Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুজাত বুখারি কিংবা গৌরি লঙ্কেশ হত্যার ভার কি বইতে পারবে ভারতের গণতন্ত্র?

গত ১৪ জুন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে ‘রাইজিং কাশ্মীর’ সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং রাজ্যের স্বনামধন্য সাংবাদিক সুজাত বুখারিকে তার দফতরের সামনেই গুলি করে হত্যা করে কয়েকজন আততায়ী। গুলিবর্ষণে মারা যান বুখারির দুই নিরাপত্তারক্ষীও। স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীরের অন্যতম নির্ভীক কণ্ঠ বলে পরিচিত বুখারির এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে নিন্দার ঝড় ওঠে দেশে তো বটেই, দেশের বাইরেও। ভারতে স্থিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ জাস্টরও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন; দেশের সাংবাদিক মহল সোচ্চার হয়ে ওঠে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও যেটা চোখে পড়ে তীব্রভাবে, তা হলো বুখারির হত্যাকাণ্ড নিয়ে চূড়ান্ত মেরুকরণ। যে বা যারা তার খুনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে বা কলম তুলে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও নানা গণমাধ্যমে দেখা গেল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সমস্ত বিতর্ক সীমিত থাকল কে বুখারিকে প্রাণে মেরেছে তার উপরেই। কারও মতে তিনি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার; আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ভারত-বিরোধী জঙ্গিদের চক্ষুশূল ছিলেন। আসল কথা হলো: ভারতের আরও একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিককে চিরকালের মতো নীরব করে দেওয়া হলো এবং তারপরও এরকম কোনো আশ্বাস পাওয়া গেল না যে, এরপর এরকম কোনো ঘটনা আর ঘটবে না; ঠিক যেমন পাওয়া যায়নি গত বছর সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের আরেক নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পরেও।

পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রয়াত সুজাত বুখারি; Source: Twitter handle of Shujaat Bukhari @bukharishujaat

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘অবজেক্টিভ’ অবস্থান নেওয়া বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত এ-দেশের সাংবাদিককূল। বিশেষত যেই সমস্ত সাংবাদিক কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ করে এক ধরনের সামাজিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার অক্লান্ত চেষ্টা করছেন, তাদের অস্তিত্ব দিনদিন আরও বড়সড় বিপদের মুখে পড়ছে। এর কারণ হচ্ছে আজকের চূড়ান্ত সামাজিক মেরুকরণ এবং অস্থিরতা। কেউ বাস্তববাদী অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করলেই তাকে লক্ষ্য করা হচ্ছে, তার উপরে প্রাণঘাতী হামলা করা হচ্ছে। এটি একটি খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা এবং আমাদের যদি সত্যিই আজকের বহু-চর্চিত গণতান্ত্রিক সমাজ-রাজনীতিকে সার্থক দেখতে হয়, তবে এই প্রবণতাকে নির্মূল করার আশু প্রয়োজন।

রাষ্ট্র যদি নিজের দায়িত্বের সঙ্গেই সমঝোতা করে বসে, তবে আশা কোথায়?

প্রশ্ন হচ্ছে, কে করবে এই কাজ? যদি বলা হয় রাষ্ট্রের ধর্ম তার প্রজাকে বাঁচানোর, তবে প্রশ্ন উঠবে তার এই দায়িত্বরক্ষার অনীহার প্রতি। রাষ্ট্র নিঃসন্দেহে সমাজ এবং নাগরিকের জীবনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে কিন্তু সেই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের মধ্যেই যদি মেরুকরণের বীজ গ্রোথিত থাকে, তবে কীসের ভরসায় বলা যাবে যে নির্ভীক, মধ্যপন্থী নাগরিকের জীবন সে পূর্ণরূপে রক্ষা করবে? আজকের দিনে রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে দেদার মন্দা-দুর্নীতি, ধর্মীয় সংঘাত, জাতিবৈষম্যের সমীকরণ, ঘৃণার রাজনীতি, যুক্তিবাদের পরিপন্থী চিন্তাধারা। এই বিষয়গুলো যদি রাষ্ট্রের গঠনকে শুরু থেকেই প্রভাবিত করে, তাহলে কীভাবে আশা করা যাবে যে, দৈনন্দিন জীবনে রাষ্ট্র তার সৎ ও সত্যবাদী নাগরিকের জীবনরক্ষার প্রশ্নে কোনো সমঝোতাই করবে না? শুধু সাংবাদিক নিগ্রহ বা হত্যা নয়, আজকের ভারতে নানা সময়ে নানা সম্প্রদায় এক ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে, কিন্তু সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন এই দ্বিধা? জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে? রাজধর্ম পালনের শপথের তাহলে কী হবে?

সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; সুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ডে নীরব থাকা নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি; Source: Twitter handle of Narendra Modi @narendramodi

সমাজের ব্যবহারেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে অস্বাভাবিকতা

দ্বিতীয় প্রশ্ন ওঠে নাগরিক সমাজের উপরে। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে আজকের এই সংকীর্ণতার যুগেও যখন একজন নারী রাজধানীর রাজপথে চলন্ত বাসে নির্মমভাবে গণধর্ষিত হয় বা একজন সাংবাদিক বা যুক্তিবাদীকে নিমেষে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, তখন চারিদিকে প্রবল প্রতিবাদ দেখা যায়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ চিন্তাভাবনার প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, বাসের ওই ধর্ষিত নারীটিই আসলে দোষী বা ওই সাংবাদিককে খুন করে ঠিক কাজই করা হয়েছে। মতানৈক্য অস্বাভাবিক নয় কিন্তু যেটা অস্বাভাবিক, তা হচ্ছে চিন্তাভাবনায় মানবিকতার অনুপস্থিতি। আদর্শগত অমিল থাকতেই পারে, তা আলবৎ থাকবে- কিন্তু তাই বলে মনুষ্য জীবনকে নষ্ট করে দেওয়া বা কেড়ে নেওয়ার মতো অপরাধকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিচারবোধ বা চিন্তার ভারসাম্যটাই যেন আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজের। বলতেই হবে, এটি অস্বাভাবিকতার লক্ষণ।

জাতিসংঘ: সম্প্রতি কাশ্মীরের উপরে প্রকাশিত এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের একটি রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারত; Source: Author: Patrick Gruban; www.flickr.com

সামাজিক চিন্তাধারায় এই অস্বাভাবিকতার কারণ বোধহয় সব বিষয়কেই তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং প্রথমেই একটি সুবিধাজনক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে নেওয়া। আজকে গৌরী লঙ্কেশ বা বুখারির মৃত্যুতে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হওয়া ‘ক্ষমতায়ন’-এর দৌলতে চটজলদি মতামত জানিয়ে দিচ্ছেন; অবস্থার গুরুত্বকে ঠিকমতো বিচার না করেই। অতি-জাতীয়তাবাদী গণমাধ্যমের সাজানো খবরে প্রভাবিত হয়েই তারা এই কাজ করছেন। নিজেদের বিচারবোধ, যুক্তি কিছুই কাজে লাগাচ্ছেন না; মস্তিষ্কের কোনো ব্যবহারই করছেন না বলতে গেলে। আর তাতে শুধু বিতর্কই বাড়ছে; নাগরিকের অধিকারের দিকে ধেয়ে আসা অনবরত আক্রমণের মোকাবেলা করতে এবং এই জটিল সমস্যার সমাধানে সমাজের যে বড় ভূমিকা রয়েছে, তা কখনোই পালন হচ্ছে না। রাষ্ট্রের তৈরি করা এজেন্ডাকে যদি সমাজের একটি বড় অংশ নির্দ্বিধায় সিলমোহর দিয়ে দেয়, তবে তা সবার জন্যই ডেকে আনবে এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে অসহায় নাগরিক বেচারা কী করবে?

সবশেষে আসা যাক নাগরিকের কথায়। ভারতের গণতন্ত্রের মূল আজ অনেকটাই বিস্তৃত। স্বাধীনতার পর এতগুলো দশকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আজকে এদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, বিশেষ করে সামাজিক ক্ষেত্রে। সাম্প্রদায়িক ক্ষমতায়ন এখন ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম বড় সাফল্য। কিন্তু ব্যক্তি অধিকারের পথে আমরা কতটুকু এগিয়েছি?

গত বছর সেপ্টেম্বরে খুব হন দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ; Source: Indiatimes.com

সুশীল সমাজের একটি ধারণা এদেশে চলে ঠিকই, কিন্তু সেই সমাজেও ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রের সাফল্য কতটা? আর যদি ব্যক্তি অধিকারের গুরুত্ব আমরা এখনও না প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবে আমাদের গণতন্ত্রকে বিশ্বের শ্ৰেষ্ঠ গণতন্ত্রগুলোর মধ্যে ধরা হবে কিনা, তা কে নিশ্চিত করবে? গৌরী লঙ্কেশ বা সুজাত বুখারিকে তাদের ব্যক্তি অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে আমাদের গণতন্ত্র তার নিজের প্রতি কতটা সুবিচার করল? বিশেষ করে, একথা যখন জানাই যে, দলের সঙ্গে সংঘাতে ব্যক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তখনও এই লড়াইতে আমরা ব্যক্তির সুরক্ষায় এগিয়ে আসব না কেন? কেন বারবার ঘটতে থাকবে একই ঘটনা?

একদিকে রাষ্ট্রের আপন হিসাব-কিতাব, অন্যদিকে সমাজের অসুস্থ চিন্তাধারা এবং ব্যক্তির অধিকারের লাঞ্ছনা- এ সমস্ত কিছুর সমষ্টিতে আজকে আমাদের গণতন্ত্রের হাঁসফাঁস অবস্থা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্তম্ভ যে রাজনৈতিক দলগুলো- তারাও সুবিধাজনক অবস্থান নিতে ব্যস্ত, কারণ, এই মুহূর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবাবেগকে অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস কারোরই নেই, তা জাতীয় স্তর বা রাজ্য স্তর যেখানেই হোক না কেন। যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব একে অপরকে দুষছেন গণতান্ত্রিক বাতাবরণ খর্ব করার অভিযোগে, তাদের কারও ট্র্যাক রেকর্ডই নিখুঁত নয় আর তাই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও মানুষের মনে কম।

গৌরী বা বুখারির হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দেয় যে এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বড় দু’টি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ- সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ- কীভাবে বড় আকার ধারণ করছে অথচ আমরা সব দেখেশুনেও কিছুই করতে পারছি না। বিশেষ করে, গৌরী বা বুখারির মতো অভিজ্ঞ সাংবাদিক যারা কিনা রাষ্ট্র-সমাজ এবং নাগরিকের মধ্যে সেতুর মতো কাজ করে এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধান নিরুপণে সাহায্য করতে পারতেন, তাদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে আমাদের সমাধান খোঁজার কাজ আরও দুরূহ হয়ে উঠছে। এর থেকে পরিত্রাণ কোন পথে, আপাতত আমরা জানি না কেউই।

Featured Image Source: Times Now

Related Articles