মনে পড়ে? আদালতে রেবেকা হক জিতে যান, সাগরেদ বদিও বেঈমানি করে বসে বাকের ভাইয়ের সাথে। ফাঁসি হয় বাকের ভাইয়ের। জেল গেটে মুনা এসে বাকের ভাইকে নিয়ে যায়, কোথাও কেউ নেই। বাকের ভাইকে বাঁচাতে চেয়েছিল সবাই, শিল্পপতি থেকে পানবিড়ির দোকানদার। তবে বাঁচাতে পারেননি খোদ প্রধানমন্ত্রীও, কাজ করেনি রাষ্ট্রপতির মার্সি পিটিশন। করবেই বা কেমন করে? এ তো ধারাবাহিক নাটক, হুমায়ুন আহমেদের রচনা ও চিত্রনাট্য পরিচালনায় বরকত উল্ল্যাহ। যেভাবে তারা চাইবেন সেভাবেই কাহিনি এগোবে। চিত্রনাট্যকার যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই হয়েছে, বাকের ভাইকে দড়িতে ঝুলতে হলো। আমরা সেখানে শুধু দর্শক।
কেমন হতো যদি আমরা যেমন চাইতাম সেভাবেই সিনেমা এগোবে, আমরা ঠিক করে দিতাম বদি বাকের ভাইয়ের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে না! আমরা ঠিক করে দিতাম আদালতে রেবেকা হকের জয় হবে না, জয় হবে মুনার চোখের জলের। বাকের ভাই বেকসুর খালাস হয়ে আসবেন, কোথাও কেউ নেই কথাটি হবে মিথ্যে, সহজ। অতীতে এই আলাপ বড় নস্যাৎ ছিল, মেঘের দেশে অট্টালিকা গড়ার মতো শোনালেও ভবিষ্যৎ সেই অবাস্তবকে উড়িয়ে দেয় না। ঠিক তাই, ইন্টারেকটিভ সিনেমা হবে ভবিষ্যতের বিনোদন, যেখানে দর্শক যেমন দেখতে চাইবে, সেভাবেই চলচ্চিত্র চলবে।
যেমন- সহজে বলতে গেলে, দেবদাস সিনেমায় পারুকে দেবদাস পায় না, চন্দ্রমুখীও না। বেচারা দেবদাস মদ গিলে গিলে মরে যায়। ভাবা যাক, সিনেমায় যেখানে পার্বতীর জমিদারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়, তখন দর্শকের কাছে স্ক্রিনে জানতে চাওয়া হবে পার্বতীর বিয়ে হবে কিনা? হ্যাঁ অথবা না। হ্যাঁ হলে সিনেমা একভাবে এগোবে, না হলে বিয়ে ভেঙে যাবে। সেখান থেকে সিনেমা এগোবে। দর্শকের এই যে সিনেমায় ইন্টারেকশন, এটা রূপকথার মতো ঘটনা হয়ে কাহিনী এগোবে, কারণ দর্শক তা-ই দেখতে চেয়েছিল। টাইটানিক ডুবে গেলেও রোজ বেঁচে যায় যেমন, এমনভাবে বহু বছর পর ফিরে আসবে জ্যাক, কারণ দর্শক তা দেখতে চেয়েছিল। অথবা হ্যারি পটার আশ্চর্য কোনো জাদুতে ফিরে পেতে পারে তার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের, যারা মারা গিয়েছিল। বাবা, মা, সিরিয়াস, ডাম্বলডোর, স্নেপরা ফিরে আসত হগওয়ার্টসে। অতীতে এমন হয় না, আমরা যা চাই আর ভাবি তা কখনো স্ক্রিপ্টের সাথে মিলে যায়নি। অথচ প্যারাডক্সের ধারণা থেকে, ঠিক তা-ই হবে হয়তো!
প্যারাডক্স বলে, প্রতিটি ঘটনার দুটো সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমরা যখন কোনো কিছু করার জন্য ভাবি, তখন সেটা করলে যা যা হতো আর না করলে যা যা হতো সেরকম দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন পরিবেশে চলতে শুরু করে। প্যারালাল ইউনিভার্সের কেচ্ছা আমরা হরহামেশা শুনি। আমরা ভাবি এই দুনিয়ার আপসাইড ডাউনে যদি অন্য দুনিয়া থাকে সেখানে আমার অন্য একটা ‘প্রতি-আমি’ আছি। আমি এখানে দুঃখ পেলে ওখানে সে হয়তো আনন্দে আছে, যদিও এরকম ঠুনকো বা ছেলেমানুষী বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্যারাডক্স নয়, সেই আলাপ ভিন্ন ।
ইন্টারেকটিভ ভিডিও গেমের সাথে আমরা পরিচিত। যেখানে কাহিনী থাকে, বেশ কিছু চরিত্র থাকে, চরিত্রগুলোর উপর ভর করে গেম সামনে যায়। মিশন দেয়া হয়, মিশন পুরো করলে আসে পরের মিশন। অবশ্যই একটি মিশন শেষ করলে আসবে অন্য মিশন, মিশন সম্পন্ন করলে একরকম গতি, কোনো কারণে অদক্ষতায় ব্যর্থ হলে অন্যরকম, ভীষণ দুর্গতি। রকস্টার গেমসের জিটিএ ভাইস সিটি (Grand Theft Auto: Vice City) বা জিটিএ স্যান অ্যান্ড্রেস গেম আমাদের শৈশব দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সরাসরি গেমসে সম্পৃক্ত হবার এই যে আনন্দ, সেটা আর কোথাও নেই। তবে এই গেমগুলো ছিল থার্ড পার্সন ভিউ থেকে। যেখানে একটি ক্যারেক্টারের মাধ্যমে আমরা ইন্টারেক্ট করতাম।
এখানে এসে আলাপ একটু জটিল হতে চলেছে, ক্রমশ আরও গভীর হবে। সাধারণত যেকোনো বই, সিনেমা বা ভিডিও গেম ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভ ভিউ থেকে লেখা হয়, নয়তো থার্ড পার্সন। যারা ব্যাটল গ্রাউন্ড খেলেছেন, তাদের জন্য বিষয়টা বোঝা সহজ। এফপিপি (FPP) বা টিপিপি (TPP)- এই দুটো টার্মের মধ্যেই চিত্তবিনোদনের জগত সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ সীমাকে অতিক্রম করা যাবে না এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেননি ‘Choose your own Adventure’ বইয়ের লেখক রেমন্ড আলমিরান, এডওয়ার্ড প্যাকার্ড ও জো স্ট্রেচ। পাশার দান পাল্টে যায়, একজন ন্যারেটর পাঠকের সাথে কথা বলার ছলে গল্প গতি পায়, মোড় নেয়, দৌড়ায়।
ব্যাপারটা এরকম- ৮ নম্বর পাতায় গল্পের কোনো একটি চরিত্র বিপদে পড়েছে, তার সাহায্য দরকার। তখন পাঠকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে- তুমি যদি সাহায্য চাও? তবে ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় যাও। সাহায্য না চাইলে পরের পৃষ্ঠা থেকে পড়তে থাক। এখন পুরো বিষয় পাঠকের ইচ্ছাশক্তির উপর। একেই ‘ফ্রি উইল’ বলা হচ্ছে। পাঠক নিজেই ঠিক করছে এই মুহুর্তে গল্প কীভাবে মোড় নেবে। পেছনের গল্পটা এমন, যেখানে দু’ভাবেই গল্পটা লেখা আছে। পাঠক যেভাবে পড়তে চাইছে, সেভাবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এখানে এই আলাপের বিরতি থাকুক, আরও তিনটি অনুচ্ছেদের পর এই আলাপ গতি পাবে।
নন্দনতত্ত্বের ভেতর সিনেমা তার শিল্পীসত্ত্বায় অকৃত্রিম। সিনেমা নিয়ে তড়িঘড়ি, পালাবদলের গল্পও বেশ লম্বা; সেই গল্প যাকগে। সিনেমার ইনোভেশনে ইন্টারেক্টিভ ফিল্ম একেবারে আনাড়ি শোনালেও এর হাতেখড়ি ষাটের দশকে। গ্রাফ থিওরি ব্যবহার করে এরকম একটি চমকপ্রদ বিষয় চেক রিপাবলিকের ডিরেক্টর রাডুজ সিন্সেরা, ইয়ান রোহাক আর ভ্লাদিমির ভিটাচেক দাঁড় করিয়ে ফেলবেন- দূর এই অতীত অন্তত আমার জন্য রোমাঞ্চকর বটে।
পালাক্রমে এমন সিনেমা বানানোর চেষ্টা অনেক হয়েছে। খেই হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা ঘটেছে, চড়াই-উতরাই পার করে আমরা ভুলেই বসেছিলাম ষাটের দশক থেকে নব্বই, চেক রিপাবলিক থেকে নিউ ইয়র্কে ইন্টারেক্টিভ ফিল্ম সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থতার এই গ্লানি যদিও বাণিজ্যিক সিনেমার। ইন্টারেক্টিভ ফিল্মের জন্য সরঞ্জামের প্রয়োজন। যেখানে বাটন টিপে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে হয়, প্রথমদিকে সিনেমা হলে সেই পরিবেশ তৈরির জন্য আসনের হাতলেই ছিল দুটো করে বোতাম। কিন্তু সব সিনেমা তো আর ইন্টারেকটিভ না যেখানে একটা ক্লাইম্যাক্স পার্টে এসে পপ আপ হতো, জানতে চাওয়া হতো কী চান দর্শক, এবং সিনেমা হলের দর্শকেরা নিজেদের পছন্দমতো ভোট দিবেন। সেই ভোটের পাল্লা যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতটি ভারি হতো সেভাবেই হবে সিনেমার পরিনতি। ১৯৬৭ সালে ‘Kinoautomat: One Man and His House’ সিনেমার মাধ্যমেই দুনিয়া এই আশ্চর্য বিষয় দেখল।
একই ঘটনার যে কয়টি পরিণতি, তার মাঝে দুটি নিশ্চিত। ডান-বাম বা উপর-নিচের মতো সরাসরি বিভাজিত ঘটনায় এই চর্চা খাটানো যায়। তবে এই ধরনের সিনেমার সবচেয়ে মজার বিষয় এর স্টান্টবাজিতে, যেখানে দর্শককে গেলানো হচ্ছে সিনেমায় আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে, কিন্তু পরিণতিগুলো পূর্বনির্ধারিত। আপনাকে বার বার বলা হবে, আপনি যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ভেবে নিন, আপনার হাতেই সিনেমা। কিন্তু আসলে কি তা-ই? ক্যাথারসিস ছাড়া তো সার্থক ট্রাজেডি হয় না। কিন্তু ট্রাজেডির সেই মায়াকান্নার পর কি কখনোই সুখ নেই? অথবা সব কমেডির ইতিকথা, অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল, এরপরের দিনেই কি সেই সু্খ অব্যহত থাকে? এই সুখের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় কখন? দিনশেষে, সিনেমায় আমাদের অংশগ্রহণ থাকুক আর না থাকুক, সিনেমা স্রেফ বিনোদনের খোরাকই!
নিকট অতীতে এই ইন্টারেকটিভ ফিল্ম ফের আসার আলো দেখেছে নেটফ্লিক্সের হাত ধরে। কারণ সিনেমা হলের কালেক্টিভ ইউনিটির থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ, বেছে নেয়ার সক্ষমতার ইন্টারেক্টিভ সিনেমার চমক যে ঢের উপভোগ্য তা এতক্ষণে টের পাওয়া উচিত। ‘ব্ল্যাক মিরর: ব্যান্ডারস্ন্যাচ’ আমাদের সামনে তার চাক্ষুস প্রমাণ। সেখানেই শঙ্কা; প্রায় অর্ধ শতক পর আমরা এই ধারা নিয়ে ফের উৎসাহ পাচ্ছি, যার হদিস প্রায় ছিল না বললেই চলে।
“Choose your own Adventure” সিরিজটি প্রায় ১৮৪টি বইয়ের সমাহার। এর চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বেশ কিছু সম্ভাবনা তৈরি করে যা ‘Black Mirror: Bandersnatch’ এর মতো সিনেমার জন্ম দেয়। ফ্লো চার্টের লুপ হোল আমরা যদি দেখি, একটি ঘটনা ‘হ্যাঁ’ অথবা কোনোটি ‘না’ হলে তা পূর্বের কোনো ঘটনার কাছে ফিরে যায়। ইন্টারেকটিভ ফিল্মও এই কাজ করে চতুরতার সাথে। একটি সিদ্ধান্ত আমরা নেয়ার পর যদি সেটি কোনো একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তখন একে ভুল অথবা সিনেমার ভাষায় ‘goof’ মনে হতে পারে, কিন্তু সেটাকে দেজা ভ্যু হিসেবে দেখিয়ে পাশ কাটিয়েছে স্টিফেনের ব্ল্যাক মিরর। একপর্যায়ে তাই দেখা যায়, যেখানে পুরো সিনেমায় যে স্টিফেন হয়ে থাকে, সে শ্যুটিং স্পটে মাইক হয়ে যায়। সিনেমার প্লট আর সেটিং হলে ১৯৮৪ সালের হলেও কম্পিউটার স্ক্রিনে ভবিষ্যতের এক মানুষ জানান দেয়, স্টিফেনের জীবন আসলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নেটফ্লিক্সের এই গ্রাহকের দ্বারা। স্টিফেন বুঝতে পারে না কিছু। আবার এসব বুঝতে সে ব্যান্ডারস্ন্যাচ গেমের মালিক কোম্পানির একজনের সহযোগিতা পায়, কলিন রিটম্যান তাকে ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড জিহ্বায় দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে আমরা যা করি তা আসলে আমাদের করানো হয়। আমরা আসলে আমাদের সিদ্ধান্তগুলো একটি লুপের মধ্যে থেকেই করছি; এর দায় রাষ্ট্রের, সমাজের, সংস্কৃতির।
‘ব্যান্ডারস্ন্যাচ’ একটি বড়সড় প্রজেক্ট যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকদের জন্য একটি ইন্টারেক্টিভ চলচ্চিত্রের প্রথম সত্যিকারের আধুনিক পুনরাবৃত্তি। বিকল্প কাহিনির জন্য পুরো ঘটনাই স্বাভাবিক মনে হয় এবং দৃশ্যের পরিবর্তনগুলো নির্বিঘ্ন। টাইমার গণনা করে এবং দর্শক সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ডিফল্ট নির্বাচন হয়ে যাবে। টাইমার গণনা করার সময় চরিত্রগুলো কথা বলা চালিয়ে যায়, বাস্তব জীবনের চাপ অনুকরণ করে এবং আপনাকে আরও নিমজ্জিত করে।
ইন্টারেক্টিভিটির এই ধারণা দর্শকদের পছন্দের প্রভাবগুলোকে একটি ছলনা করার পরিবর্তে তাদের পরিবর্ধন করে। পছন্দের ফলাফলগুলো প্রায়শই অনির্দেশ্য। এমন সময় আছে যখন প্লটটি মনে হয় এটি আপনাকে একটি পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আসলে আপনাকে তা দেয় না, ভ্রান্তিতে ফেলে। “ব্যান্ডারস্ন্যাচ” ইন্টারেক্টিভ ফিল্ম ঘরানার সীমা এবং প্রত্যাশাগুলোকে ঠেলে দেয়। যেখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, তুমি আসলে কে? প্রোগ্রাম এন্ড কন্ট্রোলড? PAC!
ইন্টারেক্টিভ এই ধারণা আমাদের মনস্তত্ত্বকে দারুণভাবে প্রভাবিত করবে। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো সিনেমার জনরা বদলে দেবে। ভবিষ্যতের সিনেমা যদি সত্যিই ইন্টারেক্টিভ হয়ে যায়, যদি নেটফ্লিক্সের এই চারকোনা বাক্স হয়ে যায় আমাদের বিনোদনের জগত, তবে ‘ফ্রি উইল’ কি ফ্রি হবে? কারণ, এখানে যা কিছু ঘটে সবকিছু আমাদের উপর।
এই ঘরানার সিনেমা দেখার জন্য অবশ্যই ইন্টারেক্টিভ মিডিয়া প্লেয়ার লাগবে। সাধারণ মিডিয়া প্লেয়ারে এই সিনেমা আস্ত কতগুলো ক্লিপের খিচুড়িকল্প ছাড়া কিছুই মনে হবে না।