প্রাচীন আর্যভারতকে জানার যে কয়টি সুলভ মাধ্যম রয়েছে, তন্মধ্যে পুরাণ সর্বাপেক্ষা লোকপ্রিয় ও চর্চিত মাধ্যম। পুরাণ আর বেদকে পাশাপাশি দাঁড় করালে ধর্মীয় গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যে বেদ এগিয়ে থাকলেও লোকপ্রিয়তার মানদণ্ডে পুরাণ বেদকে ছাপিয়ে গিয়েছে। বেদ পুরাণের পূর্বে লেখা হলেও বেদের বাণীগুলো বা অনুচ্ছেদাদি পুরাণের ন্যায় সর্বমহলবিদিত হতে পারেনি। প্রায় চার হাজার বছর আগে আর্যদের দ্বারা বেদ লিখিত হয়েছিল। পুরাণ লেখা শুরু হয়েছিল তার কিছু পরে।
বেদে প্রধানতম দেবতা হিসেবে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, সূর্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদের বর্ণনা করা হয়েছে পৃথিবীর বাইরের দেবতা হিসেবে। তারা হলেন বৈদিক দেবতা। তখন ‘‘ভগবান’ বা ‘ঈশ্বর’-এর স্থলে ‘দেব’ শব্দটি ব্যবহার হতো। বিভিন্ন যাগ-যজ্ঞের আয়োজন করে মানুষ বৈদিক দেবগণকে আহুতি দিত। বৈদিক যুগের শেষের দিকে মুনিগণ কর্তৃক পুরাণ লিখিত হওয়া শুরু হলে সেখানে নতুন দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটতে শুরু হয়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দূর্গা, চণ্ডী প্রভৃতি দেব-দেবীর মাহাত্ম্যকাহিনী পুরাণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জনমনে ধর্মভাব ও ভক্তিভাবকে সঞ্জীবিত করে রাখা। এখান থেকেই ‘ভগবান’ শব্দের প্রচলন হওয়া শুরু হয়।
দেবগণকে যখন মানুষ বা অসুরদের মতো একটি প্রজাতি হিসেবে উল্লেখ করা শুরু হয়, তখন মানুষেরা উপাসনার্থে বৈদিক দেব-দেবীর স্থলে পৌরাণিক দেব-দেবীগণকে স্মরণ করা শুরু করে। এজন্য বৈদিক দেবতাদের (ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি) কোনো মন্দির নেই। আবার, পুরাণ লিখিত হয়েছে কয়েকশো বছরে। সঠিকভাবে পুরাণের সংখ্যা বলাটাও মুশকিল। তাই একই প্রসঙ্গে বিভিন্ন পুরাণে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। একে পুরাণের সীমাবদ্ধতা না ধরে বৈচিত্র ধরলেই পাঠকগণ পুরাণ থেকে যথাযথ রস আস্বাদন করতে পারবেন।
সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মা প্রজাপতি দক্ষকে সৃষ্টি করে আইন বা সংহিতা লেখার দায়িত্ব দেন। দক্ষ আইন সংকলিত করে শাসনকার্য শুরু করেন। দক্ষ তার কন্যাদের মধ্যে তেরো কন্যার (অদিতি, দিতি, দনু, সুরসা, সুরভী, অরিষ্ঠা, বিনতা, কদ্রু, ইরা, তাম্রা, ক্রোধবশা, বিশ্বা ও মুনী) সাথে কাশ্যপ মুনির বিবাহ দেন এবং কাশ্যপের ঔরসে তেরো পত্নীর গর্ভ থেকে তেরোটি প্রজাতির (দেবতা, অসুর, দানব, দৈত্য, নাগ, পক্ষী, মানব ইত্যাদি) উদ্ভব হয়।
আদতে, দেবতা, অসুর, দানবাদি বৈমাত্রেয় ভাই। দেবতাদের মা অদিতি। অদিতির গর্ভের প্রথম সন্তান এক হাজার বছর অবধি মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। জন্মকালে স্বাভাবিকভাবে শিশুটির জন্ম হয় না, মায়ের পেটের পার্শ্বদেশ চিরে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। জন্মের পরপরই সে আকাশকে আলোকিত করে। পাহাড়, পর্বত ও আকাশ প্রকম্পিত হয়। ঝড়, বজ্র দেখা দেয় পুরো আকাশ জুড়ে। এর নামকরণ করা হয় ‘শত্রু’।
শত্রু অন্যান্য ভাইদের সাথে ধর্ম, যুদ্ধকলা, শিল্প প্রভৃতি বিদ্যা শিখতে শুরু করে। যৌবনে পদার্পণের পরে শত্রুকে দেবতাদের রাজা বা ‘দেবেন্দ্র’ ঘোষণা করা হয় এবং স্বর্গলোক দেবতাদের থাকার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ‘ইন্দ্র’ শব্দটির অর্থও রাজা। ইন্দ্র মূলত আকাশের দেবতা। বজ্র, বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদি প্রভৃতি তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। ইন্দ্রের বাহন সাত শুঁড় ও চার দন্তবিশিষ্ট শ্বেতবর্ণের ‘ঐরাবত’ এবং সাতমাথা-দুইপাখাবিশিষ্ট শ্বেতবর্ণের ‘উচ্চৈঃশ্রবা’ ঘোড়া, যেটি তিনি অসুররাজ মহাবলির থেকে হরণ করেছিলেন।
ইন্দ্রের সারথীর নাম মাতলী। ইন্দ্রের অস্ত্রাদির ভেতর রয়েছে ধনুর্বাণ ও অঙ্কুশ। ইন্দ্রের ধনুকের মতো সাতরঙ থাকায় সাতরঙা রংধনুকে বলা হয় ইন্দ্রধনু। ইন্দ্রের তরবারির নাম পারন্ধ। ‘বজ্র’ নামক একটি বিশেষ অস্ত্রের ব্যবহার করতে দেখা যায় দেবরাজকে। দেবরাজের বজ্রপ্রাপ্তির গল্পটিও চিত্তাকর্ষক।
সহস্রনয়ন ইন্দ্র
ইন্দ্রের ছিল হাজারটি চোখ। একবার দুই অসুর ভাই সুন্দ ও উপসুন্দ মিলে দেবতাদের অনেক নাজেহাল করে বেড়াচ্ছিল। তারা ব্রহ্মার বর পেয়েছিল যে একমাত্র এক ভাই-ই আরেক ভাইকে হত্যা করতে পারবে; অন্য কেউ নয়। দুই ভাইয়ের ভেতর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে দেবতাদের দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা জগতের তিল তিল সৌন্দর্য এক করে তৈরী করেন তিলোত্তমা নামীয় এক অপরূপাকে। তিলোত্তমাকে দেখার জন্য তখন ইন্দ্রের সারা গায়ে সহস্র চোখ উৎপন্ন হয়। স্বর্গের রাজধানী অমরাবতী। এখানেই দেবরাজ নিজের সভা ‘সুধর্মা’র স্থাপনা করেন। স্বর্গের বাগান নন্দনে দেবরাজ ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন।
দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নীর নাম শচী। তিনি একজন রাক্ষসকন্যা। পরিভ্রমণরত হয়ে ইন্দ্র একবার রাক্ষসপুরীতে এসে রাক্ষসদের রাজা পুলোমার কন্যা শচীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। প্রতিশোধ ও অভিশাপের ভয়ে ইন্দ্র পুলোমাকে বধ করেন এবং শচীকে বিয়ে করে স্বর্গে নিয়ে আসেন। রাক্ষস রাজকন্যা থেকে শচী হন দেবতাদের রানী।
ইন্দ্র অনেকবার বিভিন্নভাবে অভিশাপগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অভিশাপমুক্তও হয়েছেন। অহংকার ও ভোগবিলাসে ডুবে যাওয়ার দরুণ শাস্তিস্বরূপ অসুরকর্তৃক স্বর্গচ্যুত হয়েছেন। ইন্দ্র সোমরস বড্ড ভালোবাসতেন। সোমরস পান করতে করতে তার পেট ফুলে যেত। তার পেটকে তাই বলা হয় ‘সোমরসের কুম্ভ’। ইন্দ্র একবার মহামুনি গৌতমের দ্বারা শাপিত হন। গৌতমের স্ত্রী অহল্যাকে ধর্ষণের দায়ে গৌতম তাকে শাপ দিয়েছিলেন। এই অহল্যাকে সৃষ্টির পরে ব্রহ্মা বলেছিলেন,
“তুমি অনিন্দনীয়া, তুমি নিষ্কলুষ, তুমি অপরূপা। তাই তোমার নাম দিলাম অহল্যা।”
ব্রহ্মদেব ঘোষণা দিয়েছিলেন,
“যে মহান দেব, মুনি, মানব, দানব, অসুর সবার আগে ত্রিভুবন পরিক্রমা করে এখানে আসতে পারবে, তার সাথে আমি অহল্যার বিয়ে দেব।”
এ কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্র বাহন ঐরাবতে চড়ে ত্রিভুবন ঘুরে এসে দেখেন, গৌতম ঋষির সাথে অহল্যার বিয়ে হয়ে গেছে। একজন মানুষ কীভাবে দেবরাজের আগে ত্রিভুবন ঘুরে আসতে পারে, একথা ভেবে ইন্দ্র যারপরনাই আশ্চর্য হলেন। তখন দেবর্ষি নারদ এসে তাকে বলেন যে, গৌতম ঋষি পূজো করার সময় গরুর চারদিকে পরিক্রমা করেছিলেন। আর গো যেহেতু মাতৃসম ধরণী। তাই, মুনি অজান্তেই ত্রিভুবন পরিক্রমা করে এ বাজি জিতে গেছেন।
গৌতম ও অহল্যার বিয়েতে সবাই ধন্য ধন্য করলেও ইন্দ্র খুব সন্তুষ্ট হতে পারেননি। গৌতমের আশ্রমে নজরদারি শুরু করে ইন্দ্র। খুব ভোরে গৌতম গঙ্গাস্নান ও পুজো করতে বের হয়ে গেলে ইন্দ্র গৌতমের রূপ ধরে অহল্যার কাছে যান। স্বামীর অসময়ে ফিরে আসা দেখে অহল্যা চকিত হলেও বাধা দেন না গৌতমরূপী ইন্দ্রকে। স্নান-পূজো সেরে আশ্রমে এসে গৌতম অহল্যা ও ইন্দ্রকে একপলক দেখেই ক্রোধানলে ফেটে পড়েন। ইন্দ্রকে নপুংসক ও শত্রুর দ্বারা বিজিত হওয়ার অভিশাপ দিয়ে তিনি অহল্যাকে বলেন,
“তুমি সৌন্দর্যহীনা, নিঃসাড় হয়ে এ আশ্রম কুটিরে পড়ে থাকো। কেউ তোমায় দেখতে পাবে না, স্পর্শ করবে না। তোমার রূপের অহংকার নস্যাৎ হবে।”
অনেক কাকুতির পরে গৌতম শাপ থেকে মুক্তির উপায়ও বাতলে দেন অহল্যাকে,
“ত্রেতা যুগে দশরথপুত্র রাম এসে তোমায় উদ্ধার করবেন।”
ওদিকে ইন্দ্র অভিশাপগ্রস্ত হওয়ার পরে সকল দেবতারা মিলে শক্তি দিয়ে ইন্দ্রের পুরুষত্ব ফিরিয়ে আনেন। পরে রামকর্তৃক অহল্যারও শাপমুক্তি হয়।
দেবতাদের গুরু ছিলেন বৃহস্পতি। গুরু হওয়ার সুবাদে বৃহস্পতির স্থান ছিল ইন্দ্রের উপরে। একবার স্বর্গসভায় বৃহস্পতিকে সকল দেবতার সামনে ইন্দ্র অপমান করে বসেন। অপমানিত হয়ে বৃহস্পতি স্বর্গসভা থেকে বেরিয়ে যান। গুরুহীন হয়ে পড়েন দেবতারা। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অসুরেরা ইন্দ্রকে স্বর্গচ্যুত করে। ইন্দ্র পালিয়ে ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মার শরণে যান। ব্রহ্মার উপদেশে ইন্দ্র এক ব্রাহ্মণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার পদসেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেন।
অনেককাল সেবা করেও ব্রাহ্মণকে তুষ্ট করতে না পেরে ইন্দ্র ভেতরে ভেতরে গুরুর উপর চটতে থাকেন। পরে যখন জানতে পারে যে ব্রাহ্মণটি মায়ের দিক থেকে অসুরকূলীয়, তাই ইন্দ্রের প্রতি তিনি বুঝে-শুনে অন্যায় করছেন- তখন রাগে ইন্দ্র সেই ব্রাহ্মণকে মেরে ফেলেন। ব্রহ্মহত্যার মহাপাপে পাপী হন দেবরাজ। এক ফাঁড়া কাটতে না কাটতেই আরেক মহাবিপদে পতিত হন তিনি। তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণু তাকে তার পাপ চারভাগে ভাগ করে চারজনকে দিতে বলেন এবং সাথে চারজনকে চারটি বর দেওয়ারও নির্দেশ দেন।
বিষ্ণুর পরামর্শে ইন্দ্র পাপের প্রথম অংশ গাছকে দিয়ে বলেন, “তুমি মরে গেলেও তোমার মৃতপ্রায় শেকড় থেকে তোমার আরেকবার জন্ম হবে”। পাপের দ্বিতীয় অংশ জলকে দিয়ে বলেন, “জল, তোমায় আমি সবকিছু বিশুদ্ধ করার ক্ষমতা দিলাম”। তৃতীয় অংশ ভূমিকে দিয়ে বললেন, “তোমার গায়ে যত আঘাত ও ক্ষতই আসুক, সব পূরণ হয়ে যাবে আপনাআপনি”। আর পাপের শেষাংশ নারীকে দিয়ে বললেন, “কামক্রীড়ায় তুমি পুরুষের চেয়ে অধিক দক্ষ হবে এবং তোমার ভেতরে নবজাতক খুব নিরাপদে লালিত-পালিত হবে”। এভাবে সেবারের মতো ব্রহ্মহত্যা থেকে নিস্তার পান দেবরাজ।
ইন্দ্র হওয়া খুব সুখকর ছিল না। অসুরদের সাথে যুদ্ধে দেবতারা অনেকবার মানুষদের সাহায্য নিয়েছেন। একবার এক যুদ্ধে মানুষদের রাজা রজির সাহায্য নেন দেবতারা। সাহায্যদানের বিনিময়ে রজি ইন্দ্রপদ চেয়ে বসেন। প্রথমে রাজি হলেও যুদ্ধশেষে ইন্দ্র পদরক্ষার্থে রজিকে নিজের ধর্মপিতা বানান। পিতা হয়ে পুত্রকে পদচ্যুত কীভাবে করবেন, এই ভেবে রজি আর কিছু বলেন না। রজির মৃত্যুর পরে তার পুত্রেরা ইন্দ্রকে পরাজিত করে স্বর্গ দখল করলেও বেশিদিন স্বর্গে রাজত্ব করতে পারেননি। রজির পরে পরঞ্জয় নামক এক রাজা ইন্দ্রের ঘাড়ে চড়ে যুদ্ধে অসুরদের সাথে লড়েছিলেন।
ইন্দ্র হওয়া একমাত্র ইন্দ্রকেই মানায়। মহামুনি অত্রির পুত্র আত্রেয় ইন্দ্রলোকে বেড়াতে গেলে দেবতারা সবাই তাকে অনেক আদর আপ্যায়ন করেন। দেবলোকের ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন, ভোগ ইত্যাদি খেয়ে এবং নৃত্য-গীতে মুগ্ধ হয়ে ঋষি তপোবনে ফিরে আসেন। কিন্তু, তপোবনের সাদামাটা জীবন আর তখন তার ভালো লাগে না। তিনি দেবতাদের শিল্পী বিশ্বকর্মাকে ডেকে ইন্দ্রের অনুরূপ প্রাসাদ, বাগান, রসুইঘর বানিয়ে দিতে বলেন। বানানো হয়ে গেলে সেখানে উঠে মনের সুখে গানবাজনা শুনতে থাকেন আর ছাপ্পান্নভোগ খেতে থাকেন।
এর মধ্যে অসুরদের ভেতর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ইন্দ্র স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসে আস্তানা গেড়েছেন। এখনই সময় তাকে শায়েস্তা করার। অসুরেরা সদলবলে মুনির প্রাসাদে ঢুকে সবকিছু ভূলুণ্ঠিত করা শুরু করে। মুনির চুল-দাড়ি ধরে টানাটানি শুরু করে। পরে মুনিপত্নী এসে অসুরদের সাবধান করা মাত্র সব রাক্ষস চোখের নিমেষে চম্পট দেয়। পরে মুনি ভুল বুঝতে পারেন। তিনি বিশ্বকর্মাকে ডেকে আবার সবকিছু আগের মতো করে দিতে বলেন। মুনির এমন কাণ্ডে পুরো স্বর্গে হাসির রোল পড়ে যায়।
সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করতে থাকা দেবতাদের জীবনে অসুর, দানব ও দৈত্যেরা বারবার বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। দেবতাদের বলা হয় ‘সুর’। সে হিসেবে তাদের বিরুদ্ধাচরণকারীরা অসুর। অসুররা পাতাল থেকে স্বর্গলোক অধিকার করতে বারবার স্বর্গ আক্রমণ করে। কোনোবার সফল হয়, কোনোবার বিফল হয়।
একবার ত্বষ্টা নামীয় এক প্রজাপতি (পূর্বোক্ত দক্ষের মতো যুগে যুগে যারা প্রজা পালন করেন এবং আইন রচনা করেন) ইন্দ্রের উপর ক্রোধান্বিত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ‘ত্রিশিরা’ নামীয় এক পুত্রের সৃষ্টি করেন, যার সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নির ন্যায় তিনটি মুখ বা মাথা ছিল। এক মুখ নিয়ে অনবরত তিনি বেদ আবৃত্তি করতেন, অপর মুখ দিয়ে সুরা পান করতেন এবং শেষ মুখ দিয়ে সর্বগ্রাসী দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতেন। পিতার আদেশে ইন্দ্রত্ব লাভের উদ্দেশ্যে ত্রিশিরা ঘনঘোর তপস্যায় লিপ্ত হন। কাউকে তপস্যা করতে দেখলেই ইন্দ্রের সিংহাসন কেঁপে উঠত। সবকিছু ভুলে তখন তার তপস্যাভঙ্গই হতো ইন্দ্রের প্রধান কাজ।
স্বর্গসভায় যারা নাচে, তাদের বলা হয় অপ্সরা এবং যারা গায়- তাদের বলা হয় গন্ধর্ব। অপ্সরা আর গন্ধর্বদের ধর্মই নৃত্য-গীতের মাধ্যমে দেবতাদের মনোরঞ্জন করা। তপস্বীগণের তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোর জন্য দেবতারা অপ্সরা ও গন্ধর্বদের নিযুক্ত করতেন। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পরে ইন্দ্র নিজের ইন্দ্রত্ব রক্ষার্থে ত্রিশিরাকে বধ করেন। ত্রিশিরার ধড় মারা গেলেও মাথা তিনটি জীবিত থেকে তপস্যা চালিয়ে যান।
তপের প্রভাবে ইন্দ্র কুলোতে না পেরে এক সূত্রধর বা ছুতোরকে প্রলোভিত করে ত্রিশিরার মাথা তিনটিও কেটে ফেলেন। আবার ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার দায়গ্রস্ত হন। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে ত্বষ্টা তপস্যাবলে বৃত্র নামক আরেক পুত্রের জন্ম দেন। বৃত্রকে বধ করতে সকল দেবতারা গিয়ে দধীচি নামীয় একজন ঋষির শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং ঋষির কাছে এমন বস্তু চেয়েছিলেন, যা কেউ কোনোদিন কারো কাছে চায়নি। সে গল্প থাকছে পরের পর্বে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।