নবম দিনের ভোরে যুদ্ধের আগে দুর্যোধন দুঃশাসনকে ডেকে নির্দেশ দেন যে, কৌরব সৈন্যরা যেন সকল অবস্থায় ভীষ্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। দুর্যোধন উল্লেখ করেন যে, ভীষ্ম শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবেন না, এবং এই সুযোগকে ব্যবহার করে শিখণ্ডী যাতে ভীষ্মকে হত্যা করতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করার জন্য দুর্যোধন দুঃশাসনকে নির্দেশ দেন। তিনি যোগ করেন যে, ভীষ্ম জীবিত থাকলে কৌরবদের বিজয় নিশ্চিত। দুর্যোধনের নির্দেশ শোনার পর শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা একটি বৃহৎ রথী সৈন্যদলসহ ভীষ্মকে বেষ্টন করে রাখেন এবং যুদ্ধযাত্রা করেন।
নবম দিনের যুদ্ধ: অভিমন্যুর রণকুশলতা, ভীষ্মের রুদ্রমূর্তি এবং কৌরবদের বিজয়
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নবম দিনে ভীষ্ম কৌরব সৈন্যদেরকে নিয়ে ‘সর্বতোভদ্রব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ কৌরব বাহিনীকে এমনভাবে সজ্জিত করেন যাতে কৌরব বাহিনীর অগ্রভাগ, পশ্চাদ্ভাগ, ডান বাহু এবং বাম বাহু সকল দিকই সুরক্ষিত থাকে। এটিকে প্রতিহত করার জন্য পাণ্ডবরা নিজেদের সৈন্যদের নিয়ে ‘নক্ষত্রমণ্ডলব্যূহ’ গঠন করেন, অর্থাৎ পাণ্ডব বাহিনীকে নক্ষত্রমণ্ডলের আকারে সজ্জিত করেন। উভয় পক্ষ কর্তৃক ব্যূহ গঠনের পর তাদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
যুদ্ধের শুরুতে অভিমন্যু বিশেষ পরাক্রম প্রদর্শন করেন এবং তার তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। রথে চড়ে ক্ষিপ্রগতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে চলাচল করে তিনি কৌরব বাহিনীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিলেন এবং তার রথ এত দ্রুত চলাচল করছিল যে, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা বা জয়দ্রথ কেউই তাকে আঘাত করতে পারছিলেন না। এটি লক্ষ্য করে দুর্যোধন অভিমন্যুকে আক্রমণ করার জন্য রাক্ষস অলম্বুষকে নির্দেশ দেন। অলম্বুষ তীব্র গর্জন করে পাণ্ডব বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তার গর্জন শুনে পাণ্ডব সৈন্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বহুসংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য এই বিকট শব্দ শুনেই প্রাণ হারায়। অভিমন্যুর কাছাকাছি পৌঁছে অলম্বুষ তার সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং অলম্বুষের তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়।
এরপর অলম্বুষ উপপাণ্ডবদের (পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে) বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। উপপাণ্ডবদের তীরের আঘাতে তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, কিন্তু শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং ক্রুদ্ধ হয়ে উপপাণ্ডবদের আক্রমণ করেন। অলম্বুষের তীরের আঘাতে উপপাণ্ডবদের ধনুকগুলো ও তাদের রথগুলোর ঝাণ্ডাগুলো কাটা পড়ে, তাদের রথগুলোর সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো নিহত হয়, তাদের রথগুলোর সারথিরা নিহত হয় এবং তারা নিজেরাও ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন। অলম্বুষ তাদেরকে হত্যা করার জন্য তাদের দিকে ছুটে যান।
অলম্বুষের নিকট উপপাণ্ডবদের পরাজয়ের পর অভিমন্যু তাদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষিপ্রগতিতে অলম্বুষের দিকে অগ্রসর হন এবং অলম্বুষের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তারা উভয়েই একে অপরকে অসংখ্য তীরে বিদ্ধ করেন। অভিমন্যুর তীরের আঘাতে আহত হয়ে অলম্বুষ ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করে চতুর্দিক ঘন অন্ধকারে ছেয়ে ফেলেন। কিন্তু অভিমন্যু মন্ত্র উচ্চারণ করে সৌরাস্ত্র প্রয়োগ করেন এবং অলম্বুষ কর্তৃক সৃষ্ট অন্ধকার দূরীভূত করেন। এরপর তিনি অলম্বুষের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অলম্বুষ অভিমন্যুর বিরুদ্ধে নানাবিধ ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করেন, কিন্তু অভিমন্যু দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে সেগুলোর সবই প্রতিহত করেন। অলম্বুষের সমস্ত ইন্দ্রজাল অকার্যকর হওয়ার পর তিনি আতঙ্কিত হন এবং তার রথ ত্যাগ করে পশ্চাৎপসরণ করেন।
অলম্বুষকে পরাজিত করার পর অভিমন্যু আবার কৌরব সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালান এবং তার তীরবর্ষণের ফলে বহুসংখ্যক কৌরব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে ভীষ্ম অভিমন্যুর দিকে অগ্রসর হন এবং তার ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। এরপর কৌরব বাহিনীর বহুসংখ্যক শীর্ষ যোদ্ধা অভিমন্যুকে ঘিরে ফেলে তার ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং অভিমন্যু সেগুলো প্রতিহত করতে থাকেন। ইতোমধ্যে অর্জুন তার ছেলেকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং অর্জুনকে সেদিকে ছুটে আসতে দেখে ভীষ্ম তার দিকে অগ্রসর হন। শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা ভীষ্মের সুরক্ষার জন্য তাকে ঘিরে ফেলেন এবং অনুরূপভাবে, শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা অর্জুনের সুরক্ষার জন্য অর্জুনকে ঘিরে ফেলেন। এরপর উভয় পক্ষের শীর্ষ যোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়।
কৃপাচার্যের তীর অর্জুনকে বিদ্ধ করে, কিন্তু সাত্যকি অগ্রসর হয়ে কৃপাচার্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর সাত্যকি কৃপাচার্যকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সাত্যকির তীরটি কাটা পড়ে।
এরপর সাত্যকি কৃপাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সাত্যকির ধনুক কাটা পড়ে এবং এরপর সাত্যকি তীরবিদ্ধ হন, কিন্তু তিনি আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অশ্বত্থামাকে তীরবিদ্ধ করেন এবং সাত্যকির তীরের আঘাতে অশ্বত্থামা কয়েক মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তিনি শীঘ্রই সংজ্ঞা ফিরে পান এবং তার নিক্ষিপ্ত একটি দীর্ঘ তীর সাত্যকির বর্ম ও শরীর ভেদ করে মাটিতে গেঁথে যায়। অশ্বত্থামার তীরের আঘাতে সাত্যকির রথের ঝাণ্ডা কাটা পড়ে এবং অশ্বত্থামা সাত্যকির ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু সাত্যকি তীরের সাহায্যে উক্ত তীরবৃষ্টি প্রতিহত করেন এবং এরপর তার তীরের আঘাতে অশ্বত্থামা ক্ষতবিক্ষত হতে থাকেন।
দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামাকে সহায়তা করার জন্য সাত্যকির বিরুদ্ধে অগ্রসর হন, কিন্তু সাত্যকির তীর তাকে বিদ্ধ করে। এসময় অর্জুন দ্রোণাচার্যের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং দ্রোণাচার্য সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। দ্রোণাচার্য ও অর্জুন উভয়ে একে অপরকে তীরবিদ্ধ করেন।
এসময় দুর্যোধনের নির্দেশে ত্রিগার্তার রাজা সুশর্মা ও তার ছেলে সসৈন্যে অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদের তীর অর্জুনকে বিদ্ধ করে। প্রত্যুত্তরে অর্জুন সুশর্মা ও তার ছেলেকে তীরবিদ্ধ করেন এবং এরপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে সুশর্মা ও তার ছেলে কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরবৃষ্টি প্রতিহত করেন। এরপর অর্জুন মন্ত্র উচ্চারণ করে সুশর্মার সৈন্যদের বিরুদ্ধে বায়ব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই অস্ত্রের প্রভাবে তীব্র বাতাস বয়ে বহুসংখ্যক গাছ উপড়ে ফেলে এবং সেগুলো সুশর্মার সৈন্যদের ওপর আপতিত হওয়ার ফলে তার বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয়। এরপর দ্রোণাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করে শৈলাস্ত্র প্রয়োগ করেন। এই অস্ত্রের প্রভাবে বায়ব্যাস্ত্রের প্রভাব নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং সেটির প্রভাবে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহ বন্ধ হয়ে চতুর্দিক শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু এরপর অর্জুনের তীব্র আক্রমণে ত্রিগার্তার সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে পশ্চাৎপসরণ করে।
এরপর দুর্যোধন, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, কম্বোজের রাজা সুদক্ষিণ, অবন্তীর রাজপুত্র বিন্দ ও অনুবিন্দ এবং বাহ্লিকের রাজা বাহ্লিক সসৈন্যে অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত এবং শ্রুতায়ু একটি হস্তীবাহিনীসহ ভীমের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন। ভুরিশ্রবা, রাজা শাল ও শকুনি নকুল ও সহদেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভীষ্ম ও দুর্যোধনের ভাইয়েরা সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেন।
কৌরব হস্তীবাহিনী দ্বারা বেষ্টিত হয়ে ভীম একটি গদা হাতে নিয়ে তার রথ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং উক্ত হস্তীবাহিনীকে আক্রমণ করেন। উক্ত হস্তীবাহিনীর সিংহভাগ হাতি ভীমের গদার আঘাতে নিহত হয় এবং অবশিষ্ট হাতিগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত ও উন্মত্ত হাতিগুলোর পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে বেশকিছু কৌরব সৈন্য নিহত হয় এবং এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের উক্ত স্থান থেকে কৌরব সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
সেদিন দুপুরে ভীষ্ম ও পাণ্ডবদের মধ্যে এক তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ভীষ্মের তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হয়। এটি দেখে ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, দ্রুপদ ও বিরাট একযোগে ভীষ্মকে আক্রমণ করেন এবং তাকে তীরবিদ্ধ করেন। প্রত্যুত্তরে ভীষ্ম ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রুপদ ও বিরাটকে তীরবিদ্ধ করেন, কিন্তু শিখণ্ডীর ওপর তীর নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন। এভাবে কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলার পর শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারা ভীষ্মের প্রতিপক্ষকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন এবং শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা ভীষ্মকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হন। এরপর উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে একটি প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এদিকে সুশর্মা ও তার ভাইয়েরা তাদের সৈন্যদলসহ অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই অর্জুনের তীরে ত্রিগার্তার বহুসংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং অবশিষ্টরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। সুশর্মা তাদেরকে পশ্চাৎপসরণ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত কেবল সুশর্মা ও তার ভাইয়েরা অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। এমতাবস্থায় তাদেরকে সহায়তা করার জন্য ভীষ্ম ও দুর্যোধনের নেতৃত্বে শীর্ষ কৌরব যোদ্ধারা সসৈন্যে অর্জুনের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। অনুরূপভাবে, শীর্ষ পাণ্ডব যোদ্ধারাও সসৈন্যে অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য সেদিকে অগ্রসর হন এবং উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়।
দ্রোণাচার্য দ্রুপদের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, এবং শীঘ্রই দ্রোণাচার্যের তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে দ্রুপদ সেখান থেকে পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হন। বাহ্লিক ভীমের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু শীঘ্রই ভীমের তীরের আঘাতে বাহ্লিকের রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয় এবং তিনি তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে দুর্যোধনের ছেলে লক্ষ্মণের রথে আরোহণ করেন। দুর্যোধনের ভাই চিত্রসেন অভিমন্যুর বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর অভিমন্যুর তীরের আঘাতে তার রথের সঙ্গে যুক্ত ঘোড়াগুলো ও রথের সারথি নিহত হয় এবং তিনি তার বিকল রথ থেকে লাফিয়ে নেমে তার ভাই দুর্মুখের রথে আরোহণ করেন।
সাত্যকির তীরে কৃতবর্মা বিদ্ধ হন এবং এরপর ভীষ্ম সাত্যকির বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন। একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর ভীষ্ম সাত্যকির দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সাত্যকি ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে তীরটিকে এড়িয়ে যান। এরপর সাত্যকি ভীষ্মের দিকে একটি বিশেষ ধরনের তীর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু ভীষ্মের তীরের আঘাতে সাত্যকির তীরটি কাটা পড়ে। এরপর সাত্যকি ভীষ্মের তীরে বিদ্ধ হন এবং তখন পাণ্ডব সৈন্যরা সাত্যকিকে সহায়তা করার জন্য অগ্রসর হয়ে ভীষ্মকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। এমতাবস্থায় দুর্যোধনের নির্দেশে দুঃশাসনের নেতৃত্বাধীন একটি বৃহৎ সৈন্যদল ভীষ্মের সুরক্ষার জন্য অগ্রসর হয়।
শকুনির নেতৃত্বে কৌরবদের একটি বৃহৎ অশ্বারোহী সৈন্যদল যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে ঘিরে ফেলে, কিন্তু তারা বিপুল পরাক্রমের সঙ্গে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাদের তীর ও তলোয়ারের আঘাতে বিপুল সংখ্যক কৌরব অশ্বারোহী নিহত হয় এবং এরপর উক্ত বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যরা পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। তখন দুর্যোধনের নির্দেশে শল্য একটি বৃহৎ রথী সৈন্যদল নিয়ে যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি একযোগে যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে আক্রমণ করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে।
এরপর ভীষ্ম রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন এবং পাণ্ডব সৈন্যদের বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হন। তার তীরবর্ষণের ফলে বিপুল সংখ্যক পাণ্ডব সৈন্য নিহত হতে থাকে। তার হাতে পাণ্ডব বাহিনীর ১৪,০০০ রথী নিহত হয় এবং বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী, পদাতিক সৈন্য ও হাতি তার তীরের আঘাতে নিহত হয়। তীব্র ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পাণ্ডব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় কৃষ্ণের উৎসাহে অর্জুন ভীষ্মের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তাকে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হতে দেখে পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে মনোবল সঞ্চারিত হয় এবং তারা পশ্চাৎপসরণ বন্ধ করে।
ভীষ্ম অর্জুনের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তার তীরবৃষ্টির ফলে অর্জুনের রথ কার্যত ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু কৃষ্ণ নিপুণভাবে অর্জুনের রথের সঙ্গে যুক্ত তীরবিদ্ধ ঘোড়াগুলোকে পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর অর্জুনের তীরের আঘাতে ভীষ্মের পরপর দুইটি ধনুক কাটা পড়ে, কিন্তু ভীষ্ম আরেকটি ধনুক উঠিয়ে অর্জুনের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। কৃষ্ণ অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে রথ সঞ্চালন করে ভীষ্মের তীরবৃষ্টি এড়িয়ে যান। কিন্তু ভীষ্ম অর্জুনের ওপর তীরবর্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং শীঘ্রই অর্জুন ও কৃষ্ণ উভয়েই ভীষ্মের তীরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান।
কৃষ্ণের কাছে মনে হচ্ছিল যে, অর্জুন তার পূর্ণ শক্তিসামর্থ্য দিয়ে ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন না। এজন্য তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেই অর্জুনের রথ থেকে নেমে বিনা হাতিয়ারে কেবল চাবুক হাতে ভীষ্মের দিকে অগ্রসর হন। ভীষ্ম নতমস্তকে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন যে, তিনি কৃষ্ণের হাতে মৃত্যুকে বরণ করতে প্রস্তুত। এমতাবস্থায় অর্জুন তার রথ থেকে নেমে কৃষ্ণের গতিরোধ করার চেষ্টা করেন এবং বহু চেষ্টার পর তার গতিরোধ করতে সক্ষম হন। এরপর অর্জুন ক্রুদ্ধ কৃষ্ণকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি ভীষ্মকে বধ করবেন এবং তিনি শপথ করছেন যে, সেদিনই তার হাতে ভীষ্মের পতন ঘটবে। কিন্তু কৃষ্ণের ক্রোধ দূরীভূত হয়নি এবং তিনি ক্রোধান্বিত অবস্থাতেই পুনরায় অর্জুনের রথে আরোহণ করে সারথির স্থান গ্রহণ করেন। অর্জুনও রথে চড়ে পুনরায় ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।
কিন্তু অর্জুন সেদিন তার শপথ পূরণ করতে পারেননি। ভীষ্ম পুনরায় তার ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করেন এবং এরপর পাণ্ডব সৈন্যদের ওপর তীরবর্ষণ করতে থাকেন। ভীষ্মের তীরে হাজার হাজার পাণ্ডব সৈন্য নিহত হতে থাকে এবং পাণ্ডব সৈন্যেরা সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যাস্ত হয় এবং নিজের সৈন্যদের পরিস্থিতি দেখে বিচলিত যুধিষ্ঠির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করেন। এরপর কৌরবরাও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। এভাবে পাণ্ডবদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নবম দিনের অবসান ঘটে।
সেদিনের বিজয়ে দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা বিশেষ আনন্দিত ছিলেন এবং তারা ভীষ্মের জয়গান করে বিশ্রামের জন্য নিজ নিজ শিবিরে চলে যান। অন্যদিকে, সেদিনের পরাজয়ে পাণ্ডবরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। শিবিরে প্রত্যাবর্তনের পর তারা একত্রিত হয়ে সলাপরামর্শ করেন। ভীষ্মের রণনৈপুণ্যের বিবরণ দিয়ে যুধিষ্ঠির হতাশার সঙ্গে মন্তব্য করেন যে, তার বিভ্রান্তির কারণে তিনি ভীষ্মের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন এবং তার উচিত সবকিছু ছেড়ে বনবাসে ফিরে যাওয়া। তিনি এটিও উল্লেখ করেন যে, তার দোষেই এই পুরো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে।
কৃষ্ণ তাকে সান্ত্বনা প্রদান করেন এবং মন্তব্য করেন যে, অর্জুন ভীষ্মকে বধ করতে সক্ষম, কিন্তু অর্জুন যদি সেটি করতে না চায়, সেক্ষেত্রে তিনি নিজেই ভীষ্মকে বধ করে পাণ্ডবদের জয়যুক্ত করবেন। প্রত্যুত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন যে, তিনি নিজের স্বার্থের জন্য কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হতে দিতে রাজি নন (কৃষ্ণ এই যুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন)। তিনি যোগ করেন যে, যুদ্ধের আগে ভীষ্ম তাকে বলেছিলেন, তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য, কিন্তু তিনি পাণ্ডবদের সুপরামর্শ দিতে প্রস্তুত। যুধিষ্ঠির মত প্রকাশ করেন যে, এই অবস্থায় তাদের উচিত ভীষ্মের কাছে গিয়েই পরামর্শ চাওয়া। কৃষ্ণ তখন বলেন যে, তাদের উচিত হবে ভীষ্মের কাছে তার মৃত্যুর উপায় জানতে চাওয়া।
এরপর পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণ ভীষ্মের শিবিরে গমন করে তার সঙ্গে দেখা করেন এবং ভীষ্ম তাদেরকে স্বাগত জানান। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে জানতে চান যে, কীভাবে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করা সম্ভব? ভীষ্ম তার উত্তরে জানান যে, যতক্ষণ তার হাতে অস্ত্র আছে ততক্ষণ তাকে বধ করা সম্ভব নয়, কিন্তু শিখণ্ডী তার সামনে এসে দাঁড়ালে তিনি অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন। তিনি পরামর্শ দেন যে, অর্জুন যেন শিখণ্ডীর পিছনে অবস্থান নিয়ে সেখান থেকে ভীষ্মের দিকে তীর নিক্ষেপ করেন। ভীষ্মের এই পরামর্শের পর পঞ্চপাণ্ডব তাকে অভিবাদন জানিয়ে নিজেদের শিবিরে ফিরে আসেন।
অর্জুন এই বিষয়টি নিয়ে দোটানার মধ্যে ছিলেন। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ভীষ্ম তাকেই সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন এবং সেজন্য ভীষ্মকে হত্যা করার ক্ষেত্রে অর্জুনের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে কম। অর্জুন কৃষ্ণকে বলে ওঠেন যে, তার পক্ষে এভাবে ভীষ্মকে হত্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু কৃষ্ণ অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, অর্জুন ভীষ্মকে বধ করার জন্য শপথ করেছেন এবং এই যুদ্ধে বিজয় অর্জনের জন্য ভীষ্মের পতন আবশ্যক। কৃষ্ণের বক্তব্য অর্জুনকে প্রভাবিত করে এবং তিনি শেষ পর্যন্ত শিখণ্ডীর সাহায্যে ভীষ্মকে হত্যা করতে সম্মত হন।