সেই ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট বিশটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বিশটি বিশ্বকাপে নানা ধরনের ঘটনাই ঘটেছে, কিছু কিছু ঘটনা একের অধিকও ঘটেছে। আবার কিছু কিছু ঘটনা পুরো বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র একবারই ঘটেছে। বিশ্বকাপে এমনই এক বিরল রেকর্ড হচ্ছে এক আসরে প্রথম ম্যাচ থেকে ফাইনাল পর্যন্ত সবগুলো ম্যাচে একজন খেলোয়াড়ের গোল করা। ৮৮ বছরের বিশ্বকাপ ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র একবারই। ১৯৭০ বিশ্বকাপে এই অনন্য কীর্তিটি করে দেখিয়েছিলেন ব্রাজিলের জায়ার্জিনহো। আজ আমরা জায়ার্জিনহোর সেই অমর রেকর্ডের ব্যাপারেই জানবো, কিভাবে তিনি এই রেকর্ডটি গড়লেন জানবো সেকথাও।
কে এই জায়ার্জিনহো?
জায়ার্জিনহোর এই অমর কীর্তির ব্যাপারে জানার আগে তার ব্যাপারে আমরা কিছু জেনে নিই। ১৯৪৪ সালের বড়দিনে রিও ডি জেনেইরোতে জন্ম নেওয়া জায়ার্জিনহোর পেশাদার ফুটবলে অভিষেক ঘটে বোটাফোগোর হয়ে। জায়ার্জিনহো ছিলেন একজন রাইট উইঙ্গার। বোটাফোগোর হয়ে অসাধারণ পারফর্ম করায় ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে তার।
কিন্তু জাতীয় দলে তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না জায়ার্জিনহো, কারণ তখন ব্রাজিল দলে রাইট উইঙ্গার হিসেবে তার আদর্শ গারিঞ্চার জায়গাটা পাকাপোক্ত ছিল। তাই তাকে তখন লেফট উইঙ্গার হিসেবেই খেলতে হতো। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ দলেও লেফট উইঙ্গার হিসেবেই খেলেছিলেন জায়ার্জিনহো, কিন্তু নিজের স্বাভাবিক পজিশন না পেয়ে সেই আসরে নিজেকে একদমই মেলে ধরতে পারেননি তিনি।
ব্রাজিলও সেবার দল হিসেবে একদম সুবিধা করতে পারেনি। হাঙ্গেরি ও পর্তুগালের কাছে হেরে গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়তে হয় সেলেসাওদের। তবে এই বিশ্বকাপের পরেই জাতীয় দলে ভালো করার রাস্তাটা জায়ার্জিনহোর জন্য পরিষ্কার হয়ে যায়। কারণ এই বিশ্বকাপের পরেই গারিঞ্চা জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ফলে জাতীয় দলে নিজের প্রিয় রাইট উইঙ্গার পজিশন পেয়ে যান তিনি।
নিজের প্রিয় পজিশন পেয়ে জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত গোলের দেখা পেতে থাকেন জায়ার্জিনহো। বাছাইপর্বে ব্রাজিলের হয়ে তিনটি ম্যাচে গোলও পেয়েছিলেন। তাছাড়া নিজের ক্লাব বোটাফোগোর হয়েও সময়টা ভালোই কাটছিলো তার। এ কারণে ১৯৭০ বিশ্বকাপে জায়ার্জিনহোকে নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের প্রত্যাশার পারদটা বেশ উঁচুতেই ছিল।
যেভাবে এই রেকর্ডটি গড়লেন জায়ার্জিনহো
১৯৭০ বিশ্বকাপে পুরো ব্রাজিল দলটাই ছিল দুর্দান্ত। সবগুলো পজিশনেই সেরা সেরা তারকা ছিল সেবার। পেলে, রিভেলিনো, তোস্তাও সাথে জায়ার্জিনহো- এই চারজন মিলে সেবার বিধ্বংসী এক আক্রমণভাগ তৈরি করেছিলেন। তবে এই চারজনের মধ্যে গোল করার দিক থেকে সেবার জায়ার্জিনহো বাকিদের চেয়ে বেশ এগিয়েই ছিলেন। সেই আসরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে চেকোস্লোভাকিয়াকে ৪-১ গোলে হারায় ব্রাজিল। এ ম্যাচের ৬১ ও ৮৩ মিনিটে দুই গোল করে ব্রাজিলের বড় জয় নিশ্চিত করেন জায়ার্জিনহো।
পরের ম্যাচে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে শুরু থেকেই লাগাতার আক্রমণে দিশেহারা করে ফেলেছিলো সেলেসাওরা। ববি মুরের মতো সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার দলে থাকলেও ইংলিশ ডিফেন্স বারবার খেই হারাচ্ছিলো পেলে, জায়ার্জিনহোদের টানা আক্রমণের কাছে। কিন্তু ব্রাজিলের সব আক্রমণ একাই আটকে দিচ্ছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলকিপার গর্ডন বাঙ্কস। এর মধ্যে পেলের একটি হেডার অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকিয়ে দেন বাঙ্কস, যে সেভকে “সেভ অফ দ্য সেঞ্চুরি” বলা হয়।
শেষপর্যন্ত ৫৯ মিনিটে ডেডলক ভাঙ্গতে পারে ব্রাজিল আর সেই ডেডলক ভাঙ্গার আক্রমণটা ছিল আক্ষরিক অর্থেই নান্দনিক। তোস্তাও প্রথমে তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে জায়গা তৈরি করে বলটি পেলের দিকে বাড়িয়ে দেন আর পেলে অসাধারণভাবে বলটা রিসিভ করে টার্নব্যাক করে বাড়িয়ে দেন জায়ার্জিনহোর দিকে। জায়ার্জিনহোর বুলেট শট জালের উপরিভাগে জড়িয়ে যায়। তার এই গোলই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে রোমানিয়াকে ৩-২ গোলে হারায় ব্রাজিল। এ ম্যাচের ২২ মিনিটে ব্রাজিলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন জায়ার্জিনহো।
কোয়ার্টার ফাইনালে পেরুকে ৪-২ গোলে হারায় ব্রাজিল। এ ম্যাচের ৭৫ মিনিটে ব্রাজিলের চতুর্থ গোলটি করে টানা চার ম্যাচে গোল করার সাথে দলের জয়টাও নিশ্চিত করেন জায়ার্জিনহো। সেমিফাইনালে আরেক লাতিন দল উরুগুয়ের বিপক্ষে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয় ব্রাজিল। ম্যাচের ৭৬ মিনিট পর্যন্ত স্কোরলাইন ছিল ১- ১। দলের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আবারো জ্বলে ওঠেন জায়ার্জিনহো। তার গোলে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। শেষপর্যন্ত রিভেলিনোর গোলে ৩-১ ব্যবধানে উরুগুয়েকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যায় ব্রাজিল।
ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। দুই দলের সামনেই সুবর্ণ সুযোগ প্রথম দল হিসেবে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে জুলে রিমে ট্রফিটা নিজেদের করে নেওয়ার। আর জায়ার্জিনহোর সামনে সুযোগ এক আসরে ফাইনাল পর্যন্ত সবগুলো ম্যাচে গোল করার রেকর্ডটি তৈরি করার। হাইভোল্টেজ সেই ম্যাচে ইতালির বিপক্ষে শুরু থেকেই দাপট দেখাতে থাকে ব্রাজিল। পেলে ও জারসনের গোলে ৭১ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল ব্রাজিল, কিন্তু একগোলের লিড পুরোপুরি স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছিলো না সেলেসাওদের। আগের সবগুলো ম্যাচে গোল পাওয়া জায়ার্জিনহো ফাইনালে গোল পাবেন না তা কি করে হয়!
৭১ মিনিটে সেই স্বস্তির হাওয়া হয়ে আসেন জায়ার্জিনহো। জারসনের নেওয়া লং ফ্রি কিকে হেড করে আনমার্কড জায়ার্জিনহোকে পাস দেন পেলে। সেই পাস থেকে সহজেই গোল করে ব্রাজিলের তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা মোটামুটি নিশ্চিত করার সাথে জায়ার্জিনহো গড়ে ফেলেন সেই অনন্য রেকর্ডটিও।
সেই আসরে ছয় ম্যাচে মোট সাত গোল করেন জায়ার্জিনহো। তবে জার্মানির জার্ড মুলার সেই আসরে দশ গোল করলে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটি জায়ার্জিনহোর পাওয়া হয়নি। আর নিজের সতীর্থ পেলে চার গোলের সাথে পাঁচ অ্যাসিস্টে সেই আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সেটিও জায়ার্জিনহোর পাওয়া হয়নি। তবে তাতে কি? যে অনন্য রেকর্ডটি জায়ার্জিনহো সেই আসরে গড়েছিলেন, তা যেকোনো ব্যক্তিগত পুরস্কারের চেয়েও কম কিছু না। এখন পর্যন্ত হওয়া বিশটি বিশ্বকাপে এমন কীর্তি জায়ার্জিনহো ছাড়া আর কেউই গড়তে পারেননি।
কিন্তু একটি কথা…
বিশ্বকাপে ফাইনাল পর্যন্ত সবগুলো ম্যাচে গোল করার কীর্তি একমাত্র জায়ার্জিনহোর আছে এ কথা সত্য। কিন্তু এই শর্তে কিছুটা পরিবর্তন আনলেই এই রেকর্ডের ভাগীদার হিসেবে আমরা আরেকজনকে পেয়ে যাই! ১৯৭০ বিশ্বকাপে জায়ার্জিনহো ছয় ম্যাচ খেলে ছয় ম্যাচেই গোল করেছিলেন ঠিক। সেভাবে ১৯৫৮ বিশ্বকাপে জাঁ ফন্টেইনও ছয় ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ছয় ম্যাচেই! পার্থক্য একটাই, জায়ার্জিনহোর দল ফাইনালে ওঠায় ফাইনাল পর্যন্ত গোল করার শর্তটা পূরণ করার সুযোগ জায়ার্জিনহো পেয়েছিলেন। কিন্তু জাঁ ফন্টেইনের দল ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বাদ পড়ায় সেই সুযোগটা তিনি পাননি। তাই তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে গোল করে ছয় ম্যাচ খেলে ছয় ম্যাচেই গোল করার রেকর্ডটি গড়েছিলেন জাঁ ফন্টেইন। অবশ্য ফাইনাল পর্যন্ত সবগুলো ম্যাচে গোল রেকর্ড গড়তে না পারলেও ওই আসরে ফন্টেইন এমন এক রেকর্ড গড়েছিলেন যা আজও অক্ষুণ্ন। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ১৩ গোল করেছিলেন জাঁ ফন্টেইন! সেই আসরে ফন্টেইনের গড়া ১৩ গোলের রেকর্ড আজও কেউ ভাংতে পারেনি।
জায়ার্জিনহো, জাঁ ফন্টেইনের মতো আরেকজন খেলোয়াড় আছেন যিনি বিশ্বকাপে ছয়টি ম্যাচে গোল করেছিলেন। তিনি ফাইনালেও গোল করেছিলেন। তাও তিনি এই রেকর্ডের ভাগীদার হতে পারেননি! বলছিলাম ব্রাজিলের রোনালদোর কথা। ২০০২ বিশ্বকাপে সাত ম্যাচ খেলে ছয়ম্যাচেই গোল করেছিলেন রোনালদো! শুধুমাত্র কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই গোল পাননি তিনি। তাই জায়ার্জিনহো, ফন্টেইনের মতো বিশ্বকাপের এক আসরে ছয় ম্যাচে গোল করলেও সবগুলো ম্যাচে গোল করার শর্ত পুরণ না করায় এই রেকর্ডের ভাগীদার হতে পারেননি দ্য ফেনোমেনন।
দরজায় কড়া নাড়ছে আরেকটি বিশ্বকাপ, এই আসরেও জায়ার্জিনহোর রেকর্ডে ভাগ বসানোর সুযোগ খেলোয়াড়দের সামনে থাকবে। কিন্তু এই রেকর্ডে ভাগ বসানোটা আসলেই কিছুটা দুরূহ। কারণ রেকর্ডের প্রথম শর্তমতে আগে নিজ দলকে ফাইনালে নিয়ে যেতে হবে। এবং সেই সাথে দলের হয়ে সবগুলো ম্যাচে গোলও করতে হবে। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে এমনিতেই স্নায়ুচাপ বেশি থাকে। তাই সাত ম্যাচের সাতটিতেই গোল করা বেশ কঠিনই বটে। এখন দেখা যাক, ৪৮ বছর আগে গড়া জায়ার্জিনহোর রেকর্ডে এবার কি কেউ ভাগ বসাতে পারে, নাকি রেকর্ডটি এককভাবে জায়ার্জিনহোর দখলেই থাকে!
ফিচার ইমেজ: abc.net