যাকে ‘ভারতের লৌহমানব’ বা ‘দ্য আয়রনম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলে ডাকা হয়, যার জন্মদিবস পুরো ভারতে ‘রাষ্ট্রীয় একতা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়, গান্ধীজীর একটি আদেশে যিনি অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তিনি ভারতের সর্বকালের অন্যতম মহান রাজনীতিবিদ সর্দার বল্লভভাই জাভেরভাই প্যাটেল। সংক্ষেপে সর্দার প্যাটেল। ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পরাধীন ভারতে গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত কুর্মী পরিবারে বল্লভভাই প্যাটেল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জাভেরভাই প্যাটেল ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের সেনাবাহিনীতে কিছুদিন সার্ভিস দিয়েছিলেন এবং মা লাডবাঈ ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক তপস্বিনী মহিলা। বাবা-মায়ের সূত্রেই বল্লভভাই প্যাটেল অধিকারী হয়েছিলেন একটি প্রগাঢ়, শীতল এবং আপোষহীন ব্যক্তিত্বের।
বাড়িতেই শুরু হয় তার প্রাথমিক শিক্ষা। গুজরাটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেখানে পড়ার সময় ১৮৯১ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে জাভেরবেন নাম্নী এক মেয়ের সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের প্রায় ছয় বছর পরে বল্লভভাই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১১-তে প্রিয়পত্নী জাভেরবেন প্যাটেল পঞ্চবর্ষীয় কন্যা মনিবেণ এবং ত্রিবর্ষীয় পুত্র দয়াভাইকে রেখে দেহত্যাগ করলে বল্লভভাই প্যাটেল মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়েন।
ছত্রিশ বছর বয়সে তিনি ইংল্যান্ড গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বেন বলে মনস্থির করেন। ইংল্যান্ডের মিডল টেম্পলে ৩৬ মাসের ব্যারিস্টারির পড়া ৩০ মাসে শেষ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। দেশে ফিরে গুজরাটের গোধরায় ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। উকিল হিসেবে ব্যাপক সুনাম কুড়ান। ব্রিটিশ সরকার তাকে বিচার বিভাগীয় উচ্চতর পদে নিয়োগের প্রস্তাব করলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। যে ব্রিটিশদের হাতে পুরো ভারত ছিল পরাধীন তাদের অধীনে চাকরিবৃত্তি বল্লভভাইয়ের মনঃপুত হয়নি।
গান্ধীবাদী হওয়ার আগে আদতে বল্লভভাই গান্ধীজীর অহিংস নীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯১৭ সালটি বল্লভভাইয়ের জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরই তিনি আহমেদাবাদে স্যানিটেশন কমিশনার পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। রাজনীতিতে তার একদম আগ্রহ ছিল না। গান্ধীজীর এক সভায় তার স্বাধীনতা আন্দোলনের পদ্ধতির উপহাস করে বল্লভভাই তার বন্ধু বিখ্যাত উকিল গণেশ বাসুদেব মাভলানকারকে বলেছিলেন, “গান্ধীজীর কথায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা আর চাল থেকে কাঁকর বাছা একই কথা!”
একই বছর অক্টোবরে আরেকটি সভায় গোধরায় গান্ধীজীর সাথে বল্লভভাইয়ের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। গান্ধীজীর আচরণ ও দর্শনে প্যাটেল মুগ্ধ হন। তিনি গান্ধীজীর স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন। ইংরেজি বেশ-ভূষা ছেড়ে খাদি পরা শুরু করেন। গান্ধীজীর অনুরোধে প্যাটেল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং গুজরাট কংগ্রেসের সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন। পরের বছর গুজরাটের কায়রায় ভয়াবহ বন্যায় কৃষকগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রিটিশ সরকার বন্যার বিষয়টি মাথায় না নিয়েই কায়রার কৃষকদের ওপর করারোপ করে। কৃষকরা ‘কর দেব না’ আন্দোলন শুরু করলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে।
ব্রিটিশ সরকার কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়া শুরু করলে বল্লভভাই ছুটে যান কায়রায়। কায়রার কৃষকদের সংগঠিত করে বিশাল ‘কর শুল্ক অভিযান’ পরিচালনা করেন। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরাজ নত হয় এবং কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া শুরু করে। কায়রার কৃষকরা বল্লভভাইকে ‘সর্দার’ (যার অর্থ নেতা) উপাধি প্রদান করে।
তার বছর পাঁচেক পরে ১৯২৩ সালে গান্ধীজী ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে সর্দার প্যাটেল সে আন্দোলনেও সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেন। দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও লালনের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েন। গান্ধীজীর নির্দেশে এ সময় তিনি পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করে কংগ্রেসের পক্ষে প্রায় তিন লাখ সদস্য এবং প্রায় পনের লক্ষ টাকা দলের তহবিলে সংগ্রহ করেন। গান্ধীজী জেলে যাওয়ার পরে তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। বারদোলির কৃষকরা সরকার কর্তৃক কর বৃদ্ধির ফাঁদে পড়লে আবারও সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায় কংগ্রেস এবং সর্দার প্যাটেল। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল।
তারপর গান্দীজীর ডাকে সর্দার ‘লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে’ যোগদান করেছিলেন। ফলতঃ গান্ধীজীর সাথে তাকেও কারাবরণ করতে হয়। পরের বছর ১৯৩১ সালে গান্ধীজীর সাথে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যেটি ইতিহাসে ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি’ নামে খ্যাত। সেই চুক্তির একটি শর্ত ছিল গান্ধীজী তার অনুসারীদের আন্দোলন থামাতে বলবেন এবং সরকার সকল রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেবে। চুক্তির আওতায় সর্দার প্যাটেলসহ অনেক রাজবন্দী মুক্তি পেয়েছিলেন।
১৯৩১ সালেই সর্দার প্যাটেল করাচিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসের পক্ষে ভারতজুড়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন যদিও নিজে কোনো আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। সভাপতি হওয়ার পরে অনেক বিষয়েই কংগ্রেসের আধিকারিকদের সাথে তার মতপার্থক্য দেখা দিতে থাকে। অনেকের ওপর তিনি বিরক্ত হতেন। কংগ্রেসের রাজনৈতিক আদর্শে সমাজতন্ত্র ঢুকানো হলে তিনি জওহরলাল নেহেরু ওপর যারপরনাই বিরক্ত হন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে গান্ধীজীর মতভেদ এবং মনোমালিন্য হলে প্যাটেল তাকে ‘ক্ষমতালোভী’ আখ্যা দিয়েছিলেন এবং এর ফলে যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছিলেন।
সর্দার প্যাটেল কোনোদিনও রাজনীতিতে গান্ধীজীর মতের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি। কংগ্রেসে গান্ধীবিরোধী জিগির উঠলে তিনি তা বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিহত করতেন। ১৯৪২ এ গান্ধীজী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’ শুরু করেন। সর্দার প্যাটেল ভারত ছাড় আন্দোলনেও আপাদমস্তক গান্ধীজীকে সমর্থন করেন। প্যাটেলসহ কংগ্রেসের কয়েকজন বড় বড় নেতৃবৃন্দকে এ সময় গ্রেফতার করা হয়। তিন বছর কারাভোগের পরে ১৯৪৫ সালে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন।
সর্দার প্যাটেল দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একমাত্র দেশ ভাগই হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে শান্ত করতে পারবে এবং দেশ ভাগ না করে একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করলে সেটি হবে দুর্বল এবং এর ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা একসময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। গান্ধীজীকেও তিনি দেশ ভাগের ব্যাপারে বোঝানো শুরু করেন। হিন্দু-মুসলিম প্রতিনিধিদলের সমন্বয়ে গঠিত পার্টিশন কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন সর্দার প্যাটেল।
১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচন করা হয়। এ বিষয়টি নিশ্চিত ছিল যে যিনি হবেন কংগ্রেসের সভাপতি তিনিই হবেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। প্রত্যেকটি প্রদেশের কংগ্রেস সভাপতিদের একটি করে ভোট ছিল। মোট পনেরটি ভোটের মধ্যে সর্দার প্যাটেল তেরটি ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও গান্ধীজীর অনুরোধে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদটি ছেড়ে দেন।
যুগে যুগে এটি নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হলেও বল্লভভাই কোনোদিনও এ বিষয়ে কোনোপ্রকার আফসোস করেননি। কেউ কেউ ধারণা করেন, গান্ধীজী মনে করতেন– সর্দার খানিকটা রক্ষণশীল এবং নেহেরু কিছুটা উদারপন্থী; আর, একটি নবসৃষ্ট দেশকে সুসংগঠিত করার জন্যে নেহেরু অধিক যোগ্য। তাই, তিনি সর্দারকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের অনুরোধ করেছিলেন। অনেক সমালোচক প্যাটেলকে একজন সাম্প্রদায়িক এবং হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে দেখেন। কিন্তু তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে সর্দার এমন একটি কথা বলেননি বা একটি পদক্ষেপ নেননি যাতে প্রমাণ হয় তিনি হিন্দুত্ববাদের সমর্থক। বরং গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) নিষিদ্ধ করেন।
যে কারণে প্যাটেলকে লৌহমানব বা আপোষহীন নেতা বলা হয় সেটি হচ্ছে দেশীয় করোদ রাজ্য বা প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে ভারতের সাথে সংযুক্তিকরণ। দেশীয় জমিদার বা রাজা যারা ইংরেজদের কর প্রদান করে নিজেদের মতো করে স্ব স্ব রাজ্য বা জমিদারির অন্তর্ভুক্ত এলাকা শাসন করত সেই এলাকাগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট। ‘দ্য ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট, ১৯৪৭’ এর আওতায় ইংরেজ সরকার প্রিন্সলি স্টেটের রাজা বা জমিদারদের সামনে দুটো রাস্তা খোলা রাখেন। হয় ভারত বা পাকিস্তানের সাথে জুড়ে যাওয়া, নয়তো স্বাধীন থাকা।
সিংহভাগ প্রিন্সলি স্টেটের রাজাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ভি পি মেনন এবং সর্দার প্যাটেল তাদের ভারতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে রাজি করালেও সমস্যার সৃষ্টি হয় জুনাগড়, হায়দরাবাদ, জম্মু ও কাশ্মীর ও ভোপালকে নিয়ে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক ছলনা ও কূটনীতির দ্বারা এ রাজ্যগুলোকেও ভারতের অন্তর্গত করেছিলেন সর্দার প্যাটেল। জম্মু ও কাশ্মীর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রবেশ করিয়ে পুরোটা দখল করা নিয়ে নেহেরুর সাথে প্যাটেলের বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছিল। এভাবে, সর্দার প্যাটেল ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা করেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) ও ভারতীয় পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস) গঠন ও সংস্কারে সর্দার প্যাটেলের অবদান অনস্বীকার্য। দেশপ্রেমিক প্যাটেলের সাথে গান্ধীজীর সম্পর্ক ছিল মধুর। গুরুগম্ভীর রূপের আড়ালে সর্দার প্যাটেলের ছিল আরেকটি রঙ্গ-রসিকতাপূর্ণ রূপ। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসের পনের তারিখ সর্দার প্যাটেল দিল্লীর বিড়লা হাউসে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর।
১৯৯১ সালে সর্দার প্যাটেলকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক মরণোত্তর ভারতরত্ন প্রদান করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। দু’বছর বাদে বলিউডে সর্দার প্যাটেলের জীবনীর আলোকে কেতন মেহতা ‘সর্দার’ নামে সিনেমা নির্মাণ করেন যেখানে পরেশ রাওয়াল মুখ্য চরিত্র সর্দার প্যাটেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করার পরে প্যাটেলের জন্মদিনকে ‘রাষ্ট্রীয় একতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। গুজরাটের নর্মদা জেলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সর্দার প্যাটেলের প্রায় ১৮২ মিটার উঁচু প্রতিকৃতি– দ্য স্ট্যাচু অফ ইউনিটি যেটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য।