১৯৪৮ সালের ১৪ই মে; ম্যান্ডেটরি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন ছাড়ে। সেদিনই তেল আবিব থেকে ইহুদী জাতীয় পরিষদ ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণার কয়েক ঘন্টা পরেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্কের শুরু সেখান থেকেই। এরপর দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত, যেখানেই ইসরায়েলি স্বার্থ সেখানেই আমেরিকা রক্ষাকবচ, ইসরায়েলের দ্ব্যর্থহীন সমর্থক।
সমর্থনের স্বরুপ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত দেশের তালিকায় ইসরায়েলের নাম সবার উপরে। শুধুমাত্র ২০২০ সালেই ইসরায়েলের সামরিক খাতে আমেরিকার সাহায্য ছিল ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধু তা-ই নয়, ২০২৮ সাল নাগাদ এ সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। শান্তিতে (!) নোবেলজয়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৬ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরায়েলের এমন বিশাল সামরিক সাহায্য প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমেরিকা তার ভেটো দেবার ক্ষমতা ব্যবহার করেছে মোট ৮৪ বার, যার মধ্যে ৪৩ বারই ইসরায়েলের পক্ষে, ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সাম্প্রতি (মে ২০২১) ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষ বন্ধের জন্য যুদ্ধবিরতি আহবান করে একটি সামান্য বিবৃতি দিতে চাইলে সেটাতেও ভেটো দেয় আমেরিকা। জাতিসংঘ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলো ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী অনেক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও আমেরিকা এসব ব্যাপারে বরাবরই চুপ থেকেছে। এভাবে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের যাবতীয় দমন-পীড়নের একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে থেকেছে তারা। আর সে কারণেই অনেকে ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার সম্পর্ককে দ্বিপাক্ষীয় সম্পর্ক না বলে ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার একপক্ষীয় সমর্থন-নীতি বলে থাকেন।
কেন এই অন্ধ সমর্থন?
এখন প্রশ্ন হলো- আমেরিকা কেন ইসরায়েলকে এমন দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন করে? আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থী সব কর্মকাণ্ডেও আমেরিকা কেন সর্বদা ইসরায়েলকে প্রশ্রয় দেয়? ইসরায়েলের ব্যাপারে কেন তাদের মানবাধিকার লংঘনের বুলি পাল্টে যায়? কী তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট? এর ভূরাজনৈতিক নিয়ামকই বা কী? চলুন জেনে নিই।
স্বীকৃতিদানের তড়িঘড়ি রহস্য
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাসখানেক আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান। রুজভেল্টের মৃত্যুর পরে ট্রুম্যানকেই তাই প্রেসিডেন্সির দায়িত্ব নিতে হয়। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময়ে তিনিই ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আগেই যেমন বলা হয়েছে, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয় ১৯৪৮ সালের মে মাসে। আর সে বছরের নভেম্বরেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
রুজভেল্টের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে এটিই ছিল হ্যারি ট্রুম্যানের জন্য প্রথম নির্বাচন। প্রতিষ্ঠার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইসরায়েলকে ট্রুম্যানের স্বীকৃতি দেয়ার পেছনে এ নির্বাচনটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কেননা তার জন্য ইহুদী ভোট ব্যাংক এবং অর্থ তহবিল দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবুও তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ মার্শালসহ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করেন, কেননা তাদের স্বীকৃতি দিলে আরবদের সমর্থন হারানোর ভয় ছিল মার্কিন প্রশাসনের। এরপরও শেষ মুহুর্তে এসে ইসরায়েলকে ট্রুম্যানের স্বীকৃতি দেয়ার পেছনে নির্বাচন-ফ্যাক্টর ছাড়াও আরো দুটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, ট্রুম্যানের ওপর তার ইহুদি বন্ধু এবং ব্যবসায়িক অংশীদার এডওয়ার্ড জ্যাকবসনের প্রভাব, এবং দ্বিতীয়ত, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্যে একটি অনুগত অমুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার সুপ্ত বাসনা।
স্নায়ুযুদ্ধ ফ্যাক্টর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির অংশ হিসেবে ব্রিটিশদের জয় হলেও এ যুদ্ধের মাধ্যমে পরাশক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হয়। বিশ্বের নতুন মোড়ল কে হবে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। বিশ্ব দুটি ব্লকে বিভক্ত হয়ে যায়।
আমেরিকা নিজের ব্লককে শক্তিশালী করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সেই লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের একটি এজেন্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস করার মানসে তারা ইসরায়েলকে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি দেয়। একই কারণে স্নায়ুযুদ্ধকালে ইসরায়েলের সব কাজকে তারা দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দেয়। সিরিয়া, জর্ডান আর মিশরের মতো দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের উত্থান ঠেকানোর মানসে ইসরায়েলও তখন আমেরিকার পক্ষে নিজেদের দিক থেকে সবটুকু দিয়ে কাজ করে।
সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমা; যেখান থেকে শুরু
আমেরিকা প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও শুরুর দিকে দেশটি ইসরায়েলকে অতটা প্রকাশ্যে সাহায্য-সমর্থন করেনি। আরব দেশগুলোর তেলের রিজার্ভ এবং এর ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় সেখানে সোভিয়েত প্রভাব একচ্ছত্র বৃদ্ধির ভয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ নীতি অবলম্বন করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরেই দৃশ্যপটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। এ যুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে আরবদের সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হয়।
আমেরিকা তখন উপলব্ধি করে যে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দুর্বল সামরিক শক্তির আরব দেশুগুলোর মন যুগিয়ে চলার দরকার নেই। তখন থেকেই তারা সবটুকু দিয়েই ইসরায়েলকে রক্ষায় আটঘাট বেধে নেমেছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৬৭ পরবর্তী সময়ে মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে ইসরায়েলকে দেয়া আমেরিকার সাহায্যের পরিমাণ প্রায় ৪৫০% বেড়ে যায়।
আমেরিকার জনমত, পিআর মেশিন ক্যারিশমা
আমেরিকার পরারাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ইসরায়েলকে একচ্ছত্র সমর্থন। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সাধারণ মানুষের সমর্থন না পেলে আমেরিকা কখনো ইসরায়েলের প্রতি এমন একতরফা সমর্থন নীতির উপর অটুট থাকতে পারত না। আমেরিকান ভোটারদের সিংহভাগ ফিলিস্তিনের চেয়ে ইসরায়েলের সমর্থক। গ্যালপের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমেরিকার প্রায় ৭৫% মানুষ ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। সম্পূর্ণ অন্যায়ের উপর দাঁড়িয়েও ইসরায়েল কীভাবে আমেরিকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এমন সহানুভূতি পায়?
মূলত আমেরিকায় রয়েছে ইসরায়েলের শক্তিশালী পিআর মেশিন, যা এই সংক্রান্ত যেকোনো ইস্যুতে আমেরিকানদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায়। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রতিটি জনসমর্থন আদায়কারী প্রজেক্টে যারা খরচ করে কাড়িকাড়ি অর্থ। এছাড়া ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ১১ জন ইসরায়েলি অ্যাথলেট হত্যার মতো ঘটনাগুলো ব্যবহার করে ইসরায়েল সফলতার সাথে আমেরিকানদের সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে।
ইসরায়েলি সংগঠন AIPAC, নাটের গুরু
আমেরিকায় ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা সবচেয়ে বড় সংগঠন AIPAC (American Israil Public Affairs Committee)। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে আমেরিকার ইহুদী ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মাঝে ইসরায়েলের পক্ষে মত তৈরিতে এ সংগঠনটি সিদ্ধহস্ত। তহবিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচন- প্রত্যেক ক্ষেত্রেই রয়েছে এর সক্রিয় ভূমিকা। সংগঠনটি ইসরায়েলের পক্ষে একাত্মতা পোষণের নিমিত্তে প্রতি বছর ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজন করে বিশাল সমাবেশ, যেখানে অংশগ্রহণ করে বিশ হাজারের অধিক প্রতিনিধি, যে সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আমেরিকার বাঘা বাঘা সব রাজনৈতিক নেতা। নিয়মিত উপস্থিত থাকেন বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর মতো ইসরায়েলি নেতারাও।
ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সামরিক শক্তির দিক থেকে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের এক পরীক্ষিত পরাশক্তি। তাদের সামরিক প্রযুক্তি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যের আকাশের সবচেয়ে বড় দানব, মিসাইল পাড়ি দিতে পারে সুদূর ককেশাস কিংবা কৃষ্ণসাগর, রয়েছে মোসাদের মতো দুর্ধর্ষ গোয়ান্দাসংস্থা। তাই তারা আমেরিকার কাছে যোগ্য পোষ্য। তারাই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার একমাত্র হাতিয়ার। সুতরাং সবটুকু দিয়ে তাদের রক্ষায় আমেরিকা বদ্ধ পরিকর।
আমেরিকার প্রো-ইসরায়েলি রাজনীতিবিদগণ
যখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার টপ প্রায়োরিটি কী, তখন আমি বলি শিশু, শিশু এবং শিশু।
– ন্যান্সি পেলোসি
মার্কিন কংগ্রেসের বহুল আলোচিত স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের নৈতিক মান নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তোলা মার্কিন রাজনীতিবিদ তিনি। শিশুদের অধিকার আদায়েও তিনি সোচ্চার। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে ইসরায়েলি হামলায় যখন গাজায় ষাটের অধিক শিশু নিহত হয়েছে, তখনও এই তিনি বলে গিয়েছেন, “ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।” কংগ্রেসে যখন ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে বিল আনার প্রস্তাব উঠেছে, তখন পেলোসি তার বিরোধিতা করেছেন। পেলোসি ছাড়াও কংগ্রেস মেজরিটি পার্টি লিডার স্টেনি হয়ার, সিনেটের মেজরিটি লিডার চাক শুমারসহ অনেক হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা আমেরিকায় ইসরায়েলের পক্ষে জোরাল ভূমিকা রাখেন।
একটি নতুন প্রেক্ষিত, কিছু আলো
চলতি বছরের মে মাসে ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় এগারো দিনের নির্বিচার হামলায় নারী-শিশুসহ দুই শতাধিক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় এভাবে সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন বিষয় নয়। তবে নতুন হচ্ছে আমেরিকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার উর্ধ্বমুখী পারদ। নিউ ইয়র্কের মতো শহরে গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেসে কিছু আমেরিকান আইনপ্রণেতা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। বার্নি স্যান্ডার্সের মতো রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভেতরে-বাইরে নানামুখী চাপের মুখে পড়েছেন, যা আগে সেভাবে চোখে পড়েনি। এন্টি-সেমিটিক তকমা পাওয়ার ভয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে আমেরিকায় কেউই তেমন উচ্চবাচ্য করত না। এখন অন্তত দুই-একজন সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হচ্ছেন। ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক-আধটু কথা বলা শুরু করছেন, এবং এটাই সম্ভবত ইসরায়েল-আমেরিকা সম্পর্কের আপাত অবনতির দিক।