আব্রাহামিক ধর্মগুলোর বিশাল এক অংশজুড়ে রয়েছে প্রাচীন মিশরের ফেরাউন ও মুসা (আ)-এর কাহিনি। কুরআন এবং বাইবেলে তা বর্ণিত থাকায়, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুসলিমদের প্রায় সকলেই এই কাহিনি সম্পর্কে অবগত। ১৯৫৬ সালের ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’ থেকে আধুনিককালের ‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’- অনেকবারই বিখ্যাত সেই উপাখ্যানকে সেলুলয়েডের ফিতায় বুনতে চেয়েছেন বিভিন্ন নির্মাতাগণ। খ্যাতনামা পরিচালক রিডলি স্কট ‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’ সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়ে পুড়িয়েছেন বহু কাঠ-খড়। এই সিনেমা তৈরির পিছনে রয়ে গেছে বহু অজানা জিনিস। এক্সোডাসের জানা-অজানা নানা বিষয় নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
ফাইনাল কাট
‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’ সিনেমার থিয়েটার কাটের রানটাইম ছিল প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো। কিন্তু পরিচালক রিডলি স্কট ‘অ্যাক্সেস হলিউড’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই ফিল্মের ফাইনাল কাটের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৪ ঘণ্টা। প্রোডাকশন হাউজ ছুরি-কাঁচি চালিয়ে সেটাকে আড়াই ঘণ্টার এক থিয়েটার কাটে পরিমার্জন করে। এক্সটেন্ডেড কাটে ১৫-২০ মিনিট অতিরিক্ত যোগ করা হয়েছে। স্কট এটাও জানান, সুযোগ পেলে তিনি ব্লু-রে ডিস্কে ৪ ঘণ্টার এই ফাইনাল কাট রিলিজ দিবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই ফাইনাল কাট রিলিজে কোনো সম্ভাবনা দেখেনি।
পারফেকশনিস্ট বেল
প্রফেট (মসিহ) মোসেসের চরিত্রে অভিনয় করা ক্রিশ্চিয়ান বেল নিঃসন্দেহে হলিউডের সেরা অভিনেতাদের একজন। শক্তিমান এই অভিনেতাকে পরিচালক ড্যারেন অ্যারোনোফস্কি ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নোয়াহ’ সিনেমার প্রধান চরিত্রে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিডিউল জটিলতায় নোয়াহ সিনেমা ছেড়ে দিতে হয় বেলকে। পরবর্তীতে বেলের জায়গায় কাস্ট করা হয় রাসেল ক্রোকে। বেল আবার তখন ‘আমেরিকান হোস্টেল’ (২০১৩) সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
এই মুভিতে তার ওজনও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু তিলে তিলে কষ্ট ভোগ করা মসিহের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হলে যে শরীরের ওজন অনেকখানি কমিয়ে নিজেকে রোগা-পাতলা হিসেবে দেখাতে! কিন্তু নামটা ক্রিশ্চিয়ান বেল। সহসা নিজের শরীর গড়তে-ভাঙতে তিনি এককাঠি সরেস। তাই, সাথে সাথেই এক্সোডাস সিনেমার চাহিদানুসারে নিজের শারীরিক ওজনকে খাপ খাইয়ে নিলেন। প্রফেটের চরিত্রকে আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি বাইবেল, কুরআন, লুইস গিঞ্জবার্গের ক্লাসিক ‘লিজেন্ডস অব দ্য জস’, জোনাথন কির্শের ‘মোসেস, অ্যা লাইফ’ ইত্যাদি পড়ে সময় কাটিয়েছেন। অস্কার আইজ্যাক এবং জাভিয়ার বারডেমকে দ্বিতীয় রামসেসের চরিত্রের জন্য বাছা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সে চরিত্রে সুযোগ পান জোয়েল এডগারটন।
গ্রেট স্ফিংক্স
সিনেমার এক অংশে প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা ভাস্কর্য গিজার গ্রেট স্ফিংক্স দেখানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রফেট মোসেসের জন্মের প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে।
টাইটেল বিভ্রান্তি
প্রথমদিকে এই সিনেমার টাইটেল রাখার কথা ছিল শুধু ‘Exodus’। কিন্তু পরবর্তীতে নামের সাথে ‘Gods and Kings’ সাবটাইটেল জুড়ে দিতে হয়। কারণ, ‘Exodus’ নামে আরও একটি সিনেমা ১৯৬০ সালে মুক্তি পেয়েছিল প্রোডাকশন হাউজ MGM এর অধীনে। তাই ’20th Century-Fox’ এর কাছে এই নামের কপিরাইট না থাকায়, তারা শেষে সাবটাইটেল জুড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
সিনেমা নিষিদ্ধ
এই সিনেমাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ফেরাউনের ভূমি খ্যাত মিশর এবং মুসলিম দেশ মরক্কোতে। মিশরের সংস্কৃতি মন্ত্রীর দাবি,
এই সিনেমা মিশরের ইতিহাসকে বিকৃত করার পাশাপাশি ইহুদিদের বর্ণবাদকে ফুটিয়ে তুলেছে। পুরো সিনেমাজুড়ে আন্তর্জাতিক জায়োনিস্টদের প্রভাব বিস্তার করে আছে। সিনেমায় দেখানো হয়েছে নিষ্ঠুর ফারাওরা ইহুদি দাসদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করছে। অথচ, প্রাচীন মিশরে এই ফাঁসির ব্যবস্থা চালু ছিল কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এখানে ইহুদিদের প্রদর্শিত করা হয়েছে দুর্বল ও নিপীড়িত হিসেবে।
এই সিনেমা রিভিউয়ের জন্য মিশরীয়রা দুটো কমিটি বানিয়েছিল। একটিতে ছিল সেন্সর বোর্ড, অন্যটিতে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। ‘প্রাচীন মিশরের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে’ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমনটা দাবি করার পর এই সিনেমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সেন্সরবোর্ড।
অন্য সিনেমার অনুপ্রেরণা
সিনেমায় দ্বিতীয় রামসেসকে যখন সর্বশেষ মড়কের মুখোমুখি হতে দেখা যায়, তখনের দৃশ্যে যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছিল, তা মূলত প্রফেট মোসেসের আরেক সিনেমা ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’ (১৯৫৬) থেকে নেওয়া। ওই সিনেমায় মিউজিক দিয়েছিলেন সুরকার এলমার বার্নস্টেইন।
দেবদূত মালাক
সিনেমায় প্রফেট মোসেসকে যে ছোট এক ছেলের সাথে কথা বলতে দেখা যায়, তিনি ছিলেন মূলত একজন দেবদূত। অনেকে তাকে ঈশ্বর ভেবে ভুল করেন। সিনেমায় তাকে ‘মালাক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, হিব্রু ভাষায় যার অর্থ হলো বার্তাবাহক।
মরুর দৃশ্য
এই সিনেমার কিছু দৃশ্য স্পেনে অন্তর্গত আলমেরিয়ার তাবারনাস মরুভূমিতে ধারণ করা হয়েছে। এই মরুভূমিতে ক্লিওপেট্রা (১৯৬৩), কিংস অব কিংস (১৯৬১), লরেন্স অব অ্যারাবিয়া (১৯৬২), ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেডের মতো ইতিহাসখ্যাত সিনেমার শুটিংও করা হয়েছিল।
ইহুদিদের বাছুর পূজা
বুক অব এক্সোডাস অনুসারে, প্রফেট মোসেস যখন সিনাই পর্বতে ৪০ দিন, ৪০ রাত অতিক্রান্ত করে ঈশ্বরের আদেশ আনতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর অনুসারীরা স্বর্ণনির্মিত এক বাছুরের পূজায় লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রফেট মোসেস সিনাই পর্বত থেকে ফিরে এসেছিলেন তাকে পাথরের এক ফলক নিয়ে, যাতে খচিত আছে ঈশ্বরের দশ আদেশ (দ্য টেন কমান্ডমেন্টস)। ফিরে এসে মূর্তিপূজার দৃশ্য দেখার পর প্রচণ্ড ক্ষোভে আদেশ-খচিত সেই পাথরের ট্যাবলেট ভেঙে ফেলেছিলেন তিনি, দিয়েছিলেন বাছুর পূজারিদের হত্যার আদেশ। কিন্তু ‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’ সিনেমায় দেখানো হয়েছে, দেবদূত মালাক যখন সিনাই পর্বতের চূড়া থেকে মোসেসের অনুসারীদের মূর্তিপূজা লিপ্ত হতে দেখলেন, তখন তিনি নীরবে প্রফেট মোসেস থেকে দূরে সরে গেলেন। এই কাহিনির ব্যাখ্যা থিয়েটার কাটে পরবর্তীতে আর খোলাসা করা হয়নি।
বর্ণবাদী মনোভাব
মূল চরিত্রগুলোতে আফ্রিকান বা ইহুদি বংশোদ্ভূত অভিনেতাদের না নিয়ে বেছে নেওয়া হয়েছে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের। অপরদিকে দাস, ভৃত্য, চোর-ডাকাতদের চরিত্রে বাছাই করা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের। চিতার আগুন আরও উস্কে দেওয়ার জন্য রিডলি স্কট বলেছিলেন, মূল চরিত্র শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা ছাড়া এই সিনেমা আর্থিকভাবে সফলতার মুখ দেখবে না। যা সুস্পষ্টভাবে তার বর্ণবাদী আচরণ ফুটিয়ে তুলেছে। শ্বেতাঙ্গ অভিনেতার আধিক্য থাকায়ও একে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কারণ, মিশর আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ। তবে, প্রাচীন মিশরীয়দের সাথে বর্তমানকালের সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকানদের কোনো নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য ছিল না। সাম্প্রতিক ডিএনএ রিপোর্ট অনুসারে, প্রাচীন মিশরীয়রা জিনগতভাবে সেমিটিক, তুর্কি, এবং ইউরোপীয়দের সাথে সম্পৃক্ত।
মোলাকাত
এই সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক রিডলি স্কট এবং চিত্রনাট্যকার স্টিভেন জাইলিয়ানের তৃতীয়বার মোলাকাত হয়েছে। তাদের এর আগের দুটো কাজ ছিল ‘হানিবল’ (২০০১), ও ‘আমেরিকান গ্যাংস্টার’ (২০০৭)। এছাড়াও এই মুভি দিয়ে সিগর্নি ওয়েভারের সাথেও তৃতীয়বার জুটি বাধেন পরিচালক। প্রথমে ‘এলিয়েন’ (১৯৭৯), এরপর ‘১৯৪২: কনকোয়েস্ট অব প্যারাডাইজ’ (১৯৯২), এবং সবশেষে এক্সোডাস।
সুপার সিক্স
এই সিনেমায় অভিনয় করা শুধুমাত্র ছ’জন অভিনেতা ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত। এর মধ্যে মেন্ডেলসন ও টরটরো ছিলেন আশকেনাজি ইহুদি, ফারাহানি ছিলেন ইরানীয়, বেন কিংসলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ঘাসান মাসুদ সিরীয়, এবং ইন্দিরা ভার্মা ভারতীয়।
ত্রাণকর্তা কিংসলে
এই মুভির মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো ইহুদিদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন ইংরেজ অভিনেতা বেন কিংসলে। প্রথমবার ‘শিনডার্স লিস্ট’ (১৯৯৩), দ্বিতীয়বার ‘মোসেস’ (১৯৯৫), শেষবার ‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’ (২০১৪) মুভিতে।
ভিএফএক্স
এই সিনেমার অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল প্রাচীন মিশরকে রূপালি পর্দায় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলা। প্রায় ১,৪০০ ভিজুয়াল ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে সিনেমাজুড়ে। মেম্ফিস নগরী, লোহিত সাগরের অংশ, মহামারীর দৃশ্যায়ন ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি গ্রাফিক্সের অধিকাংশ গুরুদায়িত্ব সামলেছে ভিজুয়াল ইফেক্ট কোম্পানি ‘মোভিং পিকচার কোম্পানি’। তারা ছাড়াও ‘ফ্রেমস্টোর’, ‘সিনেসাইট’, ‘ডবল নেভিগেটিভ’ এর মতো খ্যাতনামা ভিএফএক্স কোম্পানিও ভিজুয়াল ইফেক্টের কাজে হাত লাগিয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান বেলের প্রথম থ্রিডি সিনেমা ছিল এটি। ছবির মূল যুদ্ধের দৃশ্য ছয়টা থ্রিডি রিগসের সমন্বয়ে ১২টি ক্যামেরা দ্বারা শুট করা হয়েছে। টুডি ফুটেজের জন্য অতিরিক্ত আরও ৬টা ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছিল।
বক্স অফিস ও ক্রিটিকস
বক্স অফিস কিংবা সমালোচক, কোনো মহলেই আলোর মুখ দেখেনি ‘এক্সোডাস: গডস অ্যান্ড কিংস’ সিনেমা। ১৪০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের এই সিনেমা ডোমেস্টিকে মাত্র ৬৫ মিলিয়ন ডলার নিজ ঝুলিতে পুরতে পেরেছে। তাই, একে ডোমেস্টিক বক্স অফিস ফ্লপ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে বিশ্বব্যাপী ২৬৮ মিলিয়ন ডলার গ্রোসের ফলে প্রযোজনা সংস্থার লগ্নিকৃত অর্থ তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। প্রোডাকশন কস্ট ছাড়াও কিছু পরিমাণ অর্থ লাভ হয়েছে এতে।
সমালোচকদের কাছে এই সিনেমা একপ্রকার তুলোধুনা হয়েছে। শুরু থেকেই ইতিহাস বিকৃতির দায় কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়ানো এই ফিল্ম বিভিন্ন মুসলিম দেশে করা হয়েছে নিষিদ্ধ। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের নিয়েও কম জল-ঘোলা হয়নি। বর্তমানে সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৬.৫/১০, এবং রোটেন টমাটোজে এটি মাত্র ৩০% ফ্রেশ।
পুরস্কার
উল্লেখযোগ্য কোনো পুরস্কা র বাগাতে পারেনি এই মুভি। এর দৌড় শুধুমাত্র পুরস্কার মনোনয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অস্কার, ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, এবং ক্রিটিকস চয়েস মুভি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা ভিজুয়াল ইফেক্ট ক্যাটাগরিতে, এবং স্যাটেলাইট অ্যাওয়ার্ডে সেরা আর্ট ডিরেকশন এবং প্রোডাকশন ডিজাইনে মনোনয়ন পেয়েছে এই সিনেমা।