প্রযুক্তিখাতে চীন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে অনেকেরই ধারণা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে চীন প্রায় সব খাতেই আমেরিকাকে হারিয়ে দিতে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ অর্থনীতির মূল কারিগর এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার হয়তো চীনের উপরই আসবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি বিপ্লবে আমেরিকা দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকাতে উন্নত মানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, এয়ারপোর্ট, প্রতিভায় ভরপুর বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেখানে আছে আধুনিক প্রযুক্তিতে ভরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ব্যবসার দিক দিয়ে আমেরিকার সাথে এখন অন্য কারোর তুলনা করাটাই বোকামি। বিশেষ করে সিলিকন ভ্যালির সাথে কারোরই তুলনা হয় না। অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করছেন, চীন যেভাবে তাদের রপ্তানি এবং উৎপাদনের দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে তারা জিডিপির দিক দিয়ে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। কারণ ২০১১ সালের মধ্যে এই দুটি খাতে চীন অবিশ্বাস্য উন্নতি করেছে এবং নিজেদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। কিন্তু সিলিকন ভ্যালির পর্যায়ে যেতে আরও কিছু সময় লাগতে পারে। কারণ সর্বোত্তম নতুন কিছু করার চিন্তা এবং ক্ষুধার্ত সব উদ্যোক্তাদের ভিড় সিলিকন ভ্যালিতে। সুযোগ সুবিধারও কোনো অভাব নেই। বলতে গেলে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে মেধাবীদের ভিড় এই সিলিকন ভ্যালিতে এবং এর সাথে আছে টাকার বৃষ্টি।
গত বিশ বছরে চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথা ছিল না। কারণ স্পষ্ট। চীনকে গত দুই বা তিন দশকে মনে করা হচ্ছিলো কপিক্যাট করার দেশ, যারা শুধু অন্যান্য দেশের প্রযুক্তি পণ্যগুলোর অনুলিপি করে আরও সস্তায় বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছিলো। এজন্যই চীনের পণ্যগুলোকে একটু তাচ্ছিল্যতার সাথে সাধারণ মানুষ “চীনা মাল” বলতেও ছাড়েনি। এছাড়া তাদের আরেকটি দোষ ছিল বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি এবং শিল্প কারখানায় গুপ্তচর পাঠানো। কিছু দিন আগে পর্যন্তও চীনে এমন সব প্রযুক্তিগত পণ্য তৈরি হচ্ছিলো যেগুলো চীনের বাইরের রপ্তানি করা যায়নি। এজন্য তাদের “Tech Galapagos”– বলা হয়েছিলো। কিন্তু ধূর্ত চীন তাদের সমস্যা বুঝতে পেরেছে। তারা এখন মৌলিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে যে কারণে খুব দ্রুত তারা তাদের পণ্যের বাজার তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে হুয়াওয়ে। সিলিকন ভ্যালি থেকেই একটি বার্তা এমন এসেছে যে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার লড়াইয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে ফেলার জন্য যেভাবে চীন এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রযুক্তিখাতে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য এবং ঔদ্ধত্যের শেষের শুরু হতে বেশী সময় বাকি নেই।
কয়েকটি দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দিচ্ছে চীন। যেমন আলিবাবা এবং টেনসেন্ট এর কথা ধরা যাক। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে Conglomerate অর্থাৎ অনেকগুলো বহুজাগতিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। আলিবাবা যুক্তরাষ্ট্রের এলফাবেট, ওয়ালমার্ট, আমাজন, ই-পে এগুলোর তুলনায় অনেক বেশি বাণিজ্য বাজার তৈরি করে ফেলেছে। ২০১৫ সালে আলিবাবা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে যা কামিয়েছে সেটা ওয়ালমার্ট, আমাজন এবং ই-পে এর সমষ্টিগত আয় থেকেও বেশি ছিল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বাজারের যে আয় হয়েছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি আয় করেছে আলিবাবা। আবার টেনসেন্টও ফেসবুককে টক্কর দিচ্ছে। ভালো লড়াই জমে গিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। এছাড়া চীন চালু করেছে ট্যাক্সি রাইড সেবা ডিডি চাকজিং, অনলাইনে টাকা বদলের সুবিধা নিয়ে তৈরি হয়েছে Ant Financial– যেখান থেকে আলি-পে নামক একটি সেবা পে-পালের আয়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় Online Payment System হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। এছাড়া আরও আছে লুফাক্স যেটা অনলাইনে পিয়ার টু পিয়ার অর্থ আদান প্রদানের সেবা চালু করেছে। চীনের ই-কমার্স যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক সক্রিয়। চীনের ই-কমার্স থেকে যত বিক্রি হয় তা যুক্তরাষ্ট্রের ই-কমার্স থেকে বিক্রির তুলনায় দ্বিগুণ এবং মোবাইল ব্যবহার করে চীনারা যত টাকা আদান-প্রদান করছে তা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ১১ গুণ বেশি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে এখনও টাকা আদান-প্রদানের জন্য চেক ব্যবহার করা হয়।
উদ্যোক্তাসমৃদ্ধ অর্থনীতির দিকে এখন চীন ঝুঁকেছে। উদ্যোক্তাদের জন্য কাজের যে নীতিমালা চীন তৈরি করেছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। Venture-capital বলে অর্থনীতিতে একটি কথা আছে যার মানে হচ্ছে উদ্যোক্তারা যদি তাদের নিজেদের স্টার্ট আপ কোম্পানি খুলে চায় তাহলে বিনিয়োগকারীরা তাদেরকে বিনিয়োগ করবে। এই বিনিয়োগ কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে হতে পারে বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হতে পারে। চীনে যে উদ্যোক্তাদের বাজার তৈরি হচ্ছে তা মূলত প্রযুক্তি কেন্দ্রিক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে এ উদ্যোক্তারা কাজ করছে। গত বছর তাদের সরকার ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিবে। তারা এখন স্মার্ট শহর বানাচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থায় চালকবিহীন গাড়ি তৈরির শিল্প তৈরি করছে এবং সাথে সাথে প্রযুক্তিগত আরও উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সেই দিকেও নজর দিচ্ছে। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণার জন্য প্রচুর আর্থিক তহবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকার থেকেও এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৬০ সালের দিকে জাপানে যে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। তাদের সরকার যেভাবে উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছিলো এবং জাপানের মানুষরা সরকারের সেই প্রচেষ্টাকে যতটুকু গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলো, চীনের বেলাতেও এখন সেরকমই কিছু ঘটছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা এখন অনেক আর্থিকভাবে লোভনীয়। কারণ এক যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় সাত মিলিয়ন চাকরি তৈরি হয়ে গিয়েছে যেখানে পুরো দেশের গড় বেতনের থেকেও বেশি বেতনে ঘরে থেকে কাজ করা যায়। এমনকি বিভিন্ন শিল্প কারখানাগুলো যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে সেই ব্যবহারের ফলেও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক ব্যবসা করতে পারছে। প্রতি বছর শুধুমাত্র প্রযুক্তিখাতেই যত টাকা বাইরে থেকে আমেরিকাতে প্রবেশ করে অনেক দেশের রিজার্ভ ব্যাংকেও সেই পরিমাণ টাকা থাকে না। এছাড়া বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য, যেমন হার্ডওয়্যার বানানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে যে নিয়ম তৈরি করেছে তা সারা বিশ্বে ব্যবহার করা হয়। তো এই কপিরাইট থেকেও আয়ের পরিমাণ কম নয়।
চীনও এসব দিক দিয়ে কম যাচ্ছে না। Sinovation ventures নামক একটি Venture-capital প্রতিষ্ঠান আছে, যেটা প্রায় ৩,০০০ অন্যান্য টেক কোম্পানির সাথে একত্রে কাজ করছে। হুয়াওয়ে, যেটা চীনের সবচেয়ে বড় হার্ডওয়ার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বাধাহীন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
এটা অনস্বীকার্য যে, চীন এখনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশ পিছিয়ে আছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। কিছু পরিসংখ্যান দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে আমেরিকার ৪২% পর্যন্ত চীন পৌঁছাতে পেরেছে, যেটা ২০১২ সালে ১৫% ছিল। আমেরিকায় প্রযুক্তি ছাড়া অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো নিজেদের সবকিছু আধুনিক প্রযুক্তির আওতায় এনে ফেলতে চাইছে, যেটা চীনের ক্ষেত্রে মাত্র ২৬%। এছাড়া Semi-conductor এবং Business Software তৈরিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় দুর্বল।
তবে আগেই বলা হয়েছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশী পিছিয়ে নেই। সংখ্যা দিয়ে যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যায় যে, ই-কমার্স এর দিক দিয়ে আমেরিকার ৫৩% পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে চীন, Venture-capital এর দিক দিয়ে তা ৮৫%, গবেষণার দিক দিয়ে বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে চীন এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গবেষণা জার্নালের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যাবে খুব উন্নত গবেষণা সংবলিত প্রবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে চীন থেকে, যেটা আমেরিকার ৮৯% এর সমান। Face++, যেটা কোনো কিছু দেখে শনাক্তকরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি কোম্পানি এবং iFlytek যেটা মানুষের আওয়াজ শনাক্তকরণ এবং বিশ্লেষণ করে, এমন সব Artificial Intelligence (AI) প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে চীনে এবং প্রতিটি AI সম্বলিত গবেষণা চীনের ভিতরে অর্থাৎ ঘরে বসেই হচ্ছে।
আগে থেকেই মনে করা হচ্ছিলো, ভবিষ্যতে এশিয়া হবে মূল অর্থনীতির কাণ্ডারি। হয়তো এই কাণ্ডারির চালিকাশক্তি হতে পারে চীন। এটা অনস্বীকার্য যে, বেশি সুযোগের কারণে মেধাবীদের ভিড় আমেরিকাতে বেশি দেখা যায়। কিন্তু চীনও নিজেদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য যেভাবে উন্নত গবেষণা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতি নজর দিচ্ছে এবং সফল বিনিয়োগ করছে, তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারবে।
ফিচার ইমেজ: CGTN.feature-image.com