শুরুতেই পাঠকদের জন্য রইল একটা প্রশ্ন। বলুন তো, সাম্ভালা কী? এটা কি খায়? নাকি এটা কোনো দর্শনীয় বস্তু? কোনো অজানা স্থান, কোনো গন্ধ আছে এর? এ নামে কি কোনো গাছ আছে, যার আছে অনেক রঙের ফুল-ফল? নাকি সাম্ভালা উর্বর মস্তিষ্কের কোনো কল্পনা? যদি তা সত্যিই থেকে থাকে, তবে কোথায়? আর যদি নিছক ভ্রম হয়, তবে কেন সাম্ভালার পেছনে কালে কালে মানুষ ছুটছে? চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেসব পথিকদের, ‘সাম্ভালা’ বই সিরিজের চরিত্রদের।
সে এক অজানা পথিক। যে ভুলে গেছে সে কে, তার ঘর কোথায়, তার পরিবার কোথায়। তার গন্তব্য কেবল সাম্ভালা। সে তাই সাম্ভালার খোঁজে হাঁটছে, যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। কিন্তু সে কি দেখা পাবে সাম্ভালার?
মা-হারা রাশেদ। ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। গ্রামে আছে দাদু, যাকে নিয়ে তার অনেক চিন্তা। বাবা গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তি। দ্বিতীয় বিয়েও করেছেন। সেই মা-ও ভালোবাসেন রাশেদকে। তবে নিজের একটা সন্তানের জন্য আকাঙ্ক্ষাও বড্ড বেশি।
দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রাশেদের দুই বন্ধু। শামীম আর লিলি। এই তিনজনই আছে, একসাথে। এর মধ্যে রাশেদ-লিলি একে অপরকে ভালোবাসে। একদিন শামীম ভয়ানক বিপদে পড়ে, সেই বিপদে জড়িয়ে যায় রাশেদ আর লিলি। খুন হয় শামীম। কিছু না করেও খুনীর দায় ঘাড়ে চাপে রাশেদের। সে পালিয়ে বেড়ায়। খুন হয় আরো কয়েকজন।
আকবর আলী মৃধা, চর্চা করে কালোজাদুর। লুসিফারের উদ্দেশে তিনি বলি দেন কুমারী নারীকে। খুন করা তার কাছে কোনো ব্যাপার না। হন্যে হয়ে সে খুঁজছে রাশেদকে। কিন্তু কেন?
সেইন্ট জারমেইন, ইতিহাসখ্যাত এক আলকেমিস্ট। কিছু গবেষণা বলছে, তিনি বেঁচে আছেন; আর আছেন এই দেশেই, এই ভূখণ্ডে। তার বেশ কিছু প্রমাণও মিলেছে।
ডক্টর নিকোলাস কারসন একটা বিশেষ কাজের জন্য বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খুঁজছেন কিছু একটা। কিন্তু কী? হঠাৎ করে তাকে অপহরণ করা হলো। এর পেছনে কি রয়েছে কোনো কূটনৈতিক স্বার্থ?
আব্দুল মজিদ ব্যাপারী, রাশেদের দাদা, ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসে তিনি উধাও। ওদিকে গ্রামের বাড়িতে একের পর এক ভৌতিক ঘটনা ঘটেই চলেছে।
ঢাকা শহরে আবির্ভাব হলো বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের এক যুবকের। বেশ সুদর্শন। রাশেদকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে যাচ্ছে সে। বারবার সাবধান করে দিচ্ছে। ঠিক একই সময়ে গ্রিক দেবতার মতো দেখতে বোবা এক যুবককে দেখা যাচ্ছে শহরে। এই দুই যুবকের মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা সংযোগ আছে। কিন্তু কী?
নিঃসন্তান ডক্টর আরেফিন। না চাইতেই রাশেদ আর শামীমের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। একদিকে সবার পেছনে লেগেছে খুনীরা, অমূল্য এক সম্পদ উদ্ধারের জন্য একের পর এক খুন-গুম-অপহরণ হচ্ছে। নানা সময়ে নানা মানুষ যোগ দিচ্ছে সব দলে। অন্যদিকে এক দল জীবন, আরেক দল সম্পদ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কে যে আসল, কে যে নকল- কেউ জানে না। তবে সবার গন্তব্য এক। কিন্তু সেই গন্তব্য যে আসলে কী, তা কেউ কেউ জানে, আবার কেউ না জেনেই পথে নেমেছে।
অমৃতসুধা বা এলিক্সির অভ লাইফ। এর অস্তিত্ব কি আছে? প্রাচীন আলকেমিস্টদের পথে, আছে। খুব কম মানুষ সেটা জানে এবং বিশ্বাস করে। সেই ফর্মূলা রয়েছে এই দক্ষিণাঞ্চলে। কিন্তু কার কাছে? আদৌ কি আছে? অনেক প্রশ্ন, অনেক উত্তর আর অনেক রহস্যের মিশেল এই ‘সাম্ভালা’ বইটি। সেই অজানা গন্তব্যে, রাশেদ, জারমেইন, আরেফিন, আকবর আলীসহ সবাই ছুটছে। কিন্তু কে পৌঁছবে সেই ঠিকানায়? সাম্ভালা কার হাতে ধরা দেবে? সাম্ভালা কি বাস্তব, না কেবল মরীচিকা? এলিক্সির অভ লাইফ কি মিথ, না কোনো সত্যিকারের পানীয়, যা এনে দেবে অনন্ত যৌবন? সবকিছুর উত্তর মিলবে বইটি পড়লে।
প্রায় ৭৬০ পৃষ্ঠার এই অখণ্ড সমগ্র প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। এর আগে বইটি প্রথম, দ্বিতীয় এবং শেষ যাত্রা নামে তিনটি আলাদা আলাদা খণ্ডে পাওয়া যেত। প্রকাশ হবার পর বাংলাদেশসহ ভারতে বেশ ভালো সাড়া ফেলে। এতটাই জনপ্রিয় হয় যে এর ইংরেজি সংস্করণ ভারতে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন অরিন্দম মুখার্জী। মূল লেখক শরীফুল হাসান, বেশ সময় নিয়ে, অনেক পড়াশোনা করেছেন বইটি লেখার জন্য। এ বইয়ে আছে থ্রিল, সাসপেন্স, রহস্য- সবকিছুর অদ্ভুত সুন্দর একটা মিশেল। প্রতি পাতায় নতুন নতুন রহস্য, নতুন নতুন জট। প্রতিটি চরিত্রের সাথে পাঠক নিজেও নেমে পড়বেন অভিযানে। চাঁদের পাহাড়ে যেমন আছে হাজারো রহস্য, প্রতিবন্ধকতা আর উত্তরণ, ঠিক সেরকম একটা বই হতে পারে এটাও। যদিও অনেকে বলেন, লেখক কিছুটা বড় করে ফেলেছেন। তবে অধিকাংশ পাঠক মনে করেন, চাইলে আরো লেখা যেত এর চরিত্রগুলো নিয়ে।
কাহিনীতে উপস্থিত প্রতিটি চরিত্র খুব নিপুণভাবে লেখক তুলে ধরেছেন। সে হোক শামীম কিংবা আফরোজা। কিছু কিছু চরিত্র খুব স্বল্প সময়ের জন্য ছিল, তবে বেশ ভালো আর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছে। এই ছোটখাট কিছু চরিত্রের জন্য বেশ পূর্ণতা পেয়েছে উপন্যাসটি।
অন্যদিকে ইতিহাসের নানা সময়ের নানা ছোট-বড় ঘটনা উল্লেখ করা আছে এতে। নিজের জানা ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন। যদিও এখানে লেখা গল্প কাল্পনিক, তবে কিছু বাস্তব ঘটনার উল্লেখ আছে। এই ছোট ছোট ঘটনা উপন্যাসের সৌন্দর্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। কল্পিত কাহিনী পড়তে গিয়ে তাই মনে হবে যেন বাস্তব কোনো ঘটনা।
আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে লেখা উপন্যাস এটি। এতে প্রযুক্তির ছোঁয়া সেভাবে নেই, কিন্তু আছে অনেক জ্ঞান, অনেক প্রজ্ঞার সন্ধান। বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ বইয়ে ত্রুটি বলতে চোখে পড়ে টুকটাক বানান ভুল, যা এ প্রকাশনীর অন্য বইতেও লক্ষণীয়। সে অনুযায়ী বরং এ বইয়ে বানান ভুলের পরিমাণ কম।
খণ্ডাকারে প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ ছিল অন্যরকম সুন্দর, তবে অখণ্ড সমগ্রের প্রচ্ছদও বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু প্রথম প্রকাশিত আলাদা আলাদা খণ্ডের প্রচ্ছদ বইয়ের কাহিনীতে প্রাণ এনে দিয়েছিল বেশি। দেখলেই মনে হতো, এবার বোধহয় কোনো এক রহস্যে ডুব দেব। সম্মোহনী শক্তি ছিল। এবারের প্রচ্ছদ যদিও বেশ গোছানো, ছিমছাম। তবু লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের মতো, সেই পুরনো প্রচ্ছদের উপর পাঠকের অনাবিল ভালোবাসা রয়েছে।
বই: সাম্ভালা, এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা
লেখক: শরীফুল হাসান
ধরন: ফ্যান্টাসি-অ্যাডভেঞ্চার ট্রিলজি
প্রকাশক: বাতিঘর
প্রথম প্রকাশ: ২০১২ ২০১৩, ২০১৪ (তিন খণ্ড)
প্রথম অখণ্ড প্রকাশিত: ২০১৮ সাল (সংশোধিত এবং পরিমার্জিত)