হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ আটলান্টিসের গল্প আমরা অনেকেই শুনেছি। গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ভাষ্যে প্রথম আটলান্টিস নামক একটি দ্বীপ মহাদেশের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছিল। প্লেটোর বিবরণ অনুযায়ী, আটলান্টিসের নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু ‘দেবতাদের অনুগ্রহ হারিয়ে ফেলায়’ দ্বীপ মহাদেশটি সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়েছিল। যদিও অধিকাংশ বিশ্লেষক ‘আটলান্টিস’কে নিছক কল্পকাহিনীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন, তবুও যুগে যুগে এই ‘হারানো মহাদেশ’টি মানুষের কল্পনাকে আকৃষ্ট করে এসেছে। কেউ কেউ তো আটলান্টিসের অবস্থানও নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। মিসরের আশপাশের অঞ্চল থেকে উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত তারা আটলান্টিসকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। কিন্তু বরাবরই আটলান্টিস কৌতূহলীদের জন্য মরীচিকা প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু এই কল্পিত আটলান্টিসের বিপরীতে একটি বাস্তবিক আটলান্টিস রয়েছে, যেটির গল্প অনেকটাই কল্পিত আটলান্টিসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই আটলান্টিসও একসময় সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এর সলিল সমাধি ঘটে। অবশ্য, এই আটলান্টিসের সলিলসমাধি ঘটার পেছনে দেবতাদের কোনো হাত ছিল না, এর জন্য দায়ী ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাণী, অর্থাৎ মানুষ!
এই ‘আটলান্টিস’টির অবস্থান বর্তমান রুশ ফেডারেশনের রাজধানী মস্কো শহর থেকে উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত ইয়ারোস্লাভল প্রদেশে। এই রুশ আটলান্টসটির নাম ছিল ‘মলোগা’ (Моло́га)। মলোগা ছিল রাশিয়ার একটি প্রাচীন শহর, এবং ভোলগা ও মলোগা নদীদ্বয়ের সঙ্গমস্থলে শহরটি অবস্থিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই শহরটির অস্তিত্ব ছিল, কারণ ১১৪৯ সালের রুশ ধারাবিবরণীগুলোতে শহরটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এসময় রাশিয়া তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল, এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মলোগা শহরটি রোস্তভ রাষ্ট্রটির অংশ ছিল। পরবর্তীতে ইয়ারোস্লাভল রাষ্ট্রটি মলোগা শহর দখল করে নেয়। ১৩২১ সালে মলোগা নিজেই একটি স্বাধীন রুশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী রুশ রাষ্ট্র মাস্কোভি মলোগাকে দখল করে নেয়।
চতুর্দশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিক পর্যন্ত মলোগা ছিল রাশিয়ার একটি অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এসময় রাশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম একটি বাণিজ্য মেলা মলোগায় অনুষ্ঠিত হত এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের বণিকরা এই মেলায় অংশ নিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে মলোগা শহরটি রাশিয়া ও এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসময় মলোগার প্রতিরক্ষার জন্য একটি দুর্গও নির্মিত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাশিয়ায় যে সামাজিক–রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, সেসময় মলোগা একটি বাণিজ্যিক ‘স্লোবোদা’ বা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৭৭৭ সালে রুশ সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় একাতেরিনা (‘ক্যাথেরিন দ্য গ্রেট’) মলোগাকে প্রশাসনিকভাবে একটি ‘জেলা সদরে’ রূপান্তরিত করেন। এসময় ভোলগা বাণিজ্যপথ এবং রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রবৃদ্ধির ফলে মলোগা শহরটিরও ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। মলোগা ভোলগা নদীর তীরবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে পরিণত হয়। প্রতি বছর শত শত নৌযান মলোগা হয়ে যাতায়াত করত এবং এই নৌযানগুলো মলোগা থেকে মালামাল সংগ্রহ করত ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা লাভ করত।
মলোগা শহরটি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পাশাপাশি এর মধ্যযুগীয় ও ধ্রুপদী স্থাপত্যশিল্পের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত সেইন্ট আথানাসিয়াস কনভেন্ট ছিল শহরটিতে অবস্থিত দালানগুলোর মধ্যে অন্যতম, এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কনভেন্টটিতে ৪টি গির্জা ছিল। ১৮৮২ সালে রুশ বাইজান্টাইন রীতিতে নির্মিত এপিফানি ক্যাথেড্রালও শহরটির অন্যতম একটি আকর্ষণ ছিল। শহরটিতে অবস্থিত পাথরের তৈরি অগ্নিনির্বাপণ কেন্দ্র এবং এর সংলগ্ন ওয়াচটাওয়ারও শহরটির অধিবাসীদের কাছে গর্বের বস্তু ছিল। এর স্থপতি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ফিয়োদোর দস্তয়ভস্কির ভাই আন্দ্রেই দস্তয়ভস্কি।
১৮৮১ সালে মলোগার নিকটবর্তী একটি মঠের কর্ত্রী মাদার সুপিরিয়র তাইসিয়া স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পান, তিনি একটি রাইয়ের ক্ষেতে হেঁটে যাচ্ছেন, যেটি ক্রমশ পানিতে ডুবে যাচ্ছে। তিনি পানির মধ্যে হাঁটতে থাকেন এবং ক্রমশ পানি তার গলা পর্যন্ত উঁচু হয়ে যায়। এ সময় কেউ একজন পানির ওপর থেকে তাকে একটি বস্তু প্রদান করে, যেটির ওপর ভর করে তিনি পানির ওপরে ওঠার চেষ্টা করেন। এ সময় পানি আবার কমে যেতে শুরু করে এবং মঠের সাদা পাথুরে দেয়াল পানির মধ্য থেকে উঠতে শুরু করে!
মাদার তাইসিয়া তার এই অদ্ভুত স্বপ্নটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন, কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই তাদের প্রিয় শহরটির সত্যি সত্যি সলিল সমাধি ঘটবে!
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ফলে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকরা রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠত হয়, এবং ১৯২২ সালে রুশ সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপরে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকে পরিণত হন। স্তালিনের নেতৃত্বে শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক হারে শিল্পায়ন শুরু হয়। ১৯৩০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের শিল্পপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়। আর এই শিল্পায়নেরই একটি বলিতে পরিণত হয় মলোগা শহর।
১৯৩৫ সালে ইয়ারোস্লাভল প্রদেশে বৃহদাকৃতির রিবিনস্ক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও রিবিনস্ক জলাধার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রিবিনস্ক শহরটি মলোগার সন্নিকটে অবস্থিত। এই প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্য মনে করা হয়েছিল, মলোগা শহরটিকে ডুবিয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, এবং রিবিনস্ক জলাধার নির্মাণের পর মলোগা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে পরিণত হবে। কিন্তু রিবিনস্কে বাঁধ নির্মাণকালে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে জলাধারটির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯৮ মিটারের পরিবর্তে ১০২ মিটার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর ফলে জলাধারটির আয়তন প্রাথমিক পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বড় হয় এবং এজন্য মলোগা শহরটি ডুবিয়ে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেসময় রিবিনস্ক জলাধার ছিল বিশ্বের বৃহত্তম মানবনির্মিত জলাধার।
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ এজন্য মলোগা শহর ও এর আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। এদের মধ্যে যাদের বাড়িঘর কাঠের ছিল তারা সেগুলোকে খুলে ফেলে এবং জাহাজে করে স্থানান্তর করে। আর যাদের পাথরের তৈরি বাড়িঘর ছিল তাদেরকে সোভিয়েত সরকার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। মলোগার এই ‘উন্নয়ন শরণার্থী’দেরকে ইয়ারোস্লাভল প্রদেশের অন্যান্য স্থানে, পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলোতে এবং মস্কো ও লেনিনগ্রাদে পুনর্বাসন করা হয়। ১৯৪১ সালের মধ্যে শহরটি ফাঁকা করার পর মলোগার বড় বড় সমস্ত দালানকোঠা, শিল্পকারখানা, গির্জা ও অন্যান্য ভবন বিস্ফোরক ব্যবহার করে উড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর শহরটিকে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনকেভিডি’র একটি গোপন প্রতিবেদন অনুযায়ী, মলোগার অধিবাসীদের মধ্যে কেউ কেউ শহরটি ত্যাগ করার নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। শহরটির ২৯৪ জন অধিবাসী নিজ নিজ বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিভিন্ন ভারী বস্তুর সঙ্গে নিজেদের শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তবে ধরে নেয়া হয়, মলোগার সঙ্গে সঙ্গে মলোগার এই হতভাগ্য অধিবাসীদেরও সলিল সমাধি ঘটে। ২০০৩ সালে মলোগার এই অধিবাসীদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
মলোগা শহরটি পুরোপুরি জলমগ্ন হলেও মাঝে মাঝে রিবিনস্ক জলাধারের উচ্চতা হ্রাস পায় এবং সেসময় মলোগা শহরটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে প্রথম মলোগার ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৯২ সালে রিবিনস্ক জলাধারের উচ্চতা দেড় মিটার কমে যায় এবং এর ফলে ইতিহাসবিদরা মলোগাতে একটি অভিযাত্রী দল প্রেরণ করতে সক্ষম হন। এই অভিযাত্রী দল কর্তৃক মলোগা থেকে সংগৃহীত সামগ্রী দিয়ে ‘মলোগা জাদুঘর’ নির্মাণ করা হয়েছে এবং একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে জলাধারটির উচ্চতা আবার হ্রাস পাওয়ার কারণে মলোগাকে আবার সাময়িকভাবে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
বর্তমানে মলোগা শহরটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সোভিয়েতরা যা ধ্বংস করেনি, এতদিন পানির নিচে থাকার ফলে তা-ও বিনষ্ট হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এখনও মলোগার প্রাক্তন অধিবাসীরা বা তাদের বংশধররা শহরটিকে দেখার জন্য প্রতি বছর রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে। তাদের অনেকের বিশ্বাস, মাদার তাইসিয়ার স্বপ্নের প্রথম অংশের মতো শেষ অংশও সত্যি হবে, অর্থাৎ মলোগা শহরটি কোনো একদিন আবার বাসযোগ্য হয়ে উঠবে! প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল ইয়ারোস্লাভল প্রদেশে মলোগার সলিলসমাধির স্মরণে ‘মলোগা দিবস’ উদযাপন করা হয়।
মলোগার সলিলসমাধি স্তালিনীয় শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের একটি নমুনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকের মতে, মলোগার ট্র্যাজেডি রাশিয়াকে এর চেয়ে আরো অনেক বড় ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা করেছে। মলোগাকে জলমগ্ন করে সৃষ্ট রিবিনস্ক জলাধারই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সঙ্কটময় সময়ে মস্কোকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করত। ‘রিবিনস্ক সাগর’ নামে পরিচিত এই সুবৃহৎ জলাধারটি বর্তমানে মৎস্যশিল্প, বিনোদন ও পর্যটনের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষত নিকটবর্তী অঞ্চলে যেসব মানুষের রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলে বেড়াতে যাবার সামর্থ্য নেই, রিবিনস্ক ‘সাগর’ তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। তদুপরি, ‘রুশ আটলান্টিস’ মলোগাও কৌতূহলী অনেক পর্যটককে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে।