গ্রীক মিথোলজির গল্পের নায়ক চিন্তা করলে কার কথা মাথায় আসবে? হারকিউলিস, পার্সিউস, বেলেরফন, জ্যাসন, একিলিসসহ আরো অনেকের নামই হয়তো মনে পড়বে। কিন্তু কোনো নারীকেন্দ্রিক কাহিনী কি খুব সহজেই ভেবে বের করা যাবে?
হ্যাঁ, অনেক গল্পেই নারীদের ভূমিকা ছিল, কিন্তু তাদের আমরা বলি পার্শ্বচরিত্র। অস্কার পাওয়া প্রধান চরিত্রকে নিয়ে যেরকম মাতামাতি, পার্শ্ব অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে কি সেরকম হয়? গ্রীক পুরানের বেশিরভাগ গল্পেই নারী চরিত্রের প্রধান কাজ ছিল পুরুষ চরিত্রের প্রেমে পড়া, তাকে তার অভিযান সফল করতে সহায়তা দেয়া। অনেক সময়ই তাদের পরিণতি হত করুণ। কাহিনীর প্রধান চরিত্রই নারী সেরকম গল্প হাতেগোণা। আজকে সেরকম এক গল্পই শোনানো হবে, আটলান্টার গল্প।
কে এই আটলান্টা
আটলান্টার কাহিনী বহু পুরনো। তখন ট্রোজান যুদ্ধ শুরু হয়নি, জ্যাসনও তার আর্গোন্যাটস দলকে নিয়ে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দেননি স্বর্ণ পশমি মেষচর্মের লক্ষ্যে। সেই সময় আটলান্টার জন্ম। তিনি ছিলেন গ্রীসের কোনো এক রাজ্যের রাজকুমারি। কোন সে রাজ্য তা নিয়ে মতভেদ আছে। কবি হেসিয়ড দাবী করেন তার বাবা মধ্য গ্রীসের বোয়েশিয়ার রাজা স্কোয়েনাস। অ্যাপোলোডোরাস নামে আরেক লেখক জানান, আটলান্টার জন্ম পেলোপন্নেসের পাহাড়ি এলাকায় আর্কেডিয়াতে, রাজা ইসাসের ঔরসে।
পিতৃপরিচয় যা-ই হোক, আটলান্টার জন্ম যে রাজবংশে তা নিয়ে সংশয় নেই। বলা হয়, তার বাবা উত্তরাধিকারীর আশায় জিউসের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। কাজেই স্ত্রী গর্ভবতী হলে তার আনন্দের সীমা ছিলনা। কিন্তু সন্তান হলে তার মুখ আঁধার হয়ে গেল। মেয়ে সন্তানের কাছে তো রাজ্যভার দেয়া যায় না। মেয়ে কাপড় বুনবে, গাইবে, খেলবে, রাঁধবে। ছেলেকে শিক্ষা দেয়া যাবে লড়াইয়ের কায়দা, রাজ্য শাসনের কৌশল আর বড় হলে তার মাথায় মুকুট পরিয়ে তিনি অবসর নিতে পারবেন। মেয়েকে দিয়ে কি আর ছেলের অভাব পূরণ হবে? ক্রুদ্ধ বিরক্ত রাজা তার লোকদের আদেশ করলেন এই বোঝা পাহাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে, যাতে সেখানেই এই হতভাগার মৃত্যু হয়।
রাজার আদেশ বলে কথা। ফুটফুটে শিশুকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলেও রাজ কর্মচারী বাধ্য হলেন নির্দেশ পালন করতে। বনের মধ্যে পাহাড়ের উপর বিরাট এক পাথরের ছায়ায় ঘাসের বিছানায় শিশুকে শুইয়ে দিয়ে তিনি চলে আসলেন। দিন ফুরনোর আগেই সে নিশ্চয়ই কোনো হিংস্র পশুর খাবারে পরিণত হবে।
জঙ্গলে বেড়ে ওঠা
একদিন একরাত পার হয়ে গেল। ক্ষুধার জ্বালায় শিশুর কান্না একসময় দুর্বল হয়ে পড়ল। আর একদিনে পরেই হয়তো মৃত্যু এসে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেত। কিন্তু দেবতাদের ইশারা ছিল ভিন্ন। সেদিন সন্ধ্যায় এক মাদি ভালুক তার হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের খোঁজে বেরিয়ে এসেছিল। তার কানে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ গিয়ে পৌঁছে। সারারাত ভালুক বাচ্চার পাশে থেকে তাকে পাহারা দিল। পরদিন সে তাকে নিয়ে গেল নিজের গুহাতে। ভালুক মাতার স্তন্যপানে ছোট্ট মেয়েটি বড় হয়ে উঠতে লাগল। জঙ্গলের ফুল ফল আর বাতাস তাকে করে তুলল শক্তিশালী আর ক্ষিপ্র। সে ছুটতে পারত বায়ুর বেগে। তার সাথে পাল্লা দিতে এমনকি পশুদেরও সমস্যা হত।
ছোট্ট মেয়েটি একবার জঙ্গলে খেলতে খেলতে শিকারিদের চোখে পড়ে যায়। তারা তাকে সাথে নিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসে। বাচ্চাটির নাম তারা রাখল আটলান্টা। তারা আটলান্টাকে শেখাল শিকারের কায়দা কানুন। দীক্ষা দিল অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের। এরপর থেকে যখনই তারা শিকারে যেত আটলান্টা তাদের সঙ্গী হত। খুব দ্রুতই সে তার পুরুষ সাথীদের থেকেও দক্ষ শিকারি হয়ে ওঠে। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার সৌন্দর্যও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। একবার দুই সেন্টর কুমতলবে আটলান্টাকে তাড়া করে। বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে আটলান্টা স্থিরচিত্তে ধনুকে তীর পড়াল, নির্ভুল নিশানায় গেঁথে ফেলল দুই দুর্বৃত্তকে।
ক্যালেডোনিয়ান ভালুক শিকার
ক্যালেডোনিয়া রাজ্যের রাজা ওনেস শস্য তোলার অনুষ্ঠানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদানের সময় শিকারের দেবী আর্টেমিসকে ভুলে গিয়েছিলেন। রাগান্বিত আর্টেমিস তাকে শাস্তি দিতে বিরাটকায় এক হিংস্র ভালুক প্রেরণ করলেন। চারদিক তছনছ করে সেই ভালুক পুরো রাজ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করল। অনন্যোপায় ওনেস সবখান থেকে সাহসী যুবাদের ডেকে পাঠালেন। তাদের নেতৃত্ব নিলেন যুবরাজ মেলেজার।
এদিকে মেলেজার যখন পরিকল্পনা নিয়ে সবার সাথে আলোচনায় বসেছেন তখন আবির্ভূত হলো আটলান্টা। তার পরনে আলখাল্লা, চুল সাদামাটা ভাবে খোঁপা করা। তার বাম কাঁধ থেকে ঝুলছে তূণীর, আর হাতে ধনুক। প্রথমে বুঝতে না পারলেও অচিরেই সবার মধ্যে ফিসফাস শুরু হলো। আরে, এ তো দেখছি মেয়ে? কী করছে সে এখানে? আটলান্টা যখন জানালো সে-ও ভালুক শিকারে যাবে তখন সবাই তার উপর খাপ্পা হয়ে উঠল। এটা পুরুষদের কাজ বাপু, তোমার থাকার কথা ঘরে, সেখানেই ফিরে যাও।
মেলেজার কিন্তু প্রথম দেখাতেই আটলান্টাকে ভালবেসে ফেলেছিল। কাজেই সাথীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে আটলান্টাকে সঙ্গে নিতে রাজি করিয়ে ফেলল। ভাগ্যিস করেছিল। কারণ যখন তারা আর্টেমিসের পাঠানো ভালুকের দেখা পেল, সেই জন্তু এমন জোরে ছুটে এল যে মেলেজারের দলের দুজন তার ধাক্কাতেই মারা গেল। আতঙ্কিত হয়ে সবাই নিজের বর্শা ছুঁড়ে মারলে সেই বর্শার আঘাতে তাদেরই আরেকজন নিহত হয়। এই গোলমালের মধ্যেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে আটলান্টা তীর ছুঁড়ে মারে। তীরের আঘাতে ভালুকের আহত হলে মেলেজার এগিয়ে যায় এবং পশুটিকে হত্যা করে। কিন্তু সে জানত আটলান্টার সহায়তা ছাড়া তার পক্ষে এই কাজ সম্ভব ছিল না। ফলে মেলেজার ঘোষণা করল শিকারের পুরস্কারস্বরূপ নিহত পশুর চামড়া আটলান্টার প্রাপ্য। অন্যরা তার সাথে একমত না হলেও কেউ বিরোধিতা করল না, কেবল তার দুই মামা ছাড়া। তাদের সাথে বচসা হাতাহাতিতে গড়ালে মেলেজারের হাতে তার মামারা নিহত হলো।
নিজ পুত্রের হাতে ভাইদের নিহত হবার সংবাদ মেলেজারের মা আলথিয়ার কাছে পৌঁছলেন। তিনি শোকে উন্মাদ হয়ে উঠলেন। তার মনে পড়ল ছোটবেলার একটি কাহিনী। মেলেজার তখন এক সপ্তাহের শিশু। ভাগ্যদেবী তার ঘরে হাজির হয়ে একখণ্ড কাঠ ছুঁড়ে মারলেন আগুনে। এরপর তিনি সুতা বুনতে বুনতে গান ধরলেন। গানের মর্মার্থ এই যে, যতক্ষণ এই কাঠ পুড়ে ছাই না হচ্ছে ততক্ষণই মেলেজারের আয়ু। আলথিয়া সাথে সাথেই আগুন থেকে কাঠ তুলে নিয়ে তা সযত্নে রেখে দেন। আজ এতদিন পরে তিনি সেই কাঠ বের করে আবার আগুনে ফেলে দিলেন। কাঠ পুড়ে ছাই হয়ে যেতেই মেলেজারের মৃত্যু হলো। আলথিয়া যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। পুত্র-ভাই সবাইকে হারিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
আর্গোন্যাটস অভিযান
জ্যাসন আয়োল্কাসের সিংহাসনের দাবী করলে তার চাচা পেলিয়াস তাকে পাঠালেন স্বর্ণ পশমি মেষচর্ম কলচিস থেকে নিয়ে আসতে। প্রতিশ্রুতি দিলেন এই কাজে সফল হলে তিনি স্বেচ্ছায় রাজদণ্ড ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে ছেড়ে দেবেন। অভিযানের জন্য যখন জ্যাসন দল গঠন করছিল তখন আটলান্টার কথাও আসে। এখানে বেশ মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়। অনেকে বলেন, জ্যাসন প্রস্তাব দিলেও আটলান্টা রাজি হয়নি। আরেক দল বলে থাকে, জ্যাসনই আটলান্টাকে নিতে চাননি, তার ভয় ছিল এতগুলো পুরুষ মানুষের মাঝে আটলান্টার মতো অপরূপা নারী থাকলে সবার মনোযোগ বিঘ্নিত হতে পারে। ছোট একদল দাবী করেন, আটলান্টা পুরো অভিযানেই ছিলেন এবং জ্যাসনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন।
কুস্তির খেলা
জ্যাসন তার কাজে সফল হলেও কূট স্বভাবের পেলিয়াস তার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে গড়িমসি শুরু করেন। ত্যক্তবিরক্ত জ্যাসন তার জাদুকর স্ত্রী মিডিয়ার সহায়তায় পেলিয়াসকে হত্যা করে। মৃত রাজার সম্মানে আয়োজিত হয় বিশাল অনুষ্ঠান। সেখানে কুস্তির খেলা হচ্ছিল। আটলান্টা এই খেলায় অংশ নেন। তার প্রতিপক্ষ ছিল পেলেউস, পরবর্তীতে যার এক ছেলে সন্তান জন্মে। সেই ছেলের নাম ছিল একিলিস। পেলেউসকে আটলান্টা কুস্তিতে হারিয়ে দেয়।
আটলান্টার দৌড়
পেলিয়াসের অনুষ্ঠানের পর আটলান্টা তার বাবা পরিচয় জানতে পারে। সে বাবার কাছে উপস্থিত হলে তিনি দেখতে পেলেন আটলান্টা যেকোনো ছেলে সন্তানের থেকে অধিক যোগ্য। তিনি মেয়েকে এবার সাদরে বুকে টেনে নিলেন। কিন্তু মেয়ে বড় হয়েছে, তাকে তো বিয়ে দিতে হবে। এদিকে বিয়ের কোনো ইচ্ছাই আটলান্টার ছিল না। সে নিজেকে আর্টেমিসের অনুসারী মনে করত। আর্টেমিস ছিলেন কুমারী, তাই আটলান্টাও কুমারী থাকার পণ করেছিল। তাই সে এক অভিনব প্রস্তাব দিল। বিয়ে সে করবে, তবে যে তাকে দৌড়ে হারাতে পারবে তাকেই। আর যে পারবে না তার গর্দান যাবে। এই কঠিন শর্তের পরেও আটলান্টার গুণমুগ্ধের কমতি হলো না। গ্রীসের দূরদূরান্ত থেকে অনেক তরুণ ছুটে এলো প্রতিযোগিতা অংশ নিতে। সবার স্থান হলো একই জায়গাতে, জল্লাদের খাঁড়ার নিচে।
একের পর এক তরুণ মারা যেতে থাকলেও আটলান্টার সাথে দৌড়ের খেলাতে অংশ নিতে মানুষ আসতেই থাকল। এদের একজন মেলানিয়ন, মতান্তরে হিপোমেনেস। আমরা সুবিধার জন্য হিপোমেনেস ধরেই এগোব। হিপোমেনেস অপরূপ আটলান্টাকে দেখেই তার প্রেমে পড়ে গেল। বলা হয়, আটলান্টাও হিপোমেনেসকে পছন্দ করে ফেলেছিল। কিন্তু তাই বলে প্রতিযোগিতা ছাড়াই হিপোমেনেসকে বিয়ে করলে সেটা ভাল দেখায় না, ফলে হিপোমেনেস প্রস্তুত হলো প্রতিযোগিতার জন্য।
হিপোমেনেস জানত দেবতাদের সাহায্য ছাড়া তার বিজয়ী হওয়া সম্ভব না। সে দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনাতে বসল। সাড়া দিলেন দেবী অ্যাফ্রোডাইট। প্রেম-ভালবাসার দেবী কুমারিত্ব দারুণ অপছন্দ করতেন। তিনি হিপোমেনেসকে দিলেন তিনটি সোনার আপেল। পরামর্শ দিলেন দৌড় শুরু হলে এক এক করে সেগুলো আটলান্টার সামনে ছুঁড়ে ফেলতে।
যথাসময়ে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো। আটলান্টা হিপোমেনেসেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই সে প্রথম আপেল ছুঁড়ে দিল। চকচকে সোনার সেই বস্তু আটলান্টাকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করল। দৌড় ছেড়ে সে ছুটে গিয়ে আপেলটি তুলে নেয়। ইত্যবসরে হিপোমেনেস অনেক দূর চলে গেল। কিন্তু আটলান্টার গতি ছিল কল্পনাতীত। দ্রুতই সে আবার হিপোমেনেসকে ছাড়িয়ে যেতে নেয়। এবার হিপোমেনেস দ্বিতীয় আপেল ছুঁড়ে দিলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। অবশেষে তারা যখন দৌড়ের শেষ প্রান্তে তখন হিপোমেনেস তৃতীয় আপেল ছুঁড়ে দেয় এবং আটলান্টা সেটা কুড়িয়ে ফিরতে ফিরতে সে জিতে যায়।
আটলান্টা পরিণত হলো সিংহীতে
হিপোমেনেস আর আটলান্টার বিয়ে হয়ে গেল। তাদের একটি সন্তানও হলো, পার্থেনোপাস। কিন্তু তাদের ভাগ্যে সুখ বেশি দিন সইল না। অ্যাফ্রোডাইটের সহায়তায় জয়ী হলেও দেবীকে যথাযথভাবে সম্মান জানাতে হিপোমেনেস ভুলে গিয়েছিল। ফলে হিপোমেনেস আর আটলান্টা যখন দেবী সিবেলি, মতান্তরে জিউসের মন্দিরে নৈবেদ্য দিচ্ছিলেন তখন অ্যাফ্রোডাইট তাদের মধ্যে প্রবল কামনা জাগিয়ে তুললেন। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাই মন্দিরের ভেতরেই হিপোমেনেস আর আটলান্টা মিলিত হন। ফলে তারা দুজনেই পড়ে গেলেন দেবতাদের রোষানলে। সিবেলি/জিউস তাদের পরিণত করলেন সিংহ আর সিংহীতে, কারণ তৎকালীন গ্রীকদের বিশ্বাস ছিল সিংহরা এক অপরের সাথে শারীরিকভাবে মিলিত হতে অক্ষম। তাদের লাগিয়ে দেয়া হলো দেবতাদের রথ টানার কাজে। আর এভাবেই সমাপ্ত হল আটলান্টার গল্প।
নানা ধরনের চমকপ্রদ কাহিনী জানতে সংগ্রহ করুন গ্রিক পুরাণ বইটি