কমেন্টারি ম্যাগাজিনের ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের সংখ্যায় তাকে অভিহিত করা হয় ‘প্রফেসর অভ টেরর’ বা জঙ্গিবাদের অধ্যাপক নামে, যদিও তিনি ছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক। নিবন্ধটিতে বলা হয় যে তিনি ইয়াসির আরাফাতের অত্যন্ত আস্থাভাজন এক ব্যক্তি।
ফেডারেল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশন তাকে নিয়ে ২৩৮ পৃষ্ঠার এক সুদীর্ঘ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে তার নাম লেখা হয় এডুয়ার্ডো সাঈদ। কে জানে, হয়তো এফবিআই ভেবেছিল চরমপন্থী মাত্রই নামের মাঝে কিছুটা ল্যাটিন গন্ধ থাকতে হবে! প্রখ্যাত সাহিত্যিক ভি এস নাইপল তাকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন,
“একজন মিশরীয় যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে হারিয়ে গেছেন কিংবা সর্বত্র বিরাজমান!”
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইয়ের রচয়িতাও তিনি। সেই বইয়ের ভূমিকায় নিজেই প্রশ্ন রেখেছেন, “একজন মানুষ সত্যিই কে?”
বলছিলাম এডওয়ার্ড সাঈদের কথা। নানা কাজের মাঝে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত বই ‘ওরিয়েন্টালিজম’ যাকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। প্রশ্নটা বরং হওয়া উচিত ছিল, সাঈদ কী ছিলেন না? ধ্রুপদী পিয়ানোবাদক, সাহিত্য সমালোচক, সংগীতজ্ঞ, তাত্ত্বিক ইত্যাদি নানাবিধ পরিচয়ের পাশাপাশি সচেতন বিশ্ববাসীর কাছে তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয়- তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে সর্বাপেক্ষা উচ্চকণ্ঠ।
১৯৩৫ সালে পশ্চিম জেরুসালেমে এডওয়ার্ড সাঈদের জন্ম। শৈশবের কিছুটা অংশ কেটেছিল ধাত্রীর সান্নিধ্যে। তার কাছ থেকেই তিনি আরবি ও হিব্রু ভাষার প্রথম পাঠ লাভ করেন। বাবা ছিলেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। তার পরিবারটি ছিল এপিস্কোপালিয়ান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ক্যাথলিকরা কেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী এবং এর সূত্র ধরেই তারা পোপকে মান্য গণ্য করেন। অন্যদিকে এপিস্কোপালিয়ানরা পোপের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেন না, বরং তারা বিশপের অভিভাবকত্বকে মেনে নেন। দীর্ঘকাল যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার কারণে সাঈদের বাবার মাঝে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি একধরনের পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব গড়ে উঠেছিল। সেই মনোভাবের হাত ধরেই তিনি যখন দেখলেন যে সন্তান সাঈদের ত্বকের রঙ হয়েছে ফর্সা। এতে তিনি পেয়েছিলেন অপার আনন্দ। ছেলের গায়ের রঙের প্রশংসা করেই তিনি প্রিন্স অভ ওয়েলসের নামানুসারে তার নাম রাখেন এডওয়ার্ড সাঈদ।
দ্বন্দ্ব সাঈদের জীবনের শুরু থেকেই তার নাছোড়বান্দা সাথী। নির্বাসন কিংবা দেশান্তরী হওয়ার যে অভিজ্ঞতা, সেটি সবার জন্যই কমবেশি তিক্ততার; সাঈদও তার ব্যতিক্রম নন। জন্মসূত্রে তিনি একজন ফিলিস্তিনি। অথচ ছোট্ট সেই শিশু সাঈদ থেকে একজন কিংবদন্তি সাহিত্য সমালোচক হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটির একাধিক বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় তার সাঈদ হয়ে উঠার পেছনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। সেই যুক্তরাষ্ট্রই যে ইসরায়েলের মিত্ররাষ্ট্র, সেকথা কারোই অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই তিনি হয়ে উঠেছেন একজন চমৎকার চিন্তক, বুদ্ধিজীবী। এমনকি ফিলিস্তিনের সাথে দশকের পর দশক যাবত চলে আসা অন্যায়ের প্রতিও তিনি ছিলেন সোচ্চার। বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার আত্মসচেতনতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক এবং বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কজন উপনিবেশবিরোধী চিন্তকদের মাঝে সাঈদ ছিলেন অন্যতম। তিনি কলম ধরেছিলেন উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এবং উপনিবেশ স্থাপনকারী রাষ্ট্রগুলোর সমালোচনায় ছিলেন সদা মুখর। অথচ একজন পাঠক হিসেবে তিনি যেসব বই পড়েছেন, তার সিংহভাগই ছিল উপনিবেশ স্থাপনকারীদের লেখা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনড় অবিচল, স্বাধীনতার অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি কোনো ধরনের ‘কিন্তু’, ‘যদি’, ‘তবে’- এসবের ধার ধারেননি। তবে তিনি লিখেছেন ইংরেজি ভাষায় এবং প্রধানত ইংরেজিভাষী পাঠকদের জন্য। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“আমিই পৃথিবীর সর্বশেষ ইহুদি বুদ্ধিজীবী। আর একজনকেও আপনারা কেউ দেখাতে পারবেন না, যিনি ইহুদি অথচ বুদ্ধিজীবী। যাদেরকে আপনারা কিংবা এই বিশ্বব্যবস্থা ইহুদি চিন্তক, বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে, আদতে তারা প্রত্যেকেই একেকজন শহরতলীর জমিদার। ধরণীর বুকে বেঁচে থাকা হিম্মতওয়ালা শেষ ইহুদি বুদ্ধিজীবী আমি সাঈদ!”
‘ওরিয়েন্টালিজম’ সাঈদের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী কাজ। সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় সমালোচকের চিন্তার উদ্রেককারী এই বইটি মূলত সাঈদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ অবস্থানের মিশেল। এ বইয়ে সাঈদ ইতিহাসের একটি রূপরেখা বিনির্মাণের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বইটিতে উঠে এসেছে যে পৃথিবীর ইতিহাসে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। মূলত এই দুয়ের যৌথ প্রয়াসেই শাসনের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভবপর হয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলো প্রাচ্যের অধিবাসীদেরকে দেখে অত্যন্ত সংবেদনশীল, অলস, অত্যাচারী, নিপীড়ক হিসেবে। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই কতটা বাস্তবসম্মত, সেটি তর্কসাপেক্ষ।
সাঈদের দৃষ্টিতে ছড়ি ঘোরানোর কাজটি মূলত পাশ্চাত্যই করে এসেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্পর্কটি মূলত ক্ষমতার, যা কিনা শাসন, শোষণ, এবং আধিপত্য বিস্তারের এক অত্যন্ত জটিল ও সূক্ষ্ম শৃঙ্খলে জড়িয়ে আছে। পশ্চিমা দেশগুলো প্রকারান্তরে পূর্বের দেশগুলোর সাথে মোড়লের ন্যায় আচরণ করছে। সেটি উপনিবেশের ওপর উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশগুলোর আধিপত্যকে জোরদার করে। ফুকো, ফ্যানন, ক্লডে প্রভৃতি ফরাসি চিন্তকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত সাঈদ নিজে ছিলেন সেই বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম, যারা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাঙ্গনে দৃঢ়তার সাথে উপনিবেশবিরোধী চিন্তা ভাবনার স্ফুরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সাঈদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থা, বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণাকে গড়ে তোলার বদলে বরং বিদ্যমান নানা কিছুর মাঝে সুস্পষ্টভাবে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারদর্শী ছিলেন। যা সকলে বিশ্বাস করে, সেটি আদৌ বিশ্বাসের মর্যাদা পায় কিনা? যা আমাদের শেখানো হচ্ছে, সেটিই কি একমাত্র সত্য? যা প্রচার হচ্ছে, তার কতটা বাস্তব আর কতটা রঙ মাখানো? যা কিছুর প্রসার, তার বিপরীতে কোনো কিছুর তুমুল সংকোচন ঘটছে না তো? এসব প্রশ্ন তুলতে সাঈদের জুড়ি ছিল না। একজন খ্রিস্টান হয়েও ভিন্ন একটি ধর্মের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অভিজাত অধ্যাপকদের একজন ছিলেন, অথচ তথাকথিত দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সন্দেহাতীতভাবে একজন এডওয়ার্ড সাঈদ অধিকারবঞ্চিত ছিলেন না, অথচ তবুও তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাতারেই পড়েন। তিনি সম্পদশালী ছিলেন, তবে ক্ষমতাহীন ছিলেন। জীবনের সবটুকু জুড়ে দ্বন্দ্বমুখরতার এত তীব্র, স্পষ্ট উপস্থিতিই তাকে মানুষ হিসেবে অদ্ভুত এক সংবেদনশীলতায় ভাসিয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে তিনি নিউইয়র্ক শহরের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বদের মাঝে অন্যতম- যে শহরটিকে ইহুদিদের সাফল্য আর অর্জনে মোড়ানো সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না।
নিউইয়র্কের একজন অধিবাসী হিসেবে তিনি এই বর্ণাঢ্য জীবনযাত্রার সবটুকু সুখ উপভোগ করেছিলেন। তারপরও জায়োনিজম এবং এর পশ্চিমা সমর্থকদের কুৎসিত, জঘন্য বর্বরতার স্বীকার মানুষদের প্রতি তিনি চিরকাল সমব্যথী ছিলেন। জায়োনিজম প্রসঙ্গে সাঈদের অবস্থান একেবারেই পরিষ্কার ছিল।
সাঈদ নিজের বহুবিধ পরিচয় দিতে পারতেন। তবুও তিনি জীবনসায়াহ্নে এসে সেই পরিচয়ই বেছে নিয়েছিলেন, যা তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে সারাটা জীবনভর। নিজেকে তিনি পরিচয় দিয়েছিলেন একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন,
“নিষ্ঠুরতা, অন্যায়, অবিচার যেখানে ভীষণভাবে বর্তমান, সেখানে আশাহীনতা আত্মসমর্পণেরই নামান্তর। এহেন সমর্পণ আক্ষরিক অর্থে অনৈতিক বলেই আমি বিশ্বাস করি।”