১৯১০, প্যারিস, ফ্রান্স।
নিজের ঘরে পায়চারি করছেন স্বনামধন্য কার্টিয়ের গহনা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম স্বত্বাধিকারী, পিয়েরে কার্টিয়ের (Pierre Cartier)। তার দাদা লুই ফ্রাঁসোয়া কার্টিয়ের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন এই ব্যবসা, তার মূলনীতি ছিল কার্টিয়েররা শুধু বড় পাথর নিয়েই কাজ করবে।
কিন্তু বাজার এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট আকারের রত্ন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু পিয়েরে আর তার ভাইরা এখনও লুই ফ্রাঁসোয়া’র তত্ত্ব থেকে সরে আসতে রাজি নন। এজন্য অতিসম্প্রতি বেশ বড় একটি হীরা কিনেছেন তিনি। এই টাকা তুলতে না পারলে দেনার দায়ে ডুবে যাবে তার কোম্পানি।
অবশ্য কার্টিয়ের সবদিক ভেবেই বিনিয়োগ করেছেন। ধনী এক মার্কিন দম্পতি তার টার্গেট। এদেরকে এই হীরা গছিয়ে দিতে পারবেন বলে তিনি স্থির নিশ্চিত। তবে কথা আছে, কেবল একটি রত্ন হিসেবে এই হীরার যা দাম তার থেকে অনেক বেশি উদ্ধার করতে হবে তাকে। কীভাবে, সেটাই চিন্তা করছেন তিনি।
হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন পিয়েরে। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার মুখ। এই হীরা, হোপ ডায়মন্ড যার নাম, তার সাথে জড়িয়ে আছে অভিশাপের গল্প। এই কাহিনী ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারলে এক ধাক্কায় হীরার দাম বেড়ে যাবে বহুগুণে।
প্রশ্ন উঠতে পারে- কেন অভিশপ্ত পাথর কিনতে আগ্রহী হবে কেউ? আশ্চর্য শোনালেও সত্যি বহু মানুষ এরকম একটি রত্নের জন্যে মোটা অর্থ ব্যয় করতে রাজি থাকেন। পিয়েরে যাদের কাছে হীরা বেচতে চাইছিলেন, সেই দম্পতি সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে ফলাও করে এই হীরের গল্প বলে বাহবা নিতে পারবেন, কাজেই তারা যে টাকা ঢালতে সংকোচ করবেন না এই বিশ্বাস পিয়েরের ছিলো।
হোপ ডায়মন্ড
ফ্রেঞ্চ ব্লু (French Blue) নামেও পরিচিত এই হীরার বর্তমান ওজন ৯ গ্রামের কিছু বেশি, ক্যারেটের হিসেবে ৪৫.৫২ ক্যারেট। তবে এই হীরার আসল সৌন্দর্য নিহিত এর অপূর্ব নীলাভ আভায়। পাশাপাশি এর সাথে জড়িয়ে আছে অভিশাপের গল্প। কিংবদন্তী আছে- রত্নপাথরগুলোর মধ্যে হোপ ডায়মন্ডের অভিশাপই সবচেয়ে ভয়ানক।
হোপ ডায়মন্ডের উৎপত্তি কিন্তু আমাদের ভারত উপমহাদেশে। ধারণা করা হয়, বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্তুর জেলার (Guntur) কল্লুর খনিতে (Kollur mine) (তৎকালীন গোলকুন্ডা রাজ্যের অন্তর্গত) পাওয়া গিয়েছিল এই হীরা। প্রথম অবস্থায় এর ওজন ছিলো ১১৫ ক্যারেট বা ২৩ গ্রাম। বিশাল এক হীরা বটে!
ভারত থেকে ফ্রান্স
১৬৪২ সালে ভারতে এলেন ফরাসী এক পর্যটক, জাঁ ব্যাপ্টিস্ত ট্যাভার্নিয়ের (Jean Baptiste Tavernier)। বহুগুণে গুণান্বিত ট্যাভার্নিয়ের কেবল অ্যাডভেঞ্চারারই নন, তিনি একজন গহনা ব্যবসায়ী এবং গল্প বলিয়ে। ১৬৪০ থেকে শুরু করে ২৭ বছর তিনি দুনিয়া প্রদক্ষিণ করে বেরিয়েছেন রত্নের খোঁজে। বলা হয়, তিনিই ভারতবর্ষ থেকে এই হীরা কিনে নিয়ে যান। ট্যাভার্নিয়েরের নিজের জবানীতে এর রঙ তখন ছিলো বেগুনী।
দেশে ফিরে এসে ফরাসি পর্যটক তৎকালীন রাজা চতুর্দশ লুইয়ের কাছে ১৪টি হীরার সাথে হোপ ডায়মন্ড বিক্রি করে দিলেন। রাজার নির্দেশে দরবারের স্বর্ণকার স্যার পিটাউ (Sieur Pitau) ১৬৭৩ সালে একে কেটে ছোট করেন। এবার হোপের ওজন দাঁড়ায় ৬৭ ক্যারেটের আশেপাশে।
রাজদরবারের নথিতে হোপ ডায়মন্ডের রঙ বর্ণনা করা হয়েছে তীব্র নীল, জনমনে এটি পরিচিতি পায় মুকুটের নীল হীরা (Blue Diamond of the Crown) বা ব্লু ডায়মন্ড হিসেবে। স্বর্ণখচিত একটি গহনায় বসানো হয় একে, যা নানা অনুষ্ঠানে রাজার পরিচ্ছদে শোভা পেত।
কিন্তু অভিশাপের কী হলো? চতুর্দশ লুইয়ের বৈধ সন্তানদের অনেকেই মারা যায় পূর্ণবয়সে পৌঁছার আগেই। রাজা নিজে গ্যাংগ্রিনে (শরীরে অংশবিশেষে অনিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ যার ফলে আক্রান্ত অঙ্গে পচন ধরে যায়) ভুগে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর সম্মুখীন হন। তার উত্তরসূরি পঞ্চদশ লুই হীরাটি দিয়ে দেন ছেলে, পরবর্তীতে ষোড়শ লুইকে। ষোড়শ লুই তার স্ত্রী মেরি অ্যান্তোনেটকে উপহার দেন এটি। রানী একটি নেকলেসে ঝুলিয়ে নেন হোপ ডায়মন্ডকে।
ফরাসি বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী হন লুই ও তার পরিবার। ১৭৯১ সালে রাজা-রানী পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়েন, তাদের সব সম্পদ এবার কেড়ে নেয় বিপ্লবী কাউন্সিল। হোপ ডায়মন্ডসহ রাজকীয় গহনাও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
বিপ্লবীরা সব গহনা ‘গার্ডে-মিউবল ডে লা কুরনে’ (Garde-Meuble de la Couronne) নামে এক গুদামঘরে জড়ো করে। সেখানে উপযুক্ত প্রহরার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। ফলে যা হবার তা-ই হলো, ১৭৯১ সালের ১২-১৬ সেপ্টেম্বরের মাঝে কোনো একসময়ে গুদাম লুট হয়ে যায়। ১৭ সেপ্টেম্বর কর্মকর্তারা লুটপাটের ঘটনা বুঝতে পারলেন। চিরুনি অভিযান চালিয়ে অধিকাংশ রত্ন উদ্ধার করে গেলেও হোপ ডায়মন্ড লাপাত্তাই থেকে গেলো।
হীরা হারালেও অবশ্য ফরাসি রাজা-রানীর দুর্ভাগ্য শেষ হয়নি। ১৭৯৩ সালে প্রহসনমূলক বিচার শেষে প্রাণদণ্ডের আদেশ হয় তাদের। প্রথমে লুই এবং কয়েকদিন পর মেরিকে প্রকাশ্যে তোলা হয় গিলোটিনে।
হোপ ডায়মন্ডের পুনরাবির্ভাব
১৮১৩ সালে লন্ডনের গহনাবাজার সরগরম হয়ে ওঠে ৪৪ ক্যারেট ওজনের এক হীরার আগমনে। ১৮২৩ সাল নাগাদ ড্যানিয়েল এলিয়াসন নামে এক ব্যবসায়ী এর মালিক হন। যদিও এই হীরাই হোপ ডায়মন্ড কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে অধিকাংশ মতে ফ্রেঞ্চ ব্লু আর এই হীরা একই ছিলো।
ড্যানিয়েল এলিয়াসন হীরে ধরে রাখেননি। তিনি এই রত্ন বিক্রি করে দেন ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ জর্জের কাছে। এরপর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েন রাজা, ১৮৩০ সালে মৃত্যুকালে দেনার দায়ে নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। পাওনা পরিশোধ করতে তিনি হোপ ডায়মন্ড বিক্রি করে দেন বলে মনে করা হয়। এরপর আবার প্রায় নয় বছর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় এই হীরা।
১৮৩৯ সালে পুনরায় খোঁজ পাওয়া গেলো হোপ ডায়মন্ডের, হেনরি ফিলিপ হোপের সংগ্রহশালায়। সম্ভবত ধনবান এই ভদ্রলোকই চতুর্থ জর্জের থেকে কিনে নিয়েছিলেন এই হীরা, যদিও এর কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি। ফলে লেনদেনের পরিমাণ কেমন তা-ও অজানা। হোপের নামেই এরপর পরিচিত হতে থাকে হীরাটি।
হোপ ছিলেন চিরকুমার। ১৮৩৯ সালে মৃত্যুকালে তিন ভাগ্নের মধ্যে তার সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যান তিনি। হোপ ডায়মন্ড পড়ে তার জ্যেষ্ঠ ভাগ্নে, হেনরি থমাস হোপের ভাগে। এই ভাগাভাগির সময়েই মূলত হোপ ডায়মন্ড আবার জনসমক্ষে চলে আসে।
১৮৬২ সালে ৫৪ বছর বয়সে হেনরি থমাস হোপ মারা যান। হোপ ডায়মন্ড রয়ে যায় তার স্ত্রীর কাছে। তার নাতি লর্ড ফ্রান্সিস হোপ দাদির থেকে লাভ করেন এই হীরা। তবে দাদী কেবল তাকে নন, অন্য নাতি-নাতনিদেরও হীরার অধিকার দিয়ে যান।
ফ্রান্সিস জুয়া খেলা আর বাজে খরচে আসক্ত ছিলেন। টাকাপয়সা খুইয়ে তিনি হোপ ডায়মন্ড বিক্রি করতে মনস্থ করেন। যেহেতু ভাইবোনেরাও এর দাবিদার, তাই তারা যাতে ঘাপলা করতে না পারে সেজন্য ১৮৯৮ সালে তিনি এই হীরা বিক্রির জন্য কোর্টের দ্বারস্থ হন।
প্রথমে আদালত অনুমতি দেননি। তবে শেষপর্যন্ত বহু ধরাধরি করে হোপ ডায়মন্ড বিক্রি করতে সবাইকে রাজি করেন ফ্রান্সিস। প্রথমে লন্ডনের এক ব্যবসায়ী কিনে নেন হীরা, এরপর হাতবদল হয়ে তা চলে যায় নিউ ইয়র্কে সাইমন ফ্র্যাঙ্কেলের কাছে। হীরার ব্যবসায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন এই ভদ্রলোক।
সাইমন পরে হোপ তুলে দেন তুরস্কের এক সংগ্রাহক, সেলিম হাবিবের হাতে। বলা হয়, তাকে অর্থ যুগিয়েছিলেন উসমানী সুলতান আবদুল হামিদ। উসমানীদের সর্বশেষ এই সুলতান পদচ্যুত হবার ঠিক আগে ১৯০৯ সালে সেলিমকে দিয়ে প্যারিসে নিলামে তোলেন হোপ ডায়মন্ড।
নিলামে কেউ কেনেনি এই হীরা। তবে নিলামের পর পরই ফরাসি ব্যবসায়ী রস্নাউ দাম হেঁকে হাত করে ফেলেন হোপ। ১৯১০ সালে প্রায় অর্থ মিলিয়ন ফ্রাঁ’র বিনিময়ে (বর্তমান হিসেবে প্রায় ২.২ মিলিয়ন ডলার) পিয়েরে কার্টিয়ের তার থেকে হোপ ডায়মন্ড কিনে নেন।
ততদিনে হীরের সাথে জড়িত অভিশাপের গল্প ডালপালা ছরিয়েছে। জনশ্রুতি রটেছে হীরার প্রথম মালিক ট্যাভার্নিয়ের নৃশংস মৃত্যুর, চতুর্দশ লুইয়ের যন্ত্রণাদায়ক জীবনাবসান, এবং গিলোটিনে ষোড়শ লুই আর মেরি’র প্রাণদণ্ড, রাজা জর্জের দারিদ্র্য, ফ্রান্সিস হোপের দেনা সবই নাকি হীরের খেল। এর সাথে যুক্ত হয়েছে হোপ ডায়মন্ডের সাথে জড়িত মানুষদের দুর্ভাগ্যের গুজব।
কার্টিয়েরের পরিকল্পনা
ফ্রান্সে কার্টিয়ের বড় নাম হলেও পিয়েরে ও তার ভাই জ্যাকুইস আর লুই চাইছিলেন বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বিস্তৃত করতে। তাদের প্রথম লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ১৯১০ সালেই নিউ ইয়র্কে দোকান খুলেছিলেন। তারা জানতেন ধনী অনেক মার্কিন নারী মুখিয়ে থাকবেন হোপ ডায়মন্ড কেনার জন্য। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, তৎকালীন সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্র বলে পরিচিত প্যারিস থেকে আনা একটি মহামূল্যবান আর অভিশপ্ত হীরা বন্ধুবান্ধবদের দেখিয়ে ঈর্ষা উদ্রেক করা।
কার্টিয়ের মোটেই অভিশাপ নিয়ে বিচলিত ছিলেন না। তার প্রখর ব্যবসাবুদ্ধি বরং একে একটি সুযোগ হিসেবেই দেখেছিলো। অভিশাপের নাম ভাঙিয়ে হীরার দাম আকাশে তুলে ফেলতে পারবেন তিনি।