প্রযুক্তি আজ হাতের মুঠোয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে রূপালী পর্দার বিকল্প হিসেবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যে যাত্রা, সেটাকে সফল বলতেই হয়। ভালো গল্প, গুণী অভিনেতা, আর প্রতিভাবান কলাকুশলীদের নিয়ে এখন পর্যন্ত ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো বেশ আশাজাগানিয়া সাফল্য দেখিয়েছে। ‘তাকদীর’, ‘মহানগর’, ‘ঊনলৌকিক’—এর মতো কাজগুলো পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ওটিটি’র হাওয়া লেগেছে পশ্চিমবঙ্গেও। দুই বাংলার মেলবন্ধনের সিনেমা আগেও দেখেছি আমরা। ওটিটি যুগ আসার পরও বজায় রয়েছে সেই ধারা। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা নিয়ে ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশি প্ল্যাটফর্ম বায়োস্কোপে। জনপ্রিয়তাও পেয়েছে সেটি। এরই ধারাবাহিকতায় হইচই নিয়ে এসেছে নতুন ওয়েব সিরিজ— ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি‘।
যারা সিরিজের নাম শুনে চমকে উঠেছেন তাদের জানিয়ে রাখা ভাল যে, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের বহুল আলোচিত একই নামের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে সিরিজটি। উপন্যাসের দুই কিস্তির প্রথমটির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে সিরিজের প্রথম সিজন ‘রেক্কা’। বাংলা স্ট্রিমিং মিডিয়া ‘হইচই’ এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে সিরিজ নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশের পর থেকেই দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে আসে সিরিজটি। এরপর বিভিন্ন সময়ে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশকান জুবেরীর ভূমিকায় জয়া আহসান, পরীমণির নাম শোনা যেতে থাকে। গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিরুপম চন্দের চরিত্রের জন্য শোনা যেতে থাকে মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীর নাম। আর সেই সাথে সৃজিত মুখার্জি আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন- এই গল্প নিয়ে কাজে আগ্রহী তিনি। তাই একঝাঁক প্রতিভাবান শিল্পীই ছিলেন চরিত্রের বিবেচনায়। দীর্ঘ জল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে শুরু হয় ছবির কাজ। পরিচালক হিসেবে সৃজিতই থেকে যান। তবে কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশকান জুবেরী হিসেবে অভিনয় করেন আজমেরী হক বাঁধন, আর নিরুপম চন্দের চরিত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয় রাহুল বোসকে। করোনা মহামারীর কারণে আউটডোর শ্যুটিংয়ের সুযোগ কম থাকায় কাজ চালাতে হয়েছে ভারতীয় অভিনেতাদের নিয়েই। শিল্পীসংখ্যার বিচারে দুই বাংলার সিরিজ তাই সেভাবে হয়ে উঠতে পারেনি ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি’।
পরিচালক সৃজিত মুখার্জিকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। থ্রিলার জনরায় তার যে একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে, সেটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘২২শে শ্রাবণ’-এই। নিজ হাতে স্ক্রিপ্ট, সংলাপ, আর পরিচালনা সামলে তৈরি করেছেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা এই থ্রিলার। তবে এবার একা হাতে সবকিছু সামলাতে হয়নি তাকে। স্ক্রিপ্টের দুর্দান্ত থ্রিলিং অংশের কাজ আগেই সেরে রেখেছিলেন মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। ‘দি দ্য ভিঞ্চি কোড’ অনুবাদের মাধ্যমে রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রকে বাংলা ভাষায় সবার সামনে তুলে ধরার কৃতিত্ব তাকে দিতেই হয়। কিংবা ‘কনট্যাক্ট’, ‘নেমেসিস’—এর মতো মৌলিক থ্রিলারগুলোতেও নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। সৃজিতের কাজ শুধু ছিল সেটার উপর অভিনেতাদের রং চড়ানো। আর সেই কাজ বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন তিনি। ভালো গল্প আর দুর্দান্ত নির্দেশনায় তৈরি হয়েছে এক অনবদ্য সিরিজ।
গল্পের প্লট
পুরো একটি আস্ত বাক্য ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি’ হোটেলের নাম হিসেবে যথেষ্ট অপ্রচলিত আর উদ্ভট। কিছুটা আকর্ষণীয়ও বটে। সেই আকর্ষণেই এক আগন্তুক হাজির হয় সুন্দরপুর গ্রামে। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে শান্ত, নিবিড় গ্রাম সুন্দরপুর। অতি সাধারণ এই গ্রামে বলার মতো বিশেষ কিছুই নেই। এমনকি মোবাইল ফোনের সিগনালটাও যেন পেতে চায় না ঠিকভাবে। তবে, কিছুই যে একেবারে নেই গ্রামে, তা ঠিক বলা চলে না। আছে এই অনন্য নামের হোটেলটি। একটি ভাতের হোটেলের নাম কেন এমন অদ্ভুত? আর, রবীন্দ্রনাথ এখানে কেন খেতে আসেননি? তার থেকেও বড় কথা, রবীন্দ্রনাথ না আসলেও সবাই সেখানে ছুটে যায় কেন?
আগন্তুক জানতে চায় এসব প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু, সে যা জানতে চায়, তা জানে সুন্দরপুরের হাতে গোনা ক’জন লোক। ঘটনাচক্রে সেই আগন্তুকের সঙ্গী হয় স্থানীয় পুলিশের এক খোচর— আতর আলী। ধীরে ধীরে আগন্তুক আবিষ্কার করে যে, গ্রামের কিছু লোকজনের চরিত্রও বেশ অদ্ভুত। কবর খননকারী ফালুর কথাই ধরা যাক। সে নাকি আগেভাগেই বুঝতে পারে গ্রামে কেউ একজন মারা যেতে চলেছে। সে অনুযায়ীই অগ্রিম কবর খনন করে রাখে সে! রহস্যের চাদরে মুড়িয়ে এগিয়ে চলতে থাকে সিরিজের কাহিনী। আগন্তুক চেষ্টায় থাকে সেসব রহস্যভেদের। গল্পের মাঝে একসময় ঢুকে পড়েন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ!
হোটেলের নাম যতটা না রহস্যময়, তার থেকেও রহস্যময় এর মালিক মুশকান জুবেরী। আগন্তুক জানতে পারে রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভক্ত এই সুন্দরী মহিলা নিজেই নাকি রান্না করেন হোটেলের স্পেশাল খাবারগুলো। আর তার হাতের জাদুতেই হোটেলের এত নামডাক। গ্রামের অনেকে আবার বিশ্বাস করেন যে এই নারী আসলে মানুষ নন। তিনি একজন ডাইনি। কিছু একটা মিশিয়ে দিয়ে অমৃত স্বাদের খাবার রান্না করতে জানেন তিনি। কিন্তু, মানুষের কথায় কান দেবেন কেন তিনি? শুরু হয় তার রহস্যভেদ অভিযান। কিন্তু, এক রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে ডানা গজায় আরেক রহস্যের। শত প্রশ্নের সিঁড়ি বেয়ে যখন রহস্যের অট্টালিকায় ওঠে আগন্তক, তখন যে দৃশ্য দেখতে পায় তাকে রোমহর্ষক বললেও কম হয়। গা শিউরে ওঠা এক গল্পের মুখোমুখি হয় সে। যে গল্প বলা যায় না মুখেও। কী এমন জানতে পেরেছিল আগন্তক? গা হিম করে তোলা এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ক্লাইম্যাক্স এসে হাজির হয়।
কীভাবে হয় সব রহস্যের যবনিকাপাত? আগন্তুক কি জানতে পেরেছিল রবীন্দ্রনাথের এখানে খেতে না আসার কারণ? ফালু চরিত্রের অগ্রিম মৃত্যু খবরের রহস্যের সমাধান হয় শেষপর্যন্ত? আর হোটেলের এমন স্বাদের খাবারের আসল রহস্যই বা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে হইচই-এর ব্যানারে নির্মিত ওয়েব সিরিজটি।
অভিনয় ও কলাকুশলী
আগেই বলা হয়েছে, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুশকান জুবেরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। সম্প্রতি ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে তার অভিনীত ‘রেহানা মারিয়াম নূর’ দেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরাট সম্মান। মুশকান জুবেরী চরিত্রকে গল্পের প্রয়োজনেই রহস্যময় করে তোলার যে তাগিদ ছিল সেটা তিনি মিটিয়েছেন ভালভাবেই। সিরিজের একেবারে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত টেনে নিয়েছেন নিজ চরিত্রাধিপত্য। গল্পের আগন্তুক নিরুপম চন্দের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিজ্ঞ রাহুল বোস। ক্যারিয়ারজুড়েই বিচিত্র চরিত্রে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই নিরুপম চন্দের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। গল্পের প্রয়োজনে নিরুপমকে যে চারিত্রিক দৃঢ়তার অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেই ভূমিকা তিনি বেশ ভালোভাবে পালন করেছেন। তার জন্যই মুশকান জুবেরীর উপস্থিতি সত্ত্বেও নিরুপম চরিত্রটি ডমিনেটিং ক্যারেক্টারপ্লে করতে সক্ষম হয়েছে।
এছাড়াও আতর আলীর চরিত্রে অভিনয় করা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। রহস্যের ধোঁয়া ওঠা ভাত তার প্লেটেরই খাবার। বোমকেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে অতীতে তিনি সেটি প্রমাণ করেছেন বারংবার। তবে, এ গল্পে মূল চরিত্রে না থাকলেও পার্শ্বচরিত্র হিসেবে আতর আলীকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন শৈল্পিকভাবে। কলকাতার বাচনভঙ্গি ছেড়ে বাংলাদেশের কথ্যভাষায় তিনি যে অভিনয় করেছেন সেটি তার শক্তিশালী অভিনয়সত্তার প্রমাণ দেয়।
অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতারাও বেশ ভালোভাবে নিজেদের কাজ সেরেছেন। থানার ওসি তপন শিকদার চরিত্রে অভিনয় করা অনির্বাণ চক্রবর্তীও বেশ প্রশংসার দাবিদার। অঞ্জন দত্তের মতো গুণী শিল্পী খাশনবিশ চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন সাবলীলভাবে। তার উপস্থিতি সিরিজকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। চরিত্রের গভীরতা আর অভিনয়ের দ্বারা গল্পের কাহিনী ফুটিয়ে তুলতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আর ট্যাক্সি ড্রাইভারের ক্যামিও রোলে স্বয়ং সৃজিত মুখার্জির অভিনয়ও ছিল বেশ উপভোগ্য।
সিরিজের আবহসঙ্গীত বেশ আকর্ষণীয়। সেই সাথে, থেমে থেমে কবিগুরুর আগুনের পরশমণি আর মায়াবন বিহারিনীর মতো গানগুলো যখন বেজে উঠছিল, তখন রীতিমতো গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাবার জোগাড়। সঙ্গীত পরিচালক অনিন্দিত সিং আর অদীপ রায় এক্ষেত্রে বড় কৃতিত্বের দাবিদার। রহস্যভিত্তিক গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে আবহসঙ্গীত যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটা ভালোভাবেই পূরণ করেছেন তারা। এছাড়াও, ওস্তাদ রশিদ খান, জয় সরকার, ও জয়তী চক্রবর্তীর কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতগুলোও ছিল সিরিজের প্রাণ।
মোটাদাগে একটি দুর্দান্ত ওয়েব সিরিজ হলেও গল্পের কিছু জায়গা ছিল সামান্য বিব্রতকর। আর সিরিজের টানটান উত্তেজনার অংশটুকু ধরে রাখলেও, কোথায় যেন রহস্যের কমতি থেকে গিয়েছিল। উপন্যাস পড়েননি এমন দর্শকও যেন অনেক জায়গায় খুঁজে পাবেন ‘শেষপর্যন্ত রহস্য ধরে রাখা’র অভাব। সেই সাথে সৃজিতের স্বভাবসুলভ ‘নিজস্ব টুইস্ট’ খারাপ লাগতে পারে অনেক দর্শকের কাছে। তবে, যারা মূল উপন্যাসটি পড়েছেন, তাদের প্রতি পরামর্শ থাকবে মূল উপন্যাসের গল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে স্রেফ ওয়েব সিরিজ হিসেবে দেখবেন রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি।
হইচই-এর ব্যানারে নির্মিত ৯ পর্বের এই সিরিজ মুক্তির আগেই ব্যাপক আলোচনায় চলে এসেছিল। একে তো কেন্দ্রীয় চরিত্রে বাংলাদেশী অভিনেত্রী, অন্যদিকে গল্পও আমাদের দেশেরই। আলোচনার সেই টেবিল তাই মুক্তির পর আবার গরম হয়েছে। আলোচনার সমান তালে চলছে সমালোচনাও। তবে, প্রথম সিজন দেখার পর দ্বিতীয় সিজনের অপেক্ষা যে দীর্ঘায়িত হলো তা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না।