‘দ্য কাইট রানার’ আফগান বংশোদ্ভুত আমেরিকান লেখক খালেদ হোসাইনির প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসেই হোসাইনি তার শক্তিশালী লেখনী প্রতিভার দারুণ বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন। সমসাময়িক উপন্যাস ঘরানার এই বইটি বিচিত্র আবেগের সতর্ক সংমিশ্রণে রচিত একটি হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যান, যা পাঠকহৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করতে সক্ষম।
অসাধারণ এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে লেখকের মাতৃভূমি আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে। রাশিয়ান আগ্রাসনে জর্জরিত ও তালিবান অধ্যুষিত যে যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধূসর আফগানিস্তানের চিত্র আমরা দেখে অভ্যস্ত, তার বাইরে যুদ্ধ পূর্ববর্তী, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তানের এক দুর্লভ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই বইটিতে, যা একে করেছে অনন্য।
উপন্যাসের কাহিনীর শুরু ১৯৭০ এর দশকের পুরনো, স্বাধীন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। সেই সময়ের কাবুলের শিশুদের শুভ্র শৈশবের বর্ণনা পাওয়া যায় বইটির প্রথম পৃষ্ঠাগুলোতে। কাবুলের অভিজাত ওয়াজির আকবর খান এলাকায় বাস করা বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে আমির ও তার বাবার ভৃত্য আলীর ছেলে, তার বন্ধু হাসানের দুষ্টুমিভরা দিনগুলো চমৎকার কেটে যাচ্ছিলো। মা মরা ছেলে আমিরের দুঃখ শুধু ছিল একটাই, বাবাকে কাছে না পাওয়া। তার প্রিয় বাবা যেন কাছে থেকেও অধরা, যেন তিনি আমিরকে অপত্যস্নেহ থেকে বঞ্চিত করেই স্বস্তি পেতে চান। কিন্তু নাছোড়বান্দা আমির নানা সম্ভব-অসম্ভব উপায়ে বাবার ভালোবাসা অর্জনের জন্য লড়াই করে যেত। তা সে কচি হাতে গল্প লিখে বাবা মুগ্ধ হবেন ভেবে তাকে পড়তে দেয়াই হোক বা ভালো না লাগলেও বাবার প্রিয় খেলা ফুটবলের পাকা দর্শক বনে যাওয়ার অভিনয় করেই হোক।
১৯৭৫ সালের এক সকাল এনে দিল আমিরের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ, যা তাকে বাবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে সহায়তা করতে পারে। সেদিন ছিল আফগানিস্তানের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খেলা ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে আয়োজিত একটি স্থানীয় প্রতিযোগিতার দিন। আমির ও হাসান অন্যান্য আফগান শিশুর মতোই ঘুড়ি ওড়ানোতে দক্ষ ছিল। তাই তারা প্রতিযোগীতায় জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ও প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাদের ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবে অংশ নিল এবং আমির তাতে প্রথম হলো।
সেসময়ের রীতি ছিলো, বিজয়ী ঘুড়িটিকে কুড়িয়ে এনে স্মারক হিসেবে বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা। হাসান ঘুড়ির গতিপথ না দেখেই ঘুড়ির পতনস্থল চিহ্নিত করতে ওস্তাদ ছিল। তাই সে বিজয়ী নীল ঘুড়িটিকে কুড়িয়ে আনতে রওনা দিলো। অনেক সময় পার হয়ে গেলেও হাসান ফিরে না আসায় চিন্তিত আমির তাকে খুঁজতে বের হলো। খুঁজতে গিয়ে সে হাসানকে আবিষ্কার করে এক গলিপথে এলাকার বদমাশ ছেলেদের হাতে জঘন্য বুলিংয়ের শিকার হতে।
কিন্তু আমির ভয়ে সেদিন হাসানের পাশে দাঁড়ালো না । ঘুড়ি প্রতিযোগিতা হয়তো বাবার সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন হ্রাস করেছিল, হয়তো সে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের বাহবা কুড়িয়েছিল, কিন্তু সেদিন হাসানের পাশে না দাঁড়ানোর তীব্র অপরাধবোধ তাকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করছিলো। হাসানকে দেখলেই তা আরো তীব্রভাবে তাকে দংশন করতো। এটা সহ্য করতে না পেরে আমির হাসান ও তার বাবাকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো।
এক বৃষ্টিভেজা দিনে হাসান ও আলী যখন তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো, তখন তার বাবার তীব্র কষ্ট ও তাদের ফেরাবার আকুতি তার অপরাধবোধকে বাড়িয়ে দিলেও সে নিশ্চুপ থেকে আরেকটি অপরাধ করলো। অপরাধবোধে জর্জরিত আমিরের দিনগুলো হয়তো অনুশোচনার তাড়া খেয়েই কেটে যেতো। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণে আফগানিস্তান তখন মৃত্যপুরীতে পরিণত হয়েছে। তাই আমির ও তার বাবা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেল আমেরিকায়। আমেরিকায় নতুন জীবন শুরু হয় আমিরের। আমির একজন সফল লেখক হয়ে ওঠে ও প্রিয় রমনীর ভালোবাসা অর্জন করে। কিন্তু পুরনো পাপের অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াত, তাই সে খুঁজতে থাকে এ থেকে মুক্তির উপায়।
২০০১ সালে তার বাবার পুরনো বন্ধু রহিম খান পাকিস্তান থেকে ফোন করে তাকে বলল, “ভালো হওয়ার আরেকটা সুযোগ আছে।” সেই সুযোগটিই লুফে নিতে আমির ছুটল পাকিস্তানে। সেখানে রহিম খানের কাছে সে শুনলো অবিশ্বাস্য এক সত্য ঘটনার কথা, যার মাধ্যমে সে নতুনভাবে আবিষ্কার করল তার শৈশবকে। আবিষ্কার করলো তার বাবার অদ্ভুত আচরণের রহস্য এবং হাসানের সাথে তার প্রকৃত সম্পর্ক। তারপর সে কলুষিত অতীতকে মুছে দিতে এক ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশ নিতে যাত্রা করে আফগানিস্তানে। অবশেষে আমির কি পেরেছিলো তার জীবনজুড়ে বয়ে বেড়ানো অপরাধবোধের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে? আর কি হাসানের সাথে দেখা হয়েছিলো তার?
জানতে হলে পড়তে হবে বইটি। ‘দ্য কাইট রানার’ উপন্যাসে উঠে এসেছে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিন দশকের আফগানিস্তানের চিত্র।
এখানে যেমন আপনি পাবেন শিশুদের নিষ্পাপ শৈশব উপহার দেয়া নিরাপদ আফগানিস্তান, তেমনি পাবেন রাশিয়া- আফগানিস্তান যু্দ্ধের সময়ের বিভীষিকাময় আফগানিস্তান। তালিবান অধ্যুষিত আফগানিস্তানের চিত্রও এখানে ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। বইটিতে নানা রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জির বিপরীতে ব্যক্তিগত জীবনের গল্প বলেছেন লেখক। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। প্রকাশের পরে এটি পাঠক ও সমালোচকমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়, প্রকাশিত হয় তিন ডজন দেশে। সারাবিশ্বে জনপ্রিয়তা পেলেও খোদ আফগানিস্তানের পাঠকরাই বইটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। তবে এখানে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে যে মর্মভেদী ও নিরীক্ষাধর্মী বর্ণনা উঠে এসেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
হোসাইনির এই সাহিত্যকর্মটি একইসাথে অতীতে বিস্মৃত এমন একটি জাতির বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক জীবনকে তুলে ধরেছে, যা কি না বর্তমান সময়ের বিশ্বরাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বইটিতে লেখক আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পশতু সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘিষ্ঠ হাজারা সম্প্রদায়ের মধ্যকার জাতিগত বৈষম্যকেও চিত্রিত করেছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আমির, তার বাবা ও তার বাবার বন্ধুরা পশতু, অভিজাত আফগান। অন্যদিকে, আমিরদের বাড়ির ভৃত্য আলী ও তার ছেলে হাসান হাজারা। আমির বড়লোক বাবার সুবিধাপুষ্ট ছেলে, যে দামী স্কুলে পড়ে। অন্যদিকে, হাসান ছোট্ট কুটিরে বাস করা অশিক্ষিত, সুবিধাবঞ্চিত শিশু। আমির হাসানের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাকে ছোট করে, তাকে শাহানামা পড়ে শোনানোর সময় ভুল শোনায়, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।
বইটিতে রয়েছে শৈশবের অবিচ্ছেদ্য অংশ- খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি, দুষ্টুমি, বন্ধুত্ব থেকে বুলিংয়ের শিকার হওয়া। রয়েছে আপনজনের প্রতি বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা। গল্পের আড়ালে বইটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। লেখক বইটিতে দেখিয়েছেন কীভাবে আমাদের ছোটবেলার ভুলগুলো পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে। সবমিলিয়ে ‘দ্য কাইট রানার’ একইসাথে বন্ধুত্ব, বিশ্বস্ততা, বিশ্বাসঘাতকতা, ভালোবাসা, সহিংসতা, অপরাধবোধ, মুক্তি এবং টিকে থাকার গল্প। বইটি আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও এর মূল গল্পটি সার্বজনীন, যা যেকোনো দেশ, জাতি বা সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বইটি পড়ে আপনি প্রধান চরিত্র আমিরের প্রতি সহানুভূতি অনুভব করবেন, তার কষ্টে কষ্ট পাবেন, তার কুকর্মে রাগান্বিত হবেন।
এটি খালেদ হোসাইনির প্রথম উপন্যাস হলেও তিনি বইটির চরিত্রচিত্রণ ও কাহিনী বর্ণনায় চমৎকার মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। হোসাইনির গল্পকথন সহজ ও সাবলীল হলেও তা যথেষ্ট শক্তিশালী। বইটির কাহিনীসূত্র যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে গল্পকথনের ভঙ্গিটাও দারুণ। বইয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে প্রধান চরিত্র আমিরের জবানীতে, উত্তম পুরুষে।
২০০৭ সালে উপন্যাসটি অবলম্বনে হলিউডে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। একই নামের এই চলচিত্রটি পরিচালনা করেন মার্ক ফর্স্টার।
খালেদ হোসাইনি জন্মগ্রহণ করেন আফগানিস্তানের কাবুলে। তার বাবা ছিলেন আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কুটনীতিক, আর মা হাই স্কুলের ফার্সি ভাষার শিক্ষিকা। আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে হোসাইনির পরিবার আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। পরে হোসাইনি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। তিনি সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৮৮ সালে বায়োলজিতে ডিগ্রী নেন। পরের বছর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো স্কুল অব মেডিসিন থেকে ১৯৯৩ সালে ডিগ্রী নেন। ১০ বছর চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার পর তিনি চিকিৎসাপেশা থেকে অবসর নেন এবং পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ২০০১ সালে তিনি ‘দ্য কাইট রানার’ লেখা শুরু করেন এবং ২০০৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়। তার তিনটি বই আন্তর্জাতিক বেস্টসেলারের মর্যাদা পেয়েছে- দ্য কাইট রানার, অ্যা থাউজেন্ড স্প্লেনডিড সান এবং দ্য মাউন্টেন ইকোড। তিনি বর্তমানে পরিবারের সাথে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছেন।