২০ শতকের শুরুতে পৃথিবীর ভয়ঙ্কর এক আতংকের নাম ছিল পোলিও, যা সাধারণত আক্রান্ত করে ৫ বছরের নিচের শিশুদের, চিরতরে প্যারালাইজ করে দেয় এবং আক্রান্তদের মধ্যে ৫-১০% মারাও যায়। ভয়ানক রূপ ধারণ করা পোলিও নির্মুল অভিযান শুরুর আগে পোলিওর আগ্রাসনে বছরে প্রায় ৩,৫০,০০০ জন পঙ্গুত্ব বরণ করত! দুরারোগ্য এই রোগটি ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ অভিযান শুরু হয় ১৯৮৮ সালে এবং এতদিনে পোলিওর আগ্রাসন কমেছে ৯৯%, যেখানে প্রায় ১৬ মিলিয়ন মানুষ পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু দারুণ এই অর্জনের ছোট্ট অথচ ভবিষ্যতের জন্য হুমকির জায়গাটিই হলো ১%!
কীভাবে? যদি একজন শিশুও পোলিও আক্রান্ত থাকে, তবে পুরো পৃথিবীর সব শিশু হুমকির সম্মুখীন, এত ভালো অবস্থান থেকেও যদি সম্পূর্ণভাবে পোলিও নির্মুল না করা যায় তাহলে বছরে প্রায় ২,০০,০০০ নতুন আক্রান্ত দেখা দিতে পারে এবং ১০ বছরের মধ্যে আবারো গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিস্মৃতপ্রায় পোলিও রোগের কথা হুট করে কেন উঠে আসল, ভেবে অনেকেই অবাক হতে পারেন। এখন আসল কারণটি বলছি। ইংল্যান্ডের জন ইনেস সেন্টারের একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন পোলিও ভ্যাকসিন তৈরির দারুণ এক পদ্ধতি, যা পৃথিবী থেকে একেবারে মুছে দিতে পারবে পোলিওর ভাইরাস, একইসাথে অন্য অনেক ভাইরাস সংক্রান্ত মহামারী নিধনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। এই অসাধারণ উদ্ভাবন নিয়ে কথা বলার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ভ্যাকসিন কীভাবে কাজ করে।
ভ্যাকসিনের কার্যপদ্ধতি
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্যে রয়েছে বিশেষায়িত বিভিন্ন কোষের একদল বিশাল বাহিনী, যাদের প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে বিশেষভাবে যুদ্ধ করতে সক্ষম। বহিরাগত শত্রু (জীবাণু) আক্রমণের শুরুতে তেড়ে আসে রোগ প্রতিরোধক বাহিনীর সম্মুখভাগের দিকে, যেখানে শ্বেত রক্ত কণিকাও থাকে, যাদের ডাকা হয় ম্যাক্রোফেজ (Macrophage) নামে । ম্যাক্রোফেজগুলো যতসম্ভব জীবাণু গিলে নেয়, অ্যান্টিজেন অংশটুকু বাদে পুরোটা হজম করে ফেলে এবং আন্টিজেনগুলো জমা করতে থাকে, যেখানে রোগ প্রতিরোধের অন্যান্য কোষগুলো জড়ো হয় সেখানে। এখান থেকে কাজ শুরু করে আরেক ধরনের বিশেষ শ্বেত কণিকা, যাদের নাম লিম্ফোসাইট। এই বিশেষ শ্বেত কণিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো T ও B কোষগুলো (Cells)। T সেলগুলো জীবাণুদের সরাসরি আক্রমণ না করে জীবাণু আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস করতে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে B সেলগুলো, এরা অ্যান্টিবডি তৈরি ও নিঃসরণ করতে থাকে।
অ্যান্টিবডিগুলো আক্রমণকারী জীবাণুর অ্যান্টিজেন নিজের সাথে বেঁধে ফেলে এবং নিষ্ক্রিয় করে ফেলে জীবাণুটিকে। একটি অ্যান্টিবডি শুধুমাত্র একটি অ্যান্টিজেন নিষ্ক্রিয় করতে পারে, রোগ প্রতিরোধের ধরন ও প্রয়োজন অনুযায়ী বিলিয়ন বিলিয়ন অ্যান্টিবডি প্রস্তুত থাকে। যত দ্রুত জীবাণু বিস্তার করতে থাকে, তার চেয়েও বেশি দ্রুত ধ্বংস করে শরীর থেকে ঐ জীবাণু নিশ্চিহ্ন করে দেয় রোগ প্রতিরোধক বাহিনী। এরপর T ও B সেলগুলো পরিণত হয় মেমোরি সেলে (Memory cells)। প্রয়োজনে মেমোরি B সেলগুলো ভাগ হয়ে প্লাজমা সেলে পরিণত হয় এবং আরো বেশি অ্যান্টিবডি তৈরি করে, অন্যদিকে মেমোরি T সেলগুলো ভাগ হয়ে জীবাণুর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ করতে পারে। যখন একই জীবাণু পুনরায় আক্রমণ করে, মেমোরি সেলগুলোর কল্যাণে তখন তাদের আগে থেকেই জানা থাকে, কীভাবে তা দমন করতে হবে। এই মেমোরি সেল তৈরি করতেই ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়, যারা ঐ জীবাণুর আক্রমণ ও কর্মপদ্ধতির সাথে আগে থেকেই অবগত থাকে এবং শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম। তাই যে রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেই ভ্যাকসিনে থাকে ঐ রোগের অপেক্ষাকৃত অনেক দুর্বল ভাইরাস বা জীবাণু, যারা রোগটির বিকাশ ও নিজেদের বিস্তারে অক্ষম, এদের ভ্যাকসিন ভাইরাস বলে। এই দুর্বল ভ্যাকসিন ভাইরাসের বিপক্ষে যুদ্ধ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা মেমোরিতে রেখে দেয় T ও B সেলগুলো, অর্থাৎ ভ্যাকসিনের পুরো ব্যাপারটিই হলো কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।
নকল পোলিওভাইরাস
জন ইনেস সেন্টারের গবেষকরা ভ্যাকসিন ভাইরাস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এমন একটি নকল পোলিওভাইরাস বা Virus-Like Particles (VLPs), যা প্রায় হুবহু পোলিও ভাইরাসের মতো, পার্থক্য শুধু কার্যকারীতায়। ‘নকল পোলিওভাইরাস’ ও আসল পোলিওভাইরাস হলো মূর্তি ও সত্যিকার মানুষের মতো ব্যাপার, বাইরের দিকটা হুবহু এক, কিন্তু ভেতরটা ভিন্নরকম।
পোলিও ভ্যাকসিনের এই আবিষ্কার যুগান্তকারী অবদান রাখতে চলেছে এই জন্য যে, এই ‘নকল পোলিওভাইরাস’ ভ্যাকসিনে ব্যবহার করে ভাইরাস ভ্যাকসিনের মতোই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। এর উৎপাদন পদ্ধতিও সহজ, সস্তা ও দ্রুত। গবেষক দলটি এটি উৎপাদনের জন্যে বেছে নিয়েছেন তামাক গাছের মেটাবলিজমকে, যা পাতাগুলোকে পরিণত করে পোলিওভাইরাসের মতো দেখতে ভাইরাস তৈরির ‘কারখানায়’। পোলিওভাইরাসের জেনেটিক কোড ব্যবহার করে ভাইরাসের বাইরের আবরণটি তৈরি করা হয়, তারপর যেসব ভাইরাস সাধারণত তামাক গাছ আক্রমণ করে সেগুলোর সাথে মিশিয়ে মাটির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রাখা হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তামাক গাছকে আক্রমণ করে এবং তামাক গাছ জেনেটিক নির্দেশনা অনুযায়ী পাতায় পোলিওভাইরাসের মতো ভাইরাস উৎপন্ন করা শুরু করে। এরপর পাতা থেকে ভাইরাসগুলো আলাদা করে নেওয়া হয়।
পোলিও নির্মুলে নতুন আবিষ্কারের ভূমিকা
পোলিও প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে কিন্তু শতভাগ নির্মুল করা যায়নি, তদুপরি ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয় দুর্বল পোলিও ভাইরাস। পোলিও ভ্যাকসিনের দুটি পদ্ধতি হলো ইনঅ্যাক্টিভ্যাটেড পোলিওভাইরাস ভ্যাকসিন (IPV) ও ওরাল পোলিওভাইরাস ভ্যাকসিন (OPV)। OPV-তে রয়েছে প্রচুর ভাইরাস ভ্যাকসিন, এই ভ্যাকসিনের দুর্বল পোলিওভাইরাসও কিছুটা শক্তিশালী হয়ে বিপদজ্জনক পোলিও রোগে আক্রান্ত করতে পারে, যাকে বলে ভ্যাকসিন উদ্ভূত পোলিওভাইরাস। যদিও এটি খুবই বিরল, কিন্তু শতভাগ পোলিওভাইরাস নির্মুলের প্রশ্নে এটি বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে ‘নকল পোলিওভাইরাস’, ভ্যাকসিনে এই ভাইরাস ব্যবহার করলে ‘সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না’। কারণ, এটি পোলিওভাইরাসের মতো দেখতে হলেও, আদতে তা নয় এবং এটি থেকে পোলিও বিস্তারের কোনো রকম সম্ভাবনা নেই।
পোলিওভাইরাসের তিনটি টাইপ রয়েছে, একটিও মানুষের শরীরের বাইরে খুব একটা লম্বা সময় বেঁচে থাকতে পারে না। টাইপ-২ পোলিও ভাইরাস ১৯৯৯ সালেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, টাইপ-৩ দীর্ঘদিন দেখা না যাওয়ার পর ২০১২ সালে শেষ দেখা গেছে নাইজেরিয়াতে। বর্তমান পোলিওভ্যাকসিনের জায়গায় নতুন এই আবিষ্কারের ব্যবহার পোলিও ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিধনের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রাণীদের উপর পরীক্ষায় এটি শতভাগ সফলভাবে পোলিও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) এই গবেষণায় অর্থের যোগান দিয়েছে এই লক্ষ্যে, যেন ভবিষ্যতে পোলিও ভ্যাকসিনে ‘নকল ভাইরাস’ ব্যবহার করে পোলিওকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়।
অপার সম্ভাবনা
শুধুমাত্র পোলিওভাইরাসের ক্ষেত্রেই নয়, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশিরভাগ ভাইরাসের হুবহু নকল কিন্তু অক্ষম ভাইরাস তৈরি করা সম্ভব, শুধুমাত্র যদি সঠিক জেনেটিক কোড জানা থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের ইবোলা ও জাইকার মতো মহামারী রূপ ধারণ করা রোগের ক্ষেত্রেও সমান কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে এই প্রযুক্তি। নকল ভাইরাস তৈরির গাছগুলো খুবই দ্রুত বড় হয় এবং এর জন্য সূর্যের আলো, মাটি, পানি ও কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া ব্যয়বহুল তেমন কিছু লাগে না। বৃহৎ পরিসরে এই ভাইরাস ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরি করা ও মানুষের শরীরে এর কার্যকারীতা পরীক্ষা করা বাকি রয়েছে, কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই আবিষ্কার কতটা বিশাল ভূমিকা রাখতে চলেছে তা বলা বাহুল্য।
ফিচার ইমেজ- pinterest.com (Polio patients on “board beds” at the Dallas Scottish Rite Hospital)