বাজারে এখন প্রক্রিয়াজাত খাবারের ছড়াছড়ি। পনির, সিরিয়াল, চিপস, রোল, সালামি, সসেজ, কেক এরকম অসংখ্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমরা প্রতিদিন কিছু না কিছু পরিমাণে খেয়ে থাকছি। সম্প্রতি এসব খাবারের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। চিকিৎসক, গবেষক, পুষ্টিবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নানামুখী আলোচনায় একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, অতি গ্রহণের ফলে এসব খাবার দীর্ঘমেয়াদে শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে- খাবার যে প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে এই ধারণার উদ্ভব কবে, কোথায়, এবং কেন? ঠিক কীভাবে মানবজাতি খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠল? খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণ মানুষের মানুষ হিসেবে বিবর্তনকে কতটা বদলে দিল? প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কি সত্যিই পুরোপুরিভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর? এসব বিষয়ের আলোচনা নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
মানুষের (বিবর্তনের ধারায় টিকে থাকা, সবচেয়ে আধুনিক, এবং বর্তমানে বেঁচে আছে যারা অর্থাৎ আমরা) দ্বিপদ নাম Homo sapiens। হোমিনিন (Hominin) বলতে আধুনিক মনুষ্যজাতির সামষ্টিক রূপ বোঝানো হয়। Homo habilis (হোমিনিন গ্রুপের সদস্য) পৃথিবীতে টিকে ছিল ২.৪ মিলিয়ন থেকে ১.৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে। পৃথিবীর বুকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের ধারণা তাদের চিন্তাতেই প্রথম এসেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
পূর্বপুরুষদের তুলনায় হাবিলিসদের দাঁতের আকার ছিল বেশ ছোট। গবেষণা বলছে, বিবর্তনের ধারা একটি প্রজাতির দাঁত ছোট হয়ে যাওয়াকে শুধু তখনই অনুমোদন দেয়, যখন তার মুখগহ্বরে পৌঁছানোর পূর্বেই খাদ্যের কোনো রকম পরিবর্তন হয়ে থাকে। অর্থাৎ খাদ্যবস্তু হিসেবে ঠিক যা কিছু গ্রহণ করছিল তাতেই একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল। দু’একটা উদাহরণ দিলে ব্যপারটা বোধগম্য হতে পারে।
খাদ্যবস্তুতে আনীত সম্ভাব্য পরিবর্তনগুলোর মাঝে একটি হতে পারে গাছের শিকড় সরাসরি ভক্ষণের বদলে বরং মুখে পুরে দেওয়ার আগে কোনো পাথর দিয়ে বেশ করে থেঁতলে নেওয়া। আরেকটি উদাহরণ হতে পারে মাংস খাওয়ার আগে ছোট ছোট টুকরো করে নেওয়া। খাওয়ার আগে খাদ্যদ্রব্যে এসব পরিবর্তন আপাতদৃষ্টিতে সূক্ষ্ম হলেও এসবের প্রভাব ছিল বেশ সুদূরপ্রসারী- খাবার চিবানোর প্রবণতা ৫% কমে যাওয়া! চর্বণযন্ত্রের উপর চাপ হ্রাস পাওয়াতে শরীর তখন গাল, চোয়ালের পেশী, দাঁতের পেছনে পূর্বে ব্যয়কৃত শক্তিটুকু ভিন্ন খাতে চালনা করা শুরু করল। ফলশ্রুতিতে হাবিলিসদের মাথার খুলির তুলনায় মুখের আকার ছোট হয়ে গেল।
হাবিলিসদের পাশাপাশি ইরেক্টাস (Homo erectus; ১.৮৯ মিলিয়ন বছর-১০৮,০০০ বছর) এবং নিয়ান্ডার্থালেন্সিসদের (Homo neanderthalensis; ৪০০,০০০-৪০,০০০ বছর) ক্ষেত্রে খুলির আকারের অনুপাতে মুখের আকার ছিল অনুমিত সীমা থেকে যথেষ্টই ছোট। বিবর্তন এই ধরনের আকস্মিক পরিবর্তনকে (দাঁতের আকারের অপ্রত্যাশিত বদলে যাওয়া) মঞ্জুর করেছিল তার একটিই ব্যাখ্যা- সেই প্রজাতির জন্য খাবার চিবানোর কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে এসেছিল। আর খাবার চিবানোর সহজতম পন্থা হলো খাবারকে কোনো ধরনের তাপীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা।
খাবার চিবানোর ক্ষেত্রে দাঁতের ভূমিকা তুলনামূলক কমে যাওয়ায় মানুষের শরীরের চেয়ে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগল। খাবার চিবানোতে আগে মুখ সামগ্রিকভাবে যে পরিমাণ অংশগ্রহণ করত, এই পরিবর্তনের দরুন সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মুখের ভাষা জটিল থেকে জটিলতর করে তুলতে। ধীরে ধীরে মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মৌখিক ভাষা ও মুখভঙ্গির উন্নয়ন ঘটতে শুরু করল।
খাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি ছিল খাবারের দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ। প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমানে আমরা খাবারকে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রাতেও (শূন্যের ১৫০ ডিগ্রী কিংবা তার চেয়েও নিম্ন তাপমাত্রা) সংরক্ষণ করতে পারি।
নেপোলিয়নের যুদ্ধে সৈন্য যখন যুদ্ধের চেয়ে বরং অপুষ্টিতে ভুগে মারা যেতে লাগল, তখন তারা বিকল্পের খোঁজ শুরু করল। এভাবেই মূলত ক্যানে খাবার সংরক্ষণের পথে মানবজাতির যাত্রা শুরু। ১৯১২ সালে এক অভুতপূর্ব ঘটনা ঘটল। যুক্তরাজ্যে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল মধ্যবিত্ত পরিবারে কর্মরত গৃহপরিচারিকাদের জন্য প্রতি সপ্তাহে অন্তত অর্ধবেলা ছুটি বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হলো। আইন করে এই ব্যাপার প্রতিষ্ঠা লাভ করা গৃহপরিচারিকাদের জন্য অত্যন্ত মানবিক হলেও দারুণ বিপাকে পড়লেন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীরা। তারা হুট করে আবিষ্কার করলেন যে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন রাতের খাবার তৈরির কাজ তাদেরই করতে হবে। ধারণা করা হয়, তৈরিকৃত খাবার (ready meal) উদ্ভাবনের পথে এটাই সবচেয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন থেকে টিনের সরবরাহ কমে গেলে ক্যান করা খাবারের বাজারে ধস নামে। প্রকৃতপক্ষে, টিনের অপর্যাপ্ততাই পরবর্তীতে হিমায়িত খাবারের জনপ্রিয়তার পেছনে ভূমিকা রাখে। ১৯৮০’র দশকে খাবারের নিদারুন অপচয় ক্যালিফোর্নিয়ার একজন কৃষককে উদ্বুদ্ধ করে উদ্ভাবনের প্রতি। প্রতি বছর প্রায় ৩৬০ টনেরও বেশি গাজরের অপচয় দেখতে দেখতে ক্লান্ত-শ্রান্ত সেই কৃষক বিরক্ত হয়ে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি কর্তন যন্ত্র নিয়ে এসে গাজর কেটে দু’ইঞ্চির টুকরো হিসেবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করা শুরু করলেন। মজা করে পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা এই ঘটনাকে আখ্যা দেন ক্ষুদ্র গাজর বিপ্লব (mini carrot revolution)। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলাফল? যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গাজর খাওয়ার প্রবণতা ৩৩% বেড়ে যাওয়া।
মানুষের খাদ্য তালিকায় পনির একটি অতি পরিচিত নাম। পনিরের ইতিহাস ১০,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। তবে তখনকার পনির আর হাল আমলের পনিরের মাঝে আসমান-জমিন ফারাক। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর প্রথম পনির তৈরি হয় দুর্ঘটনাবশত। কোনো প্রাণির পাকস্থলী দিয়ে তৈরিকৃত একটি থলেতে দুধ পরিবহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পুরনো হয়ে যাওয়া থলেতে পাকস্থলীর বিভিন্ন উৎসেচকের যে অবশিষ্টাংশ ছিল, তারই প্রভাবে সামান্য উষ্ণ তাপমাত্রায় দুধ ছানা হয়ে জমে গিয়েছিল। অনেক ইতিহাসবেত্তার মতে, অতি দুঃসাহসী কেউ সদ্য জবাই করা প্রাণির পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত রস দুধের পাত্রে যোগ করে দেওয়ায় সেখান থেকেই সন্ধান মেলে পনিরের।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ৭০০ রকমের পনির তৈরি হয়ে থাকে। মোজারেলা, কটেজ, পারমিসান ইত্যাদির পাশাপাশি হিমালয়াঞ্চলের ইয়াকের দুধ থেকে এমন একরকমের পনিরও পাওয়া যায় যা ঠিকঠাকভাবে সংরক্ষণ করলে ২০ বছর পর্যন্ত বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। তবে প্রযুক্তির বদৌলতে সবকিছুর শিল্পায়ন ঘটায় শুরুর দিকে খামারবাড়ির পনিরের যে আদি ও অকৃত্রিম স্বাদ ও মৌলিকত্ব বজায় ছিল, সেটি এখন আর নেই। নানা খামারের গাভীর দুধ একই ছাদের তলায় এসে পনির হয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন খামারবাড়ির পনিরের স্বাদ, গন্ধ, বর্ণে যে সূক্ষ্ম তারতম্যের ছোঁয়া থাকত সেটি এখন সম্পূর্ণভাবে বিলীন। বর্তমানে দীর্ঘ ভ্রমণ, যুদ্ধ, বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্ন কিংবা নৈশভোজ, ঘরোয়া নাস্তা হেন কোনো সময়, পরিস্থিতি, খাদ্য তালিকা নেই যেখানে পনির জায়গা করে নেয়নি। পনিরের এই সহজলভ্যতার পেছনে দায়ী দুধের প্রক্রিয়াজাতকরণ।
অধুনা মানবজাতি হিসেবে আমরা যা, তার পেছনে প্রক্রিয়াজাত খাবারের ভূমিকা অসামান্য। আমাদের অফুরন্ত অবসর, চটজলদি খাবার খেয়ে ফেলতে পারা, যেখানে সেখানে পছন্দের প্রস্তুতকৃত খাবার নিয়ে যেতে পারা, পুষ্টি ঘাটতি পূরণ- এসবের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।