করোনার কারণে আসর পিছিয়ে গিয়েছে এক বছর, কিন্তু শুরুর পরই মাঠের অনবদ্য লড়াই বুঝিয়ে দিচ্ছে, অপেক্ষা করাটা বৃথা যায়নি। মাঠের মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়ে প্রথম তিনদিনে পুরো আলো কেড়ে নিয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। তবে, পরবর্তী তিনদিনে পাদপ্রদীপের আলোর নিচে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতে পারেননি কেউ। কখনো প্যাট্রিক শিক, কখনো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, আবার কখনো বা ইতালির প্রাণচঞ্চল আক্রমণাত্মক ফুটবলের জোয়ার – বিশ্ব মেতে ছিল এসব নিয়েই।
ইউরোর চার থেকে ছয় নম্বর দিনে (১৫ জুন থেকে ১৭ জুন) ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির সারসংক্ষেপই জানানোর চেষ্টা করা হবে এ লেখাতে।
শিক: অনবদ্য, অভূতপূর্ব, অভাবনীয়
গোললাইন ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন স্কটিশ গোলকিপার ডেভিড মার্শাল। প্রতিপক্ষের অর্ধে আক্রমণ শাণাচ্ছে তার দল, নিজেদের রক্ষণভাগের শেষ খেলোয়াড়টিরও অবস্থান প্রতিপক্ষের অর্ধে – এসব মুহূর্তে এমন থাকাটাই রীতি। যা রীতিবিরুদ্ধ, তা দেখা গেল প্যাট্রিক শিকের সৌজন্যে। স্কটল্যান্ডের জ্যাক হেনড্রির দূরপাল্লার শটটা চেক প্রজাতন্ত্রের ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে মাঝমাঠ পেরিয়েছিল মাত্র। বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়া কাণ্ডটা ঘটল এর পরই; ৪৯.৭ গজ দূর থেকে শিকের বাঁ পায়ের বাঁকানো শট পেরিয়ে গেল গোললাইন, গিয়ে পড়ল জালের একদম প্রান্তসীমায়। পড়িমরি করে ছুটে আসা মার্শালও জড়িয়ে গেলেন জালে। হ্যাম্পডেন পার্কে উপস্থিত কিংবা টিভিতে চোখ রাখা দর্শকদের চোখ তখন বিস্ফোরিত হবার যোগাড়, ইউরোর ইতিহাসে এত দূর থেকে গোল করার রেকর্ড আর কারো নেই কি না!
চেকদের হয়ে প্রথম গোলটাও শিকই করেছিলেন। তার গোলেই স্কটল্যান্ডকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়ে টুর্নামেন্টে শুভসূচনা করল চেক প্রজাতন্ত্র। সব মিলিয়ে জাতীয় দলের হয়ে শেষ ১১ ম্যাচে শিকের গোল সাতটি। বেয়ার লেভারকুসেন ছেড়ে বড় কোনো ক্লাবে তার যাওয়াটা যে কেবলই সময়ের অপেক্ষা, ঘোষণার সুরে বলে দেওয়া যায় এখনই।
পোল্যান্ড কি পারবে?
ইউরোর প্রথম ম্যাচে শেজনি আর মাঠে নামতে চাইবেন বলে মনে হয় না। তিন ইউরোর প্রথম ম্যাচে তাঁর ‘কীর্তি’গুলো দেখুন না: ২০১২ সালে লাল কার্ড দেখে বহিষ্কার হয়েছিলেন, ২০১৬ ইউরোতে ম্যাচের মাঝপথে চোটে পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন, এবং এবার স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আত্মঘাতী গোল করে পোল্যান্ডকে পিছিয়ে দিলেন। ইউরোর ইতিহাসে কোনো গোলকিপারের আত্মঘাতী গোল করা এবারই প্রথম, এবং এর চেয়ে দ্রুততম সময়ের মাঝেও (১৮ মিনিটে) আত্মঘাতী গোল হয়নি কখনো।
ম্যাচটি প্রথমের সাক্ষী হয়েছে আরও এক দিক থেকে। ৬২ মিনিটে এবারের টুর্নামেন্টে প্রথম লাল কার্ড দেখেছেন পোলিশ মিডফিল্ডার গুজাগুশ ক্রুকোভিয়াক। ১০ জনের দল নিয়ে পোল্যান্ডও স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে হেরে গেছে ২-১ গোলে।
এতে করে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার পথটা কঠিনই হয়ে গেল রবার্ট লেওয়ানডস্কির দলের। অবশ্য দুরন্তগতিতে বাছাইপর্ব উৎরে মূলপর্বে খেই হারিয়ে ফেলার গল্পটা পোল্যান্ডের জন্য পুরনো। এবার ভিন্ন কোনো গল্প লিখতে গেলে গ্রুপপর্বের পরের দুই ম্যাচে পোলিশরা তাকিয়ে থাকবে লেওয়ানডস্কির দিকেই। তিন ইউরো আর এক বিশ্বকাপ খেলে ফেললেও ক্লাবের লেওয়ানডস্কিকে জাতীয় দলের জার্সিতে অনূদিত হতে দেখা যায়নি এখনো। চারটা বড় টুর্নামেন্টে গোল লক্ষ্য করে ৩৫ শট নিলেও তিনি গোল করেছেন মাত্র ২টি! এবার কি লেওয়ানডস্কি জাগবেন?
গোলটা করবে কে!
টিকিটাকার ওই এক জ্বালা। যতক্ষণ গোল হচ্ছে, ততক্ষণ ‘ধন্য’ ‘ধন্য’ রব; আর গোল না এলেই ‘এমন বিরক্তিকর ফুটবলও খেলে কেউ!’ দ্বিতীয় মন্তব্যে সর্বশেষ ইন্টারনেট ছেয়ে গেল ইউরোতে স্পেনের প্রথম ম্যাচে, ৮৫ শতাংশ বল দখলে রেখেও যেদিন ড্র করতে হলো সুইডেনের বিপক্ষে। ম্যাচে নিজেদের মধ্যে ৮৩০ বার বল দেওয়া-নেওয়া করেছেন স্প্যানিশরা, ১৯৮০ সালে পাসের রেকর্ড রাখতে শুরু করার পর থেকে যা সর্বোচ্চ। স্পেনের কর্তৃত্ব আরও ভালো বোঝা যায় এই তথ্যে: ম্যাচের প্রথমার্ধে সুইডিশরা পাস খেলতে পেরেছিল ৩৮টি, ১৯৮০ সাল থেকে হিসেব করলে এটা সর্বনিম্ন।
তবে বল নিজেদের পায়ে রাখলে কী হবে! স্পেনকে ঠিকই আটকে রেখেছিল সুইডেন। প্রথম ৪৫ মিনিটের মাঝেই দু’বার স্কোরশিটে নাম তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন কোকে, ড্যানি ওলমোর হেডটাও আর ইঞ্চিখানেক ডানে-বাঁয়ে গেলেই ঢুকে যেত জালে। আর মোরাতা যে বলটা বারের বাইরে মারলেন, তাকে ‘নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া’ বললেও কম বলা হবে।
কৃতিত্ব দিতে হবে সুইডিশ গোলরক্ষক রবিন ওলসেনকেও। একবার তো হয়ে যাওয়া গোলকেই আটকে দিয়েছেন, ম্যাচে অন-টার্গেট শট আটকেছেন পাঁচটি। স্পেনের ধীরগতিতে খেলা গড়ার ধরনটাও সুইডেনকে সাহায্য করেছে খুব সম্ভবত। সেদিন একটি সফল আক্রমণ গড়তে স্পেনের সময় লেগেছে ১৮.৮ সেকেন্ড করে, এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ। তালিকার পরের দল বেলজিয়াম পিছিয়ে আছে তিন সেকেন্ডে।
সব মিলিয়ে শেষ ছয় মেজর টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে পঞ্চমবারের মতো জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে ব্যর্থ হলো স্প্যানিশরা। সুইডেনের বিপক্ষে ড্র’টা নাম লিখিয়েছে রেকর্ডের পাতাতেও। বিশ্বকাপ আর ইউরো মিলিয়ে টানা চার ম্যাচ জয়হীন স্পেন, মেজর টুর্নামেন্টে তাদের সবচেয়ে লম্বা জয়খরা।
‘ঘরে-বাইরে’ রোনালদো
ইউটিউবে স্ক্রল করতে করতে মুকেশের ওই ‘ম্যায় পাল দো পাল কা শায়ের হু’ গানটা কি সিআর-সেভেনের সামনে এসেছে কখনো? হাঙ্গেরির বিপক্ষে তার পারফরম্যান্স তো ওই গানটাকেই মনে করাল। ম্যাচের ৮৭ মিনিট পর্যন্ত মাঠে খুঁজে পেতেই কষ্ট হচ্ছিল তাকে, ফাঁকা গোলপোস্টে বল রাখতেও তো ব্যর্থ হয়েছিলেন একবার।
তবে এরপরই ওই ‘মুহূর্তের কবি’ হয়ে ওঠা। ৮৭ মিনিটে পেনাল্টি এনে দিয়েছিলেন রাফা সিলভা, সেখান থেকে গোল করে দলকে ২-০তে এগিয়ে দিয়েছিলেন রোনালদো। আর এখন তো রোনালদো গোল করলেই রেকর্ড বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে হয়! রেকর্ড হয়েছে এই গোলেও। মিশেল প্লাতিনিকে টপকে ইউরোতে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এখন তার। ১৯৮৪ ইউরোর এক আসরেই প্লাতিনি গোল করেছিলেন ৯টি, ‘পাঁচ’ আসর মিলিয়ে ২২ ম্যাচ খেলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো পেরোলেন তাকে। পাঁচ-এর ওপর চোখ রাখতে হবে আলাদা করে, ইউরোর পাঁচ আসরে গোল করা একমাত্র ফুটবলার তিনিই কি না!
রোনালদো পর গোল করেছেন আরও একটি, হয়েছেন ইউরোতে এক ম্যাচে জোড়া কিংবা এর বেশি গোল করা সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার। অবশ্য ৩৩ পাসের ওই গোলের নান্দনিকতার বর্ণনা দেওয়াটা অসম্ভবেরই নামান্তর, ওসব গোল কেবল চোখেই দেখতে হয়।
মাঠের বাইরেও আলোচনায় রোনালদো। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে কোকাকোলার বোতল সরিয়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন পানির বোতল। শরীর ঝরঝরে রাখতে গেলে যে কোকের বদলে পানিকেই বেছে নিতে হবে, বুঝিয়েছিলেন তা-ই। তার কথা বুঝতে যে সমস্যা হয়নি কারো, তার প্রমাণ মিলেছিল পরদিন স্টক মার্কেটে। একদিনের ব্যবধানে কোকাকোলা হারিয়েছিল ১.৬% শেয়ারমূল্য, আর কোম্পানি মূল্যমান হারিয়েছিল চার বিলিয়ন ডলার।
একই কাজ করেছেন পল পগবাও। নিজের ধর্মবিশ্বাস থেকে ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিয়ার প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হেইনেকেনের বোতল সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
তবে সবাই যে রোনালদো কিংবা পগবার পথে হাঁটবেন না, তার প্রমাণও মিলেছে। রাশান ম্যানেজার তো সংবাদ সম্মেলনে এসে সামনে থাকা কোকের পুরো বোতলটাই সাবাড় করে দিয়েছেন!
আবারও তাহলে ফ্রান্স!
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই শিরোপার সবচেয়ে বড় দাবিদার মানা হচ্ছে তাদের। প্রথম ম্যাচের পারফরম্যান্সেই বুঝিয়ে দিলেন ফরাসিরা, সেটা ভুল কিছু হচ্ছে না। বিশ্বকাপ-ইউরো মিলিয়ে সর্বশেষ তিন ম্যাচেই তাদের বল পজেশন ছিল ৪০ শতাংশেরও কম। তবে জয় পেতে সমস্যা হয়নি কোনো। এমবাপ্পের গতি কিংবা পগবার ডিফেন্সচেরা পাস কাজে লাগিয়ে একটা গোল বের করো, অতঃপর রক্ষণে খিল এঁটে বসে থাকো – দিদিয়ের দেশম এগোলেন তার এই চিরাচরিত দর্শন মেনেই। শিষ্যরাও গুরুর বিদ্যাকে অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়ে জয় এনে দিল ১-০ গোলে।
ফলে ইউরোতে প্রথমবারের মতো নিজেদের উদ্বোধনী ম্যাচে হারতে হলো জার্মানিকে, আরেক প্রথমের সৌজন্যে। জার্মানদের ইউরো ইতিহাসের প্রথম আত্মঘাতী গোলটা হলো ম্যাটস হামেলসের পায়ে। তার গোলটা এবারের টুর্নামেন্টের তৃতীয়, যেখানে এর আগের ইউরোতে পুরো আসর মিলিয়েই আত্মঘাতী গোল হয়েছিল তিনটি!
ওই ম্যাচেই মাঠের বাইরে হয়েছে আরেক কাণ্ড। একটা গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্যারাগ্লাইডিং করে মাঠে নেমেছিলেন গ্রিনপিস-এর এক কর্মী। তবে নামতে গিয়েই বাঁধিয়েছেন বিপত্তি। ল্যাটেক্স বল ফেলার কথা থাকলেও প্যারাশ্যুটে লাগানো ভিডিও ক্যামেরার একটা অংশ ভেঙে পড়ে গ্যালারিতে, আহত হন বেশ কয়েকজন দর্শক। পরিবেশবাদী সংগঠনের ওই কর্মী মাঠে নামতে গিয়েও আহত করেছেন সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানের দু-তিনজন কর্মীকে। তবুও মন্দের ভালোই ধরে নিতে হচ্ছে একে, কেননা ক্যামেরার ভাঙা অংশটা পড়েছিল ফ্রান্স ডাগআউটের খুব কাছেই। একবার ভাবুন, ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম আহত হলে কী হতো!
ইতালির দ্বিতীয়, ইতালিই প্রথম
এর আগে বিশ্বকাপ বা ইউরোর মতো ফুটবল মহোৎসবে ইতালি ম্যাচ খেলেছিল ৯৪টি, তাতে তিন গোলের ব্যবধানে জয় পেয়েছিল মাত্র দুই ম্যাচে। এবার ইউরো শুরু হতেই সংখ্যাটা বেড়ে গেল দুই গুণ। তুরস্ককে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে শুরু করার পর সুইসদেরও হারানো গেল একই ব্যবধানে। রক্ষণাত্মক ঘরানার ফুটবল ছেড়ে মানচিনির অধীনে যে প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরপুর ফুটবল খেলছে আজ্জুরিরা, এই পরিসংখ্যান যেন তারই প্রমাণ।
আগেকার মতো গোল করে খোলসে তো ঢুকে যাচ্ছেই না, বরং মানচিনি খেলোয়াড়দের দিচ্ছেন গোল করার পূর্ণ লাইসেন্স। প্রথম ম্যাচে সিরো ইমোবিলের পর দ্বিতীয় ম্যাচে জোড়া গোল করেছেন ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি। সাসসুয়েলোর ইতালিকে যেন নতুন করেই আবিষ্কার করা গেল এই টুর্নামেন্টে। গত মৌসুমে সিরি আ-তে শটপ্রতি তার গোল করার সম্ভাবনা ছিল ০.০৯, সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে গোল লক্ষ্য করে নেওয়া তিন শটে সেই সম্ভাবনাই বেড়ে হয়েছে ০.৩।
ওয়েলসের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও এমন করেই আক্রমণের ফুল ফোটাবে ইতালি? দ্বিতীয় পর্ব নিশ্চিত হয়েছে সবার আগে, তবে গ্রুপে দ্বিতীয় হলে পরবর্তী রাউন্ডে মিলবে সহজ প্রতিপক্ষ; মানচিনি কি এই সমীকরণটা মাথায় রাখবেন?
আরও যা হলো…
১৯৯৬ সালে প্রথম অংশ নেওয়ার পর গ্রুপপর্বে এ নিয়ে নয়টি ম্যাচ হারল তুরস্ক, গ্রুপপর্বে এর চেয়ে বেশি ম্যাচ হারের রেকর্ড নেই আর কারও; অবশ্য তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে রাশিয়া।
টুর্নামেন্টে স্বস্তির একটা রেকর্ডের জন্ম দিয়েছে রাশানরাও। টানা ৯ ম্যাচে গোল হজমের পর প্রথমবারের মতো ক্লিনশিট রাখতে পেরেছে রাশিয়া।
মাত্র তো টুর্নামেন্টের ছ’দিন পেরোলো, এমন আরও কত রেকর্ড যে হবে!