(পর্ব ২-এর পর)
দোনবাসের সঙ্কট শুরু হয় ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভিক্টর ইয়ানুকভিচের জয়ী হওয়ার পর থেকে। তিনি দীর্ঘ সময় দোনবাসের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তার নির্বাচিত হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ইউক্রেন ধীরে ধীরে পশ্চিমাপন্থী হয়ে ওঠছিল। প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী ইউক্রেনীয়রা একে স্বাগত জানালেও ইয়ানুকভিচের মতো রক্ষণশীল রুশপন্থীরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশকে সেই অবস্থা থেকে সরিয়ে আনেন। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করেন।
২০১৩ সালে তিনি যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তখন প্রগতিশীল ইউক্রেনীয়রা বিক্ষোভ শুরু করে। প্রথমে কিয়েভে শুরু হয়ে সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। এটা ইউরোমাইদান আন্দোলন নামে পরিচিত। এতে অন্তত একশ বেসামরিক নাগরিক ও এক ডজনেরও বেশি পুলিশ সদস্য মারা যায়।
ইউরোমাইদান সমর্থনকারী ইউক্রেনীয়রা একে বলে থাকেন ‘রেভ্যলুশন অব ডিগনিটি’। তাদের কাছে এর জন্য দায়ী ছিলেন ইয়ানুকভিচ ও তার সিকিউরিটি ফোর্স। কিন্তু ইউক্রেনীয়দের এক বড় অংশ, বিশেষ করে দোনবাসের মতো রুশ ঘরানার জায়গাগুলোতে এই পরিস্থিতি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। তারা একে দেখে পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারা মগজ ধোলাই হওয়া তরুণ প্রজন্মের বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড হিসাবে। অবশ্যই তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রুশ সংবাদমাধ্যমের প্রভাব ছিল।
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে ইয়ানুকভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। পাঁচ দিন পর রাশিয়া ক্রিমিয়ায় আক্রমণ করে। ইউক্রেন সরকার তখন আর পাল্টা আক্রমণ করেনি। তিন সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং তারা রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপ করার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিল। এই আক্রমণের ফলে রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের যতটুক সম্প্রীতি ছিল, সেটাও শেষ হয়ে গেল।
খুব দ্রুতই দোনবাসে ইউরোমাইদানের পাল্টা আন্দোলন শুরু হয়, যা রূপ নেয় ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে। এর নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা জাতিগত দিক দিয়ে ইউক্রেনীয় ও রুশ দুই অংশেরই ছিলেন। এর মাঝে ছিলেন রাশিয়ার সিকিউরিটি সার্ভিস ও মিলিটারির বর্তমান ও সাবেক সদস্যরা। এদের কেউ কেউ আবার ক্রিমিয়া আক্রমণেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডিপিআর ও এলপিআর তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। ইউক্রেন থেকে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তড়িঘড়ি করে গণভোটের আয়োজন করে। এতে দেখা যায়, ডিপিআরের ৮৯ শতাংশ ও এলপিআরের ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে স্বাধীনতার পক্ষে। অন্তত বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের দাবি এরকমই।
রাজনৈতিক এই বিচ্ছিন্নতাবাদ ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কিয়েভের বাসিন্দারা বিমান হামলার সময় আত্মরক্ষার অনুশীলন শুরু করে। দেশ দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে ইয়ারোস্লাভ সিমিনইয়াকার মতো লোকেরা যুদ্ধে যাওয়া শুরু করে। নিয়মিত বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে তৈরি বাহিনীর দ্বারা ইউক্রেনীয়রা পাল্টা আক্রমণ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সীমান্তের দিকে সরিয়ে দেয়। রুশ মিলিটারিও প্রতিক্রিয়া দেখায় কামান আর বিমান হামলা দিয়ে। তীব্র যুদ্ধ ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর থেকে যুদ্ধ অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ক্রিমিয়া দখলের ব্যাপারে পুতিনের কোনো রাখঢাক নেই। তবে তিনি যুদ্ধের শুরুতে পূর্ব ইউক্রেনে রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি স্বীকার করলেও দোনবাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার আনুষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে অস্বীকার করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, রুশ স্বেচ্ছাসেবকরা সীমানা অতিক্রম করে আদিবাসীদের বিদ্রোহে সহায়তা করতে গিয়েছে। একইসাথে তারা ‘রুশ সংস্কৃতি’ও রক্ষা করছে। পুতিনের বক্তব্য অন্তত দুটি দিক দিয়ে ভুল।
প্রথমত, ডিপিআর ও এলপিআরে রাশিয়ার প্রভাব খুব স্পষ্ট। তারা ২০১৪ সাল থেকেই সেখানে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সেখানে প্রকৃত তথ্যের চেয়ে প্রোপাগান্ডাই চলে বেশি। বিদেশি সংস্থাগুলোর সেখানে কাজ করার কোনো অনুমতি নেই। অল্প যেসব খবর আমরা জানতে পারি, তা আসে মূলত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে, আর কিছু স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম থেকে। ডিপিআর ও এলপিআরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী তাদের সরকারের নেতারা ইউক্রেনীয়। কিন্তু সেখান থেকে পালিয়ে আসা নাগরিক ও মুক্তি পাওয়া বন্দিদের কথা বলে আমি জানতে পেরেছি, রাশিয়ার প্রভাব সেখানের সকল স্তরে বিদ্যমান।
এই অঞ্চলে ইউক্রেনীয় মুদ্রা হিরভনিয়াকে সরিয়ে রুশ মুদ্রা রুবল চালু করা হয়েছে। সেখানের বাসিন্দাদের ইউক্রেনীয় পাসপোর্ট ত্যাগ করে রুশ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছে। তারা রাশিয়ার নির্বাচনেও ভোট দেয়। যদিও এখানকার প্রায় ৩০-৪০ লক্ষ জনগণকে পুরোপুরি রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি।
রুশ ও ইউক্রেনীয় এজেন্টরা সেখানে দমন ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ইউক্রেনীয় ভাষা শেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইসাথে ইউক্রেনীয় ছুটির দিনগুলো পালন করাও নিষিদ্ধ। দোনবাস থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকরা বর্ণনা করছেন সেখানকার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেখানে এখন কাজ আর জিনিসপত্রের অভাব। সমাজসেবামূলক কার্যক্রমও বন্ধ। তারপরও রুশপন্থীরা আশা ধরে রেখেছেন, পুতিন একসময় তাদেরকে বুকে টেনে নেবেন, এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ২০২০ সালের আগে এই অঞ্চল থেকে মানুষজন ইচ্ছামতো বের হয়ে আসতে পারতেন কিংবা ঢুকতে পারতেন। কিন্তু কোভিড অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে কেবল দুটি রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে।
দোনবাসের বিভাজন সেখানকার ইউক্রেনীয় পরিবার আর প্রতিবেশীদেরও বিভক্ত করে দিয়েছে। কেউ এলপিআর, কেউ ডিপিআর, কেউ বা ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে চলে গেছে। এটা তাদেরকে আদর্শগত দিক দিয়েও বিভক্ত করে ফেলেছে। ২০১৪ সালের আগে ইউক্রেনীয় দেশভক্তি কিংবা রাশিয়া প্রেম জেগে ওঠার আগে তারা পাশাপাশি থেকে বাস করতে পারত। যদি এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না-ও করত, অন্তত সেখানে সহিংসতা ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউক্রেনীয়দের, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলীয় নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় তারা কোন পক্ষের প্রতি আনুগত্য দেখাবে। কোনো পরিবারের বাবা যদি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে থাকেন, তাহলে সন্তান হয়তো চলে গেছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে। স্ত্রী হয়তো এলপিআরে পালিয়ে গেছে, অন্যদিকে স্বামী থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দোনবাসে আপনি এরকম গল্প সবসময়ই শুনবেন।
পুতিনের অস্বীকার করা মিথ্যা হওয়ার দ্বিতীয় আরেকটি কারণ হচ্ছে, ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পুতিনের কল্পকাহিনী অনুযায়ী চলতে চায় না। দোনবাসে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আট বছর আগে শুরু হলেও এর আঁচ কয়েক প্রজন্ম ধরেই চলে আসছিল, ১৯৯১ সালের যেদিন ইউক্রেনীয়রা ভোট দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু খুব দ্রুতই অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হলে ইউক্রেনীয়রা তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। আধুনিক ইউক্রেনে এই অনুশোচনাটা বেশি অনুভূত হয় দোনবাসবাসীদের মধ্যে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রুশদের উস্কানির ফসল কিংবা বড় অংশের নেতৃত্ব রুশদের হলেও এই আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ ছিল প্রত্যেক স্তরের রুশপন্থী ইউক্রেনীয়দের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এদের মাঝে ছিলেন দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শ্রমিক, অবসরপ্রাপ্ত জনগণ।
গত গ্রীষ্মে কিয়েভে আমি ক্যাটেরিনা নামে এক নারীর সাথে আমি দেখা করি, যিনি শুরুর দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি সম্প্রতি ডিপিআর ছেড়ে চলে এসেছেন। তিনি দোনেৎস্কে থাকতেন। ক্যাটেরিনা আমাকে বলেন, যুদ্ধের শুরুতে ওই অঞ্চলে রুশ প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর বিষয়টা সত্য। তখন শোনা যাচ্ছিল রক্তপিপাসু ইউক্রেনীয়রা দোনবাসকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রুশ ভাষাও বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। হাস্যকর হলেও মানুষজন এগুলো বিশ্বাস করছিল। যদি তারা বিশ্বাস না-ও করে থাকে, তাদের কাছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পন্থাটাই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছিল। ক্যাটেরিনা বলেন, “আমার কাছে ওই সময় মনে হচ্ছিল, রাশিয়ার সাথে যোগ দেওয়াটাই অপেক্ষাকৃত ভালো সিদ্ধান্ত হবে।”
আমি যখন তার এরকম মনে হওয়ার কারণ জানতে চাইলাম, তিনি জানান এর পেছনে তেমন কোনো কারণ ছিল না। এটা তখনকার জনপ্রিয় মতাদর্শ ছিল।
“তখন সবার মাঝে একটা আশা ছিল রাশিয়া একটা বৃহৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। আমরা ভাবছিলাম তাদের সাথে এক হয়ে যাব।” কিন্তু সাত বছর পর তিনি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে স্থান ত্যাগ করেন।
দোনবাস রাশিয়ার কাছে প্রজাতন্ত্র হিসাবে স্বাধীন ইউক্রেনের চেয়ে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন তার গুরুত্ব নেই অতটা। যদিও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিচ্ছিন্নতার চেয়ে রাশিয়ার সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী।
(পরবর্তী অংশ পর্ব ৪-এ)