ফিনিক্স পাখির কথা মনে আসতেই শুরুতেই কল্পনায় চলে আসে এক রঙিন পাখি, অনেক বছর বেঁচে যে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করে এবং এরপর নিজের ছাই থেকেই আবার নতুন করে জন্ম নেয়। যুগ যুগ ধরে নবউদ্যমে পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে যে ফিনিক্স পাখির কথা চলে এসেছে, তারই পৌরাণিক ইতিহাস নিয়ে আজকের লেখা।
এটা সত্য যে, উপকথার ফিনিক্স (Phoenix) পাখিকে মানুষ চেনে বহুকাল ধরে, কিন্তু এটাও মানতেই হবে, সাম্প্রতিককালে এই পাখির অতি জনপ্রিয়তার একটি কারণ হ্যারি পটার! হ্যারি পটার সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে লেখিকা জে কে রোলিং আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন টুকটুকে লাল এক পোষা ফিনিক্স পাখির, যার অশ্রুজলে সুস্থ হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী হ্যারি। সেই থেকে উঠতি প্রজন্মের কাছে ফিনিক্স পাখি মানেই যেন অন্য কিছু, মহান এক পাখি!
কিন্তু সত্যিকারের পৌরাণিক ইতিহাস আমাদের কী জানায় এই ফিনিক্স পাখিকে নিয়ে?
প্রাচীন মিসরের বেনু পাখিই মূলত আজকের ফিনিক্স। কেমন ছিল এই বেনু পাখি? হলুদ, কমলা, লাল আর সোনালি- হরেক রকমের মিশেলে রাঙা এক স্বপ্নিল পাখি বেনু। আবার এমনও বলা আছে যে, পাখিটির রং ধূসর, নীল, বেগুনী ও সাদার মিশেল। কেউ বলত, ৫০০ বছর বাঁচত বেনু বা ফিনিক্স, কেউ বা বলত হাজার বছর! কিন্তু সেই সময়টা শেষ হয়ে যাবার পর নিজের বানানো এক আগুনে ভস্মীভূত হয়ে মারা যেত ফিনিক্স পাখি, এরপর ছাই থেকে শিশু ফিনিক্স আবার বেরিয়ে আসত। ‘বেনু’ শব্দের অর্থই হলো আগুন থেকে ‘সুন্দর করে বেরিয়ে আসা’। ফিনিক্সের আছে পুনর্জন্ম আর অমরত্বের বৈশিষ্ট্য।
অনেক সংস্কৃতিতেই অবশ্য এই পৌরাণিক পাখির হরেক রকম উপস্থাপন রয়েছে। তবে আমরা মিসরীয় রূপকথাটাই বলি প্রথমে। এক পুরাণে বলা আছে, মিসরীয় দেবতা অসাইরিসের হৃদয় থেকে জন্ম নেয় ফিনিক্স পাখি। অন্য পুরাণে অবশ্য বলা আছে, রা দেবতার মন্দিরের পবিত্র গাছের গায়ে লাগানো আগুন থেকে জন্ম ফিনিক্সের। সে মন্দিরের পবিত্র স্তম্ভ বেনবেন পাথরের উপর বাস করত ফিনিক্স। মারা যাবার সময় এলে, সিনামন গাছের ডগাগুলো যোগাড় করে সেগুলো তার নীড়ে রেখে আগুন ধরিয়ে দিত। সেই আগুনে ছাই হয়ে যেত ফিনিক্স পাখি। আর এরপর যা হবার তাই হতো- ছাই থেকে জন্ম হতো এক নতুন ফিনিক্সের। হেরোডোটাস, লুকান, প্লাইনি দ্য এল্ডার, পোপ প্রথম ক্লিমেন্ট, ল্যাক্টানশিয়াস, ওভিড এবং সেভিলের ইসিডোর- এদের কাছ থেকে ফিনিক্স পাখি নিয়ে প্রাচীন তথ্য জানা যায়। ড্রামাটিস্ট এজেকিয়েলের মতে, ফিনিক্স পাখির পাগুলো হতো রক্তলাল আর চোখ হলদে রঙের।
মাঝে মাঝে ফিনিক্স পাখিকে মানুষের বেশেও আঁকা হতো, ধারণা করা হতো দেবতা আতুম, রা কিংবা অসাইরিসের আত্মাই ফিনিক্স পাখি। নীল নদের শুকিয়ে যাওয়া ও আবার পানিপূর্ণ হয়ে ওঠার সাথে মিসরীয়রা ফিনিক্স পাখির মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মিল খুঁজে পেত।
এবার চলুন আমরা পারস্যে ঢুঁ মেরে আসি। পারস্যে ফিনিক্স পাখির নাম ছিল ‘হুমা’। এর অর্থ হলো ‘বেহেশতের পাখি’। পারস্যেও বিশ্বাস করা হতো, শত শত বছর বেঁচে থেকে আগুনে ছাই হয়ে যেত হুমা, এরপর ছাই থেকে আবার তার জন্ম হতো। দয়ালু ফিনিক্স পাখি যাকে স্পর্শ করত, তারই সুভাগ্য বয়ে আনত। ফিনিক্সের এক দেহেই পুরুষ ও স্ত্রী সত্ত্বা। এক পাখা ও এক পা হলো পুরুষের, অন্য পা ও পাখা হলো নারীর। ফিনিক্স পাখি কখনো কোনো প্রাণী হত্যা করত না, বরং মৃত পশুর মাংস খেত। বিশ্বাস করা হতো, ফিনিক্সের ছায়ায় কেউ দাঁড়ালে তার জন্য সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে। আর কারো মাথায় বসলে তো কথাই নেই, সে একদিন রাজা হবে।
এবার গ্রিকদের পালা। ফিনিক্স শব্দটা কিন্তু আসলে গ্রিক, অর্থ ‘রক্তলাল’। গ্রিক ও রোমানরা ফিনিক্সকে ময়ূরের মতো কল্পনা করত। ফিনিক্স ফল-মূল খাবার পাখি নয়। গ্রিকরা বিশ্বাস করত, এই পাখি আরবে বাস করে। প্রতি ভোরে, ফিনিক্স তার বাসস্থানের পাশের এক কুয়ার পানিতে গোসল করে এবং সূর্য দেবতা অ্যাপোলো তার রথ থামান ফিনিক্সের গান শুনবার জন্য। সে যে কী মধুর গান!
এখন এশিয়া মহাদেশের পালা। অনেকে সংস্কৃত উচ্চারণে ‘গরুদ’ পাখিকে ফিনিক্স পাখির সাথে মেলান। রামায়ণে এর উল্লেখে পাওয়া যায়। গরুদ হলো দেবতা বিষ্ণুর বাহন। আর চীন দেশে ফিনিক্স পাখি ফেংহুয়াং নামে পরিচিত। সেখানে ফিনিক্স পাখিকে পরিপূর্ণতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তবে সে দেশে ফিনিক্স কিন্তু মরে না, কেবলই বেঁচে থাকে, অমর। এগুলো ছাড়াও রাশিয়ার ফায়ারবার্ড, জাপানিজ হোও পাখি, স্থানীয় অ্যামেরিকানদের থান্ডারবার্ডের সাথে ফিনিক্সের মিল আছে।
ইহুদি পুরাণে ফিনিক্স মিলহাম পাখি বা হল পাখি নামে পরিচিত। ইহুদীদের মিদ্রাশ রাব্বাহ মোতাবেক, যখন হযরত আদম (আ) ও বিবি হাওয়া (আ) স্বর্গে ছিলেন, তখন অন্য সকল প্রাণীও সাথে ছিল। যখন হাওয়া (আ) ধোঁকায় পড়ে নিষিদ্ধ ফল খান, তখন তিনি খুব দুঃখিত হন এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে স্বর্গের অন্য সকল প্রাণীকেও সেধে সেধে খাওয়ান। কিন্তু একমাত্র ফিনিক্স বা মিলহাম পাখি সেটি খেতে অস্বীকার করে। এজন্য ঈশ্বর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে মরণশীল করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, কিন্তু ফিনিক্স পাখিকে অমরত্ব দান করেন পুরস্কার হিসেবে। র্যাবাই শ্লোমো ইসহাকি বলেন, ফিনিক্স পাখির উপর মৃত্যুর কোনো ক্ষমতা নেই, কারণ সে নিষিদ্ধ গাছের ফল আস্বাদনই করেনি। বাইবেলের Job 29:18 রেফারেন্সেও নবী হযরত আইয়ুব (আ) এর কষ্টের দিনগুলো কত দীর্ঘ ছিল তা বোঝাতে গিয়ে ফিনিক্স পাখির আয়ুর সাথে তুলনা করা হয়। খ্রিস্টধর্মের প্রথম দিকে, ফিনিক্স পাখিকে যিশুর মরণ ও পুনরুত্থানের প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
ইউরোপীয় সেটলারগণ যখন আমেরিকার অ্যারিজোনার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত নেটিভ আমেরিকান এলাকায় নতুন করে শহর গড়ে তুলতে যায়, তখন এর নাম দেয় ফিনিক্স, কারণ এক মৃত শহর থেকে নতুন শহর বেরিয়ে আসছে।
ফিনিক্স পাখি কিন্তু আলকেমিতে একটি প্রতীকও বটে! এর অর্থ রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় পদার্থ যে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায় ও যেভাবে নতুন এক পদার্থে পরিণত হয়। পরশ পাথর বা ফিলোসফার্স স্টোন বানাবার লিখিত প্রক্রিয়ার পেছনেও ফিনিক্স পাখির কিছু না কিছু অংশ জড়িত ছিল বলে জানা যায়। ফিনিক্স পাখির অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝে আছে- ফিনিক্স পাখির অশ্রুর রয়েছে সুস্থ করে দেবার ক্ষমতা, আর ফিনিক্স পাখির সামনে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না।
শিল্প-সাহিত্যে যে কতবার কতভাবে ফিনিক্সের কথা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। হালের জে কে রোলিং থেকে শুরু করে সেই শেক্সপিয়ার পর্যন্ত আছে ফিনিক্সের ছড়াছড়ি। যেমন ধরুন, শেক্সপিয়ারের Henry VIII নাটকের পঞ্চম অংকের পঞ্চম দৃশ্যে, রাজা বলছেন-
“Nor shall this peace sleep with her; but as when
The bird of wonder dies, the maiden phoenix,
Her ashes new create another heir
As great in admiration as herself…”
ফিনিক্স পাখির রূপকথাটি যুগে যুগে নতুনভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, নতুন করে জন্ম নিয়েছে, ঠিক যেন ফিনিক্স পাখিরই মতো। যেভাবেই পরিবর্তন হোক না কেন, আজীবন নবজন্মের প্রতীক হিসেবেই টিকে থাকবে ফিনিক্স পাখি।