সভ্যতার একদম শুরু থেকেই মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা কারণে ছবি আঁকছে, ভাস্কর্য তৈরি করছে। সময় যত অগ্রসর হচ্ছে, শিল্পকলার ততই প্রসার হচ্ছে। সময়ের হাত ধরে শিল্পীরা পৃথিবীকে উপহার দিয়ে যাচ্ছেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম। এরকমই এক অন্যতম শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো, ইউরোপীয় রেঁনেসাসের সময় যার জন্ম।
‘রেনেসাঁস’ শব্দের উৎপত্তি ইউরোপের সাংস্কৃতিক ইতিহাস থেকে, যার অর্থ পুনর্জাগরণ। ইউরোপীয় রেনেসাঁসে অর্থনীতি-রাজনীতির অনেক বিকাশ ঘটলেও এর শিল্পের বিকাশ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আর এই বিকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাইকেলেঞ্জেলো। মাইকেলেঞ্জেলোর জন্ম ১৪৭৫ সালের ৬ মার্চ, ক্যাপ্রিসিতে। তার পূর্বপুরুষ ফ্লোরেন্সে বসবাস করতেন এবং সেখানেই ব্যাংকিংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু একসময় ব্যাংকিংয়ের কাজে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ায় মাইকেলেঞ্জেলোর বাবা ক্যাপ্রিসিতে আসলে এখানেই মাইকেলেঞ্জেলোর জন্ম হয়। তার বাবা লুদভিকো দি লিওনার্দো বুওনারোত্তি সিমোনি এবং মা ফ্রাঞ্চেসকা দি নেরি দেল মিনিয়াতো দি সিয়েনা।
জন্মের কয়েক মাস পর তারা আবার সপরিবারে ফ্লোরেন্সে ফিরে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ছয় বছর বয়সে, তার মা মারা গেলে তিনি সেত্তিগনানো নামক শহরের এক পাথর খোদাইকারী পরিবারে সাথে থাকতে শুরু করেন। এখানেই তার ভাস্কর্য তৈরির হাতেখড়ি হয়।
মাইকেলেঞ্জেলো ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও স্থপতি। কিন্তু ছোট থেকেই মার্বেল পাথর খোদাইয়ের সাথে জড়িত থাকায় এদিকে ঝোঁকও ছিল তুলনামূলক বেশি। তার ধারণা ছিল- মানবদেহের আসল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা যায় ভাস্কর্যে। কথাটি যে খুব একটা ভুল নয়, সেটা তার ভাস্কর্যগুলো দেখলেই বুঝতে পারা যায়।
মাইকেলেঞ্জেলোর সৃষ্ট ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পিয়েতা’। মার্বেল পাথরের এই মর্মস্পর্শী ভাস্কর্য তিনি তৈরি করেন ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকার জন্য। ভাস্কর্যে উপস্থিত মাতা মেরির কোলে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রাণহীন দেহ দেখানো হয়েছে। মাতা মেরি জাগতিক সবকিছু ভুলে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে নির্মীলিত নেত্রে তাকিয়ে আছেন তার মৃত পুত্রের মুখের দিকে। এমন স্তব্ধ, সংযত, শোকাবহ, শান্ত কিন্তু পবিত্র ভাব কীভাবে শক্ত পাথরের গায়ে প্রতিফলিত হলো তা এক রহস্যই বটে!
‘পিয়েতা’র পর মাইকেলেঞ্জেলো ফ্লোরেন্সে গিয়ে নির্মাণ করেন ‘ডেভিড’। পূর্বে দোনাতোল্লা এবং ভেরোচ্চিও ডেভিড নির্মাণ করলেও অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডের তুলনায় সেগুলো ছিল আকারে ছোট, অল্পবয়স্ক বালক, আর এই ডেভিড আকারে বেশ বড় এবং বয়সে যুবক। পূর্বের ডেভিডদের শরীর জামাকাপড় ও অস্ত্রে সজ্জিত, কিন্তু অ্যাঞ্জেলোর ডেভিড সম্পূর্ণ নগ্ন এবং সুঠাম দেহের অধিকারী, ফলে পুরুষোচিত সৌন্দর্যের আধার হয়ে ওঠে তার ডেভিড। দেহের প্রতিটি ভাঁজ আদর্শায়িত, যার সাথে গ্রীক বা রোমান ক্ল্যাসিক্যাল স্টাইলের মিল পাওয়া যায়। শরীর এবং মুখভঙ্গির মধ্যে দেখা যায় দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং কিছুটা বেপরোয়া কিন্তু শান্ত ভাব। সব মিলিয়ে বেশ অস্থির অথচ প্রস্তুত একটি ভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়।
মাইকেলেঞ্জেলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের সমাধিসৌধের ভাস্কর্য। মার্বেলে নির্মিত ‘ডাইং স্লেইভ’ বা ‘মৃত্যুপথযাত্রী দাস’ নামক দণ্ডায়মান এই ভাষ্কর্যে তিনি মূর্ত করেছেন মৃত্যুর ঠিক আগমূহুর্তকে। মৃত্যুর আগে শুধু মৃত্যুযন্ত্রণা নয়, জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির এক অদ্ভুত প্রশান্তির ব্যাকুলতাও ব্যক্ত হয়েছে এখানে। এত ছন্দময়তা এবং সচল ভঙ্গি যে ফিগারটি দেখে বাস্তব বলে ভ্রম হয়।
মাইকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্যের এই সচলতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গমব্রিখ বলেছেন, অ্যাঞ্জেলো সবসময় ভাস্কর্যগুলো নির্মাণের আগেই শক্ত প্রস্তরখণ্ডের অভ্যন্তরে ভাস্কর্যের চরিত্রগুলো নিহিত রয়েছে বলে কল্পনা করতেন, এবং ভাস্কর হিসেবে তিনি শুধু পাথর থেকে চরিত্রগুলোকে বাইরে বের করে এনেছেন।
ভাস্কর্যের প্রতি টান থাকলেও পোপের পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক কারণে অ্যাঞ্জেলোকে চিত্রকর্মও করতে হয়েছে। ভাস্কর্যের মতোই তার আঁকা ছবিগুলোও ছিল আদর্শায়িত। তার বেশিরভাগ চিত্রকর্মই ফ্রেস্কো পদ্ধতিতে করা। ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত সিস্টিন চ্যাপেলের পুরো ছাদে যে ফ্রেস্কোওয়ার্ক দেখা যায় তার জুড়ি মেলা ভার। পুরো ছাদ জুড়ে বেশ কয়েকটি অংশে বিভক্ত ঘটনাবহুল এই দৃশ্য আঁকতে তার সময় লেগেছিল চার বছরের কাছাকাছি!
এর একটি অংশে দেখানো হয়েছে ‘দ্য ক্রিয়েশন অফ অ্যাডাম’ শীর্ষক ঈশ্বর কতৃক অ্যাডামকে প্রাণদানের ঘটনা। ছবিতে দেখা যায়- ঈশ্বর এবং অ্যাডাম পরস্পরের আঙুল ছুঁয়ে আছেন। ঈশ্বর যে অংশে আছেন সেটুকু আঁকা হয়েছে স্বর্গের মতো করে, আর অ্যাডামের অংশটুকু পৃথিবীর মতো। অ্যাডামের পৃথিবীতে আবির্ভাব এবং পৃথিবীর সাথে ঈশ্বরের যোগাযোগের ইঙ্গিতপূর্ণ এই চিত্রকর্ম অ্যাঞ্জেলোর সেরা কাজগুলোর একটি।
সিস্টিন চ্যাপেলের আরেক দেয়ালে এঁকেছেন ‘দ্য লাস্ট জাজমেন্ট’। এই ফ্রেস্কোতে দেখানো হয়েছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনানুযায়ী ঈশ্বরের শেষ বিচারের কার্যক্রম, যীশুর পুনর্জন্ম, যেখানে যীশুর সাথে তাঁর অনুসারীরাও উপস্থিত। আর নিচের দিকে দেখা যায় পাপীদের নরকে প্রেরণের এক ভয়ংকর দৃশ্য। এছাড়াও নূহ নবীর (আ.) সময়ে ঘটা প্লাবনের দৃশ্য এবং নবী কর্তৃক মানুষের পরিত্রাণের মতো আরো অনেক ঘটনাবলীর সূক্ষ্ণ বিবরণ পাওয়া যায় এই বিশাল চিত্রকর্ম থেকে।
মাইকেলেঞ্জেলো এত বেশি ফ্রেস্কো করলেও ফ্লোরেন্সে থাকাকালীন ‘দ্য হোলি গ্রেইল’ নামক একটি তৈলচিত্রও অঙ্কন করেন, যেটি এখন উফফিজি গ্যালারিতে সংরক্ষিত রয়েছে। ভাস্কর্যের মতোই অ্যাঞ্জেলোর চিত্রকর্মেও ফিগারের মধ্যে একধরনের চঞ্চলতা দেখা যায়। কর্মব্যস্ত, অস্থির এবং উত্তেজিত দেহভঙ্গি সাধারণ ফিগারগুলোকে যেমন প্রাণবন্ত করে তুলেছে, আরেকদিকে তেমন অ্যাডামকে দেখানো হয়েছে এক ঐশ্বরিক জীবনীশক্তিতে ভরপুর মানব হিসেবে; মানুষ হয়েও যে সে সবার থেকে আলাদা এটা বোঝানোর জন্যই।
আবার পৃথিবীর সাথে ঈশ্বরের যে এক যোগসূত্র আছে তা-ও বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্যণীয়। একপাশে যেমন ধুলো-মাটির পৃথিবী, অপরদিকে তেমন দেবদূতবেষ্টিত ঈশ্বরের স্বর্গীয় জগৎ। অথচ এই দুই জগত মেলবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে দুটি আঙুলের স্পর্শে! কী অদ্ভুত নাটকীয় একটি বিষয়! এই যে ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কের বিষয়টি যেমন পবিত্র সৌন্দর্যের নমুনা, একই সময়ে লাস্ট জাজমেন্টের শাস্তিপ্রাপ্তদের যন্ত্রণাকাতর মুখের অভিব্যক্তি আরেকটি কষ্টদায়ক অনূভুতি! একইসাথে দুটি বিপরীতধর্মী অনূভুতির এমন রূপদান খুব সহজ কথা নয়, কিন্তু এই কঠিন কাজই খুব দক্ষতার সাথে করে ফেলেছেন মাইকেলেঞ্জেলো।
ভাস্কর বা চিত্রশিল্পী ছাড়াও অ্যাঞ্জেলোর ছিল আরও একটি পরিচয়। স্থপতি হিসেবেও বেশ নামডাক ছিল তার। ভাস্কর্য, চিত্রকলার মতো এই ক্ষেত্রেও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন তিনি। এর পরিচয় পাওয়া যায় ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত ‘সেন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা’ থেকে। তৎকালে এটাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গীর্জা।
প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে গীর্জাটির নির্মাণ কাজ চলে। অ্যাঞ্জেলো এর প্রধান স্থপতি হলেও এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে রাফায়েল, ফ্রা জিওকন্দো, জুলিয়ানো দ্য সাঙ্গালো, আন্তোনিও দ্য সাঙ্গালোও কাজ করেছেন। অ্যাঞ্জেলোর দুর্ভাগ্য যে, ব্যাসিলিকার কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে থাকতে পারেননি। সেন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা ছাড়াও আরো স্থাপন করেছেন মেডিচি ফ্যামিলির লরেন্টিয়ান লাইব্রেরি, পালাজ্জো দে কজারভেটরি, প্লেস অফ দ্য হলি অফিস, পালাজ্জো সেনাটোরিওর মতো বিশাল বিশাল সব স্থাপনা, যা আজও আপন আপন সৌন্দর্য বিস্তার করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে আর প্রতিনিয়তই আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে নির্মাণকারীর কথা।
মাইকেলেঞ্জেলোর ব্যাপারে বলা হয়- তিনি স্বর্গীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কারণ তার কাজের ধরনই ছিল এমন যে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত রং তুলির ছবি বা প্রাণহীন পাথরের মূর্তি— এত প্রাণবন্ত কীভাবে হতে পারে ভেবে। একদিকে যেমন সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেস্কোতে অ্যাডাম ফিগারে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাহিনী চিত্রিত করেছেন, অন্যদিকে মরণাপন্ন দাসের পাথরের মূর্তিতে দেখিয়েছেন মৃত্যুযন্ত্রণার করুণ রূপ! আর এই সবক্ষেত্রেই অনুভূতির প্রকাশ এত তীব্র, এত আকর্ষণীয় যে দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকাতেই হয়।
তার শিল্পকর্মের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে ১৫৬৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর মায়া কাটালেও পৃথিবী তার মায়া আজও কাটাতে পারেনি। তার প্রতিটি কাজের মধ্যেও মানুষ আজও তাকে খুঁজে পায়, পাবে।