কেউ যখন আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যায় তখন আমরা তাদের সঠিকভাবে সৎকার করার চেষ্টা করি। আমরা একেকজন আমাদের ধর্ম অনুযায়ী সৎকার করে থাকি। মুসলমান ও খ্রিস্টানরা মাটিতে দাফন করে থাকে। হিন্দুরা পুড়িয়ে সৎকার করে। আমরা আমাদের আপনজনকে যতই ভালোবাসি, মৃত্যুর পর তাদের আর শারীরিকভাবে কাছে রাখতে চাই না। যত দ্রুত সম্ভব তার সৎকার করতে চাই। মিশরে সৎকারের জন্য পিরামিড ছিলো। যদিও মমি করার মাধ্যমে দেহ সংরক্ষণ করা হতো। এটিও এক ধরনের সৎকার। কারণ লোকালয় থেকে মৃতদেহকে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। আপনাকে যদি বলা হয় আপনার প্রিয়জনের মৃতদেহের সাথে থাকতে, আপনি কখনোই থাকবেন না। কিন্তু যদি বলা এমন এক সম্প্রদায় আছে যারা মৃতদের সাথে বসবাস করে, তবে আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
ইন্দোনেশিয়ার সোলোওয়েসি দ্বীপে টোরাজা নামের আদিবাসী বাস করে। তারা কেউ মারা গেলে তাকে সাথে সাথে সৎকার করে না। অনেক সময় কয়েক মাস কিংবা বছর পেরিয়ে যায় সৎকার করতে। তাদের সৎকার অনেক ধুমধামের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। অনেক শূকর ও গরু মহিষকে উৎসর্গ করা হয়। কারণ তারা মনে করে এটি মৃতের বাহন। এ ব্যয় যোগাড় করতেও অনেকের সময় লেগে যায়। এভাবে মৃতরা অবশেষে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। অন্তিম সৎকারের আগ পর্যন্ত তারা মৃতের সাথে একসাথে একই ঘরে বাস করে। বিবিসি একটি ডকুমেন্টারিও করেছে এদের নিয়ে।
ডানডুরো মারা গেছেন দুই বছর আগে (ডকুমেন্টারির সময়ে)। তার ছেলে মনে করে তিনি এখনও তাদের কথা শোনেন। তার আত্মা এখনও সেখানে আছে। প্রতিদিন দুইবেলা তাকে খাবার দেয়া হয়। সাথে কফি ও সিগারেটও থাকে। দেহ যাতে না পচে এজন্য নিয়মিত ফরমালিনের ইনজেকশন দেয়া হয়।
ডানডুরোর ছেলের মতে,
“যখন আপনি কাউকে সাথে সাথে দাফন করেন, আপনি কষ্ট অনুভব করেন। এজন্য আমি আমার বাবাকে এত সময় ধরে রেখেছি যাতে তার সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে পারি। অসুস্থ ব্যক্তির মতো তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করি।”
তারা মৃত দেহকে ভয় পায় না। মৃত মানুষ তাদের কাছে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাওলো সিরিন্ডা মারা গেছেন ১২ বছর আগে। এত বছর ধরে তার মেয়ে তাকে দেখাশোনা করছেন। তার মেয়ের সন্তানদের কাছে নানার মৃতদেহ স্বাভাবিক। তারা প্রায়ই বলে,”নানা ঘুম থেকে উঠো। চলো খেতে যাই।” তারা হয়তো এখনও বুঝতে পারে নি তাদের নানা আর বেঁচে নেই। তার মেয়ের মতে,
“উনি একজন ভালো মানুষ এবং ভালো বাবা। আমাদের মাঝে গভীর আবেগের সম্পর্ক আছে।”
এভাবে বছরের পর বছর রাখার পর যখন অন্তিম সৎকারের সময় হয়, তখন মহাসমারোহে এর আয়োজন করা হয়। দিনের পর দিন চলে এ অনুষ্ঠান।
কিন্তু অন্তিম সৎকারও যেন শেষ বিদায় নয়। মৃতদেহগুলো অনেকদিন পর পর আবার বের করা হয়। জীবিতদের সাথে মৃতদের পুনর্মিলনীর জন্য। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘মানানা’। তখন সবার মৃতদের সাথে সম্পর্কের কথা মনে পড়ে যায়। আগেকার সেই আবেগগুলো আবার পুনর্জীবিত হয়। পরে মৃতদেহকে আবার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলা হয়।
টরাজানরা তাদের মৃতদের দেহ ঘরে রাখে। কিন্তু ফিলিপাইনের ম্যানিলা শহরের কিছু মানুষের বসবাস কবরস্থানে। আমরা কবরস্থান নিয়ে অনেক ভূতের গল্প এবং অনেক অতিপ্রাকৃত গল্প শুনেছি। রাতের বেলায় একলা শ্মশানে কিংবা কবরস্থানে যেতে আমরা অনেকেই সাহস করবো না। কিন্তু কিছু মানুষের দিনরাত কাটে কবরস্থানে। কারণ তাদের থাকার আর কোনো জায়গা নেই।
কবরের উপরেই তাদের বসবাস। সেখানেই তাদের ঘর বাড়ি। সেখানেই তাদের জন্ম। শত শত মানুষ এভাবে থাকে। দুই থেকে চার বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল আছে। যে স্কুলটিতে পড়ানো হয় সেটিও একটি কবর।
সিলিয়া দশ বছর ধরে কবরস্থানে থাকে। তার ঘর তিনটি কবর মিলে যেটা অন্যান্যদের তুলনায় বড়। তার স্বামী বিয়ের পর তাকে এখানে নিয়ে আসে। সে তার নাতি সহ একটি কবরের উপর শোয়। শোয়ার জন্য কবরের উপর সে ফোম বিছায়।
সিলিয়া চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। তার আয় উপার্জনের উৎস হলো কবর পরিষ্কার করা। এভাবেই কবর পরিষ্কার করে অনেকের জীবন কাটে এখানে। তাদেরকে বলা হয়েছে যে এখান থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হবে এবং অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু এটা কখন কীভাবে হবে তারা সেটা জানে না!
কেউ মারা গেলে তাকে পাঁচ বছরের জন্য কবর লিজ দেয়া হয়। এরপরও মৃতদেহ রাখতে গেলে তার জন্য আরও টাকা দিতে হয়। অনেকের সে সামর্থ্য থাকে না। তখন পাঁচ বছর পর কবর খুঁড়ে সব হাড়গোড় বের করে সেখানে আবার নতুন কারও কবর দেয়া হয়।
কবর খুঁড়ে জীবিকা নির্বাহ করে এমন একজনকে জিজ্ঞাসা করা হলো, যখন তিনি হাডগুলো দেখেন তখন তার কেমন লাগে। উত্তরে তিনি বলেন,
“কিছু না। আমার কিছু অনুভূত হয় না। আপনার জীবিতদের ভয় পাওয়া উচিত, মৃতদের নয়। সমস্যা শুধু তখনই যদি আপনি আত্মাদের দ্বারা অভিশপ্ত হন। মাঝে মাঝে হাঁটার সময় তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। গরমের সময়ও ঠাণ্ডা অনুভূত হয়।”
রিকার্ডো মেডিনা পঞ্চাশ বছর ধরে সেখানে আছেন। এখানে তিনি তার তৃতীয় স্ত্রীর সাথে থাকেন। আঠারো সন্তানের জনক রিকার্ডো। সব সন্তানই বেড়ে উঠেছে তার এই ঘরে। কিন্তু এখন সবার যার যার সংসার আছে।
রিকার্ডোর ছেলের কবরও সেই কবরস্থানে রয়েছে। তার ছেলেকে খুন করা হয়। কে তাকে খুন করেছে সে জানে না। তার আক্ষেপ তার জীবদ্দশাতেই তার পরিবারের একজনকে পৃথিবী ছাড়তে হলো।
৬৭ বছর বয়সী ড্যানিয়েলও রিকার্ডোর মতো অনেকদিন ধরে এখানে আছেন। বারো বছর বয়স থেকে তিনি কবরস্থানের বাসিন্দা। তার ঘরের কবরে যারা আছেন তিনি তাদের চিনেন। তিনি তাদের নিজ হাতেই দাফন করেছেন। তারা ড্যানিয়েলকে তাদের এই জায়গা রক্ষণাবেক্ষণ করতে বলে গেছেন। যখন তিনি মারা যাবেন তখন তাকে এই কবরস্থানেই দাফন করা হবে। তিনি মনে করেন, মারা যাবার পর তার আত্মা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ দেবে।
ইন্দোনেশিয়ার সেই আদিবাসীরা যারা তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে মৃতদের সাথে রাখে কিংবা ফিলিপাইনের এই কবর বাসিন্দারা যারা জানে কবরে থাকা ঠিক নয় তবুও তারা বাধ্য হয়ে এখানে থাকে। এদের কেউ আমাদের সাধারণ জীবনযাপনের অংশ নয়। যে কবরের ভয়ে আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হই, যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে ভৌতিক উপন্যাস কিংবা সিনেমা, সেই ভয়ংকর কিংবা অস্বাভাবিক জায়গাতেই অনেক মানুষ জীবনযাপন করছে। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাথে এক হয়ে আছে সেখানকার কবরের বাসিন্দারা।
ফিচার ইমেজ: davisgraveyard.com