কথায় আছে প্রকৃতিই মানুষের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, কিন্তু বাস্তবে কি এমন কেউ আছেন, যিনি প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়ে উঠেছেন মহামানব; যে শিক্ষা তিনি মানুষ-প্রাণ ও প্রকৃতির সেবায় লাগিয়েছেন? ভারতের কর্ণাটকে রয়েছেন এমনই একজন স্বশিক্ষিত মানুষ, যিনি ভেড়া চরাতে চরাতে হয়ে গিয়েছেন প্রাণ ও প্রকৃতির সেবক। তিনি কথা বলেন দার্শনিকদের মতো গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে; নাম তার কারে কামেগৌড়া। বর্তমান বয়স ৮২ বছর।
কর্ণাটকের মান্দিয়া জেলার ‘মালাভালি’ এলাকার ‘কুন্দিনিবেট্টা’ নামক ঊষর পাহাড়ে কামেগৌড়ার জন্ম। শৈশব থেকেই তিনি দেখেছেন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ঝর্ণাগুলো। শুকিয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী কাবেরী নদীর পানিও। ঝর্ণা ও নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পুরো পাহাড়। পানি না থাকলে সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে না। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। গড়ে তুলেছে নতুন আবাসস্থল। তারপরও যারা থেকে গেছে, তাদের পানি আনতে হয় প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে। পানির অপর নাম জীবন, তাই হয়ত যারা অন্যত্র বাস করতে যেতে পারেননি, তারা ১৫ কিলোমিটার দূর থেকেই পানি সরবরাহ করে জীবন নির্বাহ করছেন- যা স্বাভাবিক জীবনযাপনের বাইরে একটি কষ্টসাধ্য চেষ্টা। কিন্তু সবাই কি আর জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্য এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করতে পারে?
অন্য এলাকায় গিয়ে বসবাস করা সম্ভব হয়নি রাখাল কামেগৌড়ার। ভেড়া চরাতে চরাতে প্রকৃতির সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল কিশোর বয়সেই। পানির অভাবে মরে যাচ্ছিলো গাছপালা। শুধু প্রকৃতি নয়, তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করলেন মানুষের দুর্দশাও; পানির অভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে বাকি মানুষগুলো। পশুরা পানির অভাবে মারা যাচ্ছে অথবা এলাকা ত্যাগ করছে। কী করা যায় এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য- কামেগৌড়ার মাথায় এই চিন্তা বারবার আঘাত করে যাচ্ছিলো।
প্রায় ৪০ বছর আগের কথা; কামেগৌড়ার বয়স তখন ৪২ বছর। এ বয়সে মানুষ ঘর-সংসার করে ক্রমান্বয়ে নীরব হয়ে যেতে থাকে। আর তখনই কিনা পাগলামি চেপে বসল কামেগৌড়ার মাথায়; তিনি এখানকার মানুষ, পশু আর প্রকৃতিকে রক্ষা করবেন। সবার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়ে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।
পাহড়ে পানির প্রধান উৎস ঝর্ণা। পাহাড় ঘামিয়ে যে জলের সৃষ্টি হয়, তা থেকে উৎপত্তি হয় ঝর্ণার। কামেগৌড়া ছোটবেলায় দেখতেন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সকাল বেলা পাহাড় ঘামিয়ে পানি জমত। পাহাড়ের মানুষেরা রাত হলে সেসব ভাঁজে পানি সঞ্চয়ের জন্য পাত্র রেখে আসত। যদিও খুব কম মানুষ পর্যাপ্ত পানি সংগ্রহ করতে পারত। এক পর্যায়ে পাহাড় সে পানিটুকুও দেয়া বন্ধ করে দিল। কামেগৌড়া বুঝতে পারল আবার যদি পাহাড়ে সঠিকভাবে ভাঁজ তৈরি করে দেয়া যায়, তাহলে পাহাড় আবার পানি দেবে। তাই তিনি পাহাড়ে পুকুর খননের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্ত মানুষকে জানালে সবাই তাকে ‘ম্যাড ম্যান’ বা পাগল বলতে লাগল। স্থানীয় শিক্ষিতরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকল। পরিবার পরিজন তাকে অনুৎসাহিত করতে লাগল। কিন্তু কামেগৌড়া থামলেন না। কাউকে না পেয়ে নিজেই পুকুর খনন করা শুরু করে দিলেন।
কামেগৌড়া প্রথম পুকুরটি খোঁড়েন পাহাড়ের ‘দসানদোদদি’ নামক পার্শ্বে। এটি খুঁড়তে তার সময় লাগে প্রায় ছয়মাস। মনে হতে পারে আশেপাশের মানুষ তার কাজে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল- বাস্তবে তা নয়; উল্টো সবাই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল। পুকুর খনন করার মতো কোনো যন্ত্রও তার কাছে ছিল না। গাছের ডাল ধারালোভাবে তৈরি করে সেই ডাল দিয়েই শুরু করলেন পুকুর খনন। কিন্তু তাতে খুব বেশি এগোতে পারলেন না তিনি। এক পর্যায়ে কিছু কর্মী ভাড়া করে আনলেন কামেগৌড়া। নিজের জমানো কিছু টাকা ছিল, তা পুকুর খননের জন্য আনা কর্মীদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। এভাবেই তার প্রথম পুকুর খননের স্বপ্ন পূরণ হল। সেই স্মৃতি স্মরণ করে কামিগুয়াদারা বলেন,
“পুকুর তৈরির পর পানিতে সেটি পূর্ণ হয়ে উঠল। সেখান থেকে পানি নিম্নাঞ্চলেও প্রবাহিত হতে থাকলো। এর চেয়ে কোনো সুখকর দৃশ্য আমার জন্য কখনো আসেনি।”
তারপর একে একে তৈরি করে গেছেন পুকুর। ২০১৮ সালে এসে সেই পুকুরের সংখ্যা ১৪। এ পর্যায়ে এসে তিনি তার ‘ম্যাড ম্যান’ উপাধি মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তাকে বলা হয় ‘কারে’। ‘কারে’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘খাল’ বা ‘জলাশয়’; তবে এটা এখন আর তুচ্ছার্থে নয়- এখন মানুষ তাকে ভালোবেসেই ‘কারে’ উপাধি সহকারে ডাকে। ফলে তার নাম দাঁড়ালো ‘কারে কামেগৌড়া’। এই ১৪টি পুকুর তৈরি করতে তার লেগেছে দীর্ঘ ৪০ বছর। নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই দীর্ঘ সময় তিনি ব্যয় করেছেন প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য। সেই দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে তিনি বলেন-
“তুমি কি একদিনেই সারা বছরের খাবার গ্রহণ করতে পারবে? পারবে না। আমিও আমার পুকুরগুলো একদিনে খনন করতে পারিনি, বহু বছর লেগে গিয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, লেগে ছিলাম।“
১৪ টি পুকুর তৈরি করার জন্য কামেগৌড়ার প্রায় ১০-১৫ লাখ ভারতীয় রুপি খরচ হয়েছে। খরচের শুরুটা হয়েছে নিজের জমানো টাকা থেকে। পরবর্তীতে যখন তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তখন অনেক পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। পুরস্কার বাবদ যত টাকা তিনি পেয়েছেন তার একটি পয়সাও তিনি নিজের জন্য খরচ করেননি। সব নতুন নতুন পুকুর তৈরির জন্য শ্রমিকদের দিয়ে দিয়েছেন। সেসব সুখ-দুঃখের স্মৃতি নিয়ে কামেগৌড়া নিজেই বলেন-
“আমি পুকুরগুলো তৈরির জন্য প্রায় ১০-১৫ লাখ টাকা ব্যায় করেছি। মূলত সে টাকা এসেছে বাসাভাসরি অ্যাাওয়ার্ড ও অন্যান্য পুরস্কারের অর্থ থেকে। আমি পুরস্কার থেকে পাওয়া সব অর্থই পুকুর খননের কাজে বিলিয়ে দিয়েছি। আমার মাত্র দুই একর ব্যক্তিগত জমি আছে… যদি আমি পুকুর তৈরির পিছনে সেসব টাকা ব্যয় না করে দিতাম, তাহলে এখন আমি অনেক জমির মালিক হতে পারতাম এবং আমার একটি বিলাসবহুল বাড়ি থাকত।”
শুধু পুকুর খনন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি- এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে যাওয়ার জন্য তিনি তৈরি করেছেন সরু রাস্তা। এছাড়া পাহাড়কে মানুষের বসবাসোপযোগী করে তোলার জন্য তৈরি করেছেন অসংখ্য ছোট ছোট রাস্তা। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কামেগৌড়া কখনো কোনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি। তবুও তিনি প্রকৃতি থেকে শিখে নিয়েছেন যে কোনোকিছু নির্মাণের আগে সেখানকার মাটি পরীক্ষা করে নিতে হয়। পুকুর খননের আগে সেখানকার মাটিতে পানি জমবে কিনা এবং জায়গাটি পুকুর তৈরির উপযোগী কিনা, তাও কামেগৌড়া কিছুটা মাটি খুঁড়ে পরীক্ষা করে নিতে পারেন নিজস্ব পদ্ধতিতে। ফলে নিস্ফলা পাহাড়েও তার পুকুরগুলো বারো মাস পানি দেয়- এমনকি গ্রীষ্মকালেও সেখানে পানি থাকে। সবমিলিয়ে কামেগৌড়া এখন সফল। নিজের কাজে নিজে আনন্দিত। তিনি বলেন-
“আমি যখন পুকুর খনন করতে শুরু করলাম এবং আমার সমস্ত সঞ্চয় এর পেছনে ব্যয় করতে থাকলাম, তখন সবাই আমাকে অবজ্ঞা করতে শুরু করল। আমি আমার আত্মীয়দের হারাতে শুরু করলাম; তারা আমাকে ত্যাগ করতে থাকল। কিন্তু গাছ, পুকুর, পাখি এবং প্রাণীরা আমার নতুন আত্মীয়তে পরিণত হতে থাকল। কেউ কেউ আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকল… কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে সরকারি জমি নষ্ট করার অভিযোগ ও প্রচারণা চালাতে থাকল। কিন্তু আমি তাতে ভয় পেয়ে থেমে যাইনি। আমি এখন সবাইকে ওপেন চ্যালেঞ্জ করতে পারি- আমি যেসকল পুকুর খনন করেছি, তার প্রতিটিতে পানি সংরক্ষিত রয়েছে এবং কখনই সেই পানি ৫-৬ ফুটের নিচে নামে না… এমনকি গ্রীষ্মকালেও না।”
গল্পটা সেখানেও শেষ হয়নি। একজন মানুষ পুকুর খনন করতেই পারেন। হোক সে কৃষক। কিন্তু কামেগৌড়া কী যেমন তেমন বা প্রচুর অবসরে থাকা কোনো কৃষক? মোটেই না। তার দায়িত্ব ভেড়া লালন পালন করা। তার অধীনস্থ ভেড়ার সংখ্যা ৫০টিরও অধিক। এই ৫০টি ভেড়া পালনের জন্য তার কাজের সময়ও নির্ধারিত। না, ৮ নয়- পাক্কা ১২ ঘণ্টা; অর্থাৎ প্রতিদিন ভেড়া পালনের পেছনে তাকে একদিনের অর্ধেক সময় ব্যায় করতে হয়। ভেড়া পালন করা বাবদ তিনি যে টাকা পান, সেটাই তার একমাত্র উপার্জন। ফলে তিনি দিনের বেলাকে ভেড়া পালনের জন্য আর রাতকে পুকুর খননের জন্য বরাদ্দ করে নিয়েছেন। সারাদিনের কাজ শেষে চাঁদের সাথে তার সখ্যতা শুরু হয়। চাঁদ তার কাজে আলো দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাবে রাতের পর রাত পরিশ্রম করেই কামেগৌড়া গড়ে তুলছেন তার একের পর এক পুকুর। কামেগৌড়ার কাছে এখন এটি একটি নেশা। প্রাণ-প্রকৃতি সেবার নেশা। কামেগৌড়া বলেন-
“আমি আমার চোখ বন্ধ করি, তারপর আবার খুলি; তখন আমি ভাবতে থাকি এই প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতিটি ইঞ্চির কাছে আমি দায়বদ্ধ। যদি কোন মাদকাসক্তকে মাদক গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়, তবে কি সে মাদক ছেড়ে দেবে? ছাড়বে না। আমিও তেমনি নেশাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছি। আমি এটি ছাড়তে পারব না।”
তিনি আরও বলেন-
যখন কেউ আমাকে ব্যক্তিগত খরচের জন্য টাকা দান করে, তখন আমি তা গ্রহণ করি। কিন্তু আমি একজন মাদকাসক্তের মতো- তাই আমি সেসব ব্যক্তিগত টাকাও পুকুরের পেছনে খরচ করে ফেলি। এটিই আমার আজকালকার নেশা!”
শুধু ১৪টি পুকুর খননের গল্প আপনাদের কাছে তুলে ধরলে কামেগৌড়ার প্রতি অবিচার করা হবে, কারণ তার আরেকটি বিরাট অবদান রয়েছে- সেটা হলো প্রায় মরুভূমি হতে চলা কুন্দিনিবেট্টা পাহাড়কে বৃক্ষভূমিতে পরিণত করা। তিনি এই পাহাড়ে প্রায় ২০০০ বৃক্ষ রোপণ করেছেন। ফলে সমস্ত পাহাড় ফের সবুজ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এভাবেই প্রাণ ও প্রকৃতির বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন কামেগৌড়া
পৃথিবীতে কামেগৌড়ার আপন বলতে এখন বেঁচে আছেন তার স্ত্রী ও দুই সন্তান। কিন্তু এত অল্প আপনজন নিয়ে থেমে থাকেননি তিনি, কামেগৌড়া বন্ধু বানিয়েছেন পাহাড় ও প্রকৃতিকে। ভালোবেসেছেন পাহাড়ের অসংখ্য অসহায় প্রাণকে। এমনকি সন্তানদের জন্যও প্রকৃতি ব্যতীত কোন সম্পদ বা বন্ধু তিনি রেখে যাচ্ছেন না। তার ভাষায়-
“যদি আমি আমার সন্তান ও নাতিদের জন্য টাকা রেখে যেতাম, তাহলে তারা তা অপচয় করে ফেলতে পারত। কিন্তু এখন যদি আমি তাদেরকে এই পুকুরগুলো দিয়ে যাই, যাতে রয়েছে সারা বছরের জন্য পর্যাপ্ত পানি- তা তারা অপচয় বা নষ্ট করে ফেলতে পারবে না।“
ফিচার ইমেজ- newindianexpress.com