ইন্টারনেট ব্যবহারের তুমুল জনপ্রিয়তা লাভের পর ফিনটেক শব্দটি অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিটকয়েন প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর এই শব্দটি আরও বেশি মানুষের কাছাকাছি আসতে পেরেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ বিটকয়েনকে অস্বীকার এবং অবৈধ ঘোষণা করলেও উন্নত দেশ এবং কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিটকয়েনের মারফত লেনদেনের সুযোগ-সুবিধা রাখছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ যারা উন্নয়নের পথে হাঁটা শুরু করেছে তারাও এই নতুন প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করছে। বিটকয়েনের কথা বলতে গেলে অবশ্যই ব্লকচেইনের কথাও আসবে। ব্লকচেইন অনেকটা জমা-খরচ হিসাবরক্ষক খাতার মতো, যেখানে যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের হিসাব রাখা হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ব্লকচেইন হচ্ছে ডিজিটাল, কম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল এবং বিকেন্দ্রীভূত হিসাবরক্ষক। মূল কেন্দ্রের সাথে এর কোনো যোগাযোগ থাকে না এবং কেন্দ্রে কোনোপ্রকার ডিজিটাল কারেন্সি লেনদেনের কোনো হিসাব থাকে না। তবে যারা বিটকয়েন মারফত লেনদেন করে, শুধুমাত্র তাদের জন্য একটি জমা-খরচের তথ্য সেখানে জমা থাকে।
ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার এখন এত বেড়ে গিয়েছে যে এর উপযোগিতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমে প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন- যেকোনো লেনদেনের যথার্থতা প্রমাণের জন্য ব্লকচেইন ব্যবহার হচ্ছে, বিভিন্ন ডিজিটাল পত্রাদি শনাক্ত করতে, যেকোনো লেনদেন এবং জমা-খরচের প্রকৃত হিসাব রাখতে ইত্যাদি। যে লেনদেনই হোক না কেন, সেটা শুধু একটি সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান লক্ষ্য রাখবে তা নয়, বরং প্রত্যেকে সেটা দেখতে পারবে। ব্লকচেইনের মাধ্যমে এমনভাবে লেখ্যপ্রমাণ রাখা হয় যেটা কেউ কখনও পরিবর্তন করতে পারবে না।
বর্তমানে চালকবিহীন গাড়ির নিরাপত্তাজনিত গবেষণায় ব্লকচেইনকে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের মাধ্যমে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে হয়তো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার বাড়বে। কিন্তু ব্লকচেইনের ব্যবহার পশ্চিমা বিশ্ব এবং পূর্ব এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে বাড়লেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর কী ধরনের ব্যবহার হচ্ছে বা আদৌ হচ্ছে কি না সেটা একটু পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। আজকের আলোচনার এটাই মূল বিষয় যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্লকচেইনের ব্যবহার যে দিন দিন বাড়ছে- সেটা কীভাবে বাড়ছে, কোন দেশের অবস্থান কোথায়, আমাদের বাংলাদেশের অবস্থানই বা কোথায় ইত্যাদি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ খুব বেশি উন্নত না হওয়া সত্ত্বেও কয়েকটি বিষয় তাদেরকে ব্লকচেইনের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রভাবিত করেছে। প্রথমটি হচ্ছে- এই অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট নেই। ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে যে, এই অঞ্চলে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন লোকের বসবাস। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ মানুষ ব্যাংক সুবিধা ভোগ করছে। অর্থাৎ ৪৩৮ মিলিয়ন মানুষের ব্যাংক একাউন্ট নেই।
কিছু কিছু দেশে এর পরিমাণ আরও ভয়াবহ। কম্বোডিয়াতে মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে, বাকিদের জন্য এর কোনো সুযোগ নেই। তাই টাকা-পয়সা জমা না রাখার কারণে এসব অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়েই চলেছে। অপরদিকে এসব অঞ্চলে ইন্টারনেটের সুবিধা অনেক বেশি। পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ ইন্টারনেটের আওতায় আছে, যা ব্যাংক একাউন্ট সুবিধা ভোগকারী থেকে দ্বিগুণ। লাওস এবং মায়ানমারে তুলনামূলক কম, মাত্র ৪৫ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াতে এই সুবিধার হার ৮০ শতাংশ।
ব্যাংকিং সুবিধা নেই, কিন্তু পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুযোগ-সুবিধা আছে- এমন একটি মিশ্রণ বা সংযুক্তি ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনেক বড় সুবিধা এনে দিয়েছে। বিশেষ করে ব্লকচেইনের মাধ্যমে এসব অঞ্চলে তারা সবাইকে ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আনতে পারবে। আরও একটি আশার কথা হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেকটি দেশের সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করছে।
থাইল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। তারা তাদের রেলখাতে এবং পোস্টাল সার্ভিসে ব্লকচেইন এবং ইন্টারনেট অব থিংস- এই দুটি প্রযুক্তি একসাথে ব্যবহার করছে। ফিলিপাইন তাদের গ্রামীণ এলাকাতে বৈদ্যুতিক সুযোগসুবিধা প্রয়োগ করছে। এই সুযোগসুবিধা প্রয়োগের একটি বড় অংশে কাজ করছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। তারা ব্লকচেইন এবং ব্লকচেইন ধারণা ব্যবহার করে তাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে আলাদা আলাদা বৈদ্যুতিক সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ার জন্য তাদেরকে কেন্দ্রীয় গ্রিড কিংবা অন্যকিছুর উপর নির্ভর করতে হবে। ব্লকচেইন ধারণা কাজে লাগিয়ে তারা এমন একটি আকল্প তৈরি করছে যার মাধ্যমে খুব সহজেই বিদ্যুৎ মজুদকরণ এবং বণ্টন করা যাবে। এজন্য তারা চীনের সাংহাইতে অবস্থিত এনারগো নামক ল্যাবের সাথে কাজ শুরু করেছে।
কম্বোডিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাপানের সোরামিতসু প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ দিয়েছে এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে কম্বোডিয়াতে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে, যেটা হবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। মালয়েশিয়া “হ্যালো গোল্ড” বলে একটি ব্লকচেইন নির্ভর সোনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে, যা সিলিকন ভ্যালী থেকে অর্থ মূলধন হিসেবে পেয়েছে। এর ফলে তারা আরও ৫০০টি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবে। সিঙ্গাপুরে “চেঞ্জ” নামক আরেকটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, যারা ব্লকচেইন নির্ভর ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাপ তৈরি করছে।
ভেনচার ক্যাপিটাল বা ঝুঁকিপূর্ণ মূলধন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমার এই কথা শুনে অনেকে ভুরু কোঁচকাবে, কিন্তু ব্যাপারটি সত্যি। যেকোনো বিনিয়োগে ঝুঁকি না নিলে সেখানে সফলতা লাভ করা যায় না। যেকোনো অর্থনীতিবিদ, অর্থশাস্ত্রবিদ বা ব্যবসায়ীরা এই ব্যাপারটি জানবে। এখান থেকেই নতুন এই শব্দ উৎপন্ন হয়েছে “ভেনচার ক্যাপিটাল” এবং ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই শব্দটি অনেক জনপ্রিয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা নিজেদের পুঁজি প্রযুক্তিনির্ভর কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করছে, যা সেই প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট করছে। সিঙ্গাপুর “চেঞ্জ” বলে যে প্রকল্পে কাজ করছে তার জন্য ভেনচার ক্যাপিটাল তারা পেয়েছে প্রায় ১৭.৫ মিলিয়ন ডলার। আবার সিঙ্গাপুরে “ব্লুজেল” বলে ব্লকচেইন নির্ভর বিকেন্দ্রীকরণ ডাটাবেজ তৈরির আরেকটি কাজে হাত দেয়া হয়েছে যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন ডলার। বিটকয়েন নির্ভর মোবাইল ওয়ালেট “ফিলিপিনো” তৈরি করা হচ্ছে যার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার ভেনচার ক্যাপিটাল সংগ্রহ করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে ব্লকচেইন নির্ভর অনেকগুলো প্রকল্পে হাত দেয়া হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর এই দেশ ডিজিটাল কারেন্সি বিনিময়ে এবং ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং রাশিয়ার পরেই অবস্থান করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের অঞ্চলেই ব্লকচেইনের উপর বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। ব্লকচেইননির্ভর বিভিন্ন অ্যাপ এবং সফটওয়ার তৈরি হওয়ার ফলে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বস্ততা পাওয়া গিয়েছে এবং প্রচুর পরিমাণে লোকবল থাকার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া দিন দিন ব্লকচেইনের কেন্দ্রস্থল হয়ে পড়ছে। হংকং এর ফিনটেক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান Intrepid Ventures এর সহ প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক পিয়েস্টার দক্ষিণ এশিয়ার এমন অগ্রগতি সম্পর্কে বলেছেন যে, এই অঞ্চল হতে যাচ্ছে “The center of the universe for us”।
উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় ধরনের দেশই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে। এই খাতে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশে বিটকয়েন অবৈধ। ব্লকচেইন নির্ভর কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি না সন্দেহ। তবে ই-জেনারেশন বলে একটি বাংলাদেশী ফার্ম দুবাইতে ব্লকচেইন নির্ভর লেনদেন করার জন্য একটি সিস্টেম তৈরি করে দিচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। এটা একটি সুসংবাদ। কারণ যদি বাংলাদেশী একটি ডিজিটাল প্রতিষ্ঠান অন্য একটি উন্নত দেশে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা এবং ব্লকচেইনের মতো অত্যাধুনিক কাজের নেতৃত্ব দিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ব্লকচেইননির্ভর লেনদেন ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে এখনও লেনদেন করা ছাড়া ব্লকচেইন দিয়ে অন্যান্য কাজ সহজে করা সম্ভবপর ছিল। যেমন- স্মার্ট এনআইডি তৈরি করার সময় বাংলাদেশের নাগরিকদের সবরকমের তথ্য গুছিয়ে মজুদ করার জন্য যে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে হয়েছে সেটার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতো। এর ফলে গ্রাহকদের এনআইডি নিয়ে অসুবিধা কম হতো।
পরিশেষে বলা যায়, যেহেতু সারা বিশ্ব এখন ব্লকচেইন প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশও খুব বেশি দিন পিছিয়ে থাকবে বলে মনে হয় না। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পর ব্লকচেইন হচ্ছে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। ইন্টারনেট মিডিয়া জগতে যে নতুন বিপ্লব এনে দিয়েছে, ব্লকচেইনও আর্থিক লেনদেনের জগতে সেরকম বিপ্লব আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: fintech singapore