গত ৩০ জুন নোভিচক নার্ভ এজেন্টের শিকার হওয়া ব্রিটিশ নারী ডন স্টারগেস (৪৪) রবিবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তার সাথে আক্রান্ত চার্লি রাওলি নামে অপর ব্যক্তি আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছেন। স্টারগেসের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে তদন্ত করছে পুলিশ। গত মার্চ মাসের ৪ তারিখে এই নোভিচক নার্ভ এজেন্ট দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন রুশ গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়া। চলুন জেনে নেওয়া যাক আবার কীভাবে নোভিচক নার্ভ এজেন্টের শিকার হলেন দুজন ব্রিটিশ।
কীভাবে আক্রান্ত হলেন তারা?
রবিবার আমেসবুরুরির মাগল্টন রোডের একটি ফ্ল্যাটে দু’বার ডাক্তার ডাকা হয়। প্রথমবার ডাকা হয় ডন স্টারগেস অসুস্থ হয়ে গেলে। এর কয়েক ঘণ্টা পরে রাওলি অসুস্থ হয়ে গেলে আবার ডাক্তারদের আসতে হয়।
স্যাম হবসন নামে এই দম্পতির এক বন্ধু জানান স্টারগেসের মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। পরবর্তীতে রাওলি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তিনি খুব ঘামছিলেন, মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল এবং তার চোখ লাল দেখাচ্ছিল।
যুক্তরাজ্যের সামরিক গবেষণা পরীক্ষাগার পোর্টন ডাউনের বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেন, এই দম্পতি নার্ভ এজেন্ট নোভিচক দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।
আক্রান্তদের পরিচয় কী?
8 জুলাই মৃত্যুবরণ করা স্টারগেস, স্যালিসবুরির জন বেকার হাউসে বসবাস করতেন। তিনি তিন সন্তানের জননী। একই ভবনে বাসকারী স্টারগেসের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে স্নেহপূর্ণ ও যত্নশীল ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি আরও জানান, স্টারগেস কখনো মাদক নেননি।
রাওলির বড় ভাই ম্যাথু বলেন, তিনি ছিলেন একজন চমৎকার ব্যক্তি যে আপনার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারেন। তার ভাইয়ের যা হয়েছে তা হৃদয় বিদারক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশ জানায়, শুক্রবার স্যালিসবুরিতে বেশ কয়েকটি দোকান পরিদর্শন করে রানী এলিজাবেথ গার্ডেনসের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে এই জুটি দুপুরে জন বেকার হাউজেই অবস্থান করছিলেন। তারা প্রায় রাত সাড়ে ১০টায় একটি বাসে করে আমেসবুরি যাওয়ার আগে ৪.২০ মিনিটে হোস্টেল্টিতে ফিরে আসে। পুলিশের মতে, তারা শনিবারে জরুরি সেবা আহ্বান না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই উপস্থিত ছিলেন।
আক্রান্তদের পরিচিত স্যাম হবসন জানান, তিনি শুক্রবার এবং শনিবার তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, স্টারজেস অচেতন হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এবং রাওলি আমেসবুরিতে একটি ব্যাপটিস্ট গির্জার অনুষ্ঠানে যাবার আগে কাছাকাছি একজন কেমিস্টের কাছে প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। এরপর তারা দুজন ফ্ল্যাটে ফিরে যান এবং হাসপাতালে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাওলির খুব গরম লাগতে থাকে এবং তিনি ঘামতে থাকেন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন হবসন।
স্যালিসবুরি সিটি কাউন্সিলের নেতা ম্যাথিউ ডিন বলেন, এই জুটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পরিচিত ছিল।
পুলিশের বক্তব্য কী?
উইল্টশায়ার পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে তার ধারণা ছিল এই দুই রোগীর হেরোইন বা ক্র্যাক কোকেইন ব্যবহার করছিলেন। আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর তারা নোভিচক নিয়ে নিশ্চিত হন। বৃহস্পতিবার তারা নিশ্চিত করেছে যে, দূষিত বা নোভিচক মেশানো বস্তুর সংস্পর্শে এসে এই জুটি নোভিচক দ্বারা আক্রান্ত হন। তবে বস্তুটি কী ছিল তারা সে বিষয়টি প্রকাশ করেনি। আমেসবুরি ও স্যালিসবুরির তিনটি জায়গা পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে।
তদন্ত চলছে কীভাবে?
স্পেশালিস্ট অপারেশনস এর সহকারী কমিশনার নিল বসু বলেন, উইল্টশায়ার পুলিশের পাশাপাশি কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশিং নেটওয়ার্ক (সিটিপিএন) থেকে প্রায় ১০০ জন গোয়েন্দা এই তদন্তে কাজ করছেন। স্টারগেস ও রাওলি নোভিচক মেশানো যে বস্তুটি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন সেটি কীভাবে তাদের কাছে এলো, তা বের করাই তাদের তদন্তে প্রথমে অগ্রাধিকার পাবে। আপাতত তারা সেই বস্তুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে পুলিশ জানায়, এটি সম্পন্ন করতে তাদের কয়েক সপ্তাহ থেকে এক মাসের মতো সময় লেগে যেতে পারে। তারা আক্রান্ত হওয়ার উত্স খুঁজে পেতে প্রায় ১,৩০০ ঘণ্টারও বেশি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছেন।
স্বরাষ্ট্র সচিব সাজিদ জাভিদ বলেছেন, ইউলিয়া ও সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টার সাথে এর কোনো সংযোগ রয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করা স্পষ্টভাবে এ তদন্তের একটি উদ্দেশ্য। কর্মকর্তারা বলেন, আর কেউই নোভিচকে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখায়নি। আক্রান্ত জুটির অতীতে এমন কিছুর নজির নেই, যা থেকে বলা যেতে পারে তাদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। আগামী দিনগুলোয় কিছু এলাকায় পুলিশের অধিক উপস্থিতি দেখতে পারে জনসাধারণ।
অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে আক্রান্তরা পাঁচটি এলাকা পরিদর্শন করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অ্যামসবুরিতে তারা মাগল্টন রোড, বুটস ফার্মেসি এবং ব্যাপটিস্ট গির্জা, স্যালিসবুরিতে রোলস্টন স্ট্রিটের জন বেকার হাউসে এবং রানী এলিজাবেথ গার্ডেনসে তল্লাশী চলছে।
এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার কী বলেছে?
প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেছেন, তিনি আক্রান্তদের সাথে আছেন। তিনি আরও বলেন, “স্যালিসবুরির বার্তাটি স্পষ্ট – এটা বাণিজ্যের জন্য একেবারেই উন্মুক্ত রয়েছে। সরকার স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতি সকল সমর্থন প্রদান করবেন।”
স্বরাষ্ট্র সচিব রাশিয়াকে ‘ঠিক কি ঘটেছে’ তা ব্যাখ্যা করার জন্য বলেছিলেন। তিনি বলেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন তারা।
এদিকে কমন্স ফরেন অ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান টম টুগেণ্ডহাট বলেন, সর্বশেষ ঘটনাটি রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের একটি কারণ। একটি বেসামরিক এলাকায় নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করা একটি জঘন্য সন্ত্রাসমূলক অপরাধ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ব্যাপারে রাশিয়ার মন্তব্য কী?
রাশিয়াকে আমেসবুরির ঘটনায় ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে, জাভিদের এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া বলেছে, থেরেসা মের সরকার তাদেরকে নরকের অধীনে নিয়ে যাচ্ছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা পুলিশকে নোংরা রাজনৈতিক খেলার দ্বারা পরিচালিত না হতে বলেন। তিনি জানান, লন্ডনকে রাশিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কোভ এই খবরকে ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেন এবং এটি ‘গভীর উদ্বেগ’ সৃষ্টি করছে বলে জানান। তিনি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন, “স্যালিসবুরির গল্পের শুরু থেকেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তারা সেখানে যা ঘটেছে তাতে যেকোনোভাবে জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে।”
এদিকে সেই এলাকার জনসাধারণ এই ঘটনার পরে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। স্বরাষ্ট্র সচিব জাভিদ যদিও সাধারণ জনগণের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নেই বলে জানিয়েছেন, নিরাপত্তা মন্ত্রী বেন ওয়ালেস জানান, এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব না। তার মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ভালো গোয়েন্দারা কাজ করলেও স্ক্রিপালদের হত্যা প্রচেষ্টার পুরো চিত্রটি উন্মুক্ত করতে না পারলে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারটি পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না।
Featured Image Source: BBC