অনেক চলচ্চিত্রেই কুকুরের উপস্থিতি দেখা যায়। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে নায়ক বা নায়িকার পোষা প্রাণী হিসেবে তাদের দেখানো হয়। এখানে কুকুরের চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। মূল চরিত্রের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে কুকুরের বিকাশ লাভ করার চমৎকার ও সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি হচ্ছে ২০১১ সালে নির্মিত ‘দ্য আর্টিস্ট’ চলচ্চিত্রটি। কুকুরটির পারফরমেন্স এতই ভালো ছিল যে দ্য আর্টিস্ট চলচ্চিত্রে অভিনয় করা কুকুরটিকে অস্কার পুরষ্কার দেবার জন্য বেশ গুঞ্জন উঠেছিল। বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা ইন্ডিপেনডেন্ট-এর কালচার বিভাগে বলা হয়েছিল- এ বছর যদি কোনো চার পা ওয়ালা প্রাণীকে অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয় তাহলে সেটি অবশ্যই অর্জন করে নিবে দ্য আর্টিস্ট-এর কুকুর চরিত্র উগি (Uggie)। সেরা অভিনেতা হিসেবে দেয়া না গেলেও বিশেষ পুরষ্কার যেন দেয়া হয় অন্তত। কিন্তু সে মানুষ নয় বলে অস্কার কমিটি তাকে পুরষ্কার প্রদান করেনি।
দ্য আর্টিস্ট-এ কুকুরটি ভালো অভিনয় করেছিল, কিন্তু চলচ্চিত্রের মূল ফোকাস ছিল নায়কের উপরে। তবে কিছু কিছু চলচ্চিত্র আছে যেখানে সবকিছুকে ছাড়িয়ে কুকুরই প্রধান চরিত্র হয়ে উঠে। এসব ক্ষেত্রে কুকুরই হয়ে যায় মূল নায়ক। এরকমই একটি কুকুর হচ্ছে রিন টিন টিন। রাশিয়ান এই কুকুরটি তার জীবনে ২৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল। অনেক মানুষ অভিনেতা আছে যারা তেইশটি ছবিতে অভিনয় করতে পারেনি, কিন্তু এই কুকুরটি পেরেছিল।
রিন টিন টিনও জড়িয়ে আছে অস্কার পুরষ্কারের সাথে। ১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম যখন অস্কার পুরষ্কারের প্রচলন শুরু হয় তখন প্রথম আসরেই একটি কুকুরকে পুরষ্কারের জন্য দাবী তোলা হয়। আর এই কুকুরটি হচ্ছে রিন টিন টিন। বলা হয়ে থাকে, সেরা অভিনেতার পুরষ্কার কাকে দেয়া হবে এর জন্য ভোটাভুটি করা হয় এবং সবচেয়ে বেশি ভোট অর্জন করে নেয় এই কুকুরটি। মানে এক অর্থে নৈতিকভাবে অস্কার জয় করে নেয় কুকুরটি। কিন্তু অস্কার কমিটি একে পুরষ্কার প্রদান করেনি। এখানেও কারণ সে দুই পা ওয়ালা প্রাণী নয়। কমিটি চাইলে পুরষ্কার দিতে পারতো, কমিটির কোনো কোনো সদস্যের ইচ্ছাও ছিল তাকে দেবার। কিন্তু পুরষ্কারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করে শেষমেশ দেয়া হয়নি।
শুরু থেকেই অস্কার কমিটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল। অনেকটা নোবেল পুরষ্কারের মতো। তাদের ধারণা ছিল, এবারই প্রথম চালু হচ্ছে অস্কার পুরষ্কার, প্রথমবারেই যদি একটা কুকুরকে পুরষ্কার দেয়া হয় তাহলে সেটা সকলের কাছে হাস্যরসের খোঁড়াক হবে। বিসমিল্লাতেই যা হাস্যরসের উপকরণ হয়ে যাবে তার পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা অনিশ্চিত। তাই কমিটি এই ঝুঁকিটি নিতে চায়নি। ফলে সবচেয়ে বেশি ভোট ও জোরালো দাবী থাকা সত্ত্বেও রিন টিন টিন পুরষ্কার পায়নি। ঐ বছর অস্কার পুরষ্কার ঘরে তোলেন এমিল জেনিংস।
রিন টিন টিনের জীবন
১৯১৮ সালে চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ উত্তাল ফ্রান্সে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জন্মগ্রহণ করে এই কুকুরটি। জন্মের একদম সঠিক দিন তারিখ সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। জন্মের সময় যারা উপস্থিত ছিল তাদের কেউই এ সম্বন্ধে কোনো কিছু জানায়নি। তবে জন্মের কিছুদিন পরপরই লি ডানকান নামের একজন মার্কিন যুদ্ধ সেনা এই কুকুরটিকে খুঁজে পান। খুঁজে পাবার দিনটি হচ্ছে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ। যখন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তখনো কুকুরটি অনেক ছোট ছিল এমনকি ভালো করে চোখও ফোটেনি। এ থেকে ধরে নেয়া যায় ১৫ তারিখের মাত্র কয়েকদিন আগে জন্মেছিল এই কুকুরটি।
যুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপের মাঝে মার্কিন সৈন্য লি ডানকান একটি মা কুকুর ও তার কতগুলো নবজন্ম নেয়া বাচ্চা দেখতে পায়। এদের প্রতি মায়া হলে কুকুরগুলোকে তুলে নিয়ে আসেন তার ইউনিটে। সেখানে যত্নের সাথে বড় হতে থাকে। বাচ্চাগুলো যখন দুধ খাওয়া ছেড়ে দিলো তখন মা কুকুরটিকে দিয়ে দিলেন তার অফিসারের কাছে এবং তিনটি বাচ্চাকে দিয়ে দিলেন অন্য সৈন্যদের কাছে। তিনি নিজে রাখলেন দুটি কুকুর। এদের একটির নাম নানেট এবং আরেকটির নাম রাখলেন রিন টিন টিন।
ডানকান খেয়াল করে দেখলেন দুটি ছানার মধ্যে রিনটিনটিন তুলনামূলকভাবে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত। ১৯১৯ সালের দিকে লি ডানকান যুদ্ধ ময়দান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন এবং সাথে করে কুকুরটিকেও নিয়ে আসেন। মূলত দুটি কুকুরকেই নিয়ে আসছিলেন। জাহাজে করে তাদেরকে আনতে বেশ ঝামেলাতেও পড়তে হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে রেলে করে বাড়িতে ফেরার সময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নানেট মারা যায়।
তখনো নির্বাক ছবির চল। সবাক চলচ্চিত্র এখনো বাজার দখল করেনি। ‘ইউজিন প্যালেট’ নামে নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন অভিনেতা ছিল ডানকানের বন্ধু। তারা দুজন কুকুরটির আনুগত্যের দিকটি খেয়াল করলেন এবং পোষা প্রাণী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে মনস্থ হলেন। প্রতিযোগিতায় কুকুরটি যদিও তার মালিকের আদেশ পালন করছিল কিন্তু তারপরেও জোরে জোরে ঘেও ঘেও করেছিল। যার কারণে ফলাফলে তেমন ভালো করতে পারেনি। পথে ফেরার সময় ঘটে আরেক দুর্ঘটনা, ট্রাকের উপর থেকে মালামালের স্তূপ এসে পড়ে কুকুরের উপর এবং প্রচণ্ড চোট লাগে এক পায়ে।
বছরখানেকের ভেতরে সে চোট সারিয়ে উঠে এবং মনিবের আদেশের প্রতি বেশ অনুগত হয়ে উঠে। ডানকানের বন্ধু কুকুরটির এমন আনুগত্য দেখে তাকে সিনেমায় অভিনয় করানোর প্রস্তাব করে। তখন সিনেমা জগতে আরেকটি কুকুর বিখ্যাত ছিল। কয়েকটি ভালো ভালো সিনেমা ছিল তার। ডানকানের বন্ধুটি ভবিষ্যদ্বাণী করে রিনটিনটিন হয়ে উঠবে এর চেয়েও অনেক বড় তারকা। বন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। তার পরেও কোনো কুকুর এত বিখ্যাত কিংবা এত সফল হয়নি। বললে বিশ্বাস হবে কিনা, একসময়ের মাটিতে নেমে যাওয়া ওয়ার্নার ব্রাদার্স কোম্পানিকে টেনে তুলে এনেছিল এই কুকুরটিই। এটি এতটাই বিখ্যাত ছিল যে ১৯৩২ সালে যখন এর মৃত্যু হয় তখন সারাদেশে শোক নেমে আসে। এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেই শোক পালন করা হয়।
১৯২২ সালে ‘দ্য ম্যান ফ্রম দ্য হেলস রিভার’ সিনেমার মাধ্যমে রিনটিনটিন সর্বপ্রথম হলিউডের জগতে প্রবেশ করে। এরপর ‘হোয়ার দ্য নর্থ বিগিনস’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে সারা দেশে তারকা বনে যায় এটি। এদিকে ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ার্নার ব্রাদার্স একদমই দেউলিয়া। খাঁদের কিনারায়। ‘হোয়ার দ্য নর্থ বিগিনস’ ছবির ব্যাপক সফলতার মাধ্যমে ওয়ার্নার ব্রাদার্স আবারো ঘুরে দাঁড়ায় এবং আজকের এই অবস্থানে আসে। সিনেমা দেখার সময় স্ক্রিনের সামনে যখন WB লগোটি ভেসে উঠে তখন থেকেই অনুমান করে নেয়া যায় এই সিনেমাটা চমৎকার হবে। একদিনের দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান আজকে এতটা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে তা ভাবতেই অবাক লাগে এবং আরো অবাক লাগে এর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে একটি কুকুর।
এরপর থেকে একে একে ২৩ টি ছবিতে অভিনয় করে রিনটিনটিন। দ্রুতই তারকা বনে যায় মার্কিন মুলুকে। অটোগ্রাফ শিকারিরাও চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। অটোগ্রাফ দেবার ধরণটাও অসাধারণ- নীচে লেখা থাকতো ‘আপনার বিশ্বস্ত রিন টি’ আর এর উপরেই দিতো পায়ের ছাপ। এটাই অটোগ্রাফ! কয়েকটা বিজ্ঞাপনেও অভিনয় করেছে। বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবীরা যেমন রেডিওতে উপস্থিত থেকে বক্তব্য বা মতামত দেয়, এই কুকুরটিও রেডিওর এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছিল। তারা গলা আওয়াজ শোনাবার জন্য। এটা কেমন করে হয়? হয়, হয়; মার্কিন জাতির পক্ষে সবই সম্ভব।
এর মাঝে ১৯২৯ সালে শুরু হলো অস্কারের প্রচলন। কুকুরটি প্রচুর ভোট পেলো। কিন্তু তাকে দেয়া হলো না সে মানুষ নয় বলে। তবে নৈতিকভাবে সে সব পুরষ্কার অর্জন করে নিয়েছিল। তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এতই বেশি যে Susan Orlean নামে একজন লেখক তাকে নিয়ে মোটা আকারের আস্ত এক বই লিখে ফেলেছেন। যে জিনিস বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষের বেলায়েও হয় না সে জিনিস একটি কুকুরের বেলায় হয়ে যাওয়া সাধারণ কথা নয়।
এতগুলো ছবিতে অভিনয় করা, একটি মেগা কোম্পানিকে বাঁচিয়ে তোলা, অটোগ্রাফ দেয়া, রেডিওতে উপস্থিত থাকা, এই কাজগুলো কটা সুস্থ সবল মানুষ করতে পারে? সেই হিসেবে বলা যায় নৈতিকভাবে সে অনেক কিছু অর্জন করেছে। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে সবসময়ই সম্মানের হয়ে থাকবে সে।