মনে হয় না দুনিয়ার কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিই বুঝতে পারে সে কখন আসক্তির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। প্রথমে সবারই মনে হয় যে সে শখের বশেই এসব ব্যবহার করছে, চাইলেই ছেড়ে দিতে পারবে। ইচ্ছাশক্তির তো আর কমতি নেই তার। কিন্তু তারা ভুলে যায়- এটি একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। প্রথমে ব্যক্তি মাদক গ্রহণ করে, আর পরে মাদক ব্যক্তিকে গ্রহণ করে।
১৯৯১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রাশ মুভির গল্প আবর্তিত হয় দুজন আন্ডারকাভার নার্কোটিকস এজেন্টকে ঘিরে। তারা নিজেদের কাজের জন্য কেনা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে এবং অবৈধভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে শুরু করে।
একদম শুরুতে আমরা দেখতে পাই গ্রেগ অলম্যান অভিনীত উইল গেইন্স চরিত্রকে। সে বীরদর্পে হেঁটে চলেছে বারের মধ্যে, চলনে-বলনে ঠিকরে পড়ছে শৌর্যবীর্য এবং ভাবগাম্ভীর্য। আশপাশের মানুষের আচরণে বোঝা যায় তার প্রতাপ। সবার মনোযোগ তার প্রতি, এবং এমনিতে স্বল্পভাষী গেইন্স কিছু বললে সাথে সাথে তার জবাব দিচ্ছে। ওপেনিং সিকোয়েন্সের শেষে এই গেইন্স তার যাবতীয় কুলনেস নিয়ে বার থেকে বের হয় এবং নিজের গাড়িতে উঠে চলে যায়। সংগীতশিল্পী হিসেবে সাফল্য পাওয়া গ্রেগ অলম্যান এই সিনেমার মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো ক্যামেরা সামনে দাঁড়ান। প্রথম চলচ্চিত্র বলেই হয়তো পরিচালক খুব একটা ডায়লগ দেননি তাকে। তবে তার চরিত্রের বাকি সবদিকের উপস্থাপনে তিনি পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
পরবর্তী সিকোয়েন্সে আমরা একটি পুলিশ স্টেশন দেখতে পাই। যেখানে আন্ডারকাভার নার্কোটিকস এজেন্ট জিম রেনর (জেসন প্যাট্রিক) যান তার বস ক্যাটার্লি কাউন্টির পুলিশ ক্যাপ্টেন ডডের (স্যাম এলিয়ট) কাছে। সেখানে তাদের টুকটাক কথাবার্তা হয়। পরে ডড তাকে নিয়ে যান তাদের নতুন কিছু রিক্রুটকে দেখাতে। এই রিক্রুটদের মাঝ থেকে জিম কোনো ছেলেকে নিজের সাথে আন্ডারকাভার হিসেবে কাজ করার জন্য বেছে নেবে, এটাই ছিল ডডের ধারণা। এমনকি রিক্রুটদের মধ্যে অনুষ্ঠিত দৌড় প্রতিযোগিতায় কে জিতবে সেটা নিয়ে তারা বাজিও ধরে। কিন্তু দেখা যায়, ছেলেদের হারিয়ে নারী এক রিক্রুট জিতে যায়, আর জিমের বাজি ছিল তার পক্ষেই।
এই নারী রিক্রুটকে বেছে নেওয়ার পর যে পরিস্থিতির অবতারণা হয়, তাতে নারী সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের হীনম্মন্যতার পরিচয় ফুটে ওঠে। এই হীনম্মন্যতা পুরো চলচ্চিত্রজুড়েই দেখা যায়। কিন্তু রক লেজেন্ড জিম মরিসনের মতো বেশধারী রেনরের মাঝে এসব ভাবনা নেই। সে নিজেকে ড্রাগ ওয়ার্ল্ডের সর্বেসর্বা মনে করে। এই ঝানু, অভিজ্ঞতায় পোক্ত এজেন্ট জানে কীভাবে বড় বড় ড্রাগ ডিলারদের ধোঁকা দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয়। সে নিজেও আসলে ডিলারদের উপস্থিতিতে মাদক ব্যবহার করে, যেন সে যে পুলিশের সদস্য এ ব্যাপারে তাদের সন্দেহ না হয়। তার কাছে আন্ডারকাভারের কাজ খেলার মতো।
নতুন রিক্রুট ক্রিস্টেন কেটসকে (জেনিফার জেসন লী) আন্ডারকাভারের কাজে তালিম দেওয়ার সময় সে বলে, ক্রিস্টেনকেও হয়তো মাদক গ্রহণ করতে হবে, কারণ এসব ডিলারদের সন্দেহ হলে বা তাদের হাতে ধরা পড়লে মৃত্যু সুনিশ্চিত। সাথে সাথে সে তাকে অভয়ও দেয়। বলে, ক্রিস্টেন হয়তো আসক্ত হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু সহজেই কয়েকদিনের মাঝে এই নেশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর উদ্দেশ্যে সফল হতে পারলে ড্রাগ নিলেও ক্ষতি কী! রেনর নিজেই তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। রেনরের ব্যবহার, অতীত রেকর্ড আর আত্মবিশ্বাস দেখে ক্রিস্টেন তাকে বিশ্বাস করে। তার দেখানো পথেই কাজ করতে শুরু করে।
এবার চলুন একটু সোর্স ম্যাটেরিয়ালের ব্যাপারে জেনে নিই। জনরার দিক থেকে রাশ পড়বে ক্রাইম ড্রামার ক্যাটাগরিতে। এটি পরিচালনা করেছেন লিলি ফিনি জ্যানুক। এবং কিম ওজেনক্র্যাফটের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখেছেন পিট ডেক্সটার। ওজেনক্র্যাফট উপন্যাসটিকে সাজিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। তিনি নিজেও ছিলেন পুলিশের সদস্য, যুক্ত ছিলেন ১৯৭৮-৭৯ সালে টেক্সাসের টাইলার এবং স্মিথ কাউন্টিতে সংঘটিত ড্রাগ স্ক্যান্ডালে। কিম এবং তার পার্টনারের রিপোর্টের ফলে ২০০টি কেস ক্লোজ করা হয় এবং ৭০ জনকে আটক করা হয়। পরে এসব রিপোর্ট নিয়েই ঘটে যায় তুলকালাম কাণ্ড!
সিনেমায় আমরা ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলী দেখি। যেগুলো সংঘটিত হয় টেক্সাসের ক্যাটার্লি কাউন্টিতে। মূল উপন্যাসের কিম ওজেনক্র্যাফট এবং তার পার্টনারের চরিত্রে জিম রেনর এবং ক্রিস্টেন কেটসকে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। রাশের সফলতা এবং দর্শককে প্রভাবিত করতে পারার জন্য প্রয়োজন ছিল মূল চরিত্রগুলোর শক্তিশালী পারফরম্যান্সের। যা এসেছে জেসন প্যাট্রিক এবং জেনিফার জেসন লীর কাছ থেকে। লীর কথা বিশেষ করে বলতে হয়। এখানে তার পারফরম্যান্স দর্শকের মাঝে মুগ্ধতা ছড়ায়। কিছুদিন আগেও একজন সাধারণ নাগরিক থেকে পুলিশের সদস্য হয়ে সিস্টেমকে বদলে দিতে চাওয়ার সারল্য থেকে অল্প সময়েই পরিপক্ব হওয়ার তার যে ক্যারেক্টার আর্ক, তা প্রস্ফুটিত করতে তিনি ছিলেন অসাধারণ। যে সময়ে এই সিনেমাটি নির্মিত হয়, তখন লী স্লিজি টাইপের সিনেমার কদর্য চরিত্রসমূহে পরিচিত মুখ। সেখান থেকে সেরা তরুণ অভিনেত্রীদের একজনে পরিণত তিনি। আর এই সাফল্য ধরা দেয় তার সাহসিকতার কারণে। তিনি তখন এমন সব চরিত্রে অভিনয় করছিলেন যেগুলো নিয়ে তার সমসাময়িকরা ভাবতেনও না। রাশ-এর ক্রিস্টেন এমনই একটি চরিত্রের উদাহরণ।
প্রথমদিকে কুল, স্টাইলিশ, সবকিছু যার নখদর্পণে আছে এমন চরিত্র এবং পরবর্তীতে অন্ধকারের দিকে ধাবিত হওয়া জিম রেনরের চরিত্রে জেসন প্যাট্রিকও ছিলেন অসাধারণ। নিজেদের ভালো গুণাবলি বহু আগেই বিস্মৃত হয়েছে এমন ড্রাগ ডিলারদের কালো জগতে রেনর আর ক্রিস্টেনের রসায়ন জমে যায়। তাদের কাঁধে ভর দিয়েই গল্প এগিয়ে যায়।
এটাই পরিচালক হিসেবে লিলি ফিনি জ্যানুকের প্রথম কাজ। কিন্তু সিনেমা দেখতে গিয়ে সেটা মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে অভিজ্ঞ কারো কাজ দেখানো হচ্ছে পর্দায়। সত্তরের দশকে আবহ মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে সিনেমায়। তার কাজের মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে তখন, যখন আমরা দেখি রেনর আর ক্রিস্টেনের মতো শক্তিশালী চরিত্রের আড়ালে সাপোর্টিং ক্যারেক্টারগুলো হারিয়ে যায়নি। অলম্যান অভিনীত গেইনসের কথা তো প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। স্ক্রিনটাইম অল্প হলেও তাতেও যে মুগ্ধতা ছড়ানো যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ স্যাম এলিয়টের ডড চরিত্রটি। পুলিশ ক্যাপ্টেনের রাশভারী আচরণের আড়ালে তিনি যে তার তরুণ সহকর্মীদের নিয়ে আসলেই ভাবেন, সেটি ফুটে উঠেছে তার অভিব্যক্তিতে।
তবে সাপোর্টিং ক্যারেক্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ম্যাক্স পের্লিচের করা ওয়াকার চরিত্রটি। নির্ঝঞ্ঝাট, বন্ধুবৎসল, আমুদে মনোভাবের ওয়াকার একসময় পড়ে দোটানায়। আমরা দেখি নিজে ফাঁদে পড়লেও সে তার বন্ধুদের বিপদে ফেলতে চায় না। আবার এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও সে খুঁজে পায় না। একই চরিত্রের পরস্পর বিপরীতমুখী এই ভাবের প্রকাশে পের্লিচ ছিলেন অনন্য। আর এই কারণে সিনেমা দেখা শেষেও দর্শকের মনে থাকবে ওয়াকারের কথা।
সত্তরের দশকের ড্রাগ কালচার নিয়ে নানা বর্ণিল চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি। রাশ-এর মাধ্যমে লিলি হাঁটলেন ভিন্ন পথে। তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তখন ড্রাগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটি কেমন ছিল। কেমন ছিল এখানকার সদস্যদের জীবনপ্রণালী, জেন্ডার ডায়নামিক্স, কতটা ঝুঁকি তাদের নিতে হতো, উপর মহলের আদেশের ফলে কী অবস্থা হতো অধঃস্তনদের। ক্রিস্টেনকে দুবার ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখা যায়। ঐ দুটি সিকোয়েন্সই মাদকের দুনিয়া কতটা ভয়াবহ, সেটি প্রমাণ করতে যথেষ্ট। আর নারীরা কর্মক্ষেত্রে কেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তা তো তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারেন।
শেষের দিকের একটা দৃশ্যে আমরা কম্পমান রেনরকে দেখি একটি শটগান হাতে বসে থাকতে। তখনকার দুর্বল অবস্থার সাথে শুরুর দিকের রেনরকে মেলানো যায় না। মাঝে কী ঘটলো, কেনই বা তাকে পালাতে হচ্ছে? এসব জানতে দেখতে হবে রাশ।
সিনেম্যাটোগ্রাফার কেনেথ ম্যাকমিলানের একের পর এক লং শট সম্বলিত ১২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমাকে স্লো-বার্নই বলা চলে। গল্পের এগোনোর গতি ধীর। তবে এই ধীরগতিকে পুষিয়ে দিয়েছে কুশীলবদের অভিনয় এবং গল্পের বিষয়। প্যাট্রিক আর লীর অনবদ্য অভিনয় দর্শকের সামনে তুলে আনে মাদকাসক্তির মর্মন্তুদ দিকগুলো। আমরা দেখি এটি কীভাবে আসক্ত ব্যক্তির দৈহিক ও মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কীভাবে লোপ পায় তাদের স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি। তাই এই সিনেমা দেখতে হলে প্রয়োজন ধৈর্য্যের। তবে দর্শকের কষ্টকে লাঘব করতে আছে এরিক ক্ল্যাপটনের সংগীতায়োজন। এখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে শোনা গেছে ‘টিয়ার্স ইন হ্যাভেন’ এবং ‘অল অ্যালং দ্য ওয়াচটাওয়ার’-এর জিমি হেনড্রিক্সের ভার্সন। এগুলোর সময়োপযোগী ব্যবহার গল্পের ঘটনাবলীকে করেছে আরো শক্তিশালী এবং ইফেক্টিভ।
তাই সময় এবং ধৈর্য্য নিয়ে বসে যেতে পারেন এই সিনেমা দেখতে।