বছর প্রায় শেষ হয়ে এলো। প্রতি বছরের মতো ২০১৭ সালেও খণ্ড খণ্ড সব ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে ছিল বিষ্ফোকের মতো বিশাল সব ঘটনা-দুর্ঘটনার বীজ। আকার-আকৃতি কিংবা প্রভাবের দিক থেকে তাদের মধ্যকার কতিপয় ঘটনা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে শত শত মাইল দূর থেকেও তা এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই। তেমনি কিছু সাড়াজাগানো ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যাওয়া ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে ২০১৭ সালের সালতামামি। অনেক উপর থেকে পাখির চোখে পৃথিবীকে কেমন দেখা গেছে এই ঘটনাগুলোর সময়, তা-ই থাকছে আজকের লেখায়।
উইমেন মার্চ ২০১৭
বছরের শুরুতেই, জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখ, সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরের প্রায় ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ যোগ দেয় এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে। প্রতিবাদের মূল বিষয় নারী অধিকার আন্দোলন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হলেও পরে তার সাথে যুক্ত হয় আরও বেশ কিছু বিষয়; যেমন- স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা, জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শ্রম অধিকার, অভিবাসন সংস্কার, প্রজনন অধিকার ও সমকামী, উভকামী, ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার প্রভৃতি।
মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে মিছিলটি শুধুমাত্র ওয়াশিংটনে হওয়ার কথা ছিল এবং এর নামকরণও করা হয়েছিল ‘উইমেন’স মার্চ অন ওয়াশিংটন’ নামে। ‘ওয়াশিংটন মার্চে’ প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ যোগদান করে এবং তা ইউটিউব, ফেসবুক ও টুইটারে সরাসরি প্রচারণা শুরু হলে বিশ্ব জুড়ে প্রায় পাঁচ মিলিয়নের কাছাকাছি মানুষ এই মিছিলে যোগ দেন।
রাতের উত্তর কোরিয়া
উত্তর কোরিয়া নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এ বছর উত্তর কোরিয়া বেশ কয়েকবার আলোচনায় উঠে আসলেও এই দেশটি সম্পর্কে আজও অনেক কিছু মানুষের অজানা। দেশের সরকার ইতিমধ্যে স্বীকার করেছে যে, দেশটিতে যথেষ্ট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। এমনকি কিম জং উন তার নতুন বছর উপলক্ষে বক্তৃতাতে দেশের বিদ্যুৎ বিভ্রাট দূর করতে নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রমের আহবান জানান।
কিন্তু কে জানতো তাদের বিদ্যুতের অবস্থা এত ভয়াবহ! উপরের ছবিতে লক্ষ্য করুন, রাতে উত্তর কোরিয়াতে দৃশ্যমান আলোর পরিমাণ তাদের প্রতিবেশী দেশের তুলনায় এতটাই নগণ্য যে, মনে হয় দুই দেশের মধ্যবর্তী জায়গাটুকু হঠাৎ করে যেন আঁধারে ডুবে গেছে।
অ্যান্টার্কটিকা থেকে ভেঙে যাওয়া বরফখণ্ড
যে হারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, এতে করে অ্যান্টার্কটিকার বরফখণ্ড ভাঙার খবরে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে ভাঙা বরফ খণ্ডের ওজন যদি এক ট্রিলিয়ন মেট্রিক টনের কাছাকাছি হয়, তবে সেটা অবাক তো অবশ্যই, উদ্বিগ্ন হবার মতোও খবর বটে। এমনই বরফ ভাঙার এক ঘটনা ঘটেছে এ বছরের জুলাই মাসের ১২ তারিখ। সেদিন বিশাল এক হিমশৈল অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উয়েডল সাগরের দিকে ভাসতে শুরু করে। এর আগে কখনও এত বড় বরফখণ্ড ভাসতে দেখা যায়নি।
গত কয়েক বছর ধরেই উপদ্বীপটির বুকে ১২০ মাইল লম্বা একটি ফাটল দেখা যাচ্ছিল। গবেষকরা এখনও এর পেছনের কারণ খুঁজে পাননি, তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং আদৌ এই ভাঙনের পেছন দায়ী কিনা জানা যায়নি। তবে এই ভাঙনের ঘটনাটি অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপের ভূদৃশ্যে মৌলিক পরিবর্তন এনেছে।
আইসিসের করাল গ্রাসে ধ্বংস হওয়া শহর
কত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী হামলার তাণ্ডব ঘটিয়েছে আইসিস। তাদের সেই তাণ্ডব থেকে নিস্তার পায়নি আমাদের বাংলাদেশও। তবে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে আইসিস ইরাক ও সিরিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভূমির দখল হারাতে শুরু করে। এর মধ্যে রাক্কা, সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত এর কার্যত রাজধানী এবং মসুল, যেটি কিনা ইরাকের অন্যতম বৃহত্তম জনবহুল অঞ্চল। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়াকে আইসিস মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ঠিক। তবে সেসব অঞ্চলের সম্পূর্ণ এলাকা ইতিমধ্যে নিশ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
আমেরিকা জুড়ে সূর্যগ্রহণ
নাসার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসের আগপর্যন্ত আমেরিকাতে শেষ পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঘটেছিল সেই ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ। সেদিনের সূর্যগ্রহণ অতিক্রম করেছিল ওয়াশিংটন, অরিগন, আইডাহো মনটানা ও নর্থ ডাকোটা অঙ্গরাজ্য। আর প্রতি আঠারো মাসে পৃথিবীতে একবার করে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হওয়া সত্ত্বেও, গত ত্রিশ বছরে আমেরিকার কোথাও পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হয়নি।
শেষমেশ এ বছরের আগস্ট মাসের ২১ তারিখ আবারও আমেরিকায় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঘটে। সেদিনের সূর্যগ্রহণ অরিগন থেকে সাউথ ক্যারোলিনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবির
মায়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণ আর হত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এ বছর প্রায় ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা নিজেদের জ্বলন্ত গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নিতে শুরু করে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে।
ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কুতুপালংয়ে বৃদ্ধি পাওয়া রোহিঙ্গাদের মহাকাশ থেকে তোলা চিত্র; Source: European Space Agency
হারিকেন হারভের আক্রমণ
গত আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, ফ্লোরিডা, পুয়ের্তো রিকো ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চল জুড়ে বয়ে যায় ভয়াবহ সামুদ্রিক ঝড় হার্ভে। চার মাত্রার এই ঘূর্ণিঝড়ে বিপদগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। ঝড় থামার পর ব্যাপক বন্যা বয়ে যাওয়ার কারণে ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৯৮.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০০৫ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে এত বড় ঘূর্ণিঝড় আর হয়নি।
অন্ধকারাচ্ছন্ন পুয়ের্তো রিকো
হারিকেন হার্ভের তাণ্ডব থামার কিছুদিন পরই পুয়ের্তো রিকোতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মারিয়া, যার ফলে ধ্বংস হয়ে যায় দ্বীপটির পাওয়ার গ্রিড। ফলে রাত হলেই অন্ধকারে ডুবে যায় বিদ্যুৎবিহীন দ্বীপটির বিরাট একটি অংশ।
বিরাটাকার শৈবালের স্তর
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরি হ্রদের প্রায় ৭০০ বর্গ মাইল এলাকা ক্ষতিকারক শৈবালের ঘন স্তরে ঢেকে যায়। হ্রদটি উজ্জ্বল সবুজ রং ধারণ করে এবং অধিবাসী ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয়। গবেষকরা জানিয়েছেন, কৃষিজমিতে অতিরিক্ত সার ব্যবহারের কারণে এই সমস্যাটি গত ২০০০ সাল থেকে বাড়তে শুরু করে।
শ্বেত গাছগুলোর মধ্যে ছিল সায়ানোব্যাক্টেরিয়া, যা নির্দিষ্ট অবস্থায় ক্ষতিকর জীবাণু তৈরি করতে পারে, যার ফলে পানি দূষণ হয় এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়।
বিশ্ব জুড়ে দাবানল
২০১৭ সালে চিলি, পশ্চিম কানাডা ও আমেরিকা, পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, এমনকি গ্রিনল্যান্ডের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে বেশ কিছু দাবানল। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নেয় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলটি।
উপরের ছবিতে লক্ষ্য করুন, স্যাটেলাইট দ্বারা সংগৃহীত ইনফ্রারেড ডেটা ব্যবহার করে আগুন ধরে যাওয়া অংশগুলোর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
ফিচার ইমেজ: The New York Times