থিয়েরে ড্যানিয়েল অঁরি। নামটা শোনার পরই আপনার মাথায় ভেসে উঠবে টাক মাথার এক ভদ্রলোক, যিনি কি না আর্সেনালের লাল অথবা বার্সেলোনার ব্লাউগানা জার্সিতে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে করে যাচ্ছন একের পর এক গোল। তাকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের একজন হিসেবে এবং প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ধরুন, আপনি একটা ক্যানভাস দেখছেন । সেটার প্রতিটি অংশে নতুন রঙের ছোয়া নতুন এক একটা আমেজ তৈরি করে। থিয়েরি অঁরিও ঠিক তেমনই। মাঠ যদি ক্যানভাস হয়, সেই ক্যানভাসে অঁরি শুধু ছবিই আঁকেননি, সেখানে নানা কারুকাজ করে সেই ক্যানভাসকে আরো রঙিন করে তুলেছেন।
তার কোনো সতীর্থ বল পায়ে আক্রমণে যাওয়ার সময় যখন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডাররা তাকে ঘিরে ধরতেন, দেখা যেত হঠাৎ করেই ভোজবাজির মতো অঁরি ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে গোল করার পজিশনে পৌঁছে গেছেন, সেটা তার গতি দিয়েই হোক কিংবা অফ দ্য বল মুভমেন্ট দিয়ে। তারপরের ঘটনাও খুব সংক্ষিপ্ত, সেখান থেকে বল জালে জড়িয়ে দেওয়া অঁরির জন্য খুব বেশি কঠিন কোনো কাজ ছিল না!
কিন্তু অঁরি কি স্রেফ একজন স্কোরার? তার সময়কার ফুটবলারদের মধ্যে সেরা গোল সৃষ্টিকারীদেরও একজন ছিলেন। একজন স্ট্রাইকার হয়েও তিনি যেমন গোল করেছেন, তেমনি সমানভাবে সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোর ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন পটু। তার এই বৈশিষ্ট্যই তাকে অন্যান্য প্রথাগত ফুটবলারদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।
এজন্যই হয়তো অঁরির সতীর্থ সাবেক ইংলিশ গোলকিপার ডেভিড সিম্যান বলেছিলেন,
“থিয়েরির মতো ফুটবলার সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? সে ছিল অসাধারণ, এককথায় বিষ্ময়কর! ট্রেনিংয়ে সে ছিল সতীর্থদের চেয়ে উজ্জ্বল, তার কাজটা সবচেয়ে ভালোভাবে করত। আমি মার্টিন কেউন, টনি অ্যাডামস, সোল ক্যাম্পবেল এবং স্টিভ বোল্ডকে তাকে বাজেভাবে ট্যাকল করতে দেখেছি, কিন্তু সে সাথে সাথে উঠেই তাদের যথাযথ জবাব দিতো নিজের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে। একজন নিখুঁত ক্রীড়াবিদ ছিল। ডিফেন্স থেকে সোজা আক্রমণ পর্যন্ত খেলা পরিবর্তন করতে পারত। যখন যুবক বয়সে দলে আসে, তখন নিজেকে খুব দ্রুত বদলে ফেলেছিল। আপনি তার ক্ষিপ্রতা এবং গতি দেখতে পারেন, কিন্তু ফিনিশিংয়ের দিকে তার ফোকাস তাকে স্পেশাল করে তুলেছিল। সে ছিল রোলস-রয়েসের মতো, যে কি না যেকোনো সময় তার ‘অ্যাক্সিলারেটর’ প্যাডেলটি চালু করতে পারে।”
থিয়েরি অঁরি ১৯৭৭ সালের ১৭ আগষ্ট প্যারিসের ‘লেস উলিস’ শহরতলিতে জন্মগ্রহন করেন। ফুটবলের প্রতি তার বাবার ভালোবাসা তরুণ অঁরিকে ফুটবলের প্রতি এত বেশি আকৃষ্ট করে যে তার ফুটবল খেলার জীবনের প্রথম স্মৃতি তার বাবার হাত ধরেই শুরু হয়। বাবার সাথে সেই ছোট ছোট খেলার মুহূর্তগুলো তাকে খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য বারবার অনুপ্রেরণা যোগায়।
অঁরির শৈশবের বেশিরভাগ সময় স্থানীয় ফুটবল ক্লাব যেমন সিও লেস উলিস, ইউএস প্যালাইসেউ এবং পরবর্তীতে ভ্যারি-চ্যাটিলনে ফুটবল খেলে কেটেছিল। অঁরি তার প্রতিভার জানান দিতে খুব বেশি সময় নেননি, তাই খুব দ্রুতই ফ্রান্সের প্রথম সারির ক্লাবগুলোর নজর পড়তে শুরু করে তরুণ এই ফুটবলারের দিকে।
তিনি তার ক্যারিয়ারে প্রথম বড় সুযোগ পেয়েছিলেন মোনাকোর আর্নল্ড ক্যাটালানোর মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে মোনাকো তাদের স্কাউট প্রতিনিধি আর্নল্ড কাতালানোকে অঁরির খেলা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠান। সে ম্যাচে অঁরির দল ৬-০ গোলে জয়ী হয়, ১৩ বছর বয়সী অঁরি তার দলের হয়ে সবকয়টি গোল করেন। অঁরির খেলা দেখে কাতালানো এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি অঁরিকে ক্লাবে আনার ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভেবেও দেখেননি। কাতালানো অঁরিকে কোনো ট্রায়াল ছাড়াই ক্লাবে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসেন। তবে মোনাকোর হয়ে অঁরিকে স্বাক্ষর করার সময় এই শর্ত জুড়ে দেন যে, অঁরিকে ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্লেয়ারফন্টেইন অ্যাকাডেমিতে যোগ দিতে হবে।
অঁরির স্কুলের গ্রেড বেশ খারাপ ছিল, ক্লেয়ারফন্টেইন অ্যাকাডেমি প্রথমে তাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিল না। তবুও তিনি অবশেষে মর্যাদাপূর্ণ এই অ্যাকাডেমিতে যোগদান করার সুযোগ পান এবং তার কোর্স শেষ করার পর ১৯৯২ সালে মোনাকোর অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন।
তখন মোনাকোর কোচ হিসেবে ছিলেন আর্সেন ওয়েঙ্গার, প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করার জন্য যিনি সুপরিচিত। ওয়েঙ্গারের জহুরির চোখ অঁরির মতো রত্নকে চিনতে ভূল করেনি। মোনাকোর হয়ে অঁরির অভিষেক ঘটে ১৯৯৪-১৫ সিজনে নিসের বিপক্ষে, যে ম্যাচে মোনাকো ২-০ গোলে পরাজিত হয়। ওয়েঙ্গার শুরুতে অঁরিকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অঁরির ক্ষিপ্রতা এবং গতিতে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে শেষমেষ উইঙ্গার রোলেই খেলাতে শুরু করেন। উইঙ্গার হিসেবে অঁরি ছিলেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম; তার দ্রুততার সাহায্যে খুব সহজেই প্রতিপক্ষ ফুলব্যাকদের বিট করে স্ট্রাইকারের জন্য জায়গা তৈরি করে দিতেন।
১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে অঁরির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের উপর ভর করে মোনাকো লিগ ওয়ান শিরোপা জেতে। পরবর্তী মৌসুমে মোনাকোকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে পৌঁছে দেওয়ার পথে অঁরি ৭ গোল করেন, যেটি ছিল তৎকালীন ফ্রেঞ্চ ফুটবলারদের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক। পাঁচ মৌসুমে মোট ১০৫ ম্যাচ খেলে ২০ গোল করার মাধ্যমে অঁরির মোনাকো ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে।
১৯৯৯ এর শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে অঁরি মোনাকো ছেড়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন। তবে জুভেন্টাসে খেলার সময়টাকে হয়তো ভুলে যেতেই চাইবেন তিনি। সিরি-আ’র আঁটসাঁট ডিফেন্সলাইনের সামনে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে প্রচুর; নিজেকে খুব একটা খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি, যার প্রভাব পড়েছিল তার খেলাতেও। জুভেন্টাসের হয়ে ১৬ ম্যাচে গোল করতে পেরেছিলেন মোটে ৩টি! ফলস্বরূপ, অঁরির জুভেন্টাস অধ্যায় আর দীর্ঘায়িত হয়নি, ইতি ঘটে সেই মৌসুমেই।
বলে নেওয়া ভালো, ততদিনে আর্সেন ওয়েঙ্গার মোনাকোর পাট চুকিয়ে আর্সেনালের ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। জুভেন্টাস থেকে যখন অঁরিকে আর্সেনালে আনার কথা চলছিল, তখন বোর্ড সদস্যদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। নানা বিতর্কের পরেও আর্সেনালের বোর্ড সদস্যরা ওয়েঙ্গারের যুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হন এবং ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে অঁরিকে আর্সেনালে নিয়ে আসেন। অঁরির ট্রান্সফার নিয়ে ওয়েঙ্গার বলেন,
“এটি এমন একটি ঐতিহাসিক ট্রান্সফার হয়ে থাকবে যা আমাদের ক্লাবকে খুব তাড়াতাড়িই অন্য পর্যায়ে পৌঁছে দেবে।”
বিতর্কে আগুন লাগতে খুব বেশি সময় লাগেনি, আর্সেনালের হয়ে অঁরির শুরুটা হয়েছিল ভয়াবহ রকমের বাজে। প্রথম ৮ ম্যাচেও অঁরি গোলের খাতাই খুলতে পারেননি, ওয়েঙ্গারের উপর ইংলিশ মিডিয়ার চাপ ধেয়ে আসতে শুরু করে। ওয়েঙ্গারও বোধহয় ভাবতে শুরু করেন, তবে কি অঁরির উপর ভরসা করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
তবে সব সমালোচনার জবাব দিতে অঁরি খুব বেশিদিন সময় নেননি। সেই সিজনেই মোট ২৬ গোল করে সকল সমালোচনাকারীদের মুখ বন্ধ করে দেন। অঁরির গোলগুলোর মধ্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে বিপক্ষে করা সেই বিখ্যাত গোলটিও ছিল, যেখানে তিনি বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই পুরো শরীরকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে গোলবারের ৩০ ইয়ার্ড দূর থেকে দুর্দান্ত ভলিতে বল জালে জড়িয়ে দেন।
অঁরি ২০০১-০২ সিজনে আর্সেনালের হয়ে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা লাভ করেন, ২৪ গোল করে হন লিগের টপ স্কোরার। ২০০৩-০৪ সিজন ছিল যেকোন আর্সেনাল ফুটবল ফ্যানের জন্যই স্বপ্নের মতো। সেবার ওয়েঙ্গারের আর্সেনাল কোন ম্যাচ না হেরেই অপরাজিত অবস্থায় লিগ শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়ে, যাকে ‘গোল্ডেন প্রিমিয়ার লিগ’ নামে অভিহিত করা হয়। অঁরি লিগে মোট ৩০ গোল করে প্রথম ফুটবলার হিসেবে ব্যাক-টু-ব্যাক গোল্ডেন বুট জিতে নেন।
ব্যক্তিগত অর্জনের দিক থেকে ২০০৫-০৬ সিজনে অঁরি অসাধারণ সময় পার করেন।
অক্টোবর ১৭, ২০০৫। চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বের ম্যাচে স্পার্তা প্রাগের বিপক্ষে জোড়া গোল করার মাধ্যমে তিনি ইয়ান রাইটের ১৮৫ গোলের রেকর্ড ভেঙে আর্সেনালের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনটি নিজের করে নেন। লিগে ওয়েস্টহ্যাম ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচে গোল করার মাধ্যমে প্রিমিয়ার লিগের ১৫১তম গোল পেয়ে যান, যার মাধ্যমে আর্সেনাল লিজেন্ড ক্লিফ বাস্তিনের লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ডটিও নিজের করে নেন। তবে অঁরি ব্যক্তিগত অর্জনে পরিপূর্ণ হলেও দলগতভাবে ২০০৫-০৬ সিজন ছিল আর্সেনালের জন্য একেবারেই হতাশাজনক। আর্সেনাল সেবার লিগে চতুর্থ হয়, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও বার্সেলোনার কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয়। এরপর থেকেই অঁরির আর্সেনাল ছাড়ার গুজব ডালপালা মেলতে থাকে।
আর্সেনালের হয়ে খেলা শেষ সিজন (২০০৬-০৭) অঁরির জন্য ছিল একেবারেই হতাশায় পরিপূর্ণ। ক্রমাগত ইনজুরিতে পড়ার কারণে তিনি সে মৌসুমে মাত্র ১৭ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। ঘনঘন ইনজুরিতে পড়ার প্রভাব অঁরির পারফরম্যান্সেও পড়তে শুরু করে, যে কারণে ক্লাবে থেকে নিজের ফর্ম পুনরোদ্ধারের চেষ্টা করলেও আর্সেনাল অঁরিকে বার্সেলোনায় বিক্রি করে দেয়।
আর্সেনালের হয়ে শেষ মৌসুমটা ভালো না কাটলেও অঁরির আর্সেনাল অধ্যায় ছিল সাফল্যে পরিপূর্ণ। গানার্সদের হয়ে অঁরি ২২৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন, যে রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
আর্সেনালে অঁরি খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে, কিন্তু বার্সেলোনাতে স্যামুয়েল ইতো সে পজিশনে থাকায় তখনকার বার্সেলোনা কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড অঁরিকে উইঙ্গার পজিশনে ফিরিয়ে আনেন, যার ফলে অঁরির ধারাবাহিক গোলস্কোরিং ফর্মে খানিকটা ঘাটতি দেখা যেতে শুরু করে৷ এরপরও বার্সেলোনায় নিজের প্রথম মৌসুমে ১৯ গোল করে অঁরিই হন দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
২০০৮-০৯ সিজনে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে নিয়োগ পান পেপ গার্দিওলা। বলাই বাহুল্য, সে সিজনটি বার্সেলোনার ইতিহাসের পাতায় অমূল্য হয়ে থাকবে। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বার্সেলোনা একই সিজনে লা লিগা, কোপা দেল রে এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে ট্রেবল জয়ের মর্যাদা লাভ করে। বার্সেলোনার ফরোয়ার্ড লাইনে অঁরি-ইতো-মেসি’ত্রয়ী প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য ছিলেন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম, তিনজন মিলে সে সিজনে মোট ১০০ গোল করেন। অঁরির চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্নও অবশেষে সত্যি হয়, দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারে যেটা ছিল তার একমাত্র অপূর্ণতা।
পরের মৌসুমে বার্সেলোনা পেদ্রোকে সাইন করায়। ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে ফর্মও আর অঁরির হয়ে কথা বলছিল না, মাঠে আগের সেই ক্ষিপ্রতাও কমতে শুরু করেছিল অনেকটাই। ফলে যা হবার তাই হলো, পেদ্রোর কাছে জায়গা হারালেন অঁরি। সে মৌসুমে গার্দিওলা অঁরিকে লিগে মাত্র ১৫ ম্যাচে শুরু থেকে খেলার সুযোগ দেন। মৌসুম শেষের ট্রান্সফার উইন্ডোতে অনেকটা বাধ্য হয়েই অঁরি বার্সেলোনা ছেড়ে আমেরিকান মেজর লিগ সকারে পাড়ি জমান।
২০১০ সালে অঁরি মেজর লিগ সকার ক্লাব নিউ ইয়র্ক রেড বুলসের সাথে ২ বছরের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেন। কিন্তু আমেরিকান ফুটবলে অঁরি বলার মতো কোনো স্মৃতি রেখে যেতে পারেননি, রেড বুলসের হয়ে জিততে পারেননি কোনো মেজর ট্রফিও। তিনি নিজেও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবলকে দেওয়ার মতো আর কিছুই হয়তো অবশিষ্ট নেই তার। এজন্যই ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চিরদিনের মতো বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন, রঙিন ফুটবল ক্যারিয়ারের অবসান ঘটান।
ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের ইতি টানার পর অঁরি ২০১৫ সালে স্কাই স্পোর্টসের ফুটবল অ্যানালিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। একই বছর তিনি আর্সেনাল অনুর্ধ্ব-১৬ দলের কোচ হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু আর্সেনালের কোচ হিসেবে স্কাই স্পোর্টসে কাজ করতে আর্সেনাল বোর্ডের বাধার মুখে তিনি ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আর্সেনাল অনুর্ধ্ব-১৬ দলের কোচের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
সে বছরই তিনি বেলজিয়াম জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ হিসেবে জয়েন করেন। সহকারী কোচ হিসেবে অঁরির বেলজিয়াম অধ্যায় ছিল সফলতায় পরিপূর্ণ। বেলজিয়াম ২০১৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হলেও অঁরির কার্যক্রম ছিল প্রশংসনীয়। বিশ্বকাপ-পরবর্তী এক ইন্টারভিউতে বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু বলেন,
“১৮ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে আসার পর থেকে আমি যাদের মেন্টর হিসেবে পেয়েছি, তাদের মধ্যে অঁরি ছিলেন অনন্য। আমার কাছে থিয়েরি অন্য যে কারো চেয়েই সেরা। প্রতিদিন ট্রেনিংয়ে কিংবা ম্যাচে আমি ভালো করি বা খারাপ করি, তিনি তা খুব সুন্দরভাবে আমার কাছে তুলে ধরতেন এবং টপ লেভেলে পারফর্ম করার জন্য আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কেমন হওয়া উচিত বুঝিয়ে দিতেন।”
বিশ্বকাপের পরপরই অঁরি বেলজিয়াম ছেড়ে মোনাকোর প্রধান কোচ হিসেবে যোগদান করেন। তবে তার মোনাকো অধ্যায় এবার ছিল ভুলে যাওয়ার মতোই। মোনাকোর কোচ হিসেবে মাত্র ২০ ম্যাচ টিকতে পেরেছিলেন, দলের অবস্থা ছিল একেবারেই শোচনীয়। তাই মোনাকো বোর্ড একরকম বাধ্য হয়েই অঁরিকে বরখাস্ত করে। এরপর অঁরি মেজর লিগ সকার ক্লাব মন্ট্রিয়েল ইমপ্যাক্টের কোচ হিসেবে যোগদান করেন।
ফুটবলার হিসেবে থিয়েরি অঁরির ক্যারিয়ার সাফল্যে পরিপূর্ণ। প্রিমিয়ার লিগের সর্বকালের সেরা প্লেয়ারদের একজন হয়ে ওঠা অঁরি বার্সায় এসেও ছড়িয়ে গেছেন নিজের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সকল প্রাপ্তির মাঝেও কিছু অপ্রাপ্তি থাকে, যেটা প্রাপ্তির সব উল্লাসকে কিছুটা হলেও ফিকে করে দেয়। ব্যালন ডি’অর অঁরির জীবনে এমনই একটা নাম। প্রিমিয়ার লীগের ষষ্ঠ সর্বোচ্চ গোলের মালিক এবং আর্সেনালে সর্বোচ্চ গোলের মালিকের ব্যালন ডি’অর জেতার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেছে। ব্যালন ডি’অরের সেরা তিন জনের তালিকায় দুইবার থাকার পরও সেটা ছোঁবার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি; অঁরির সেই আক্ষেপটা হয়তো থেকে যাবে আজীবনই। নাকি আক্ষেপটা ব্যালনের, এমন একজন প্লেয়ারের মুকুট যে হতে পারেনি?
খেলোয়াড়ি জীবনটা যেখানে পূর্ণতার চিত্র স্পষ্ট, কোচ হিসেবে অঁরির ক্যারিয়ারটা এই মুহূর্তে ঠিক বিপরীত মেরুতে। কিন্তু কে বলতে পারে, এই মেঘ কেটে গিয়ে নতুন কোনো সূর্যের অভ্যুদয় হবে না! হয়তো নতুন কোনো শিল্পের জন্ম হবে তার হাত ধরেই, হয়তো তার হাতেই সাকার রূপ নেবেন নতুন কোনো তারকা। ততদিন না হয় তুলির গল্পে ক্যানভাসটা রঙহীনই পড়ে থাক! আর অপেক্ষায় থাকি ‘অঁরিইইইইইই’ শব্দের দুরন্ত উল্লাসের।