‘আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার…’
একটি মুহূর্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জিরো আওয়ার। একটি ব্যক্তিগত, একান্ত জিরো আওয়ার।
একটি মুহূর্ত। যেখানে সবকিছু নিজের ইচ্ছেমতো হবে। ইচ্ছেপূরণের বুড়ো রাশি রাশি বর দিয়ে যে মুহূর্তটিকে ভরে দেবেন একান্ত আনন্দে।
আর্জেন্টিনা একান্ত সেই মুহূর্ত চেয়েছিল। আর্জেন্টিনা বারবার সেই মুহূর্ত খুঁজতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে, অশ্রুমালায় বরণ করে নিয়েছে নিজেদের ভাগ্য। কিন্তু আশা? আশার তো মৃত্যু হয় না। আশা বেঁচে থাকে মারাকাইবো থেকে শুরু করে মারাকানা হয়ে সান্তিয়াগো কিংবা মেটলাইফ স্টেডিয়ামেও। বিধাতা কিংবা ভাগ্যের অনন্ত আক্রোশের অনলে বারবার পুড়েও আশা বেঁচে থাকে খড়কুটো আগলে ধরে।
২৮ বছরের অপেক্ষা। তাতে আর্জেন্টিনা ফুটবলের একটা প্রজন্ম হারিয়ে গেছে, আরেক প্রজন্মের চোখে কেবল জল জমেছে, শিরোপা বারবার ফাঁকি দিয়েছে “এই এলেম” বলে।
তবুও, তবুও আশা ফিরে আসে আবার মারাকানায়। আশার মৃত্যু হয় না। মারাকানায় সে ফিরে আসে হৃদয়ভঙ্গের দুঃস্বপ্নের ভেলায় চড়ে। আরেকবার কান্নার রোলের ভয় বুকে নিয়ে।
আর্জেন্টিনার নিভু-নিভু আশার প্রদীপ কোনোমতে পার করে একটির পর একটি মুহূর্ত। প্রতি পার হয়ে যাওয়া মুহূর্তে লুকিয়ে থাকে জিরো আওয়ার খুঁজে পাওয়ার তীব্র তিতিক্ষা।
উরুগুইয়ান রেফারি এস্তেবান অস্তোজিখ মারাকানায় বাঁশি বাজান ৬ সেকেন্ড বাকি থাকতে, ৭১ বছর পর আলিসিডিস ঘিঘিয়ার পুনর্জন্ম হয়ে।
লিওনেল মেসি বিশ্বাস করতে পারেন না। অবিশ্বাস নিয়ে একবার তাকান আশেপাশে, তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ঢেকে পড়েন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। তার কাছে চলে আসেন রদ্রিগো ডি পল, মার্কাস অ্যাকুনারা। তাদের জড়িয়ে ধরেন মেসি।
আর্জেন্টিনার ফাইনাল শেষে মেসির নিঃস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ, অসহায় কান্নার ছবি বারবার ঘুরে বেড়িয়েছে অন্তর্জালে। প্রতি ফাইনালের পর মেসি একা বসে থাকেন, ঠিক একই ভঙ্গিতে। একই ভঙ্গিমায় রানার্সআপ মেডেল কিংবা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার নিয়ে মেসি হেঁটে যান ট্রফির পাশ দিয়ে। মেসি, আপনার এবং আর্জেন্টিনার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। মেসির চাঁদের মতোন উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে একটা-দুটো করে চার-চারটে খাদ জন্ম নেয়।
আপনি বারবার আশা হারিয়ে ফেলেন, করোনার কারণে বিপর্যস্ত আর্জেন্টিনা ঘরের মাঠের সুবিধা হারিয়ে ব্রাজিলে যায় দিয়েগোকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে। গিয়ে হোঁচট খায়, কোনোমতে একটা, দুটো, তিনটে করে করে ছয় ম্যাচ পেরিয়ে ফাইনালে যায়।
আবারও মারাকানা। আরেকটা টাইব্রেকার পেরিয়ে মারাকানা। আবার হৃদয়ভঙ্গের জ্বালার ভয় নিয়ে মারাকানা।
রদ্রিগো ডি পল মেসিকে নিয়ে বলেছিলেন, তার জন্য যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত। তার নমুনা পুরো আসরেই দেখিয়েছেন। সেমিফাইনালে কলম্বিয়ানদের একের পর এক জঘন্য ট্যাকেল সয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে গিয়ে পেনাল্টি মিস করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
সেখানে তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ১৭ বছর বয়সে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে লন্ডনে গিয়ে বারবার ধাক্কা খাওয়া এমিলিয়ানো। নিজের চেয়ে বরং মেসির জন্য জিততে চাওয়া মার্টিনেজ।
ফাইনাল আসে, ফাইনালে লিওনেল স্কালোনি বেছে নেন ক্রিস্টিয়ান রোমেরোকে। যে রোমেরো খেলার অবস্থায় ছিলেন না, যে রোমেরো ইনজেকশন নিয়ে খেলতে নেমেছেন, যিনি খেলার মাঝেও ইনজেকশন নেন টিকে থাকতে। সঙ্গে আনহেল ডি মারিয়াকে, যিনি আগের ফাইনালগুলো খেলতে পারেননি। যিনি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার জন্য রিয়াল মাদ্রিদের চিঠি ছিড়ে ফেলেছিলেন। ডি মারিয়াকে মেসি ম্যাচের আগে বলেন, খেলতে না পারা ফাইনালগুলো পুষিয়ে দিতে।
খেলা শুরু হয়, ব্রাজিলের ফ্রেড হলুদ কার্ড দেখেন। নেইমারের থেকে বল কেড়ে নেন ডি পল, ডি মারিয়া ‘আনহেল’ থেকে হয়ে ওঠেন ‘অ্যাঞ্জেল’, মারাকানায় এগিয়ে যায় আলবিসেলেস্তেরা, যার চিৎকার বুয়েনোস এইরেস থেকে শোনা যায় ঢাকা পর্যন্ত।
দিয়েগোর বুরুচাগা ছিলেন। মেসি ডি মারিয়াকে অবশেষে পেলেন। আগের তিন ফাইনালের হতাশা ডি মারিয়া পুষিয়ে দিলেন।
বাকি সময়টুকুতে কেবল নিঃশ্বাস আটকে রাখা আর্জেন্টিনার, রিচার্লিসনের গোলে ২০০৬ এর ভূত ফিরে আসার ভয়, রেফারির অফসাইডের বাঁশিতে স্বস্তি।
টুর্নামেন্টে দলের ১১ গোলের নয়টিই যার পা থেকে এসেছে কোনো না কোনোভাবে, সেই মেসি অবশ্য এদিন পারেন না। কিন্তু বাকি দশ জন পারেন। যে অধিনায়ক এতদূর টেনে এনেছেন তাদের, সেই অধিনায়ককে ফাইনালে টেনে নেন বাকি দশজন।
লিয়ান্দ্রো পারেদেস খেলেন প্যারিসে। সেই প্যারিস-সতীর্থ নেইমারকে কোনো দয়া দেখালেন না, আর্জেন্টিনার সবাই তার সঙ্গেই তাল মেলালেন। গঞ্জালো মন্তিয়েলও তাই করলেন। ভক্তদের পছন্দের হুয়ান ফয়েথকে কোপার দলে রাখেননি স্ক্যালোনি, ভরসা রেখেছিলেন মন্তিয়েল-নাহুয়ান মলিনায়। পুরো টুর্নামেন্টে প্রথম পছন্দ মলিনাকে টপকে মন্তিয়েল ফাইনালে নামেন।
এবং মন্তিয়েল আর্জেন্টিনা রক্ষণের ডান পাশ আটকে রাখেন। তাকে পেরোতে পারেন না নেইমার, দ্বিতীয়ার্ধে থমকে যান ভিনিসিয়াস জুনিয়রও। সাত ট্যাকল, পাঁচ ক্লিয়ারেন্স করার পথে মন্তিয়েল চোটে পড়েন, মোজা ভিজে যায় রক্তে।
কিন্তু মন্তিয়েল থামেন না। মন্তিয়েল ম্যাচ শেষ করেন।
মরিয়া ব্রাজিলকে আটকাতে আর্জেন্টিনা বেছে নেয় সময় নষ্টের খেলা। সেটি করার জন্য যোগ করা সময়ে বাঁ প্রান্তে ফাউল খুঁজছিলেন মেসি। রেফারি দেননি।
হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়াতে নেবেন, এমন সময় রেফারি বাঁশি বাজান। মেসি বিশ্বাস করতে পারেন না। মেসি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেসি সতীর্থদের আলিঙ্গনে কাঁদতে থাকেন। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পেরেছে!
উদযাপন থামে না। ২৮ বছরের দীর্ঘ রাত পেরিয়ে সকালের অস্ফূট আলোর দেখা পাওয়া আর্জেন্টিনা উদযাপন থামাতে পারে না।
মেসি গিয়ে বন্ধু নেইমারকে সান্ত্বনা দেন। ডি পল, লো সেলসোরা ব্রাজিলকে তাচ্ছিল্য করার গান গাইতে নেন, মেসি না করে দেন।
মেসি নেতা নন, এই অভিযোগের তীর তার দিকে ছুড়ে দেয়া হয়েছে বারবার। সেই মেসিকে সতীর্থরা বাতাসে ছুড়ে উদযাপন করেন, তার জন্য শিরোপা জিততে পেরে এমিলিয়ানো ছলছল চোখে তার সঙ্গে ছবি তোলেন। মেসি এক রাতে অনেকগুলো অভিযোগের এপিটাফ লিখে ফেলেন, তাতে সাক্ষী হয় মারাকানা।
সেবার মারাকানায়ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটা পেয়েছিলেন। বিশ্বকাপের পাশ দিয়ে হেটে গিয়ে জন্ম দিয়েছিলেন কিংবদন্তিতুল্য এক ছবির, যে ছবি কথা বলে, বলতো। সে মারাকানায় এবার মেসি নতুন ছবির জন্ম দেন। সেরা খেলোয়াড়, গোল্ডেন বল হাতে নিয়ে মেসি এবার হাসতে হাসতে ফেরেন। অমলকান্তির জাম আর জামরুলের পাতায় লেগে থাকা মিষ্টি রোদ্দুরের মতোন।
মেসি ট্রফি হাতে নেন, উন্মত্ত উল্লাসে মাতেন। ট্রফিতে চুমু খান। আজন্ম সলজ্জ সাধের মতোন শিরোপাটাকে মেসি আগলে রাখেন।
মেসি মাঠে বসেই পরিবারকে ফোন দেন। একবার তাকালে চেনা স্মৃতি বলেই ভ্রম হয়। চেনা স্মৃতিই, প্রতিটি ফাইনাল হারেই মেসি ঠিক এরকমটি করে বসে শুন্য চোখে কী যেন খুঁজে বেড়িয়েছেন, পাননি।
এবার মেডেলটা স্ত্রী আন্তোনেল্লাকে দেখান, ছোট ছেলে চিরোকে বারবার ডেকে মেডেলটা দেখান। এরপর ড্রেসিংরুমে যান, জার্সি খুলে রাখেন, কিন্তু আর্মব্যান্ডটা পরেই থাকেন পুরোটা সময়। সার্জিও আগুয়েরোর লাইভে দেখা যায়, ট্রফিটাকে বাচ্চা ছেলের নতুন খেলনার মতো জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।
মেসিরা আর্জেন্টিনায় ফেরেন। একটা ছবিতে দেখা যায়, বাসের জানালা দিয়ে হাসিমুখ নিয়ে সমর্থকদের দেখছেন তিনি, তার মুখের ওপর এক টুকরো রোদ। যে রোদে মিশে আছেন দিয়েগো, যে রোদে মিশে আছেন আলেহান্দ্রো সাবেলা।
নাহ, বুয়েনোস এইরেসে এখনও দিয়েগোই ঈশ্বর। মেসি সর্বকালের সেরা হয়ে যেতে পারেন, বুয়েনোস এইরেসের ঈশ্বর ম্যারাডোনাই থাকবেন। দিয়েগো তাদের পরম প্রাপ্তি হাতে দিয়েছিলেন, লিও এখনও পারেননি। কিন্তু সে কথা পরের; লিওর হাতে ধরে আবারও অন্তত আর্জেন্টিনা বলতে পেরেছে, আমরা সেরা।
আলবিসেলেস্তেরা মহামারীর মধ্যেও বুকের শক্ত পাথর বিসর্জন দিয়ে হাসে; মেসি শিরোপা উৎসর্গ করেন পরিবার, আর্জেন্টিনার জনগণ এবং অতি অবশ্যই, দিয়েগোকে। মহাকালের আয়নায় দিয়েগোর মতোই মেসি আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে ছাপটা খোদাই করে রেখে যান, দিয়েগো সেটি দেখেন মহাকাল-সমান অন্য পৃথিবী থেকে।
আর্জেন্টিনায় উল্লাস হয়, মেসিরা সে উল্লাস দেখেন। উল্লাস দেখার আগে নিজেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন, উন্মত্ত উল্লাস করেন। মারাকাইবো, মারাকানা, সান্তিয়াগো ও মেটলাইফ স্টেডিয়ামের কান্না অসীম শূন্যতায় মিশে যায় মারাকানায়।
কিন্তু তার আগে মেসি রোদ্দুর হন। তার আগে মেসি নীরার দেখা পান। মেসির আর নিখিলেশকে প্রশ্ন করতে হয় না। আর্জেন্টিনা অনন্ত-অসীম মহাকালে অবশেষে খুঁজে পায় তাদের জিরো আওয়ার।
তাদের একান্ত, ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার।