“শীর্ষেন্দুর কোনো নতুন নভেলে
হঠাৎ পড়তে বসা আবোল তাবোলে”
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি নিঃসন্দেহে বাংলার এক তুমুল জনপ্রিয় লেখক। বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি এক জাজ্বল্যমান নক্ষত্রের মতোই দীপ্তি ছড়িয়েছেন। পিতার রেলের চাকরির সুবাদে ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে জন্ম নেয়া এ লেখকের শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। মোটামুটি যাযাবর জীবনের কারণে জীবন ও জগৎকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার, বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের অবাধ সুযোগ হয় তার। আর এরই প্রতিফলন ঘটেছে তার রচিত সাহিত্যে। তার রচিত ‘পার্থিব’ উপন্যাসও এর ব্যতিক্রম নয়।
আজ কথা বলব শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রচিত ‘পার্থিব’ উপন্যাসটি নিয়ে। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের সময়কাল থেকেই ‘পার্থিব’ উপন্যাসটি সর্বস্তরের পাঠকের নিকট সমাদৃত হয়। ১৯৯৪ সালে আনন্দ পাবলিশার্স উপন্যাসটি প্রকাশ করে। ‘পার্থিব’ নামটি থেকেই উপন্যাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এটি মূলত জগৎ-সংসার বা মানবজীবনেরই আধ্যাত্মিক প্রতিফলন, জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে অবলোকনের এক দর্পণস্বরূপ।
এবার চলে যাচ্ছি উপন্যাসের মূল কাহিনীতে। প্রথম দৃশ্যের সূচনা হয়েছে এক অজপাড়াগাঁয়ে, যেখানে বিষ্ণুপদ তার ভাঙা ঘরের দরজায় বসে প্রত্যাশিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার মেজো ছেলে রামজীবনের অর্ধসমাপ্ত বাড়িটির দিকে। রামজীবনের মদ্যপান ও কোন্দলের স্বভাব থাকলেও সে বাবা-মায়ের বড় ভক্ত। ধার-দেনা করে বাবা-মাকে ভালো-মন্দ খাওয়ানো থেকে শুরু করে পাকা বাড়ি করে দিতে পর্যন্ত তার বাদ সাধে না। বিষ্ণুপদের তিন ছেলে– কৃষ্ণজীবন, রামজীবন, রামাচরণের মধ্যে কৃষ্ণজীবনই একমাত্র ব্যতিক্রম।
পরিশ্রম আর মেধার জোরে তিনি গাঁয়ের গণ্ডি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমান, দেশ-বিদেশে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ হিসেবে খ্যাত হন। কিন্তু তবু তার মন জুড়ে আচ্ছন্ন থাকে শৈশবের গ্রাম বিষ্ণুপুরের স্মৃতি। শিকড়ের প্রতি তার যে মায়া, অন্য দিকে পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হওয়ার যে আত্মগ্লানি, তা উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া পৃথিবী নিয়ে কৃষ্ণজীবনের উদ্বেগ, জীবন-জগৎ নিয়ে তার আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা উপন্যাসটির এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। সরল ও উদাসমনা বিষ্ণুপদের সাথে স্ত্রী নয়নতারার চমৎকার রসায়ন, পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতা অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বিষ্ণুপদের কন্যা বীণাপানি ও তার সহজ-সরল স্বামী নিমাই। দারিদ্র্যের কারণে বাধ্য হয়ে বীণাপানিকে যাত্রায় নামতে হয়। আর্থিক অনটনের কারণে বীণাপানি ও নিমাইয়ের জীবনসংগ্রাম, বীণাপানির সাথে নিমাইয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন এ উপন্যাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অপর্ণা আর মনীশের সংসারজীবন এ উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন অপর্ণার স্বামী কিছুটা কল্পনাপ্রবণ ও ভাবনাবিলাসী। মনীশের হার্ট অ্যাটাকের পর তাদের পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। মনীশ এবং তার সন্তান- অনীশ, অনু, ঝুমকিকে আগলে রাখতে বদ্ধ পরিকর হয় অপর্ণা। অনীশের সহপাঠী সাহসী ও বুদ্ধিমতী মেয়ে ‘আপা’ উপন্যাসটির এক বলিষ্ঠ চরিত্র।
এক উদ্ভট চরিত্র চারুশীলা। স্বামী মস্ত আর্কিটেক্ট হওয়ার সুবাদে ঘন ঘন আতিথেয়তা, ভোজনের আয়োজন ও বিলাসিতার প্রবল শখ তার। চঞ্চল এ নারীর অতিরিক্ত সারল্য আর আতিথেয়তায় যেন হাঁপিয়ে ওঠে সবাই। তারই ভাই হেমাঙ্গ উপন্যাসের আরেক কিম্ভূতকিমাকার চরিত্র। একাকী থাকতে ভালবাসে বলে নিরিবিলি জীবনের বড় শখ তার। তাই প্রায়ই তাকে দেখা গেছে শহর ছেড়ে গাঁয়ে পাড়ি জমাতে, কখনো বা জীবন-সংসার থেকে দূর কোনো নদীর পাড়ে উদাসী জীবন কাটাতে। ভাইয়ের প্রতি উদ্বেগ থেকেই চারুশীলাকে দেখা যায় রশ্মি নামক বিলাত ফেরত মেয়ের সাথে হেমাঙ্গকে বিয়ের দিকে ঠেলে দিতে। তবে সত্যিই কি হেমাঙ্গ গাঁটছড়া বাঁধে রশ্মির সাথে? হেমাঙ্গ, রশ্মি, ঝুমকির মধ্যে সম্পর্কের শেষ পরিণতি কী হবে, এ প্রশ্ন উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত পাঠকের কৌতূহল ধরে রাখতে সক্ষম।
উপন্যাসের সবচেয়ে দুর্বল চরিত্র কৃষ্ণজীবনের কন্যা মোহিনীর টিউটর চয়ন, যার কাছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই প্রধান কামনা। একজন অসুস্থ মানুষের কাছে সুস্থতার গুরুত্ব কতটা, তা এ চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এপিলেপ্সির শিকার চয়ন একদিকে যেমন শারীরিকভাবে দুর্বল, অন্যদিকে আর্থিক অনটনের শিকার। তবুও যেন সে অপরাজেয়, হাল ছাড়েনি কিছুতেই।
এভাবে নানা চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে ‘পার্থিব’ উপন্যাসে। চরিত্রগুলোকে এত যত্নসহকারে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয়েছে এবং গুরুত্বের সাথে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে সবগুলো চরিত্রই অত্যন্ত সাবলীল ও বাস্তব বলে মনে হয়। এছাড়া লেখক অত্যন্ত সফলভাবে চরিত্রগুলোর মাঝে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এত চরিত্রের সমাবেশের মধ্যেও উপন্যাসের বিশাল অংশ জুড়ে ছিল কৃষ্ণজীবনের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন এবং তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে বেশিরভাগ ঘটনা। তাই তাকে এ উপন্যাসের মূল চরিত্র বলা যায়।
‘পার্থিব’ উপন্যাসের অন্যতম দিক হচ্ছে, এখানে একইসাথে গ্রামীণ সহজ-সরল জীবন ও যান্ত্রিক শহুরে জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন ও প্রাকৃতিক নিসর্গ, কোলাহল-কোন্দল থেকে শুরু করে শহুরে বিলাসিত জীবন-যাপন, শহরের সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম, শহুরে নানা সমস্যা, মানুষের মাঝে বিচিত্র সম্পর্কের সবকিছুই এখানে এক সূত্রে গাঁথা হয়েছে। প্রকৃতি ও মানবজীবনের মধ্যে যে নিবিড় যোগাযোগ, তা-ও এ রচনায় উঠে এসেছে অত্যন্ত চমৎকারভাবে। প্রকৃতি মানুষের মধ্যে কীভাবে ভাবান্তর ঘটাতে পারে, তা এ উপন্যাসে স্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায়।
এ উপন্যাসের আরেকটি দিকের কথা না বললেই নয়; তা হলো দৃশ্যের চিত্রায়ন। এত চমৎকারভাবে লেখক এখানে বিভিন্ন দৃশ্যের চিত্রাঙ্কন করেছেন, যা পাঠককে সহজেই মোহগ্রস্ত করে ফেলে। বইয়ের পাতা থেকে তুলে আনা কয়েকটি দৃশ্যের বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলো,
“মেঘলা দিনের কালো আলোয় ঘরের মধ্যে দুটি ছাইরঙা মানুষ দুজনের দিকে চেয়ে আছে। বাইরে সরু সরু অজস্র সাদা সুতোর মতো ঝুলে আছে বৃষ্টি। টিনের চালে ঝিমঝিম নেশাড়ু শব্দ। কথা নেই। বীণাপানি আর নিমাই।”
“হেমন্তের শেষ। যথেষ্টই শীত পড়েছে এখনো। একটু রাতের দিকে যখন চাঁদ উঠল, তখন বাইরের ফ্লাড লাইটটা নিবিয়ে দিয়ে কৃষ্ণজীবন একটি বেতের চেয়ার বাইরে এনে টেনে বসল। অল্প কুয়াশায় মাখা কী বন্য ভয়ংকর জোৎস্না! জঙ্গলে নীল গাইয়ের ডাক, পাখির ডাক, হরিণের গলা খাঁকারি শোনা যাচ্ছে…।”
“ছোট ফিয়াট গাড়ির মধ্যে তারা দুজন সামনের সিটে পাশাপাশি বসা। চারদিকে বৃষ্টির ঝরোখা, সামনের উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির লহর খেলছে। চারদিক আবছা, মেঘলা আলোয় কিছু অপ্রসন্নতা…।”
এ উপন্যাসের পরতে পরতে এমন কিছু কথা উঠে এসেছে, যা পাঠকমনকে নাড়া দেবে সহজেই।
“মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তার মন। মন ভালো থাকলে দুনিয়াটা বড় ভালো, আর মন বিগড়ালে পরমান্নও তেতো।”
“প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই লুকানো অব্যবহৃত কিছু গুণ থেকে যায়। সে হয়তো সারা জীবন নিজের সেই গুণটার কথা জানতেই পারে না৷ গুণটা থেকেও নষ্ট হয়।”
“দুনিয়াতে পালিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মানুষের পালানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা হল তার মন। যদি সেখানে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিতে পারি, তবে কেউ আর নাগাল পাবে না।”
“পুরুষ মানুষের মধ্যে যা আছে, মেয়ে মানুষের মধ্যে তা নেই। আবার মেয়ে মানুষের মধ্যেও এমন কিছু আছে, যা পুরুষের নেই। হরেদরে দু’পক্ষই সমান৷ যিনি মানুষ তৈরি করেছেন তিনি তো আর আহাম্মক নন, একচোখাও নন। সমান সমানই দিয়েছেন দু’জনকে, তবে রকমটা আলাদা।”
“ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা সব জ্ঞানকে গ্রাস করে নিতে পারে।”
‘ভালবাসা এক অনুশীলনসাপেক্ষ ব্যাপার। ভাবের ভালবাসা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।’
সর্বোপরি এ উপন্যাসে জীবন-সংসারের নানা প্রবহমান ঘটনা ও বাস্তব বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এসে একত্র হয়েছে নানা বর্ণ-গন্ধ-ছন্দে। লেখকের সৃষ্টিশৈলীর গুণে অতি সাধারণ ঘটনাগুলোও যেন এখানে অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর রূপে ধরা দিয়েছে। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে জীবনের অন্তর্নিহিত গুরুত্ব ও তাৎপর্য, মহাবিশ্বের সাথে মানবের সম্পর্ক প্রভৃতি পাঠককে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বারবার। সেইসাথে জীবন, জগৎ, প্রকৃতি, মহাবিশ্ব নিয়ে বহু ভাবনা ও বিস্ময় পাঠককে যে এক ভিন্ন আধ্যাত্মিক জগতে উদীয়মান করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
উপন্যাসটি শেষ হয়েছে কৃষ্ণজীবনের নতুন প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে, যেখানে তিনি অতীত-স্মৃতি, জীবন-জগতের নানা ভাবনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে সম্মোহিতের মতো লিখে চলেছেন, যা পাঠককে রোমাঞ্চিত করবে সহজেই। শেষ থেকেও মিলবে এক নতুন শুরুর সম্ভাবনা।