Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পুরাণ সবিশেষ ১: রাবণবৃত্তান্ত প্রথমভাগ

সৃষ্টির প্রথমলগ্নে সৃষ্টির দেবতা প্রজাপতি ব্রহ্মা জল বা বারিলোক সৃষ্টি করেন। তারপর, একদল প্রাণীকে জলাভূমির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন। তারা ব্রহ্মদেবকে ‘রক্ষাম’ ‘রক্ষাম’ (রক্ষা করব) বলে আশ্বস্ত করে, তারা সযত্নে জলাভূমির রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এদেরকে বলা হয় রাক্ষস। তাদের সাথেই আরেকদল প্রাণী বলে ‘যক্ষাম’ ‘যক্ষাম’; অর্থাৎ, আমরা পূজো করব। তাদেরকে বলা হয় যক্ষ। এই রাক্ষসকুলেই রাবণের জন্ম।

ব্রহ্মা জলভাগ সৃষ্টি করে তা রক্ষার দায়িত্ব দেন রাক্ষসদের; Image Source : quora.com

রাক্ষসেরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জলাভূমির রক্ষণ ও নিজেদের বংশবিস্তার করা শুরু করে। কিছুকাল পরে রাক্ষসবংশে সুকেশ নামীয় একজন রাজার জন্ম হয়। মহারাজ সুকেশ গন্ধর্বকন্যা দেববতীকে বিয়ে করেন। গন্ধর্ব হলো স্বর্গলোকে গান গেয়ে দেবতাদের আনন্দদয়ীরা। সুকেশ ও দেববতী দম্পতির তিন পুত্র জন্ম হয়– মালী, সুমালী ও মাল্যবান। তিন রাক্ষসভ্রাতাই সুমেরু পর্বতে ব্রহ্মদেবের তপস্যায় মগ্ন হলে ব্রহ্মদেব তাদের অজেয়, পরাক্রমশালী, শত্রুহন্তা ও প্রতাপশালী হওয়ার বর দান করেন। ভ্রাতাত্রয় তখন দেবতাদের শিল্পী ও নির্মাতা বিশ্বকর্মাকে ত্রিকূট পাহাড়ের উপর উজ্জ্বল ও ভব্য লঙ্কাপুরী নির্মাণের অনুরোধ করেন।

রাক্ষস ভ্রাতৃত্রয় মালী, সুমালী ও মাল্যবান; Image Source : kaushik art

লঙ্কাপুরী নির্মাণান্তে তিন ভাই বিশ্বকর্মাকে দক্ষিণা দিয়ে বিদায় করে পাহাড়ের উপরের অদ্ভুত লঙ্কাপুরীতে বসবাস শুরু করেন। রাজা হলেও রাক্ষসস্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি তারা। মুনী-ঋষি, দেব-যক্ষ, জন্তু-জানোয়ার কেউই তাদের উৎপীড়ন থেকে রেহাই পায় না। নির্যাতিতরা প্রথমে যায় কৈলাসে মহাদেবের কাছে। মহাদেব অপারগতা প্রকাশ করলে তারা বৈকুণ্ঠধামের দিকে হাঁটা দেয়। সেখানে ভগবান বিষ্ণু তাদের আর্জি মঞ্জুর করেন। বিষ্ণুদূত ও বিষ্ণুসেনারা লঙ্কাপুরীতে গিয়ে রাক্ষসসেনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে মালী নিহত হলে অন্য দুই ভাই সপত্নীক গিয়ে পাতালে আশ্রয় নেয়। পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেও মান হারায় তারা। প্রতিশোধবহ্নিতে জ্বলতে থাকে ভ্রাতৃদ্বয়।

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা; Image Source : Pinterest

মহারাজ সুমালী সিদ্ধান্ত নেন, তার কন্যা কৈকেসী, যার আরেক নাম নিকষা- তার বিয়ে তিনি দেবেন এমন পুরুষের সাথে, যিনি হবেন মহাপ্রতাপী ও মৃত্যুপুরীর রাজা; যাতে তাদের পুত্রগণ হয় অজেয়। সে হিসেবে তিনি কৈকেসীকে পুলস্ত্য মুনির পুত্র বিশ্রবার পত্নীত্ব গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। কৈকেসী সন্ধ্যাকালে মুনির আশ্রমে এসে পৌঁছান। মুনি তপোবলে পূর্বেই কৈকেসীর আগমনের হেতু জানতে পারেন।

রাবণের পিতামহ মহামুনি পুলস্ত্য; Image Source : Hinduism the forgotten facts.

কৈকেসী নিকটে এলে মুনি বলেন,

“তিষ্ঠ! তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। তবে, প্রদোষকালে এমন কামার্ত হয়ে আসার কারণে তোমার গর্ভজাত পুত্ররা হবে উগ্র-উন্মত্ত-ক্রূরকর্মা রাক্ষস।”

কৈকেসী দুঃখিত হৃদয়ে মুনির নিকট সুসন্তানের কামনা করলে মুনি বলেন,

“তথাস্তু, কনিষ্ঠটি ধর্মাত্মা হোক।”

কৈকেসীর গর্ভে বিশ্রবার একে একে চারটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সবচেয়ে বড়টির জন্মকালে প্রকৃতিতে অশুভ লক্ষণ দেখা দেয়। ভূমিকম্প আসে, সূর্যের রং মলিন হয়ে যায়, জলোচ্ছ্বাস হয়। ছেলেটির ঘাড়ে দশটি মাথা দেখে বিশ্রবা এর নাম দেন ‘দশগ্রীব’ বা ‘দশানন’। পরেরটি ছিল কুম্ভকর্ণ। তৃতীয়বারেও একটি ছেলে প্রসব করেন কৈকেসী। তার নাম রাখা হয় বিভীষণ। চতুর্থবারে একটি কন্যা প্রসব করলে তার নামকরণ করা হয় শূর্পণখা।

কৈকেসীর চার সন্তান- রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শূর্পণখা ও বিভীষণ (বাঁ থেকে); Image Source : pakkapatriot.com

মহামুনি বিশ্রবার দেববর্ণিনী নামে আরেকটি পত্নী ছিল। তিনি ছিলেন আরেক মহামুনি ভরদ্বাজের কন্যা। দেববর্ণিনীর গর্ভে বিশ্রবার একটি পুত্র হয়। কুবের। যাকে ধন-সম্পদের দেবতা বলে পূজো করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। কুবের আর রাবণ ছিলেন আদতে বৈমাত্রেয় ভাই। বিষ্ণুকর্তৃক লঙ্কাপুরী রাক্ষসশূন্য হওয়ার পরে কুবের ভগবান বিষ্ণুর কাছ থেকে লঙ্কাপুরীতে বসবাসের অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে তার মাকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। কুবের তার পুত্র বিষর্ভকে লঙ্কাপুরী পুনঃনির্মাণের আদেশ দেন।

বিরাট ধনরাশির অধিপতি ছিলেন কুবের। আপদকালে দেবতারা তার কাছ থেকে ধনসাহায্য নিত। কুবেরের ঐশ্বর্য দেখে রাবণ হিংসায় ফেটে পড়েন। তিনি তার তিন ভাইকে সাথে নিয়ে ব্রহ্মদেবের ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাবণের তপই ছিল সবচেয়ে ঘোরতর। শত বছরের ঘনঘোর তপস্যার ফলে ব্রহ্মদেব তার কাছে না এসে পারেন না। অবশেষে ব্রহ্মদেব তার সামনে প্রকট হলেন এবং তিন ভাইকেই বরপ্রার্থনা করতে বললেন।

মহামুনি বিশ্রবার কৈকেসী ও দেববর্ণিনী নামক দুটি পত্নী ছিল; Image Source : Pinterest

রাবণ অমরত্বের বর চাইলে ভগবান ব্রহ্মা বললেন,

“প্রাণ নিয়ে জন্মালে মরতে তাকে হবেই। জগতের সবই নশ্বর। এটাই সবচেয়ে বড় সত্য। আমি এমন বর তোমায় দিতে পারি না, পুত্র। তুমি আরেকটু ভেবে বর মাগ।”

রাবণ নর ও বানর বাদে জগতের প্রতিটি প্রজাতির জীবের নাম উল্লেখ করে ব্রহ্মদেবকে বললেন, “এদের কারো হাতে যেন আমার মৃত্যু না হয়।” ভগবান ব্রহ্মা “তথাস্তু” বলে মিলিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা রাবণের বাকি দুই ভাইকেও বর দিয়েছিলেন। বিভীষণ বর চেয়েছিলেন, যেন তার সতত ধর্মে মতি থাকে। কুম্ভকর্ণ মনে মনে ঠিক করেছিল তিনি ‘ইন্দ্রাসন’ চাইবেন। অর্থাৎ, দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের স্থান চাওয়ার বাসনা ছিল তার। ইন্দ্র একথা জানতে পেরে ব্রহ্মাকে গিয়ে অনুরোধ করেন যাতে তিনি কুম্ভকর্ণকে ইন্দ্রাসনের বর না দেন। ব্রহ্মা তাকে সরস্বতীর সাথে সাক্ষাৎ করে সরস্বতীকে এ সমস্যার কথা বলতে বলেন। সরস্বতী ইন্দ্রকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি কুম্ভকর্ণকে ইন্দ্রাসনের বর চাইতে আটকাবেন। কুম্ভকর্ণ বর চাইতে হা করলে বিদ্যাদেবী সরস্বতী তার গলায় গিয়ে আটকান। তখন কুম্ভকর্ণের মুখ থেকে ইন্দ্রাসনের বদলে নিন্দ্রাসন বের হয়ে যায়। ব্রহ্মদেবের আজ্ঞায় তার দু’চোখ ভারি হয়ে ঘুম নেমে বসে। রাবণ আর বিভীষণ তাকে বয়ে প্রাসাদ অবধি নিয়ে এলেন। কুম্ভকর্ণ ছয় মাস ঘুমোতেন। তারপর তার ঘুম ভাঙলে প্রচুর আহারাদি করে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন। রাম-রাবণের যুদ্ধকালে কুম্ভকর্ণকে রাবণের নির্দেশে অসময়ে জাগানো হয়, রামসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাতে।

ভ্রাতা কুবেরকে লঙ্কা থেকে উচ্ছেদ করেন রাবণ; Image Source : amar chitra katha

ব্রহ্মার বরে রাবণের প্রতাপ শতগুণ বেড়ে যায়। তিনি প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেন, মাতামহ সুমালীর অপমানের প্রতিশোধের। লঙ্কাপুরী কুবেরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন তিনি। কুবেরকে বিতাড়িত করে রাবণ সপরিবার রাক্ষসদের নিয়ে জেঁকে বসেন লঙ্কাপুরীতে। কুবের পরাজিত হয়ে পিতা বিশ্রবার নিকট গেলে বিশ্রবা তাকে হিমালয় গিয়ে বাস করার পরামর্শ দেন। কুবের মাকে নিয়ে কৈলাসে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। কৈলাসে থাকার সুবাদে মহাদেবের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয় তার এবং একপর্যায়ে মহাদেবের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হন তিনি।

রাবণপত্নী মন্দোদরী রাবণকে সীতার উপর  চড়াও হওয়া থেকে আটকাচ্ছেন; Image Source : Tamil and Vedas

রাবণ এখন হলেন লঙ্কেশ রাবণ। ভব্য লঙ্কাপুরীর রাজা তিনি। লঙ্কাজয়ের পরে রাবণ অসুরদের শিল্পী ও নির্মাতা ময়দানব ও অপ্সরা হেমার কন্যা মন্দোদরীকে বিয়ে করেন। ভাইবোনদেরও বিয়ে দেন। বোন শূর্পণখার তিনি বিয়ে দেন রাক্ষসরাজ বিদ্যুজ্জিহ্বের সাথে। মন্দোদরী পতিব্রতা নারী ছিলেন। অন্যদিকে, রাবণ ছিলেন যুদ্ধংদেহী রাক্ষস। কথিত আছে, রাবণকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে তিনি শতরঞ্জ অর্থাৎ, দাবা খেলার উদ্ভাবন করেন। রাবণের পুত্র-পৌত্রের সংখ্যা নিয়েও মতভেদ আছে। সর্বোচ্চ যে সংখ্যাটি প্রচলিত, সে অনুযায়ী তার পুত্র ছিল এক লক্ষ; আর, পৌত্র সোয়া লক্ষ।

রাবণ অমরত্বের বড়াইয়ে ত্রিভুবন জয় করতে বেরিয়ে পড়েন, অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। রাবণকে শোধরানোর পরামর্শ দিয়ে তার বৈমাত্রেয় দাদা কুবের কৈলাস থেকে একজন দূতকে একটি পত্রসহ প্রেরণ করলে রাবণ যারপরনাই ক্রোধিত হন। তিনি সেই দূতকে ধরে তার রাক্ষসদের খেতে দেন। তাতেও গায়ের জ্বালা মিটল না তার। সেনা নিয়ে কুবেরকে আক্রমণের পর তাকে পরাস্ত করে তার পুষ্পক বিমানখানি হাতিয়ে তবেই শান্ত হলেন তিনি। সে রথের এমন গুণ, যে সারথীর মনের গতির সাথে তা উড়িয়ে নিয়ে যায় সারথীকে। মনের সুখে পুষ্পকে চরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন রাবণ।

পুষ্পক বিমানে বিহাররত রাবণ; Image Source: ravana.info

একবার কৈলাসের উপর দিয়ে বিমান নিয়ে যাওয়ার সময় রাবণের বিমান আটকে যায়। রাবণ হৈহল্লা শুরু করলে মহাদেবের বাহন নন্দী এসে তাকে বলে যে,

“যেখানে হর-পার্বতী একসাথে বসে থাকেন, সেই কৈলাসের ওপর দিয়ে কোনো রথ বা বাহন যাবার অনুমতি নেই, তুমি ফিরে যাও রাক্ষস।”

নন্দীর মুখ ছিল পিঙ্গলবর্ণ। দেখতে অনেকটা বানরের মতো। রাবণ নন্দীর চেহারা নিয়ে কটূক্তি করলে নন্দী রেগে গিয়ে অভিশাপ দেয়, কোনো বানরের হাতেই যেন তোর লঙ্কাপুরী পুড়ে ছাই হয়। রাবণ নন্দীর অভিশাপকে একদম আমলে না নিয়ে বিশ হাত দিয়ে কৈলাসকে তুলে ফেলে। কেঁপে ওঠে কৈলাস। মহাদেবের সহচরগণের কেউ কেউ ভয়ে মূর্ছা যায়।

বিশহাতে কৈলাস উত্তোলনরত রাবণ; Image Source: aastik.in

মুচকি হেসে মহাদেব পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে কৈলাসে চাপ দিলে বিরাট কৈলাসের নিচে রাবণের হাতগুলো চাপা পড়ে। ভয়ংকর আর্তনাদ শুরু করেন তিনি। ত্রিভুবন কেঁপে ওঠে তার চিৎকারে। মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে রাবণ ‘শিব তাণ্ডব স্ত্রোত্র’ রচনা করে আবৃত্তি করলে পরে মহাদেব তার প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তাকে মুক্ত করেন। রাবণরচিত সে মহাস্ত্রোত্র এখনও শিবভক্তদের দ্বারা বহুলচর্চিত। মহাদেব দশাননের নাম দেন ‘রাবণ’, কারণ তার রবে ব্রহ্মাণ্ড কম্পিত হয়। সেই থেকে দশানন এ নামে পরিচিতি পান। মহাদেব তাকে ‘চন্দ্রোহাশ’ নামক একটি মহাপ্রতাপী খড়গও উপহার দিয়েছিলেন সেসময়। সেই থেকে রাবণ মহাদেবের পরম ভক্তে পরিণত হলেন। মহাদেবের ভক্তিতে রাবণ একবার এক এক করে তার মাথাগুলো কেটে আহুতি দেওয়া শুরু করেন। দশম মাথাটি কাটার আগমুহূর্তে মহাদেব এসে তাকে নিবৃত্ত করে বর প্রদান করেন।

শিবের বরে দশানন রাবণে এবং মহান শিবভক্তে পরিণত হন; Image Source : quora.com

রাবণের দশ মাথা দশ রকমের বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিল। কলা, শিল্প, সঙ্গীত, যুদ্ধ কূটনীতি, ছল, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন রাবণ। তিনি ভালো বীণা বাজাতে পারতেন। বাস্তুশাস্ত্র ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তিনি ছিলেন মহাপণ্ডিত। রাবণ তার পুত্র মেঘনাদের জন্মকালে বলপ্রয়োগের দ্বারা সকল গ্রহাদিকে শুভলগ্নে এনে হাজির করেন। সব গ্রহই রাবণের আদেশে শুভক্ষণে এসে দাঁড়ালেও শনি রাবণের কথা অমান্য করে মেঘনাদের কুষ্ঠিতে কুগ্রহ সৃষ্টি করলে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে শনির পা ভেঙে দেন। এর ফলে বাকি জীবন শনিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে।

শনিদেব; Image Source: jagran.com

রাজকার্য শেষে রাবণ পুষ্পক রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শক্তিশালীদের সাথে যুদ্ধ করতে। তাদের সবাইকে যে পরাজিত করতে পেরেছিলেন, তা নয়। অনেকের কাছেই তাকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসতে হতো। একদিন বিকালে রাবণ নর্মদা নদীর তীরে মহাদেবের স্তব করার সময় অবাক হয়ে খেয়াল করেন যে সদা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বহমান নর্মদা সেদিন পশ্চিম থেকে পূর্বে বইছিল। কারণ অনুসন্ধান করতে করতে নদীর তীর ধরে খানিকটা আগানোর পরে মাঝনদীতে জলক্রীড়ারত একজন সহস্রবাহুর লোককে দেখে রাবণের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। লোকটি ছিলেন মহারাজ কার্তবীর্য। রাবণ তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে কার্তবীর্য তাকে পরাজিত করে বন্দী করেন। পরে, রাবণের পিতামহ মহামুনি পুলস্ত্য এসে তাকে মুক্ত করেন।

কার্তবীর্য রাবণকে পরাজিত করেছিলেন; Image Source : quora.com

বানরদের দেশ ছিল কিষ্কিন্ধ্যা। সে দেশের রাজা তখন বালি। রাবণ লোকমুখের বালির বীরত্বগাথা শুনে একদিন কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হন বালির সাথে যুদ্ধ করতে। গিয়ে খবর পান, বালি সেখানে নেই, সন্ধ্যারতি করতে সমুদ্রের তীরে গিয়েছেন। আরতিরত অবস্থায় বালিকে আক্রমণ করলে বালি রাবণকে বগলদাবা করে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চার সমুদ্রের তীরে তার আহ্নিক শেষ করেন। পরাজয় স্বীকার করে রাবণ বালির সাথে মিত্রতা স্থাপন করে পরে লঙ্কায় ফিরে আসেন। মুনি-ঋষিদের সাথেও রাবণ বহু যুদ্ধ করেছেন। কপিল মুনি তাকে এক আছাড়ে ধরাশায়ী করেন।

বানররাজ বালির কাছে পরাজিত হওয়ার পরে বালির সাথে সন্ধি করেন রাবণ; Image Source: Bali gates of heaven

রাবণ একবার পাতালে গিয়ে দৈত্যরাজ বলিকে স্বভাবসুলভ দাম্ভিক বচনে প্রস্তাব দেন,

“মহারাজ, বিষ্ণু আপনাকে পাতালে আটকে রেখেছে এতকাল। কেউ আপনাকে মুক্ত করতে আসেনি। আমি মহাপ্রতাপী রাবণ। আমি আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি।”

রাবণের কথা শুনে বলি হেসে অদূরে একটি চাকচিক্যময় চাকা দেখিয়ে রাবণকে বলেন,

“ভালো কথা, আমাকে ছাড়াতে এসেছ তুমি। আগে ঐ চাকাটি গিয়ে তুলে আনতো দেখি। তারপরে বুঝবো তুমি কত প্রতাপী।”

রাবণ প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেটি তুলতে পারেন না। বরং সেটির ঝলকানিতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফেরার পর বলি তাকে বলেন,

“এটি আমার পূর্বপুরুষ হিরণ্যকশিপুর কুণ্ডল। সেই হিরণ্যকশিপু, যাকে ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার ধরে বধ করেছিলেন। আর, তুমি সেদিনের ছোকরা এসেছ আমায় মুক্ত করতে। দূর হ, ব্যাটা!”

যম-রাবণের যুদ্ধ; Image Source : sastracaksu.in

দেবর্ষি নারদ বরাবরই একটু কলহপ্রিয়। এর কথা গিয়ে ওর কাছে আর ওর কথা এর কাছে বলে কলহ তৈরি করে তিনি বড্ড আনন্দ পেতেন। রাবণকে গিয়ে একবার তিনি যমকে আক্রমণের মন্ত্রণা দেন। যম তার ধর্মদণ্ড ও মরণপাশ দিয়ে রাবণকে আঘাত করলেও ব্রহ্মার বরে আশ্চর্যজনকভাবে রাবণ বেঁচে যান। লজ্জায় যম যমপুরী ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। রাবণ তারপর পুত্র মেঘনাদকে সাথে নিয়ে স্বর্গ আক্রমণ করেন। সেই মেঘনাদ ইন্দ্রকে পরাজিত করে ‘ইন্দ্রজিৎ’ নাম ধারণ করে। ইন্দ্রকে ধরে এনে লঙ্কায় বন্দী বানিয়ে রাখা হয়। পরে ভগবান ব্রহ্মা এসে ইন্দ্রকে মুক্ত করেন এবং মেঘনাদকে বর দেন যে, যেকোনো যুদ্ধের পূর্বে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে মেঘনাদ ইষ্টদেবতাকে অর্ঘ্য প্রদান করলে সে অজেয় বীরে পরিণত হবে।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন পুরাণভেদে এসব কাহিনীতে মতান্তর রয়েছে, তাই অমিল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। এই লেখাতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনীই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

This article is in Bangla. It described the facts about on of the greatest mythological character and the great Asura King named Ravana. It's the first part of the series.

Most of the necessary references have been hyperlinked inside the article and here are some reference books:

  1. বৃহৎ, সটীক ও সচিত্র সপ্তকাণ্ড কৃত্তিবাসী রামায়ণ (মূল রামায়ণ থেকে কৃত্তিবাস পণ্ডিত কর্তৃক পয়ার ত্রিপদী ছন্দে অনুবাদিত). সম্পাদনা : শ্রী বেনীমাধব শীল, প্রকাশক : অক্ষয় লাইব্রেরি (কলকাতা).
  2. সচিত্র কিশোর পুরাণ সমগ্র (২০১৫). দীন ভক্তদাস বিরচিত. প্রকাশক : অক্ষয় লাইব্রেরি (কলকাতা).
  3. পুরাণের গল্প. লেখক : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী. মূল বই : উপেন্দ্রকিশোর সমগ্র (২০০৪). প্রকাশক : দে'জ পাবলিকেশন্স (কলকাতা, ৭০০ ০৭৩)

Featured Image: quora.com

 

Related Articles