অনেক সাহিত্য, সিনেমা, সিরিজ ইত্যাদির পটভূমি এমন এক কাল্পনিক রাষ্ট্র বা সমাজকে ঘিরে আবর্তিত হতে দেখা যায়, যেখানে চারিদিকে প্রচণ্ড দুর্দশা, যন্ত্রণা, অন্যায় বিদ্যমান। সেগুলোকে শ্রেণীভেদ করা যেতে পারে ডিস্টোপিয়ান ঘরানার কাজ হিসেবে।
আর ডিস্টোপিয়া (Dystopia) বলতে এমন এক কাল্পনিক জায়গা বোঝায়, যেখানে অস্তিত্বের অবস্থা সংকটাপন্ন বা নিপীড়িত। এমন এক পৃথিবী যেখানে সবকিছুই ত্রুটিপূর্ণ, এবং সবকিছুই ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। যে পৃথিবী বা সমাজে মানুষ অমানবিক, ভয়ঙ্কর, হতভাগ্য জীবনযাপন করে; যেখানে মানুষের দুর্দশা, যেমন ভীতিকর সমাজ ব্যবস্থা, অশ্লীলতা, নিপীড়ন, রোগ, উপচে পড়া ভিড় ইত্যাদিতে আপন্ন।
বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সমাজের এই ভীতিকর রূপ দেখা যায়। এজন্য এক বা একাধিক কারণ থাকতে পারে— একটি দুর্নীতিগ্রস্ত অথবা সর্বগ্রাসী সরকার, পরিবেশগত বিপর্যয়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে মনুষ্যত্বের সংকট, অনিয়ন্ত্রিত সহিংসতা, সীমিত সম্পদ ইত্যাদি। আরও ভয়াবহ একটি বিষয় হচ্ছে— ডিস্টোপিয়ায় সাধারণত মানুষের দুর্দশার আধিক্য বেশি থাকে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে যে, সেখানে মানুষ বিশ্বাস করে— যেন তারা দুর্দশাগ্রস্ত নয়! সেসব ক্ষেত্রে প্রায়শই শাসনযন্ত্রগুলো সমাজে প্রোপাগান্ডা চালায় যে, এটি আসলে একটি ইউটোপিয়া (Utopia), যা ডিস্টোপিয়ার বিপরীত।
ডিস্টোপিয়ার এই ‘ভালো জায়গা নয়’ এর ধারা শতাব্দী ধরে শিল্পী এবং দর্শকদের কল্পনার জগৎকে আলোড়িত করেছে। কিন্তু কেন আমরা এই সব হতাশাজনক চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামাই?
ইউটোপিয়ান ও ডিস্টোপিয়ান ধারণার উৎপত্তি
পাঠক যদি কখনও একটি আদর্শ পৃথিবীর ছবি কল্পনার চেষ্টা করেন, যেখানে আইন ও সমাজ ব্যবস্থা একদম নিখুঁত, যেখানে কোনো যুদ্ধ, রোগ, যন্ত্রণা, দারিদ্র্য, বা অপরাধ নেই, সেটি হচ্ছে ইউটোপিয়া। আর ডিস্টোপিয়া হলো ইউটোপিয়া বা একটি আদর্শ, মনোরম জায়গার ঠিক বিপরীত। বাস্তব জগতে ইউটোপিয়া তৈরি প্রায় অসম্ভব, এমনকি কল্পকাহিনীতেও ইউটোপিয়া তৈরি করা অনেকক্ষেত্রেই কঠিন। সাধারণত একটি সমাজকে ইউটোপিয়া, অর্থাৎ একটি নিখুঁত স্থানে পরিণত করার সন্ধান, হিতে বিপরীত হয়ে এই ধরনের ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যায়।
ডিস্টোপিয়া শব্দটি গ্রিক উপসর্গ δυσ (ডিস – ‘খারাপ’), এবং τόπος (টপোস – ‘স্থান’) এর সংমিশ্রণ। দার্শনিক টমাস মোরের ১৫১৬ সালের বই, ‘ইউটোপিয়া’ (গ্রীক – ‘কোনো স্থান নেই’) এই ডিস্টোপিয়া ধারণার জন্ম দিয়েছে। যেখানে তিনি এক কাল্পনিক আদর্শ দ্বীপ জাতির বর্ণনা দেন। যদিও এই নামটি আধুনিক বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ার অসম্ভব আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু তা বারবার, এই স্বপ্নের পরিবর্তে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং নিপীড়নের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। আর তা থেকে শিল্পীরা যখন ইউটোপিয়ান চিন্তা-ভাবনার বিপরীতে প্রশ্ন শুরু করেন, তখন এর উল্টো ধারণা ‘ভালো জায়গা নয়’, অর্থাৎ ডিস্টোপিয়া জন্ম নেয়। ডিস্টোপিয়ান সাহিত্য, ইউটোপিয়ান সাহিত্যের বিপরীতে মনুষ্যজাতির ভবিষ্যতের উপর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর বিপজ্জনক প্রভাব অনুসন্ধান করে।
প্রথমদিকের ডিস্টোপিয়ান কাজগুলোর মধ্যে একটি হলো জোনাথন সুইফটের ‘গালিভার্স ট্রাভেলস’। গালিভার তার পুরো যাত্রায় বিভিন্ন কাল্পনিক সমাজের মুখোমুখি হয়, যার মধ্যে কয়েকটি প্রথমে ব্যাপক চিত্তাকর্ষক মনে হলেও পরবর্তীতে উপলব্ধি করা যায় যেগুলো গুরুতরভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এর একটি ঘটনা লাপুতা নামক এক উড়ন্ত দ্বীপে। যেখানে বিজ্ঞানী এবং সমাজ পরিকল্পনাকারীরা নিচে বাস করা মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদা উপেক্ষা করে অযথা ব্যয়বহুল, অপচয়ী এবং অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস তৈরি ও পরিকল্পনা করে। আবার আরেক জায়গায় হোইনআম (Houyhnhnm) নামক বুদ্ধিমান ঘোড়ার জাতির গল্পে, পুরোপুরি যৌক্তিক সম্প্রীতিতে বাস করা হোইনআমরা মানুষের অসম্পূর্ণতা, ভুল, ত্রুটিপূর্ণতা সহ্য করতে পারত না।
সুইফট তার উপন্যাসের মাধ্যমে ডিস্টোপিয়ান ঘরানার সাহিত্যের জন্য একটি নীলনকশা প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। আর এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের জন্যে এটি রসদ যুগিয়েছে। যেমন: শিল্পবিপ্লবের ফলে, যেখানে শ্রমিকদের মুক্ত করার কথা ছিল, সেখানে তাদের উল্টো দিয়েছিল বস্তির জীবন এবং করেছিল কারখানায় বন্দী, অন্যদিকে পুঁজিপতিরা হয়ে উঠছিল রাজাদের চেয়ে ধনী।
কথাসাহিত্যে ডিস্টোপিয়া এবং বাস্তব জগৎ
কাল্পনিক ডিস্টোপিয়াগুলো প্রায়শই বাস্তব ঘটনা, সম্প্রদায় বা স্থান দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। তারপর কল্পনার সুদূর প্রান্ত থেকে ভবিষ্যতের কোনো পটভূমিতে তৈরি করা হয় সেসব কাহিনী। কথাসাহিত্যের পেছনে যে একটি বাস্তব জগতের সম্পর্ক থাকে, তা জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ ও ‘এনিম্যাল ফার্ম’ উপন্যাস পড়লে উপলব্ধি করা যায়। যেগুলোতে স্ট্যালিন, ফ্রাঙ্কো, হিটলারসহ অনেকের শাসনের সময়কার বিষয়বস্তুগুলো উঠে এসেছে।
সাধারণত ডিস্টোপিয়ান রচনাগুলোর মূল বিষয় থাকে যুদ্ধ, নিপীড়ন, বিদ্রোহ, বিপ্লব, অধিক জনসংখ্যা, বড় কোনো বিপর্যয় ইত্যাদি। যেখানে অত্যন্ত কড়া আইন মেনে ছাঁচে পড়া জীবন বা সমাজের নির্দিষ্ট মান বা মনোভাব মেনে চলার প্রবণতা দেখা যায় যায়। ডিস্টোপিয়ান কথাসাহিত্য ভবিষ্যতের একটি দূরদর্শনের মতো। সমাজের প্রলয়ঙ্করী পতন, প্রযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, সরকারি নিপীড়ন ইত্যাদি ডিস্টোপিয়ার কিছু উপাদান। ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস পাঠকদের বর্তমান বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের এ সম্পর্কে পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
ডিস্টোপিয়ান কথাসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান ও এর সমাজ বা স্থান লেখকের জল্পনা-কল্পনার দ্বারা সৃষ্ট। কিন্তু সর্বাধিক পরিচিত ডিস্টোপিয়াগুলো মোটেই পুরোপুরি কাল্পনিক ছিল না। ইউরোপে অভূতপূর্ব শিল্পযুদ্ধের সৃষ্টি হলে নতুন নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনেরও সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ সমস্ত সামাজিক শ্রেণী পার্থক্য মুছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ প্রাচীন পৌরাণিক ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। যেগুলোর ফলাফল ছিল বাস্তব জগতের ডিস্টোপিয়া, যেখানে মানুষের জীবন রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারির মধ্যে চলে যায়। আর মৃত্যু যেখানে খুবই সহজ হয়ে ওঠে। সেই সময়ের অনেক লেখক এই ভয়াবহতাগুলো শুধু পর্যবেক্ষণ করেননি, বরং তাদের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ডিস্টোপিয়ার অন্যতম একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে হিটলারের ভাবাদর্শ (Idiology) দ্বারা সৃষ্ট নাৎসি জার্মানি। যাদের লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ আর্যদের নিয়ে একটি নিখুঁত জাতি তৈরি, আর্যদের নিয়ে একটি নিখুঁত সমাজ তৈরির প্রচেষ্টা, যা কিনা হাজার বছর ধরে স্থায়ী হবে, ইতিহাসে এক বাস্তব ডিস্টোপিয়ার জন্ম দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে লেখকরা চিন্তা করেন, পারমাণবিক শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং মহাকাশ ভ্রমণের মতো নতুন নতুন প্রযুক্তি মানবতার ভবিষ্যতের জন্য কী বয়ে আনতে পারে। এর থেকে ডিস্টোপিয়ান সায়েন্স ফিকশনের নতুন নতুন ঘরানা চলচ্চিত্র, কমিক, এবং গেমগুলিতে তখন বিস্তৃত হয়। তবুও রাজনীতি সবসমই ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ছিল। এখনকার ডিস্টোপিয়ান ফিকশনগুলো সাধারণত বিভিন্ন প্রকার বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক মহামারী, সরকারী ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে চলেছে।
ডিস্টোপিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য ও ধরন
যদিও বিভিন্ন ধর্রনের ডিস্টোপিয়া রয়েছে, ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের কাজগুলোতে সাধারণত কয়েকটি থিম বা উপাদান রয়েছে যা মোটামুটি সার্বজনীন। যেখানে তথ্যের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, এবং বলতে গেলে সকল মৌলিক স্বাধীনতাই সীমাবদ্ধ। সেখানে সমাজের নাগরিকদের নেতা গোছের কোনো ব্যক্তি, বা কোনো একটি আদর্শ বা ধারণাকে পূজা করতে দেখা যায়। যেখানে নাগরিকদের ক্রমাগত নজরদারিতে রাখা হয়। এরূপ কিছু বিষয় ছাড়াও আরও অনেক বৈশিষ্ট্য ও ধরন দেখা যায় ডিস্টোপিয়ান কল্পকাহিনীগুলোতে। যেমন:
সরকারি নিয়ন্ত্রণ: ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যে সরকার একটি বড় ভূমিকা পালন করে। হয় সেখানে কোনো সরকারই নেই, অথবা একনায়কতন্ত্র বা চরম আমলাতান্ত্রিক নিপীড়ক সরকার বিদ্যমান। তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য শক্তি, হুমকি, এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের অদৃশ্য বা গুম করে দেয়ার মতো অবৈধ জবরদস্তি করে।
অভিন্ন প্রত্যাশা: নাগরিকদের মধ্যে একই ধরনের মনোভাব লক্ষ্য করা যায়, সকলের জীবনের প্রত্যাশা একইরকম থাকে।
নজরদারি: রাষ্ট্র বা সমাজ দ্বারা নাগরিকরা প্রতিনিয়ত কঠোর নজরদারিতে থাকে, যেখানে নাগরিকদের কোনো কার্যকলাপ রাষ্ট্রের বিপরীতে গেলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
প্রোপাগান্ডা: রাষ্ট্র ও সমাজ, নাগরিকদের অন্ধকারে রাখতে বিভিন্ন ধরনের প্রচার চালায়, যেখানে তারা তাদের রাষ্ট্র বা সরকারকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করে।
কর্পোরেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ: কোনো একটি বড় কর্পোরেশন, মিডিয়া বা পণ্যের মাধ্যমে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে।
দার্শনিক/ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ: সরকার দ্বারা প্রয়োগকৃত কোনো আদর্শ বা কোনো কাল্ট জাতীয় ধর্ম দ্বারা সমাজের নিয়ন্ত্রণ হতে দেখা যায়।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অভাব: স্বাধীন চিন্তার সীমাবদ্ধতার ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিনাশ দেখা যায়। সকলের মধ্যে একধরনের ছাঁচে গড়া রোবোটিক জীবন পরিচালনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
রাষ্ট্র ও সমাজ হল প্রতিপক্ষ: এই ধরনের সাহিত্যে মূল চরিত্রদের রাষ্ট্র ও সমাজ চিরায়ত স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখা যায়।
প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ: কম্পিউটার, রোবট বা বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি, যেখানে প্রযুক্তি দ্বারা মানুষের নিয়ন্ত্রিত হওয়া বা কেউ তা ব্যবহার করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সৃষ্ট অবস্থা।
প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়: পরিবেশ ধ্বংস বা বসবাসের অযোগ্য অবস্থায় সমাজে মানুষের বেঁচে থাকা নিয়েও কিছু ডিস্টোপিয়ান কাজ অনুপ্রাণিত হয়েছে।
সাহিত্য, সিনেমা ও ভিডিও গেমসে ডিস্টোপিয়া
লক্ষ্যণীয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশের আগে ডিস্টোপিয়ান রচনার খুব কম উদাহরণই আছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম যদিও আছে, যেমন- ১৭২৬ সালে লেখা জোনাথন সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস। তবে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত ডিস্টোপিয়ান কাজের ব্যাপক বিস্তার তখনও শুরু হয়নি। বেশিরভাগ ডিস্টোপিয়ান কাজের উদাহরণ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ, ও বিংশ শতাব্দী থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়। ক্রমে প্রযুক্তির বিকাশের ফলে শুধু সাহিত্যের দুনিয়া থেকে চলচ্চিত্র, সিরিজ, ভিডিও গেম, সঙ্গীতে ডিস্টোপিয়ান কাজের জন্ম হয়।
“যখন আমরা ডিস্টোপিয়া পড়ি, তখন আমরা সেখানে মানুষগুলোর মুক্তির জন্য সমর্থন করি, কারণ এই মানুষগুলো আমরাই; আমাদের চেয়ে বড় জিনিসগুলির বিরুদ্ধে আশা এবং লড়াই করি।”
— অ্যালি কন্ডি
বিখ্যাত কিছু কাজ ও সেগুলোর ডিস্টোপিয়ান জগত
উপন্যাস – লেখক – ডিস্টোপিয়া
- ১৯৮৪ – জর্জ অরওয়েল – ওশেনিয়া
- এনিম্যাল ফার্ম – জর্জ অরওয়েল – ডিস্টোপিয়ান ইংল্যান্ড
- অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ – অ্যান্থনি বার্গেস – ভবিষ্যত ইংল্যান্ড
- দ্য টাইম মেশিন – এইচ. জি. ওয়েলস – ফিউচারিস্টিক ইংল্যান্ড
- ফারেনহাইট ৪৫১ – রে ব্র্যাডবারি – ফিউচারিস্টিক ইউএসএ
- লর্ড অব দ্য ফ্লাইস – উইলিয়াম গোল্ডিং – নামহীন দ্বীপ
- দ্য হাঙ্গার গেমস – সুজান কলিন্স – প্যানেম
- দ্য চিলড্রেন অফ ম্যান – পি. ডি. জেমস – ফিউচারিস্টিক ইংল্যান্ড
- দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল – মার্গারেট অ্যাটউড – গিলিয়েড
এই সাহিত্যগুলোর বেশিরভাগেরই চলচ্চিত্রে রূপায়ণ হয়েছে। আর বেশিরভাগ সিনেমাই কোনো না কোনো বই থেকে অনুপ্রাণিত। কিছু ডিস্টোপিয়ান সিনেমা হচ্ছে: ব্লেড রানার (১৯৮২), ওয়াল-ই (২০০৮), ম্যাড ম্যাক্স, আই রোবট (২০০৪), প্ল্যানেট অফ দ্য এপস, ভি ফর ভেন্ডেটা (২০০৫), দ্য ম্যাট্রিক্স (১৯৯৯), রোবোকপ (১৯৮৭) ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য কিছু টেলিভিশন সিরিজ: ফায়ারফ্লাই (২০০২-২০০৩), ডক্টর হু (২০০৫- চলমান), ব্ল্যাক মিরর (২০১১- চলমান), দ্য ওয়াকিং ডেড (২০১০-২২) ইত্যাদি।
ভিডিও গেমসে ডিস্টোপিয়ান জগতের ব্যবহার: রেসিডেন্ট ইভিল, ফাইনাল ফ্যান্টাসি, দ্য লিজেন্ড অফ জেলডা, ডিউস এক্স ইত্যাদি।
ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের তাৎপর্য ও প্রভাব
সমাজে ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের তাৎপর্য ও প্রভাব বিস্তারের বেশ কিছু ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। এইচ. জি. ওয়েলসের ১৮৯৫ সালের উপন্যাস ‘দ্য টাইম মেশিন’, ইংল্যান্ডের একজন বিজ্ঞানীকে কেন্দ্র করে, যিনি টাইম মেশিন তৈরি করেন, এবং ভবিষ্যতে চরম পুঁজিবাদী সমাজের ফলে সৃষ্ট এক ডিস্টোপিয়ান পৃথিবীর সাক্ষী হন। এখানে, যদিও লেখকের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন অনেকটাই লক্ষ্যণীয়, তবুও এই বই একধরনের সতর্কবাণীস্বরূপ সমাজের নিকট উপস্থাপিত হয়েছে।
অন্যদিকে ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের জগতে যার নাম সচরাচরই উঠে আসে, তিনি জর্জ অরওয়েল। তার লেখা ‘এনিম্যাল ফার্ম’ এবং ‘১৯৮৪’, রাজনৈতিক ডিস্টোপিয়ার দুই বিখ্যাত কাজ। ‘এনিম্যাল ফার্ম’ প্রাণীদের রূপক হিসেবে ব্যবহার করে, যেখানে প্রাণীরা খামারের মানুষদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে খামারের ক্ষমতা হাসিল করে, আর এই ক্ষমতায় ওঠার গল্পটি রুশ বিপ্লবের উপর ভিত্তি করে তৈরি। এই ব্যঙ্গধর্মী রচনার মাধ্যমে তিনি রুশ কমিউনিস্ট শাসনের সমালোচনা করেন।
জর্জ অরওয়েলের আরেকটি উপন্যাস, ‘১৯৮৪’, চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারের চিত্র তুলে ধরে। যেখানে পুরো বিশ্ব তিনটি আন্তমহাদেশীয় সুপারস্টেটের সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি একটি বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশিষ্ট সুপারস্টেটের একটিতে বাস করা একজন নাগরিকের দৃষ্টিকোণে লেখা, যেখানে কাল্পনিক স্বৈরশাসক বিগ ব্রাদার ও তার সরকার রাষ্ট্রে বসবাসকারী সকল নাগরিকের উপর সর্বজনীন নজরদারি রাখে।
মার্গারেট অ্যাটউডের ১৯৮৫ সালের উপন্যাস ‘দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল’ ভবিষ্যৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পটভূমিতে হয়, যা গিলিয়েড নাম পরিচিত। উপন্যাসটি অত্যাচারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং একটি বড় সংকট যে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে হ্রাস করতে পারে সেই বিষয়ে সতর্কবাণী প্রদান করে। সেখানে একটি চিকিৎসাক্ষেত্রে সংকটকে সংবিধান স্থগিত করার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্থনি বার্গেসের ১৯৬২ সালের উপন্যাস ‘অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’ আচরণবাদের উপর লেখা একটি সামাজিক ব্যঙ্গাত্মক রচনা। ভবিষ্যত ইংল্যান্ডের পটভূমিতে, যেখানে চরম সহিংসতার একটি যুব উপ-সংস্কৃতি রয়েছে। যেখানে একটি সর্বগ্রাসী সরকার সমাজকে ভাল আচরণ, এবং মানুষের হিংস্র প্রবণতা বিলোপ করে সমাজকে রক্ষা করে।
সুজান কলিন্সের ‘দ্য হাঙ্গার গেমস’ এর প্রেক্ষাপট ভবিষ্যতে ধ্বংসপ্রাপ্ত উত্তর আমেরিকার পটভূমিতে, যা প্যানেম নামে পরিচিত। দ্য ক্যাপিটল নামে সর্বগ্রাসী সরকার দেশের অধিকাংশ সম্পদের অধিকারী, এবং নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতি বছর, পানেমের ১২টি ডিস্ট্রিক্টের শিশুদের হাঙ্গার গেমস নামে একটি টেলিভিশনে প্রচারিত ডেথ ম্যাচে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত করা হয় যা মানুষের জীবনের বিনিময়ে অসুস্থ বিনোদনশিল্পের দিকেও ইঙ্গিত করে।
ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসগুলো যেমন ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা হতে পারে, আবার একজন লেখকের আদর্শের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসও প্রকাশ করতে পারে। বর্তমান সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর বিপদ সম্পর্কে মানবতাকে শিক্ষিত এবং সতর্ক করার উপায় হতে পারে এই কাজগুলো। কাল্পনিক ডিস্টোপিয়াগুলো— প্রতিরোধযোগ্য ভবিষ্যতের বিষয়ে সতর্ক করে, যেগুলো শাসনতন্ত্রের প্রকৃত মৃত্যু এড়াতে সাহায্য করতে পারে।
পরিশেষে
ডিস্টোপিয়ান সাহিত্য বা সিনেমাগুলোয় একটি শিক্ষামূলক বার্তা রয়েছে, যা প্রায়শই নৈরাজ্যবাদ, নিপীড়ন, এবং গণদারিদ্র্যের মতো বিষয়ের অনুসন্ধান করে। এই কাল্পনিক ডিস্টোপিয়াগুলো সতর্কতামূলক কাহিনী হিসেবে কাজ করতে পারে; কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ ধরনের সরকার বা প্রযুক্তি সম্পর্কে নয়, বরং মানুষের প্রকৃতি বা মনুষ্যত্বকে যে ইচ্ছানুসারে ছাঁচে ফেলে যেকোনো আকারে রূপান্তর করা যেতে পারে এমন ধারণার প্রতি। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অন্ধকার দিকসহ, বিষাক্ত সাংস্কৃতিক চর্চার শক্তিশালী সমালোচনা প্রদান থেকে শুরু করে, নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদীদের কঠোর শাস্তির মুখে মানবিক চেতনার শক্তি প্রদর্শন করা পর্যন্ত বিষয়গুলো কাল্পনিক হলেও, অনেকটাই প্রতিবাদী ও মানুষের সতর্কতার দৃষ্টি জাগ্রত করার লক্ষ্যে তুলে ধরছেন এগুলোর রচয়িতারা। আপাতদৃষ্টিতে ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসগুলো তাদের পাঠকদের জন্য এসব সমাজের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য জগতের পথনির্দেশক হয়ে কাজ করছে।