Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ: প্রকৃতি যেখানে বিরোধ নিষ্পত্তিকারক

সীমানা নিয়ে দুটি রাষ্ট্রের বিরোধের ঘটনা বহু পুরনো। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে বিরোধ তো মাঝে মাঝে আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তরেখা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ কিংবা ভারত-চীনের ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ এর বড় উদাহরণ। তবে, বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের সাথে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই সুসম্পর্কের দরুণ সীমানা নিয়ে এত জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেনি। ছিটমহল বিনিময় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে, বঙ্গোপসাগরের মাত্র ২.৫ বর্গ কি.মি আয়তনের দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘ চার দশক ধরে চলে দ্বন্দ্ব। কীভাবে দুই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়েছিল এই দ্বন্দ্বে? আর কীভাবেই বা হয়েছিল এর সমাধান?

দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অবস্থান

ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ২১°৩৭` উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৯°১২` পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট থানা ও সাতক্ষীরার মধ্যবর্তী স্থানে দুই দেশকে পৃথক করেছে হাড়িয়াভাঙ্গা নদী। বিরোধপূর্ণ দ্বীপটি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার কাছেই অবস্থিত হওয়ায় দুই দেশই এর মালিকানা দাবি করে বসে। বাংলাদেশের শ্যামনগর উপজেলার তালপট্টির দক্ষিণে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশ এর নাম দেয় ‘দক্ষিণ তালপট্টি’, আর নতুন জেগে ওঠা দ্বীপ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ এর নাম রাখে ‘The New Moor Island’ বা ‘পূর্বাশা দ্বীপ’।

দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অবস্থান; Image Source: India GK

দ্বীপের জন্ম

১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ভোলায় আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সাইক্লোন ভোলা’। এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সেসময় বাংলাদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে। এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা বাঙালির মনে চরম আক্রোশের সৃষ্টি করে। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন আরো একবার বাঙালির সামনে এসে দাঁড়ায়। এই ‘৭০ এর সাইক্লোনেই বঙ্গোপসাগরে সাতক্ষীরার অদূরবর্তী স্থানে জেগে ওঠে একটি দ্বীপ।

নদী মোহনার খেলায় পড়ে দক্ষিণ তালপট্টি কিংবা পূর্বাশা দ্বীপটি হয়ে দাঁড়ায় দুই দেশের বিবাদের বিষয়; Image Source: Google Earth

 

১৯৭৪ সালে আমেরিকার ভূ-উপগ্রহ ERTS-1 সর্বপ্রথম দ্বীপটির অবস্থান শনাক্ত করে। শনাক্তের পর স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি বিশ্লেষণ করে দ্বীপের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এর পর পরই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বীপটি নিজেদের বলে দাবি করে, এবং নাম রাখে ‘পূর্বাশা’। এরপর বাংলাদেশও দ্বীপটির অবস্থান নিশ্চিত হলে মালিকানা দাবি করে বসে। দুই পক্ষই দাবি করে Thalweg Doctrine অনুসারে দ্বীপটি তাদের সীমানার ভেতরে পড়ে। ঠিক তখন থেকেই বিরোধের শুরু। পরবর্তী অংশ জানার পূর্বে আমাদের তাই Thalweg Doctrine বা Mid Channel Flow Principle সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।

Mid Channel Flow Principle

মিড চ্যানেল ফ্লো প্রিন্সিপাল হলো এমন এক নীতি যার সাহায্যে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী জলসীমান্ত নির্ধারণ করা হয়। নীতি অনুসারে, যদি দুটি দেশের সীমান্ত কোনো নদী দ্বারা পৃথক হয়, তবে নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখা হবে দুই দেশের সীমান্ত রেখা।

Thalweg Principle; Image Source: Wikimedia Commons

বিবাদের কারণ

যেহেতু, সাতক্ষীরা অঞ্চলে বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানা হাড়িয়াভাঙ্গা নদী দ্বারা পৃথক করা হয়েছে সেহেতু মিড চ্যানেল ফ্লো প্রিন্সিপাল অনুসারে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখাকে দুই দেশের সীমানা ধরা হয়। তবে সমস্যার উদ্ভব ঘটে যখন হাড়িয়াভাঙ্গা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর স্রোতধারা কখনও দ্বীপটিকে বাংলাদেশের দিকে রেখে দ্বীপের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, আবার কখনো দ্বীপের পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে, মূল স্রোতধারা নির্ধারণ এই অংশে একটি জটিল পরিস্থিতির উদ্রেক করে। আর দুই পক্ষই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজেদের দাবি করে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো- ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট এমন ছোট্ট একটি দ্বীপ নিয়ে দুই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের বিবাদের কারণটা ঠিক কী? প্রকৃতপক্ষে, ভূ-বিশ্লেষকরা দক্ষিণ তালপট্টির মাটির নিচে বিপুল পরিমাণ গ্যাস, কয়লা ও খনিজ সম্পদের ভান্ডার থাকার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। আর এই বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের ভান্ডারই মূলত দুই দেশের আগ্রহের কারণ ছিল। এছাড়াও, দ্বীপের আকার বেড়ে গেলে তা বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করার বিষয় তো ছিলই।

দ্বীপ নিয়ে বিবাদের মীমাংসার জন্য ১৯৭৯ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ভারতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দ্বীপটি বাংলাদেশের দাবি করে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও স্যাটেলাইট ছবি পেশ করেন। এরপর দুই দেশের পক্ষ যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয় যে এসব তথ্য, উপাত্ত আর স্টাডির উপর ভিত্তি করে আলোচনার মাধ্যমে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ নিয়ে বিবাদের সুষ্ঠু সমাধানে আসবে দুই দেশ। তবে, এসব আলোচনার মধ্যেই ১৯৮১ সালের ১১ মে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে INS Sandyak নামের একটি ভারতীয় নৌজাহাজ পাঠায় এবং সেখানে বিএসএফ (ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী) চৌকি স্থাপন করে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে উড়তে থাকে ভারতের পতাকা। বাংলাদেশ এই ঘটনার দু’দিন পরই, অর্থাৎ ১৩ মে ভারতীয় বাহিনীর এহেন আচরণের প্রেক্ষিতে কোস্টগার্ডের দুটি গানবোট প্রেরণ করে, এবং বিএসএফ-এর চৌকিতে হামলা চালায়। অস্ত্রের যুদ্ধে না জড়িয়ে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং দ্বীপটিকে নো ম্যান’স ল্যান্ড ঘোষণা করে।

দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে ভারতীয় সেনাদের ভলিবল খেলা; Image Source: India Today

এরপর বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা আর পালাবদল দক্ষিণ তালপট্টিকে আলোচনায় আসতে দেয়নি। তবে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাংলাদেশ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সীমানা বিরোধ মীমাংসা আদালতে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপসহ ২৫,০০০ বর্গ কি.মি. এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব দাবি করে মামলা করে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ব্যাপারে একটি ফয়সালার আশায় বুক বাধে দুই দেশই। তবে, এখানেই হাজির হয় এই গল্পের সবচেয়ে বড় খলনায়কের। প্রকৃতি! যে দ্বীপ নিয়ে দুই বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র বিবাদে জড়িয়েছিল তাদের বিবাধ মীমাংসার দায়িত্ব নিজ কাছে তুলে নেয় স্বয়ং প্রকৃতি। ২০১০ সালের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে আসলে দক্ষিণ তালপট্টি বা নিউ ম্যুর আইল্যান্ডের কোনো অস্তিত্ব এখন আর নেই! দ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ আবার সমুদ্রগর্ভেই তলিয়ে গেছে। তাই, বিবদমান দুই পক্ষের যে-ই জয়লাভ করুক, দক্ষিণ তালপট্টি দু’দেশের কাছেই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা যে দ্বীপ ঘিরে বিবাদের শুরু হয়েছিল, প্রকৃতিই সেই বিবাদের নিষ্পত্তি ঘটায়।

পরবর্তীতে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসা আদালত বিরোধপূর্ণ ২৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯,৪৬৭ বর্গ কি.মি. অংশ বাংলাদেশের বলে রায় দেয়। তবে, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ পূর্বে যেখানে ছিল সেই অংশ ভারতের পক্ষে বলে রায় দেয় আদালত। তবে, যেহেতু দ্বীপের অস্তিত্ব আর নেই, তাই সে অংশের সমুদ্রসীমায় ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বর্তমান পৃথিবীর ভয়াবহ সমস্যাগুলোর একটি; Image Source: NASA

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩.৬ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা— ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের ১৭-২০ শতাংশ সাগরতলে চলে যাবে। দক্ষিণ তালপট্টির তলিয়ে যাওয়া যেন সেসবই আবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল। মানুষের খেয়াল যদি পরিমিত না হয় তবে, প্রকৃতির খেয়াল যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে- দক্ষিণ তালপট্টির তলিয়ে যাওয়া সেটাই জানিয়ে গেলো বোধহয়।

Related Articles