হয় চতুষ্পদে। জহির রায়হান কী চমৎকার উপমা দিয়ে দেখালেন মানুষ থেকে প্রাণী হয়ে যাওয়ার চিত্রকে।
কয়েকটি ঘটনা বেশ শক্তভাবে বিবেককে নাড়া দেয়ার মত। মানবজাতি কতটা নীরব হলে কিংবা চুপসে গেলে আগত সন্তানকে দুনিয়ার আলোতে আগমন করতে দেয় না? উপন্যাসে দেখা যায় ঘরে আটকা পড়াদের একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা। শত্রুরা যখন ঘরে তাদের খুঁজতে আসে তখন সে মহিলার প্রসব ব্যথা শুরু হয়। তখন সেখানে থাকা বাকি কন্ঠস্বর আপ্রাণ চেষ্টা করে আগত নিষ্কলঙ্ক শিশুটির জন্ম প্রতিরোধ করতে। নিজের জীবন কতটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে থাকলে এমন করতে পারে মানুষ!
আরও অমানবিক আচরণ দেখা যায় যখন বাচ্চাটি ভূমিষ্ট হয়। জন্মের সাথে সাথেই সে যেন চিৎকার দিতে না পারে সেজন্য তার গলা টিপে ধরা হয়। অমানবিক এ দৃশ্য চোখের সামনে দেখে মারা যান বাচ্চার মা। মারা যায় সদ্য ভূমিষ্ট বাচ্চাটিও।
আর তাঁর বাবা!
তাঁর বাবা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে গিয়েও আটকে ফেলেন নিজের মুখ। চেপে ধরেন দুই ঠোঁট। এখন কোনও কান্না নয়। নীরবে কাছের মানুষের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করা! নিজের রক্তের প্রতিনিধিকে ভয়ঙ্করভাবে হারানো!
শত্রু চলে যাবার পর আপনা আপনি তাঁর সে হাত ছুটে গেলো মুখ থেকে। চিৎকার দিয়ে উঠলো সেই হতভাগ্য বাবা। চিত্রিত হয় অনাদিকাল ধরে চলে আসা পৃথিবীতে বসবাসকারী নরপশুদের অমানবিকতার বীভৎস রুপ।
এদিকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ ছুটতে থাকা ইভা খুঁজে পায় ক্রুশবিদ্ধ হওয়া যিশুকে। যে যিশু সেই ঘাতকদেরই শিকার। এ ঘাতকেরা মহাকাল ধরে চালিয়ে আসছে তাদের তাণ্ডবে। ছুটতে ছুটতে দেখা পেলো তাণ্ডবে বিলীন হওয়া সহস্র মানুষদের। তারা প্রাণহীন হয়ে পড়ে আছে।
কোথায়?
দেখলো তাঁরা পড়ে আছে জার্মানির নাৎসিদের কনস্ট্রাকশন ক্যাম্প বুখেনওয়াল্ড কিংবা অসউইজে। তাঁরা পড়ে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিনগ্রাডে, ভিয়েতনামে। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখে সদ্য জন্মানো আরেকটি বাচ্চার মা মারা গেছেন। বাচ্চাটি কাঁদছে। তাঁর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে গ্রিস, সাইপ্রাস, ইন্দোনেশিয়া, জেরুজালেম, হিরোশিমা কিংবা ভিয়েতনাম থেকে আসা লোকজন।
পালিয়ে যাচ্ছে কোথায়?
পালিয়ে কি বাঁচা যাবে?
আলো খুঁজতে যাচ্ছে তাঁরা।
আদৌ আলো খুঁজে পাবে?
এদিকে তপুর মা-বাবার বাড়িতে খবর যায় তপু মারা গেছে। তপুকে নির্মমভাবে মেরেছে কারা? যে ১৯ জনকে তপুর মা আশ্রয় দিয়েছেন তাদের স্বজাতিরা। সহসা হিংস্রতা ভর করে তপুর মা আর ভাইদের মনে। কিন্তু তসবিহ পড়তে থাকা তপুর বাবা বাঁধা দেন। তাকে সরিয়ে হত্যা করতে ঘরে ঢুকে তপুর ভাইয়েরা। তখন একটি বাচ্চার হাঁসি তাদের মন থেকে কঠোরতা কেটে দেয়। আমাদের পৃথিবীর শান্তি তো আছে বাচ্চার হাঁসিতেই।
শেষের অংশে চমৎকার এক প্রতীকের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখান জহির রায়হান। একটি দৃশ্যে দেখা যায় তপু ফিরে এসেছে তাঁর বাবা, মা, ভাইয়ের কাছে। তাদেরকে জড়িয়ে ধরার পর তপু খেয়াল করে তাদের হাত রক্তস্নাত। রক্ত বইছে শরীর দিয়ে। একেকজনের মধ্যে জিঘাংসার প্রলয় যেনো। সে ফিরে আসে দৌড়ে।
নিজেদের কাছের মানুষেরাই আমাদের ধবংস করতে সদা সচেষ্ট। আমরা বুঝি না সেটা, যা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। এযাবতকালে হয়ে আসছে স্বাধীন বাংলাদেশে।