কর্ণ–সহদেব যুদ্ধ: কর্ণের নিকট সহদেবের পরাজয়
সহদেব দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন, কিন্তু কর্ণ তার গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। সহদেব পরপর দুইবার কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে কর্ণ সহদেবকে তীরবিদ্ধ করেন এবং কর্ণের তীরের আঘাতে সহদেবের ধনুক কাটা পড়ে। সহদেব আরেকটি ধনুক উঠিয়ে কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সহদেবের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। সহদেব ধনুক নামিয়ে রেখে একটি ঢাল ও একটি তলোয়ার উঠিয়ে নেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেগুলো কাটা পড়ে। সহদেব একটি ভারী গদা উঠিয়ে সেটিকে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সহদেব একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেটিকে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটিও কাটা পড়ে।
এরপর সহদেব তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কাছেই পড়ে থাকা একটি রথের চাকা উঠিয়ে সেটিকে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সহদেব আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বস্তু উঠিয়ে কর্ণের দিকে নিক্ষেপ করতে থাকেন। সেগুলোর মধ্যে ছিল তার বিকল রথের বিভিন্ন অংশ, তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো যে দড়ির সাহায্যে যুক্ত ছিল সেটি এবং আশেপাশে পড়ে থাকা নিহত সৈন্য, হাতি ও ঘোড়াগুলোর দেহের বিভিন্ন অংশ। কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেগুলোর সবই কাটা পড়ে। এরপর কর্ণ সহদেবকে তীরবিদ্ধ করেন এবং আহত সহদেব সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু কর্ণ তার রথে চড়ে সহদেবের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তাকে কোণঠাসা করে ফেলেন। এরপর তিনি তার রথ থেকে নেমে সহদেবের কাছে যান এবং হেসে উঠে তার উদ্দেশ্যে বলেন, “বীর! যারা তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা তোমার সমকক্ষ। আমার এই কথায় সন্দেহ রেখো না।” এরপর কর্ণ তার ধনুকের অগ্রভাগ দিয়ে সহদেবকে স্পর্শ করেন এবং আবার তার উদ্দেশ্যে বলেন, “অর্জুন কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তুমি সেখানে যাও। অথবা চাইলে বাড়ি ফিরে যাও!” সেসময় কর্ণ চাইলে সহদেবকে হত্যা করতে পারতেন, কিন্তু কুন্তীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে তিনি সহদেবকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন এবং সহদেবকে ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে সেখান থেকে ফিরে যান। এরপর তিনি তার রথে চড়ে পাঞ্চালের সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কর্ণের নিকট পরাজিত হওয়ার পর ও তার বাক্যবাণ শুনে সহদেব দারুণ অপমানবোধ করেন, এবং বিষণ্ণ অবস্থায় পাঞ্চালের রাজপুত্র জনমেজয়ের রথে আরোহণ করেন।
উল্লেখ্য, মহাভারতে প্রদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের বিবরণে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের ভূমিকা যে বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে, সেই তুলনায় নকুল ও সহদেবের ভূমিকার ওপর সেভাবে আলোকপাত করা হয়নি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সহদেব যে কয়টি দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিল কর্ণের বিরুদ্ধে তার লড়াই। রণকুশলতার দিক থেকে সহদেব কর্ণের সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, চতুর্দশ দিনের যুদ্ধের সময় কর্ণের তীরের আঘাতে ভীমের রথ বিকল হয়ে যাওয়ার পর ভীম যেভাবে কর্ণকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন, চতুর্দশ রাতের যুদ্ধের সময় কর্ণের তীরের আঘাতে সহদেবের রথ বিকল হয়ে যাওয়ার পর তিনিও ঠিক একইভাবে কর্ণকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন।
শল্য–বিরাট যুদ্ধ: শল্যের নিকট বিরাট ও মৎস্যের সৈন্যদলের পরাজয়
বিরাটের নেতৃত্বে মৎস্য রাজ্যের সৈন্যদল দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু শল্য তাদের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদের গতিরোধ করেন। শল্য বিরাটকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে বিরাট শল্যকে পরপর তিনবার তীরবিদ্ধ করেন। শল্যের তীরের আঘাতে বিরাটের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং রথটির ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। বিরাট ক্ষিপ্রগতিতে তার অচল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়েই শল্যের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। বিরাটকে মাটিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখে তার ভাই শতানীক তাকে সহায়তা করার জন্য রথে চড়ে সেদিকে অগ্রসর হন, কিন্তু শল্যের তীরের আঘাতে তিনি নিহত হন। ভাইয়ের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ হয়ে বিরাট শতানীকের রথে আরোহণ করেন এবং শল্যের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে শল্য বিরাটকে তীরবিদ্ধ করেন। শল্যের তীরের আঘাতে বিরাট সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। এমতাবস্থায় রথটির সারথি বিরাটকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। শল্যের নিকট বিরাটের পরাজয়ের পর মৎস্যের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।
শল্যের নিকট বিরাট ও তার নেতৃত্বাধীন মৎস্যের সৈন্যদলের পরাজয়ের পর অর্জুন শল্যের দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু রাক্ষস অলম্বুশ অর্জুনের গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অলম্বুশ অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ তীব্র যুদ্ধ চলে। অর্জুন অলম্বুশকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের তীরের আঘাতে অলম্বুশের রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে অলম্বুশের রথের সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং অলম্বুশের ধনুক কাটা পড়ে। অলম্বুশ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে নেন, কিন্তু অর্জুনের তীরের আঘাতে সেটিও কাটা পড়ে। এরপর অর্জুন অলম্বুশকে আবার তীরবিদ্ধ করেন এবং অলম্বুশ আতঙ্কিত হয়ে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। অর্জুনের নিকট অলম্বুশের পরাজয়ের পর অর্জুনের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।
বৃষসেন–দ্রুপদ যুদ্ধ: বৃষসেনের নিকট দ্রুপদ ও পাঞ্চালের সৈন্যদলের পরাজয়
দ্রুপদের নেতৃত্বে পাঞ্চালের সৈন্যরা দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু কর্ণের ছেলে বৃষসেন তাদের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাদের গতিরোধ করেন এবং দ্রুপদের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রুপদ বৃষসেনকে এবং বৃষসেন দ্রুপদকে এমনভাবে তীরবিদ্ধ করেন যে উভয়ের শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। বৃষসেন পরপর তিনবার দ্রুপদকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর দ্রুপদের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। দ্রুপদের তীরের আঘাতে বৃষসেনের ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু বৃষসেন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রুপদের দিকে সজোরে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন। বৃষসেন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরটি দ্রুপদের শরীর ভেদ করে বেরিয়ে মাটিতে গেঁথে যায় এবং সেটির আঘাতে দ্রুপদ সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর পড়ে যান। এমতাবস্থায় দ্রুপদের রথের সারথি দ্রুপদকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
বৃষসেনের নিকট দ্রুপদের পরাজয়ের পর পাঞ্চালের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে শুরু করে। বৃষসেনের তীরে পাঞ্চালের বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং পাঞ্চালের বহুসংখ্যক শীর্ষ রথী তার নিকট যুদ্ধে পরাজিত হয়। এমতাবস্থায় পাঞ্চালের সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে এবং তাদের পরাজয়ের পর বৃষসেন যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন।
দুঃশাসন–প্রতিবিন্ধ্য যুদ্ধ: ফলাফলবিহীন পরিসমাপ্তি
যুধিষ্ঠিরের ছেলে প্রতিবিন্ধ্য কৌরব সৈন্যদের হত্যা করতে করতে দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছিলেন। দুঃশাসন তার গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। দুঃশাসন প্রতিবিন্ধ্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে প্রতিবিন্ধ্য দুঃশাসনকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন। দুঃশাসনের তীরের আঘাতে প্রতিবিন্ধ্যের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয় এবং রথটির ঝাণ্ডা কাটা পড়ে। প্রতিবিন্ধ্য ধনুক হাতে নিয়ে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং দুঃশাসনের তীরের আঘাতে প্রতিবিন্ধ্যের রথটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
প্রতিবিন্ধ্য মাটিতে দাঁড়িয়েই দুঃশাসনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু দুঃশাসনের তীরের আঘাতে প্রতিবিন্ধ্যের ধনুক কাটা পড়ে এবং দুঃশাসন প্রতিবিন্ধ্যকে তীরবিদ্ধ করেন। এটি দেখে বাকি চার উপপাণ্ডব (সুতসোম, শ্রুতকীর্তি, শতানীক ও শ্রুতকর্মা) প্রতিবিন্ধ্যকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। প্রতিবিন্ধ্য সুতসোমের রথে আরোহণ করেন এবং আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দুঃশাসনকে তীরবিদ্ধ করেন। এমতাবস্থায় কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা দুঃশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।
শকুনি–নকুল যুদ্ধ: নকুলের নিকট শকুনির পরাজয়
নকুল দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং নকুলের তীরে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে শকুনি নকুলের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানান। শকুনি ও নকুল একে অপরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন। শকুনির তীরের আঘাতে নকুলের বর্ম কাটা পড়ে এবং নকুলের তীরের আঘাতে শকুনির বর্ম কাটা পড়ে। উভয়ের শরীর থেকেই রক্ত ঝরতে থাকে। এরপর শকুনির তীরের আঘাতে নকুল সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন, কিন্তু তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং শকুনিকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন। নকুলের তীরের আঘাতে শকুনির ধনুক ও রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং এরপর নকুলের তীরের আঘাতে শকুনি সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। এমতাবস্থায় শকুনির রথের সারথি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। শকুনিকে পরাজিত করার পর নকুল আবার দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন।
কৃপাচার্য–শিখণ্ডী যুদ্ধ: কৃপাচার্যের নিকট শিখণ্ডীর পরাজয়
শিখণ্ডী দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছিলেন, কিন্তু কৃপাচার্য শিখণ্ডীর গতিরোধ করেন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। শিখণ্ডী কৃপাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে কৃপাচার্য শিখণ্ডীকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন। কৃপাচার্য ও শিখণ্ডী পরস্পরের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে যুদ্ধ চলার পর শিখণ্ডীর তীরের আঘাতে কৃপাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে এবং শিখণ্ডী কৃপাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন। কৃপাচার্য একটি বিশেষ ধরনের তীর উঠিয়ে সেটিকে শিখণ্ডীর দিকে নিক্ষেপ করেন, কিন্তু শিখণ্ডীর তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে।
কৃপাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে শিখণ্ডীকে ব্যাপকভাবে তীরবিদ্ধ করেন এবং কৃপাচার্যের তীরের আঘাতে শিখণ্ডী সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর বসে পড়েন। এমতাবস্থায় শিখণ্ডীর রথের সারথি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কৃপাচার্যের নিকট শিখণ্ডীর পরাজয়ের পর পাণ্ডব সৈন্যরা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং দুর্যোধনের ভাইয়েরা কৃপাচার্যকে সহায়তা করার জন্য সসৈন্যে সেদিকে অগ্রসর হয়। এরপর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আরম্ভ হয়।
শীর্ষ কৌরব যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকির লড়াই
ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তাকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে পাণ্ডব সৈন্যরা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখে। অনুরূপভাবে, দ্রোণাচার্যকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে দুর্যোধনের নেতৃত্বে শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করেন এবং দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে। ধৃষ্টদ্যুম্ন আরেকটি ধনুক উঠিয়ে দ্রোণাচার্যকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু কর্ণের তীরের আঘাতে সেটি কাটা পড়ে এবং এরপর কর্ণ, অশ্বত্থামা, দ্রোণাচার্য, শল্য, দুঃশাসন, দুর্যোধন ও শকুনি একযোগে ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাদের সকলকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর তিনি দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে উক্ত চার কৌরব যোদ্ধা ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করেন।
কৌরব রথী দ্রুমসেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরপর দুইবার তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুমসেনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরের আঘাতে দ্রুমসেন নিহত হন। এরপর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা, শল্য, দুর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে কর্ণের ধনুক কাটা পড়ে। ক্রুদ্ধ কর্ণ আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং বাকি ছয় কৌরব যোদ্ধা ধৃষ্টদ্যুম্নকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তাকে ঘিরে ফেলেন। এমতাবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সাত্যকি সেদিকে অগ্রসর হন। কর্ণ সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ ও সাত্যকির মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। কর্ণ ও সাত্যকি পরস্পরকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ কর্তৃক নিক্ষিপ্ত শত শত তীর সাত্যকিকে বিদ্ধ করে এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি কর্ণের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
বেশ কিছুক্ষণ কর্ণ ও সাত্যকির মধ্যে সমানে সমানে যুদ্ধ চলার পর বৃষসেন কর্ণের সঙ্গে যোগ দেন এবং তারা দুইজন একযোগে সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ ও বৃষসেন একযোগে সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং সাত্যকির তীরের আঘাতে বৃষসেন সংজ্ঞাহীন হয়ে তার রথের ওপর পড়ে যান। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ সজোরে সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন এবং প্রত্যুত্তরে সাত্যকি কর্ণকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন। ইতোমধ্যে বৃষসেন সংজ্ঞা ফিরে পান এবং সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেন। সাত্যকি কর্ণ ও বৃষসেনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং সাত্যকির তীরের আঘাতে কর্ণ ও বৃষসেনের ধনুকদ্বয় কাটা পড়ে। কর্ণ ও বৃষসেন উভয়েই আরেকটি ধনুক উঠিয়ে সাত্যকির দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এভাবে তাদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে, কিন্তু তাদের এই লড়াই ফলাফল ছাড়াই সমাপ্ত হয়।
এমতাবস্থায় কর্ণ দুর্যোধনকে বলেন যে, অর্জুন দূরে যুদ্ধে লিপ্ত, কিন্তু সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কৌরবদের কাছাকাছি অবস্থান করছেন এবং এই দুইজনকে হত্যা করতে পারলে কৌরবদের বিজয়ের পথ সুগম হবে। কর্ণের বক্তব্য শুনে দুর্যোধন ১০,০০০ রথ ও ১০,০০০ হাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি সৈন্যদল নিয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করার জন্য শকুনিকে নির্দেশ দেন। এরপর দুর্যোধনের নির্দেশে কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা একটি বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। উক্ত সৈন্যদল সাত্যকিকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে তার ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু সাত্যকির তীরে বহুসংখ্যক কৌরব রথী, হাতি ও অশ্বারোহী সৈন্য নিহত হয় এবং উক্ত সৈন্যদলটি প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
দুর্যোধন–সাত্যকি যুদ্ধ: সাত্যকির নিকট দুর্যোধনের পরাজয়
সাত্যকির হাতে দুর্যোধন কর্তৃক তার বিরুদ্ধে প্রেরিত কৌরব সৈন্যদলটিকে পর্যুদস্ত হতে দেখে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে নিজেই সাত্যকির দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। সাত্যকি দুর্যোধনকে এবং দুর্যোধন সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন। সাত্যকি দুর্যোধনকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে দুর্যোধনের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথটির সারথি নিহত হয়। দুর্যোধন সাত্যকির দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে দুর্যোধন কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন। এরপর সাত্যকির তীরের আঘাতে দুর্যোধনের ধনুক কাটা পড়ে। দুর্যোধন ক্ষিপ্রগতিতে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং কৃতবর্মার রথে আরোহণ করে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করেন। সাত্যকির নিকট দুর্যোধনের পরাজয়ের পর সাত্যকির তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়।
শকুনি–অর্জুন যুদ্ধ: অর্জুনের নিকট শকুনি ও তার সৈন্যদলের পরাজয়
এদিকে দুর্যোধনের নির্দেশ মোতাবেক শকুনি একটি বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে অর্জুনকে আক্রমণ করেন এবং কৌরব সৈন্যরা অর্জুনকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। কৌরব রথীরা মন্ত্র উচ্চারণ করে অর্জুনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে, কিন্তু অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে পাল্টা দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেন এবং শীঘ্রই তার তীরবৃষ্টির তোড়ে শকুনির নেতৃত্বাধীন সৈন্যদলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর শকুনি অর্জুনের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্জুন শকুনিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এরপর তিনি শকুনি ও শকুনির ছেলে উলুককে তীরবিদ্ধ করেন।
অর্জুনের তীরে শকুনির ধনুক কাটা পড়ে এবং শকুনির রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়। শকুনি তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে উলুকের রথে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে শকুনি ও উলুক অর্জুনের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ অব্যাহত রাখেন। অর্জুন শকুনি ও উলুককে তীরবিদ্ধ করেন এবং অর্জুনের তীরবৃষ্টির ফলে চতুর্দিকে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে। অর্জুনের নিকট পরাজিত হয়ে শকুনি ও উলুক সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। এভাবে শকুনির নেতৃত্বাধীন কৌরব সৈন্যদলটিকে পরাজিত করার পর অর্জুন ও কৃষ্ণ শঙ্খধ্বনি করেন।
ধৃষ্টদ্যুম্নের পরাক্রম এবং দ্রোণাচার্য ও কর্ণের রণকুশলতা
ধৃষ্টদ্যুম্ন আবার দ্রোণাচার্যের দিকে অগ্রসর হন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি দ্রোণাচার্যকে তীরবিদ্ধ করেন এবং তার তীরের আঘাতে দ্রোণাচার্যের ধনুক কাটা পড়ে। দ্রোণাচার্য আরেকটি ধনুক উঠিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের সারথিকে তীরবিদ্ধ করেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন তীরের সাহায্যে দ্রোণাচার্য কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টিকে প্রতিহত করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। ধৃষ্টদ্যুম্নের তীরবৃষ্টির তোড়ে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এভাবে কৌরব বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব ও ভীম শঙ্খধ্বনি করেন।
কৌরব বাহিনীর বিপর্যয় দেখে দুর্যোধন ক্ষিপ্ত হন এবং দ্রোণাচার্য ও কর্ণের কাছে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, তারা দুইজনেই ইতিপূর্বে দুর্যোধনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তারা পাণ্ডবদেরকে পরাজিত করবেন। কিন্তু দুর্যোধন অনুযোগ করেন যে, তারা দুইজন নির্বিকারভাবে কৌরব বাহিনীর বিপর্যয় পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দ্রোণাচার্য ও কর্ণকে এই বলে অনুনয় করেন যে, যদি তিনি তাদের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার যোগ্য না হয়ে থাকেন, তাহলে তারা যেন তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। দুর্যোধনের বাক্যবাণ তাদের উভয়কেই আহত করে এবং দ্রোণাচার্য ও কর্ণ পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। কৌরব বাহিনীর অন্যান্য শীর্ষ যোদ্ধা তাদের অনুগমন করেন। তাদেরকে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারাও তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
দ্রোণাচার্য, কর্ণ, দুর্যোধন, বৃষসেন ও শকুনি দূর থেকে সাত্যকিকে তীরবিদ্ধ করেন। দ্রোণাচার্য ও কর্ণের তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয় এবং তাদের দুইজনের তীরবৃষ্টির তোড়ে বিভ্রান্ত হয়ে তারা পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দ্রোণাচার্যকে আক্রমণ করার জন্য তার দিকে ছুটে আসে, কিন্তু দ্রোণাচার্যের তীরে তাদের সকলেই নিহত হয়। দ্রোণাচার্য ও কর্ণ পশ্চাৎপসরণরত পাণ্ডব সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তাদের তীরে পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। এমতাবস্থায় পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধারা দ্রোণাচার্য ও কর্ণকে প্রতিহত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।
কর্ণ–ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ: কর্ণের নিকট ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং পাঞ্চাল ও সোমকের সৈন্যদলের পরাজয়
কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নের মুখোমুখি হন এবং তার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করেন এবং প্রত্যুত্তরে ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন পরস্পরের দিকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং পরস্পরকে তীরবিদ্ধ করেন। কর্ণের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের দুই পার্শ্বনী সারথি ও রথটির সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয় এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুক কাটা পড়ে। এরপর কর্ণের তীরের আঘাতে ধৃষ্টদ্যুম্নের রথের মুখ্য সারথি নিহত হয় এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন একটি গদা উঠিয়ে নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন। কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে তীরবিদ্ধ করতে থাকেন, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ণের রথের কাছাকাছি এসে তার গদার আঘাতে কর্ণের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলোকে হত্যা করেন এবং এরপর ক্ষিপ্রগতিতে সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করে অর্জুনের রথে আরোহণ করেন। এভাবে ধৃষ্টদ্যুম্নকে পরাজিত করে কর্ণ শঙ্খধ্বনি করেন।
কর্ণের নিকট ধৃষ্টদ্যুম্নের পরাজয়ের পর পাঞ্চাল ও সোমকের সৈন্যরা ক্রুদ্ধ অবস্থায় সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র হাতে কর্ণের দিকে ছুটে যায়। এদিকে কর্ণের রথের সারথি রথটির সঙ্গে নতুন চারটি ঘোড়াকে যুক্ত করে এবং এরপর কর্ণ অগ্রসরমান পাণ্ডব সৈন্যদলকে আক্রমণ করেন। কর্ণের তীরে পাঞ্চাল ও সোমকের বিপুল সংখ্যক রথী, হাতি ও অশ্বারোহী সৈন্য নিহত হয় এবং পাঞ্চালের বহুসংখ্যক শীর্ষ রথী কর্ণের নিকট পরাজিত হয়। এমতাবস্থায় পাঞ্চাল ও সোমকের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে, কিন্তু কর্ণ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকেন। কর্ণের আক্রমণে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে এমন তীব্র আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছিল যে, তারা আতঙ্কের বশে নিজেদের যোদ্ধাদেরকেও কর্ণ মনে করে তাদের কাছ থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে থাকে। কর্ণের আক্রমণে পাণ্ডব বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
ঘটোৎকচের প্রতি কৃষ্ণ ও অর্জুনের নির্দেশ এবং কর্ণের বিরুদ্ধে ঘটোৎকচের যুদ্ধযাত্রা
কর্ণের পরাক্রম দেখে যুধিষ্ঠির আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে থাকেন যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে না নিলে কর্ণের হাতে তার সৈন্যদলের ধ্বংস অনিবার্য। তিনি অর্জুনকে কর্ণের ব্যাপারে তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করার আহ্বান জানান এবং কর্ণকে হত্যা করার জন্য বলেন। অর্জুন কৃষ্ণকে বলেন যে, কর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করছেন এবং তিনি এটি সহ্য করতে পারছেন না। তিনি কর্ণের দিকে রথ পরিচালনা করার জন্য কৃষ্ণকে বলেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, পাণ্ডব বাহিনীতে অর্জুন আর ঘটোৎকচ ছাড়া কর্ণের মোকাবিলা করার মতো আর কেউ নেই। কিন্তু তিনি উল্লেখ করেন যে, এখনো অর্জুনের কর্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় হয়নি, কারণ কর্ণের কাছে ইন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত ‘বাসব শক্তি’ অস্ত্র রয়েছে এবং তিনি সেটি অর্জুনকে হত্যা করার জন্য সংরক্ষণ করছেন।
এভাবে অর্জুনকে নিরস্ত করে কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে ডেকে পাঠান। তিনি কর্ণের হাত থেকে পাণ্ডব বাহিনীকে রক্ষা করার জন্য এবং ইন্দ্রজালের সাহায্যে কর্ণকে হত্যা করার জন্য ঘটোৎকচকে আহ্বান জানান। অর্জুন ঘটোৎকচকে বলেন যে, তার দৃষ্টিতে ভীম, সাত্যকি ও ঘটোৎকচ পাণ্ডব বাহিনীর শীর্ষ যোদ্ধা। তিনি ঘটোৎকচকে কর্ণের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য বলেন এবং যোগ করেন যে, এক্ষেত্রে সাত্যকি তাকে সহায়তা করবেন। তিনি ঘটোৎকচকে নির্দেশ দেন, “সাত্যকির সহায়তায় সাহসী কর্ণকে হত্যা করো!” কৃষ্ণ ও অর্জুনের নির্দেশে ঘটোৎকচ কর্ণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ঘটোৎকচকে অগ্রসর হতে দেখে কর্ণও তার দিকে ছুটে যান।
অলম্বুশ–ঘটোৎকচ যুদ্ধ: ঘটোৎকচের হাতে অলম্বুশের মৃত্যু
ঘটোৎকচকে কর্ণের দিকে অগ্রসর হতে দেখে দুর্যোধন দুঃশাসনকে ডেকে ঘটোৎকচকে প্রতিরোধ করার জন্য নির্দেশ দেন এবং তাকে এটি নিশ্চিত করতে বলেন যে, তাদের গাফিলতির জন্য যেন কর্ণ নিহত না হন। এমতাবস্থায় রাক্ষস অলম্বুশ দুর্যোধনের কাছে গিয়ে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তার অনুমতি প্রার্থনা করেন। দুর্যোধন সানন্দে তাকে সেই অনুমতি প্রদান করেন এবং এরপর অলম্বুশ ঘটোৎকচকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেন। ঘটোৎকচ অলম্বুশের আহ্বান স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন।
অলম্বুশ ঘটোৎকচের দিকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ঘটোৎকচ ইন্দ্রজালের সাহায্যে সেগুলোকে প্রতিহত করেন এবং অলম্বুশকে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করেন। অলম্বুশ ঘটোৎকচের দিকে তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করেন। এরপর তিনি পাণ্ডব সৈন্যদের ওপর তীরবর্ষণ করেন এবং তার তীরে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। অলম্বুশের আক্রমণে পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এটি দেখে ঘটোৎকচ কৌরব সৈন্যদের ওপর তীরবর্ষণ করতে শুরু করেন এবং তার আক্রমণের ফলে কৌরব সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে থাকে। এরপর ঘটোৎকচ তীরের সাহায্যে অলম্বুশের রথ, রথের সারথি ও সকল অস্ত্রশস্ত্রকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেন এবং সমগ্র কৌরব বাহিনীর ওপর তীব্র তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।
অলম্বুশ ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে গিয়ে ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। অলম্বুশের আঘাতে ঘটোৎকচ কেঁপে ওঠেন, কিন্তু সামলে নিয়ে তিনি অলম্বুশকে প্রত্যাঘাত করেন এবং অলম্বুশকে মাটিতে ফেলে তাকে পিষে ফেলার চেষ্টা করেন। অলম্বুশ ঘটোৎকচের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইন্দ্রজালের সাহায্যে মাটি থেকে শূণ্যে আরোহণ করেন এবং সেখান থেকে ঘটোৎকচকে আক্রমণ করেন। এরপর তিনি ঘটোৎকচকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তাকে পিষে ফেলার চেষ্টা করেন এবং তারপর তারা তাদের ইন্দ্রজাল ব্যবহার করে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন।
কখনো তাদের একজন আগুন ও অন্যজন বাতাসের রূপ ধারণ করেন; কখনো তাদের একজন গরুড় ও অন্যজন তক্ষকের রূপ ধারণ করেন; কখনো তাদের একজন মেঘ ও অন্যজন ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধারণ করেন; কখনো তাদের একজন বজ্র ও অন্যজন অতিকায় পর্বতের রূপ ধারণ করেন; আবার কখনোবা তাদের একজন সূর্য ও অন্যজন রাহুর রূপ ধারণ করেন। এভাবে শত ধরনের ইন্দ্রজাল ব্যবহার করে অলম্বুশ ও ঘটোৎকচ একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এরপর তারা গদা, লোহার কাঁটাযুক্ত দণ্ড, মুগুর, বর্শা, কুঠার, পর্বতশৃঙ্গ প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্র দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এরপর কখনো ঘোড়ায় চড়ে, কখনো হাতির পিঠে চেপে, কখনো রথে চড়ে, আবার কখনোবা মাটিতে দাঁড়িয়ে তারা একে অপরকে আক্রমণ করেন।
প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এক পর্যায়ে ঘটোৎকচ অলম্বুশকে ধরে মাটিতে ফেলে দেন এবং পদাঘাতে তাকে পিষ্ট করতে থাকেন। এমতাবস্থায় একটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তিনি অলম্বুশের মাথা কেটে ফেলেন এবং এর ফলে অলম্বুশের মৃত্যু হয়। এরপর অলম্বুশের বিচ্ছিন্ন মাথা হাতে তুলে নিয়ে ঘটোৎকচ দুর্যোধনের রথের দিকে ছুটে যান এবং তার রথের ওপর মাথাটিকে ফেলে দেন। এরপর ঘটোৎকচ দুর্যোধনের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে বলেন, “কোনো রাজা, ব্রাহ্মণ বা নারীর সঙ্গে দেখা করার সময় কখনো খালি হাতে যাওয়া উচিত নয়!” তিনি দুর্যোধনকে বলেন, “তোমার এই মিত্র নিহত হয়েছে, যার বীরত্ব তুমি দেখেছো। এরপর তুমি কর্ণের এবং তারপর তোমার নিজের মৃত্যু দেখবে। আমি কর্ণকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আনন্দে থাকো!” দুর্যোধনকে এভাবে শাসিয়ে ঘটোৎকচ কর্ণকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে ছুটে যান।