ছোটবেলায় একা একা বাইরে ঘুরতে যেতে চাইলে কিংবা বাইরে চলাফেরায় সতর্ক হতে বাবা-মা প্রায়সময়ই আমাদের বলতেন, “ছেলেধরা নিয়ে যাবে কিন্তু!” “ছেলেধরা কী করবে?” জানতে চাইলে তারা জানাতেন, “তোমাকে অজ্ঞান করে ধরে নিয়ে যাবে। এরপর আমাদের আর দেখতে পাবে না। পরে তোমার চোখ, কিডনি এইসব কেটে বিক্রি করে দেয় ওরা!”
বাবা-মা ছাড়াও পরিবারের অন্যান্য মুরব্বির কাছ থেকে এমন সাবধানবাণী শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই আছে। পরবর্তীতে বড় হয়ে পত্রপত্রিকা পড়ে আর টেলিভিশন দেখে আমরা বুঝতে শিখেছি যে, এসব আসলেই সত্য। আজ তাই চলুন বৈশ্বিক পটভূমিতে মানবদেহের অঙ্গ পাচারের এমনই কিছু রোমহর্ষক কাহিনী সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
১
২০০৪ সালের কথা। মোজাম্বিকে অবস্থান করছিল ব্রাজিলিয়ান খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের একটি দল, নাম সার্ভেন্টস অফ মেরি ইম্যাকুলেট। তারা জানায়, মোজাম্বিকে কাজ করা মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানকারী একটি দলের সন্ধান পেয়েছে তারা। চোরাচালানকারীদের হাতে নির্যাতিত বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলে তারা নিখোঁজ হওয়া বেশ কিছু শিশুর ব্যাপারেও জানান। তারা সবাই সেই চোরাকারবারিদের হাতে ধরা পড়েছিল। এরপর তাদেরকে হত্যা করে পাচার করা হয়েছিল তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এমনকি দুর্ভাগা সেই শিশুগুলোর জননাঙ্গ পর্যন্ত কেটে নিয়েছিল দুর্বৃত্তরা, উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে যৌনশক্তিবর্ধক হিসেবে সেসব বিক্রি করা!
এর পরপরই বিপর্যয় নেমে আসে সেই ধর্মপ্রচারকারী দলটির নানদের উপর। সিস্টার ডোরাচি এডিঙ্গারকে নিজ গৃহে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। অন্যান্য নান এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিয়মিত হুমকি দিতে শুরু করে পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। মারিয়া এলাইডা দস সান্তোস নামে আরেক নান তো দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযান চালায় ঠিকই, তবে তারা কোনো অপরাধী চক্রের সন্ধান পায়নি বলেই দাবি করে, নানদের মতে যা ছিল অপরাধীদের আড়াল করতে সরকারের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। ২০১৬ সালে তারা আবারও আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন অনুসন্ধান পুনরায় শুরু করতে, কিন্তু সেটা আজও হয়নি।
২
২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হেগের সাবেক প্রসিকিউটর কার্লা ডেল পন্টের আত্মজীবনী। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, বেশ কয়েক ডজন সার্ব বন্দীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কসোভো লিবারেশন আর্মির সদস্যরা। তাদেরকে নিয়ে রাখা হয় ‘ইয়েলো হাউজ’ নামে পরিচিত এক খামারবাড়িতে, উদ্দেশ্য বন্দীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার করে দেয়া। তার ভাষ্যমতে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের জুন থেকে পরবর্তী বছরের মে মাসের মধ্যবর্তী সময়কালে, যা ছিল কসোভো যুদ্ধের ঠিক পরবর্তী সময়ের কথা।
এরপর শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধান পর্ব। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানের ব্যাপারে শক্ত প্রমাণ তাদের হাতেও এসেছে। তবে তারা জানায়, যতটা বড় আকারে বলা হচ্ছে সেই মাত্রায় আসলে পাচারের ঘটনা ঘটেনি। তারা ১০ জনের সাথে এমনটি ঘটেছিল বলে জানায়।
পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক প্রমাণই নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল, নির্লজ্জভাবে এ ব্যাপারটিকে অস্বীকার করেছিলেন কসোভো সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় তাই কারোরই বিচার হয়নি।
৩
আবারো ২০০৯ সালেই ফেরত আসা যাক। দুর্নীতিবিরোধী এক অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি থেকে গ্রেফতার করা হয় ৪৪ জনকে। তাদের মাঝে ৫ জন র্যাবাই (ইহুদি পণ্ডিত), ৩ জন মেয়র এবং নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সি এলাকার বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন।
এতজনের মাঝে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছিলেন লেভি ইজহাক রোজেনবাম নামক এক র্যাবাই, যিনি প্রায় এক দশক ধরে অঙ্গ পাচারের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।
‘জাতীয় অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৮৪’ অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবদেহের অঙ্গ বেচাকেনা বন্ধ করা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। তবে এ আইনভঙ্গের অপরাধে পুলিশের হাতে আটককৃতদের মাঝে রোজেনবামই প্রথম।
রোজেনবাম টার্গেট করতেন মূলত ইসরায়েলের দারিদ্র্যপীড়িত নারী-পুরুষদের। তাদের কাছে গিয়ে তিনি প্রস্তাব দিতেন ১০,০০০ ডলারের বিনিময়ে তাদের কিডনি তার কাছে বিক্রি করে দিতে। পরবর্তীতে সেই কিডনিই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এনে বিক্রি করতেন ১,৬০,০০০ ডলারে!
নিজেকে ‘কিডনির রবিনহুড’ হিসেবে দাবি করা রোজেনবামের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় ২০১১ সালে। পরবর্তীতে তাকে এজন্য আড়াই বছর জেলও খাটতে হয়েছিল।
৪
২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ইতালির পুলিশ বাহিনী তখন ছদ্মবেশে কাজ করে যাচ্ছিল মাদক চোরাচালানকারীদের ধরতে। এমন সময়ই তাদের পরিচয় ঘটে ইউক্রেনীয় ৩ নারীর সাথে, যাদের মাঝে একজন ছিল আবার অন্তঃসত্ত্বা দেহব্যবসায়ী। সেই মহিলা তাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, তারা তার ’৫ মাস বয়সী পার্সেল’কে নিতে আগ্রহী কিনা! অর্থাৎ সেই মহিলা আসলে ভূমিষ্ঠ হবার পর আপন সন্তানকেই বিক্রি করে দিতে চাচ্ছিল। এরপর নিজের গর্ভজাত সন্তানের কী হবে, তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সাদা পোশাকের সেই পুলিশদের তিনি কিন্তু সরাসরি বাচ্চা বিক্রির প্রস্তাব দেননি। বরঞ্চ তিনি তাদেরকে একটি নিলামে অংশ নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেখানে যে সর্বোচ্চ দর হাঁকবে, তার কাছেই সন্তান বিক্রির পরিকল্পনা ছিল সেই মহিলার। এ যেন মানবতার এক চরম অবমাননা।
সন্তান জন্মের পর যথাসময়ে নিলাম শুরু হয়ে গেল। ভিত্তিমূল্য ছিল ৫০,০০০ ইউরো। সেদিন সাদা পোশাকের পুলিশ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি পক্ষ হাজির হয়েছিল। অপর পক্ষগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল বাচ্চাটিকে কিনে হত্যা করে তার প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গগুলো নিয়ে নেয়া। সবার মূলত নজর ছিল হৃৎপিণ্ড ও যকৃতের প্রতি। তাই অল্প সময়ের মাঝেই দাম বাড়তে বাড়তে ছুঁয়ে ফেললো ৩,৫০,০০০ ইউরোর সীমানা। অবশ্য এ দাম হাঁকিয়েছিল সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাই, যাতে করে অন্যরা বাচ্চাটিকে কিনে নিয়ে তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে না পারে।
শেষপর্যন্ত বাচ্চাটি তাদের হস্তগত হওয়া মাত্রই তারা বাচ্চার মা সহ অপর দুই নারীকে গ্রেফতার করে। এছাড়া নিলামে অংশ নেয়া প্রত্যেককেই পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
৫
এবার আসা যাক বর্তমান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসের কথা। দেশটির আনহুই প্রদেশের বাসিন্দা লিউ নাম্নী এক মহিলা একদিন খেয়াল করলেন যে, তার ছেলে জিয়াও ঝেং হঠাৎ করে কোত্থেকে যেন আইফোন ও আইপ্যাড যোগাড় করে দিনরাত ওগুলো নিয়েই পড়ে থাকছে। মায়ের মন বলে কথা। সাথে সাথেই সন্দেহ হলো তার, নিশ্চয়ই কোথাও কোনো ঘাপলা আছে। তাই তিনি ছেলের কাছে জানতে চাইলেন কোথা থেকে সে এত দামি জিনিস এনেছে, কারণ তাদের পরিবারের পক্ষে এগুলোর ব্যয়ভার বহন করা ছিল প্রায় অসম্ভব। মায়ের জেরার মুখে পড়ে আর সত্য লুকিয়ে রাখতে পারলো না ঝেং, জানালো নিজের কিডনি বিক্রি করে এরপরই এসব কেনার অর্থ যোগাড় করেছে সে!
ছেলের মুখে এমন কথা শুনে মায়ের তো আক্কেলগুড়ুম হবার দশা। সাথে সাথেই তাই তিনি পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলেন। পুলিশের জেরার মুখে ঝেং স্বীকার করতে বাধ্য যে, অনলাইনে এক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তার। তিনিই তাকে একটি কিডনির বিনিময়ে ২০,০০০ ইউয়ান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর সেখান থেকে প্রায় ৭৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চেনঝৌ শহরে দেখা করে তারা। স্থানীয় এক হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে ছেলেটির কিডনি সংগ্রহ করা হয়, তবে সেই অপারেশনটি হাসপাতালের কোনো ডাক্তার করেনি। এক ব্যবসায়ী পুরো জায়গাটি কিছু সময়ের জন্য ভাড়া নিয়ে সকলের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছিলেন। সেই সময়েই অপারেশনের কাজ সারা হয়। পুলিশের পক্ষে শেষপর্যন্ত সেই ব্যবসায়ীকে আটক করা আর সম্ভব হয়নি।
৬
এবার কথা হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের (!) দেশ মেক্সিকো নিয়ে। মাদক চোরাকারবারের সাথে যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের এক স্বর্গরাজ্য যেন এ দেশটি। বিভিন্ন দলই সেখানে সক্রিয় রয়েছে মাদক পাচারের কাজে। ’নাইটস টেম্পলার’ও তেমনই একটি দল। মজার ব্যাপার হলো, মাদক পাচারের সাথে যুক্ত থাকলেও দলটি তাদের সদস্যদের জন্য ২২ পৃষ্ঠার একটি নীতিমালা তৈরি করে রেখেছে, যা এর সদস্যদেরকে অবশ্যই মেনে চলতে হয়। ‘দ্য কোড অফ দ্য নাইটস টেম্পলার অফ মিচোয়াকান’ নামে পরিচিত সেই নীতিমালা অনুসারে এর সদস্যদেরকে লাভের উদ্দেশ্যে খুনোখুনি না করা থেকে শুরু করে নারী ও শিশুদের উপর কোনোরকম মাদকদ্রব্য প্রয়োগ না করা এবং কোনোরুপ ক্ষতি না করার ব্যাপারে শপথগ্রহণ করতে হয়। অবশ্য এর কতটা যে তারা মেনে চলে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে, কারণ আজকের আলোচ্য বিষয় অঙ্গ পাচারের সাথেও যে তাদের নাম এসে যাচ্ছে!
দূর্নীতি ও মাদক চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যে মেক্সিকোতে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। তাই জনগণ অনেকসময় নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। ডাক্তার হোসে ম্যানুয়েল মিরেলেস তেমনই একজন। ২০১৪ সালে এমভিএস রেডিওতে তিনি তাদের এক সাফল্যের কাহিনী শুনিয়েছিলেন এই নাইটস টেম্পলারদের বিরুদ্ধেই।
মেক্সিকো সিটির একটি স্কুল থেকে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে অপহরণ করেছিল নাইটস টেম্পলারের সদস্যরা। এরপর তাদেরকে কম্বলে মুড়ে হিমায়িত কন্টেইনারে ভরে ভ্যানে চালান করে দেয়া হয়। সৌভাগ্যবশত গাড়ির চালক রাস্তা ভুল করে এসে পড়ে সেখান থেকে ৩৯১ কিলোমিটার দূরে ডাক্তার হোসের শহর তেপালকেটপেকে। স্থানীয় জনগণ ভ্যানটিতে হামলা চালিয়ে উদ্ধার করে সেইসব ছেলেমেয়েকে।
৭
আজকের কাহিনীর ইতি টানা যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি কাহিনী দিয়েই। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সোলানো স্টেট প্রিজন হলো একটি মধ্যম স্তরের নিরাপত্তা সম্বলিত জেলখানা। ২০১৫ সালের ৪ঠা মে’র কথা। সকাল বেলায় হঠাৎ করেই জেলখানায় বন্দীদের মাঝে শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা-হাঙ্গামা। প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পর পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এরপর যখন বন্দীদের সংখ্যা গণনা শুরু হয়, তখন দেখা গেলো নিকোলাস রড্রিগেজ নামে একজন কম আছে। কর্তৃপক্ষ ধরে নিলো যে নিকোলাস পালিয়ে গেছে।
পনের ঘণ্টা পর অবশেষে নিকোলাসের সন্ধান পাওয়া যায়; তবে জীবিত নয়, মৃত। তার কক্ষ থেকে অল্প দূরেই একটি আবর্জনা রাখার পাত্রে খুঁজে পাওয়া যায় নিকোলাসের দ্বিখণ্ডিত লাশের সন্ধান। ময়নাতদন্তে জানা যায়, তার দেহাভ্যন্তরের বেশ কিছু অঙ্গই চুরি হয়ে গেছে!
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে জেলখানার ভেতরে কীভাবে এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলো, কীভাবে নিকোলাসের অঙ্গগুলো পাচার হয়ে গেলো সেই রহস্যের জট পুলিশ আজও খুলতে পারেনি।
Featured Photo: TXK Today