৮০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার লোকজন দলবদ্ধ হয়ে পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের দ্বীপগুলোতে হামলা চালাতো দামী জিনিসপত্র লুট করার আশায়। সমুদ্রপথে যাত্রাকারী এই যোদ্ধাদের একসাথে ভাইকিং বলা হয়। ভাইকিংদের তখন কোনো নির্দিষ্ট দেশ ছিল না, বা তারা একটি জাতি হিসেবেও ছিল না। তারা ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। ভাইকিংরা বেশিরভাগ ছিল বর্তমান সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ইত্যাদি অঞ্চলের বাসিন্দা। কিছু ভাইকিংদের বসবাস আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়াতেও ছিল বলেও জানা যায়।
প্রায় তিন শতক ধরে পুরো ইউরোপ, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং নিউফাউন্ডল্যান্ড জুড়ে ভাইকিংদের দাপট বজায় ছিল। এই ৩০০ বছর ইতিহাসবিদদের কাছে ভাইকিং এজ নামে পরিচিত। অনেকের মতে, ভাইকিংদের জনসংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো বলে তারা অন্য দেশে হামলা চালাতো। কিন্তু ভাইকিংরা কখনো জমি দখলের উদ্দেশ্যে হামলা করত না। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আকস্মিক হামলা করে মূল্যবান জিনিসপাতি নিয়ে ফিরে আসা। সেসময় ভাইকিংদের মূল লক্ষ্য থাকতো সাগর তীরবর্তী ইংল্যান্ডের খ্রিস্টধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, এগুলোতে অনেক দামী জিনিস, যেমন- রূপা মজুদ থাকতো, আর সেসবের থাকতো না কোনো বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা।
ভাইকিংদের আর পরিচয় কী ছিল, সেটি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্নমত রয়েছে। কারো কাছে ভাইকিংরা হচ্ছে জলদস্যু, কারো কাছে ব্যবসায়ী, আবার কারো কাছে অসভ্য জাতি। ভাইকিংদের নিয়ে ইতিহাসবিদদের ব্যাপক আগ্রহ এখনো বজায় আছে। ভাইকিং যুগের খুব কমই লিখিত দলিল পাওয়া গেছে, তাই তাদের নিয়ে এখনো গবেষণা করে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি এমনই একটি গবেষণায় নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে ভাইকিংদের নিয়ে। কিছু গবেষক ধারণা করছেন, ভাইকিংদের কিছু লোক হয়তো মুসলিম ছিল। ভাইকিংরা কি আসলেই মুসলিম ছিল? সেটি আপনাদের সামনে তুলে ধরতেই আজকের লেখাটি।
সুইডেনের একজন গবেষক সম্প্রতি ভাইকিংদের সমাধিস্থ করা হতো এমন একটি নৌকায় শেষকৃত্যে ব্যবহৃত একটি কাপড়ে আরবি লেখা পেয়েছেন। এই আবিষ্কার স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় ইসলামের প্রভাব নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই কাপড়গুলো প্রায় ১০০ বছর ধরে সংরক্ষিত আছে এবং ভাইকিংদের সাধারণ ব্যবহারের কাপড় মনে করে সেগুলো নিয়ে খুব একটা নাড়াচাড়া করেননি কেউ। কিন্তু সম্প্রতি সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যানিকা লারসন কবর হিসেবে ব্যবহৃত নৌকা থেকে উদ্ধার করা এই কাপড়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ‘আল্লাহ’ এবং ‘আলী’র নাম সুতা দিয়ে খোদাই করা দেখতে পান। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভাইকিং নারী এবং পুরুষদের সমাধি হিসেবে ব্যবহৃত এই নৌকাগুলো উদ্ধার করা হয়েছিলো সুইডেনের উপসালা থেকে।
লারসন এই কাপড়গুলো নিয়ে লারসন গবেষণা শুরু করেন তখন, যখন তিনি বুঝতে পারেন কাপড়গুলো স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় তৈরি নয়, বরং এগুলো তৎকালীন মধ্য এশিয়া, পারস্য অথবা চীনে তৈরি হতে পারে। লারসন বলেন,
“১.৫ সেন্টিমিটারের (০.৬ ইঞ্চি) উচ্চতার ক্ষুদ্র জ্যামিতিক ডিজাইনগুলি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কোথাও এর আগে আমি কখনো দেখিনি।”
“প্রথমদিকে ডিজাইনগুলো আমি কোনোমতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারপর আমার মনে হলো, কোথায় জানি এমন ডিজাইন দেখেছি। তারপর মনে পড়লো, স্পেনের মুরিশ টেক্সটাইলগুলোতে।”
লারসন বুঝতে পারেন, তিনি কোনো সাধারণ ভাইকিং নিদর্শন দেখছেন না, বরং তিনি দেখছিলেন প্রাচীন আরবি লিপি। প্রথমে তিনি তাতে কী লেখা আছে সেটি বুঝতে না পারলেও, তার ইরানী একজন সহকর্মীর সাহায্যে লেখাটির কিছু অংশ উদ্ধার করেন। লেখাটি ছিল ‘আলী’- ইসলামের চতুর্থ খলিফার নাম। কিন্তু ‘আলী’ এর পরে যে লেখাটি ছিল, সেটির অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিলো না। কী লেখা আছে সেটি উদ্ধার করতে লারসন কম্পিউটারের সাহায্যে অক্ষরগুলিকে অনেক বড় করে তুলেন এবং প্রতিটি কোণ থেকে পরীক্ষা করে দেখেন। অ্যানিকা লারসন বলেন, “আমি হঠাৎ দেখতে পাই যে ‘আল্লাহ’ শব্দটি মিরর লেখনীতে লেখা রয়েছে।”
লারসন প্রায় ১০০টি কাপড় নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এই একইরকম লেখা আরও প্রায় ১০টি কাপড়ে খুঁজে পেয়েছেন। সবগুলো কাপড়েই ‘আলী’ এবং ‘আল্লাহ’ দুটো নামই একসাথে পাওয়া গেছে। তিনি বলছিলেন,
“কবরে যাদেরকে পাওয়া গিয়েছে এদের মাঝে কেউ কেউ মুসলিম ছিল, এমন ধারণা একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এর আগে অন্য কবরগুলোতে পাওয়া ভাইকিংদের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছি, এদের অনেকের ডিএনএ পারস্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে। সে সময় পারস্যে ইসলাম খুবই প্রভাবশালী ছিল।”
তবে এই আবিষ্কারগুলো থেকে ধারণা করা যায় যে, ভাইকিংদের অনেকের কবর দেওয়ার রীতিনীতি ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অ্যানিকা লারসনের দল এখন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পোশাক পরিহিত এই ভাইকিংদের ভৌগোলিক উৎস জানতে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজি, জেনেটিক্স এবং প্যাথলজি বিভাগের গবেষকদের নিয়ে কাজ করছে।
ভাইকিংদের সাথে মুসলিম বিশ্বের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া এই প্রথম নয়, এর আগেও আরো অনেকগুলো মুদ্রা পাওয়া গেছে স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে, যেগুলো মুসলিম বিশ্বের সাথে তাদের যোগাযোগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। দুই বছর আগে একটি ভাইকিং কবরে এক নারীর রূপার আংটি পাওয়া যায়, যেটিতে ‘আল্লাহর জন্য’ লেখা ছিলো। এই লেখাটিও ছিলো কুফিক অক্ষরে। কুফাহ হচ্ছে ৭ম শতকে প্রতিষ্ঠিত একটি ইরাকি শহর। এই কুফিক অক্ষরেই একদম প্রথম দিককার কোরআন লিখা হয়েছিলো বলে জানা যায়। কিন্তু লারসনের আবিষ্কারের নতুন দিক হচ্ছে, এই প্রথম স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনে আল্লাহর সাথে আলীর নামও পাওয়া গিয়েছে।
আলী (রা) ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মেয়ে ফাতিমা (রা) এর স্বামী। মহানবীর (সা) এর মৃত্যুর পর আলী (রা) ইসলামের চতুর্থ খলিফাও হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শিয়া ম্যাগাজিন ‘ইসলাম টুডে’র সম্পাদক ডি মার্টিনো বলেন,
“আলীর নামের ব্যবহার শিয়া মুসলিমদের সাথে একটি সম্পর্কের দিকে ইজ্ঞিত প্রদান করে। কিন্তু ‘ওয়ালী আল্লাহ’- (আল্লাহর বন্ধু) এই লেখাটি নেই বলে এটির সাথে পুরোপুরি শিয়াদের সম্পর্কের প্রমাণ দেয় না। কারণ, আল্লাহর সাথে সরাসরি আলীর নাম লেখা শিয়া সংস্কৃতিতে চালু নেই। হতে পারে অন্য কোনো মূল লেখা থেকে নকল করতে গিয়ে কেউ ভুলক্রমে এই লেখাটি লিখেছে।”
আল্লাহ এবং আলী (রা) এর নাম পুরনো শিয়া কবরগুলো এবং ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকে প্রায় সময়ই উল্টো করে লেখা থাকে, যেগুলো আয়নাতে ধরলে বোঝা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই আল্লাহ এবং আলীর নামের সাথে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর নামও উল্লেখ করা থাকে।
কিছু অমিল থাকা স্বত্বেও লারসনের আবিষ্কার ভবিষ্যতের জন্য আরো অনেক প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
“এখন যেহেতু আমি ভাইকিং প্যাটার্নগুলোকে ভিন্নভাবে দেখছি, আমি নিশ্চিত যে খননকার্য থেকে অবশিষ্ট টুকরোগুলোতে আরও ইসলামিক শিলালিপি খুঁজে পাব এবং ভাইকিং যুগের অন্যান্য কাপড়্গুলোতেও হয়তো নতুন কিছু পাওয়া যাবে।”
এভাবেই নিজের আশাবাদের কথা জানাচ্ছিলেন অ্যানিকা লারসন। হয়তো এই আবিষ্কারের সত্যতা সম্পূর্ণ প্রমাণ হলে জানা যাবে ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায়।
ফিচার ফটো: 1001inventions.com